দেশপ্রেম বা 'দেষপ্রেম' বিষয়ক খোলা চিঠি
প্রিয় মুচকুন্দ,
অনেক দুবলা পথ, ভ্যানভ্যানানী এবং কেলুচরণদের গবা পার করে এসে অবশেষে সময় হলো তোমার সঙ্গে চ্যাটাবার। একটু সময় দিয়ে এই ক্যালক্যালানি সহ্য করলে অন্তত কতটা ফুড়ুৎ হয়েছি ইতোমধ্যেই তার একটা সঠিক ফর্দ পাবে। যাইহোক, তোমার বাবার চিপকে দেয়া নামটা এতই খিটকেলে, বরং তোমায় মুচকু বলে, না না, সবাই নামে আবার মানে খোঁজে, তাই মিচকে বলে চালিয়ে দিচ্ছি।
তো মিচকে, আমার বোধহয় এ জন্মে আর দেশপ্রেমিক হওয়া সম্ভব হলো না। চারপাশে দেশপ্রেমের হল্লা শুনে শুনে এতই ক্লান্ত যে তোমাকে এ চিঠি লিখতে বাধ্য হলাম। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দেশপ্রেমিকের সাম্প্রতিক সাজগোজটা আমার একেবারেই পছন্দ নয়, কপালে ফোঁটা, গলায় ঝোলানো ছোটো চাদর আর বল্লম বিদ্ধ শুয়োরের মত দাঁত খিঁচিয়ে তীব্র চিৎকার "জ্যায়... জ্যায়"। উরিঃ বাপরে, চ্যাঁচানো শুনলেই মনে হয় রাক্ষস প্রজাতির রক্তপিপাসু উল্লাস। এসব ফর্ম্যাটে দেশপ্রেমিক হওয়ার জন্য কসাইগিরীর যে যোগ্যতা প্রয়োজন হয়, নিশ্চিত আমার সে যোগ্যতা নেই। পরাধীন ভারতবর্ষও সম্ভবত এমন দেশপ্রেমিকদের দেখেনি।
দেখেছে বিভিন্ন সময় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পত্তি দখল ও ভাগবাঁটোয়ারা করার ধান্দাবাজী খুনোখুনীর বিভীষিকাময় দাঙ্গা, যা দেশপ্রেমের উজ্জ্বল আগুন থেকে শতসহস্র ক্রোশ দূরের ভাবনা। কিছু বছর আগে যা গোধরায় দেখেছে ভারতবর্ষের মানুষ। ধর্মীয় সম্প্রদায়ের যত্নে লালিত যে ঘৃণার ছবি দেখে চমকে উঠেছিলো ভারতবাসী। অন্তঃসত্ত্বা মহিলার গর্ভ তলোয়ারের ডগায় বিদ্ধ করে দেয়া, মায়ের চোখের সামনে তিন বছরের কন্যাকে তুলে পাথরে আছড়ে মেরে ফেলা। শুধু তাই নয়, হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু, ঘরবাড়ি লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ। মানবাধিকার সংগঠনের ফ্যাক্ট- ফাইণ্ডিং দল দাঙ্গা পরবর্তী সময়ে বিস্তর খেটেখুটে যে তথ্য তুলে দিয়েছিলো সাংবাদিকদের হাতে, শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের চোখ কপালে উঠে যায় সে সব শুনলে। বলা হলো, এক বিশেষ সম্প্রদায়, ক্ষমতার বলে লুধিয়ানা থেকে অর্ডার দিয়ে বছর খানেক আগে থেকেই নাকি বিশেষ মাপের লরি লরি তলোয়ার মজুত করেছিলো নিজেদের হেফাজতে। এমনকি গোটা শহরের প্রতিটি গলি রাস্তা বাড়ি দোকান বাসিন্দাদের পুরো ব্লুপ্রিন্ট বানানো হয়েছিলো বছর খানেক আগে থেকেই। সে জন্যই দেখা গেছে তুলসী নামের হোটেলের বিরোধী সম্প্রদায়ের মালিককে দোকানে ঢুকে নির্দয়ভাবে মেরে দেয়া হয়েছে। বস্তুত করসেবকবাহিত ট্রেনের গণ্ডগোল অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে এই দাঙ্গা না হলেও, অন্য কোন অজুহাতে ঘটানো হতো সে দাঙ্গা। যদিও খুব সম্প্রতি ভারতবর্ষের উচ্চ আদালত এই ‘পূর্বপরিকল্পিত’ অভিযোগটিকে খারিজ করে দিয়েছে আজ কুড়ি বছর পর।
সে সব থাকুক, আপাতত দেশপ্রেম বিষয়েই ভাবিত আছি। শুনেছি প্রেমের বিপরীত শব্দ ঘৃণা। তবে কি প্রেমের মধ্যে ঘৃণারও এক গোপন এজেণ্ডা আছে! ইতিহাস বলছে আছে। প্রেম এবং ঘৃণা নাকি পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। যেমন, মানুষ-মানুষীর সম্পর্ক দেখলেই মালুম হবে। আজ যারা প্রেমের ধ্বজা উড়িয়ে সমাজ সংসার ফুৎকারে পায়ের নীচে মাড়িয়ে যেতে দ্বিধা করে না, সামান্য ত্রুটিতেই চরম হিংস্র হয়ে ওঠে পারস্পরিক প্রতিশোধ স্পৃহায়। কিন্তু প্রেম নিড়োতে যেহেতু গোয়ালে ঢুকিনি, তাই চটকে চিমসে করে দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। বিষয় দেশপ্রেম বা দেষপ্রেম। প্রেমের ডগায় দেশ যেহেতু লটকে আছে, তার আলোচনা, পর্যবেক্ষণ ও অনুধাবনও যে আলাদা হইবে তাহা বলাই বিধেয়। সুতরাং মিচকে তোমাকে খুলে বলাই ভালো যে, আমি একজন সেই দেশপ্রেমিক যে ঘৃণাজর্জর প্রেম প্রয়োজন হয় দেশপ্রেমিক হবার জন্য, আমার তা আছে। বস্তুত দেশপ্রেম শব্দের মধ্যে যে দখলদারি কায়েম করবার সঙ্কল্প দরকার হয়, সে ব্যাপারে পুরুষ প্রজাতি হয়ে জন্ম নিয়ে দেখেছি, আমার প্রথম দখলদারি প্রতিষ্ঠা করবার ক্ষেত্র নারী। তার শরীর ও মনের উপর আমার একচ্ছত্র অধিকার কায়েম করাই দেশপ্রেমিক হবার প্রথম পদক্ষেপ। দেশের ক্ষেত্রে সে দখলদারি দেখানোর খোলা ময়দান হচ্ছে, শাসক হিসেবে বিরোধীদের ওপর দখল প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত যাবতীয় শক্তি প্রয়োগ করা। ক্যাডার, পুলিশ, গোয়েন্দা, আর্থিক প্রলোভন, আইন, আদালত যেনতেনপ্রকারেন বিরোধীদের ওপর দখল প্রতিষ্ঠার লড়াইটা দেশপ্রেমের এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সম্প্রতি একেবারেই উলঙ্গের মত সরাসরি বিরোধী বিধানসভার যাবতীয় প্রতিনিধিদের টাকার প্যাকেজ পাঠিয়ে কিনে নিয়ে, হাইজ্যাক করে নিজেদের স্থান হিসেবে বিবেচিত কোন নিরাপদ গুহায় পাঠিয়ে দেয়ার খেলা চলছে। দেশপ্রেমের এমন কুৎসিত নমুনা স্বাধীন ভারতের পূর্ববর্তী প্রজন্ম এর আগে বোধহয় নির্বিবাদে এভাবে প্রত্যক্ষ করবার সুযোগ পায়নি।
যা বলছিলাম, প্রেমের অন্দরে ঘৃণার চাষ বা ঘৃণা ও প্রেমের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা। যেমন স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে ভারতবর্ষের আপামর মানুষ (কিছু বিশ্বাসঘাতক বৃটিশের পা-চাটা একান্ত অনুগত সুবিধাবাদী ছাড়া) নারী, শিশু, হি্ন্দু, মুসলমা্ন, শি্খ, খ্রীস্টা্ন, আদিবাসী সহ যে কোন ভারতবাসীর কাছে দেশপ্রেমের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ঘৃণার টার্গেট ছিলো লাল চামড়ার ইংরাজ ও তাদের তল্পিবাহক দেশীয় দালালেরা। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আপামর ভারতবাসীর ঘৃণার আগুনে জ্বলে পুড়ে ছটফট করতে করতে ইংরেজরা একসময় বিদায় নিলো বা ভারতবর্ষ ছেড়ে যেতে বাধ্য হলো। এটা ছিলো স্বাধীনতার পূর্বের সময় যখন জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে দেশপ্রেম দেখানোর জন্য ইংরেজদের প্রতি ঘৃণার চাষ ছিলো প্রথম এজেণ্ডা।
আবার স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশীয় ও ক্ষেত্রজ বাতাবরণে আর এক ঘৃণার চাষ হতে দেখেছি কমিউনিস্ট ভাবধারার যাঁতাকলে সাঁতলাতে সাঁতলাতে। সেটি হচ্ছে দেশপ্রেম দেখানোর দ্বিতীয় ফেজ। শোষণহীন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে, রাখঢাক না রেখেই সরাসরি ঘোষণা - শোষিত ও শোষক দুই শ্রেণী, আর শোষিতের সংখ্যা যেহেতু বেশি তাই শোষণহীন সমাজ বানাতে গেলে অর্থাৎ শোষিতের প্রতি প্রেম দেখানোর প্রথম শর্ত, শোষক শ্রেণীর প্রতি ঘৃণার চর্চা। এবং শ্রেণীশত্রু খতমের এজেণ্ডার মধ্যে দিয়েই সে লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব। যেহেতু সরাসরি শোষক ও তাদেরই প্রতিনিধিরা বিভিন্ন রঙের পতাকা হাতে, বারবার রাষ্ট্র দখল করে রাষ্ট্রেরই তৈরী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের কারসাজিতে, তাই সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার মাধ্যমে আড়ালে ও প্রকাশ্যে যুদ্ধে নামাই প্রকৃত দেশপ্রেম। সুতরাং প্রেম ও ঘৃণা যে পারস্পরিক পরিপূরক এক মানসিক অবস্থান, সাধারণ মানুষ না বুঝলেও রাজনীতির ব্যাপারীরা সে বিষয়ে ১১০% শতাংশ নিশ্চিত।
স্বাধীনতাপ্রাপ্তির প্রায় ৬০/৬৫ বছর পার হয়ে যাবার পর, এখন আবার দেখছি দেশপ্রেমের তৃতীয় দফা। একেবারে নাজেহাল অবস্থার নির্লজ্জ ডেমনস্ট্রেশন। সরাসরি বিশেষ ধর্ম ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর তীব্রতম ঘৃণা দেখানোই প্রথম ও চূড়ান্ত দেশপ্রেম। এই সাম্প্রদায়িক দেশপ্রেম এমনই সক্রিয় যে, ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটিই দেশটার গা থেকে প্রয়োজনে কামান দেগে উবু করে দিয়ে সে জায়গায় লটকে দিতে হবে দেশটি অমুক ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। এ এক একমাত্র করণীয় এজেণ্ডা এবং জনগণ যারা ধর্ম, সম্প্রদা্য়, সংষ্কৃতির শত বিভিন্নতা দূরে সরিয়ে রেখে হাতে হাত বেঁধে একসাথে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচন করেছিলো নিজেদের জীবন আত্মাহুতি দিয়ে, তাদেরই সন্তান সন্ততি আজ ভিনধর্মের কারণে ঘৃণার পাত্র। এই দেশপ্রেম ভাবতেই কেমন গলার কাছে বমি দলা পাকিয়ে ওঠে। কত রকম কৌশল ও চক্রান্তে মানুষ ক্রমেই কেমন অনিশ্চিত হয়ে উঠছে জীবনধারণে, এমন কি প্রশ্ন তুলে দেয়া হয়েছে এই দেশটির তারা আদৌ বাসিন্দা কিনা, সেই প্রশ্ন মীমাংসার প্রয়োজনে নানাবিধ কাগজ কুড়োনোর ছোটাছুটি।
প্রিয় মিচকে, আপাতত ধরেই নিয়েছি আমি এই দেশপ্রেমিক নই এবং হওয়াও কোনমতেই সম্ভবপর নয়। আজকের যে পৃথিবী ডিজিট্যাল ব্যবস্থার বিনিময় সময়ে দাঁড়িয়ে, যখন রোবটকে দিয়ে দেয়া হচ্ছে জীবনকে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব, তখন ছেঁড়াখোঁড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, তাদের জীবনের সামগ্রিক মানকে উন্নত করবার কর্মযজ্ঞে, সম্মিলিত রাষ্ট্রিক শক্তিকে একীভূত করে ঝাঁপিয়ে পরাই রাষ্ট্রের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিন্তু তার বিপরীতে গিয়ে, নতুন করে পাঁচহাজার বছরের পেছনের কোনও সাংস্কৃতিক পিছনগামীতাকে কাঁধে বয়ে বেড়াবার কোনও দায় বোধ করছি না বলেই, আমি এই নতুন পর্যায়ের দেশপ্রমিক সাজবার পথ থেকে নিজেকে বিরত রাখছি। এবং এ কথা প্রকাশ্যে বলতে পারবার জন্য যদি ফাঁসি হয়, সেই ফাঁসির দড়িকে হাসিমুখে গলায় তুলে নেয়ার দেশপ্রেমটাই আমার পূর্বজ স্বাধীনতাকাঙ্ক্ষী মানুষেরা আমাদের শিখিয়ে গিয়েছেন। সুতরাং, এ প্রসঙ্গে আপাতত কলম থামালাম।
ইতি,
তোমার বহু আগের পরিচিত
শ্রীযুক্ত বন্ধু
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন