কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

শুভ্রনীল চক্রবর্তী

 

নকশাল আন্দোলন ও ভারতবর্ষের ছাত্র-রাজনীতি




"প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য, ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা" - সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই লাইনটি আজও ঘোরে ছাত্রদের মুখে মুখে, আজও উঠে আসে প্রতিবাদীর পোস্টারে। মূলত সত্তরের দশকে এই ধরনের নানা প্রতিবাদী কবিতা সৃষ্টি করেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। শুধু কবিতাই নয়, সৃষ্টি হয়েছে সাহিত্যের অন্যান্য উপাঙ্গও। সাহিত্য যে চিরকালই  সমাজের দর্পণ তা তো আমরা বারবার দেখে এসেছি ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে।  কিন্তু বিরল ঘটনা হলো, সত্তরের দশকের একটা আন্দোলন কীভাবে আজ  পঞ্চাশ বছর পরেও প্রাসঙ্গিক? অথবা বলা যায়, একটি গণ অভ্যুত্থান কীভাবে সমগ্র দেশের রাজনৈতিক চেহারাটা পাল্টে দিল? হ্যাঁ, আমি বলছি নকশাল  আন্দোলনের কথা - স্বাধীনতার পর ভারতবর্ষে মনে হয় এরকম ব্যাপক আন্দোলন আর সংগঠিত হয়নি, যেখানে সর্বস্তরের মানু্ষ, বিশেষ করে যুব ও ছাত্রসমাজ সমগ্র আন্দোলনের অভিমুখটাই বদলে দেয়।

৫০এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ৬০এর দশকের প্রথম দিকে খাদ্য আন্দোলনের হাত ধরে দীনেশ মজুমদার, বিমান বসু, শ্যামল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ছাত্র নেতারা  উঠেছিলেন ঠিকই, তবে সমগ্র ছাত্র সমাজের মধ্যে এই আন্দোলন সেইভাবে  ছড়িয়ে পড়েনি। তার অনেক কারণের অন্যতম হলো তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নমনীয় মনোভাব ও সংশোধনবাদ তত্ত্ব। ১৯৬৬ সালের আগে বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন বলতে একমাত্র ছিল AISF এবং ধীরে ধীরে খাদ্য আন্দোলন এবং সমসাময়িক কিছু রাজনৈতিক পরিস্থিতির সূত্র ধরেই এই AISF এর মধ্যেই আদর্শগত বিভাজন দেখা যায়। একদল বা পুরনো পন্থীরা সংশোধন বাদের  উপরই আস্থা রাখে, অন্য দল ধীরে ধীরে গণ আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের পথ বেছে  নেয়। এর চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় ১৯৬৬ সালের ২২-২৩শে সেপ্টেম্বরে বাংলা বন্ধে। ৬৬এর মার্চ মাস থেকেই বেশিরভাগ ছাত্র সমাজের মধ্যে দ্রুত রেডিক্যালাইজেশন দেখা যায় এবং এর প্রভাব পড়তে থাকে শ্রমিক সংগঠনগুলির মধ্যেও। তখনও CPM তৈরী হয়নি, এরা মূলত left CPI নামেই পরিচিত ছিল, যারা অনেক বেশী মিলিট্যান্ট ছিল।  



সেই সময় এলিট কলেজ ছিল প্রেসিডেন্সি এবং প্রেসিডেন্সির ছাত্রদের মধ্যে এই রেডিক্যালিজিমটা অনেক বেশী ছিল। এছাড়াও ছিল সিটি, বঙ্গবাসী, সুরেন্দ্রনাথ।  এইসব ছাত্র ছাত্রীরা অংশ নেয় ২২-২৩ সেপ্টেম্বরের বাংলা বন্ধে। আর এইসব কলেজের ছেলে মেয়েদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে দলে দলে বাকী কলেজগুলিও অংশগ্রহণ করে এবং ধীরে ধীরে এই আন্দোলন আরও জঙ্গিরূপ নেয়। ছাত্র  ছাত্রীরা শুধু যে এই আন্দোলনকে কলেজ প্রাঙ্গণে সীমাবদ্ধ রাখে তা নয়, এটা প্রথমে ছড়িয়ে যায় শহরের অসংগঠিত শ্রমিক সমাজের মধ্যে, যেমন প্রথম প্রেসিডেন্সির ছাত্ররা কলেজ স্ট্রিটের বই কর্মীদের নিয়ে ইউনিয়ন বানায় এবং বিভিন্ন দাবী দাওয়া পেশ করা শুরু করে। শুধু এই নয় এই ছাত্র ছাত্রীরা ধীরে ধীরে ছোট কল-কারখানাগুলিতে গিয়েও সংগঠন বানাতে থাকে এবং এইসব ঘটনা কিন্তু নকশালবাড়ির আগে থেকেই হতে শুরু করে। এই সব আন্দোলনে  নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন অমল সান্যাল, অসীম চট্টোপাধ্যায়, বিপ্লব হালিম  রণবীর সমাদ্দার প্রমুখ ব্যক্তিরা। তৎকালীন সরকার আন্দোলনের বিশৃঙ্খলা বিশেষত কমিউনিস্ট মনোভাব দেখে এইসব ছাত্রদের কলেজ থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। এতে আন্দোলনের তেজ আরও বেড়ে যায় এবং যা ভবিষ্যতে ছাত্র  যুব বিদ্রোহী আন্দোলনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে। এরপর যুক্তফ্রন্ট সরকার আসার পর ছাত্র বহিষ্কার রদ করা হয়, যা ছাত্রদের মনোবল আরও বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু ছাত্রদের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট বিরোধী মনোভাব দেখা যায় যখন ক্ষমতায় এসে তারা ছাত্র আন্দোলন বন্ধ করতে চাইল, যারা সরকারের আসার আগে পর্যন্ত ছাত্রদের বাহবা দিচ্ছিল তাদের এই মনোভাব ছাত্র সমাজ ঠিক মেনে নিতে পারলো না। আর আগেই বলেছি তখন রেডিক্যালিজিম মানেই CPIM, ছাত্ররা যাদের খুব কাছের মনে করত, কিন্তু সরকারে আসার পর এহেন আচরণে তারা কিছুটা বিক্ষুব্ধ হলো। সারা বাংলায় ছাত্ররা যেভাবে সংগঠন তৈরী করছিল ও বলা ভালো যাদের হাত ধরে ৬৬র ঐতিহাসিক বাংলা বন্ধ সাফল্য পেল, তারা হঠাৎ সবকিছু ছেড়ে দিয়ে বসে যাওয়াটা কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিল না। এর ফলে ছাত্ররা ধীরে ধীরে আরও রেডিক্যাল হয়ে উঠল এবং এর সঙ্গে অনুঘটকের কাজ করলো ভিয়েতনাম যুদ্ধ। Cpim সরকারে এসে সশস্ত্র আন্দোলন থেকে সরে আসা এবং নেতৃত্বের মিশ্র মনোভাবে ছাত্রদের একটা বড় অংশ মনে করলো পার্টি সমঝোতা করছে।

পার্টির মিশ্র মনোভাবের দরুন নেতৃত্বের এক অংশ বেরিয়ে All india  coordination committee of communist revolutionaries তৈরী করলেন,  যার মধ্যে ছিলেন চারু মজুমদার, শিবকুমার মিশ্র, এস তিওয়ারি, বিহারের  সত্যনারায়ণ সিংহ প্রমুখ। এঁরা পার্টি স্ট্রাকচার ফিরিয়ে আনতে চাইলেন এবং সমস্ত ইলেকশন, ট্রেড ইউনিয়ন বয়কটের ডাক দিলেন, যেখানে মিলিটান্ট ছাত্র  সমাজ বেশ কিছুটা অক্সিজেন পেল। বিশেষত নকশাল আন্দোলনের যে জনপ্রিয়তা একটা overehelming socio structural reformation বা mass movement সেটা ছিল মূলত ৬৭-৭০ সাল পর্যন্ত, এটাকে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক স্বর্ণযুগ বলা যেতে পারে। বিশেষ করে ৬৮ সালের ম্যাকানমারা বিক্ষোভের সময় ছাত্র রাজনীতি যেভাবে উত্তাল হয়ে পড়ল স্বাধীন ভারতে তার নজির বড়ই কম। এরপর আসে সেই ঐতিহাসিক নকশালবাড়ি যখন ক্ষমতায় ছিল দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। নকশালবাড়ির পর এই আন্দোলন ছড়িয়ে যায় বাংলার বিভিন্ন গ্রামে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ডেবরা ও গোপীবল্লভপুরের আন্দোলন। সন্তোষ রানা ছিলেন সেইসময় মেদিনীপুরের এই আন্দোলনের অন্যতম নেতা। তাঁর কাছ থেকে জানা যায় তৎকালীন সরকার চাইছিল এই আন্দোলন খানিকটা দমিয়ে দিতে। বলাই বাহুল্য, সমঝোতা করতে চারুবাবু বা কানু সান্যালরা মেনে নিতে পারেননি। সিপিএম-এর উদ্দেশ্য ছিল জবরদখল জমি ফিরিয়ে নেওয়া, তার বদলে সরকার  সমস্ত সাহায্য করবে। কিন্তু নকশাল নেতৃত্ব তা কিছুতেই মানতে চাননি।  তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী হরেকৃষ্ণ কোঙ্গার দেখা করেছিলেন চারু মজুমদারের সাথে,  এই মর্মে সঙ্গে ছিলেন দেবব্রত বন্দোপাধ্যায় land reform secretary হিসেবে।

এই নকশালবাড়ি বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রচুর স্কলাররা যোগদান করেন। বিশেষ করে চারুবাবুর লেখা এইট মোনোগ্রাফ বা আটটি চিঠি যা ছিল নকশালদের একমাত্র রুলবুক সেইসময়ে এবং বিশেষজ্ঞদের মতে ভারতের মত দরিদ্র প্রধান দেশের আর্থ সামাজিক রূপরেখা পরিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ  দলিলও বটে। এই মহান আদর্শকে পাথেয় করে দিকে দিকে ছাত্র যুবকরা এই  আন্দোলনে যোগদান করে। সিপিআই ও সিপিআইএম বিপুল সংখ্যক কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র যুবকরা নকশাল আন্দোলনের শরিক হয়। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, এই আন্দোলন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ সহ ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, বিশেষ করে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত এলাকায়। দক্ষিণ ভারতে এই আন্দোলনের মূলত নেতৃত্ব দেন ভেম্পাতাপু সত্যনারায়ণন, নাগী রেড্ডি এবং  পোলা রেড্ডি। বিহারে এই আন্দোলন মূলত ছড়িয়ে পড়ে ১৯৭০ সালে জগদীশ মাহাতোর হাত ধরে যিনি মাস্টার সাহেব নামে বিখ্যাত ছিলেন। মূলত ৭০ সালের পর এই আন্দোলনের জঙ্গি রূপ বেড়ে যেতে শুরু করে এবং কেন্দ্রীয় সরকার তথা ইন্দিরা গান্ধীর সরকার মিলিটারি নামিয়ে হোয়াইট টেরর শুরু ক’রে  নকশালিদের মারতে থাকে। রাতের অন্ধকারে তুলে নিয়ে গিয়ে জেলে অত্যাচার করে হত্যা করা হয় চারু মজুমদারকে এবং সরকার তার শবদেহ দাহ করে রাত ফুরানোর আগেই। তাঁর বাড়ির লোক পর্যন্ত থাকতে পারেননি তাঁর শেষকৃত্যে।  আস্তে আস্তে নকশাল নেতৃবৃন্দ তথা কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল সবাই অ্যরেস্ট হওয়ায় কিছুটা দিশাহীন হয়ে পড়ে এই আন্দোলন। ৭২ সালের পর থেকে cpi(ml) ভেঙে অনেক ছোট ছোট পার্টি তৈরী হয় বিভিন্ন জেলায় এবং তারা আজও নিম্নবিত্ত, দলিত ও দরিদ্র শ্রেণীর জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতবর্ষের ২১টি রাজ্যে তাদের সংগঠন বিস্তৃত হয় এবং মনে করা হয় ভারতের ভৌগলিক এরিয়ার ৪০ শতাংশ অঞ্চলে বিভিন্ন ভাবে তাদের সংগঠন আছে। ৯২০০০ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে তারা রেড করিডোর স্থাপন করেছে।



অত্যধিক জঙ্গি মনোভাব এবং নেতৃবৃন্দের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের জন্য এই আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ে ৭০-৭১ সালের পর এবং যা তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারকে আরও সুবিধা করে দেয় এই আন্দোলন দমনের। কিন্তু চারু মজুমদারের নীতি বা আদর্শ, তিনি যে শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা তৎকালীন ছাত্র যুবককে যেভাবে অনুপ্রাণিত করেছে তা ভারতবর্ষে কোনো  রাজনৈতিক দল স্বাধীনতার পর করতে পারেনি। এই আন্দোলন মুখ থুবড়ে  পড়লেও আন্দোলনের কারণ বা সদিচ্ছা মানুষের মধ্যে চিরকালীন। শুধু  সেইসময় বলে নেয় এই ৬৭-৭০এর আন্দোলন আমাদের দেশের ছাত্র রাজনীতির অভিমুখ পরিবর্তন করে দেয় পরবর্তীকালে। ছাত্ররা মূলত রাজনীতিতে উৎসাহিত হয় এবং দেশের স্বার্থে রাজনীতিতে যোগদানের উপযোগিতা অনুভব করে মূলত নকশাল আন্দোলন এর পর থেকেই। পরবর্তী কালে বামফ্রন্ট সরকার গঠন করায় ছাত্র রাজনীতির ভিত্তি প্রস্তর সুদৃঢ় হলেও সমগ্র দেশে এর বীজ বপন হয় এই নকশাল আন্দোলনের প্রভাবেই। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে স্বাধীনতার পর প্রথম ও এখনো অব্দি শেষ বিপ্লব এই নকশাল আন্দোলনই, যেখানে ব্যাপক হারে গণ অভ্যুত্থান দেখা যায়। সুতরাং  বলাই বাহুল্য, এই আন্দোলন নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে আপাত ব্যর্থ হলেও আগামীর জন্য যে এক গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দিয়ে গেছে, সে কথা অনস্বীকার্য।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন