কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

মধুবাণী ঘোষ

 

ভালোবাসার কথা বলতে এলাম : প্রাণের মানুষ ১১




ব্যাডল্যান্ডস ন্যাশানাল পার্কে আসার আগে আমার প্রেয়ারি ডগ (Prairie dog) জন্তুটা সম্বন্ধে তেমন পরিষ্কার ধারণা ছিলো না। অনেকটা মীরক্যাট গোছের হাবভাব। আমাদের লায়ন কিংয়ের টিমন। মাটির তলায় গর্ত করে দলবদ্ধ সচকিত জীবন। পরে জেনেছিলাম প্রেয়ারি ডগ আর  মীরক্যাট দূর সম্পর্কের আত্মীয়-ও নয়। মীরক্যাটের মার্জার ভাব কম আর বেজী ভাব বেশি। প্রেয়ারি ডগের সারমেয় ভাব কম আর কাঠবেড়ালী ভাব বেশি। এই বাস্তুসংস্থানে (Eco system) প্রেয়ারি ডগকে বলা হয় এক কিস্টোন (keystone) প্রজাতি। অর্থাৎ এই ব্যাডল্যান্ডস বাস্তুসংস্থানের যাকে বলে রাহুল দ্রাবিড়। এরা সকলে মিলে টুক টুক করে,  ধৈর্য্য ধরে, মাটির তলায় তৈরী করে সুড়ঙ্গপ্রণালী আর মাটির ওপরে ছোট ছোট ঢিবি। তার ফলে রুক্ষ ব্যাডল্যান্ডসের মাটিতে প্রাণসঞ্চার হয়, ঘাসের শিকড়গুলি আলো বাতাস পায় এবং  সেগুলি খেয়ে জীবনধারণ করে নানা প্রজাতির তৃণভোজী জীব। আবার এদেরকে  খেয়ে বেঁচে থাকে সোনালী ঈগল, শেয়াল আর নেকড়ের  দল।

গেট দিয়ে ঢুকেই রাস্তার দুই ধারে প্রায় শ’খানেক প্রেয়ারি ডগ নিজের নিজের বাড়ির দাওয়ায় ছানাপোনা নিয়ে বসে আড্ডা মারছিলো। আমি গাড়ি থেকে নেমে ওদের ঢিবির কাছে যেতেই ভারী বিরক্ত হয়ে - 'কে রে? বেপাড়ার লোক? ঢঙের লাল জামা  গায়ে এখানে মরতে এয়েচে কেন?' এইসব বলে মুখ ভেংচে গর্তে গিয়ে সেঁধোলো।

আমি আর বাজ বাহাদুর দুঃখের  গান গাইতে গাইতে ব্যাডল্যান্ডসের রাস্তা ধরে এগোতে লাগলাম।

'जाने वो कैसे लोग थे जिनके

प्यार को प्यार मिला

हमने तो जब कलियाँ माँगी

काँटों का हार मिला'

ব্যাডল্যান্ডস ঠিক মরুভূমি নয় তবে মরুভূমির ছোট ভাই। এখানে বৃষ্টি হয় কালে ভদ্রে আর সেই বৃষ্টিতে ধুয়ে যায় মাটির যেটুকু সঞ্চিত ধন। সেই রুক্ষ রূপ কী ভয়ঙ্কর সুন্দর! চারিদিকের পাহাড়গুলির কী আশ্চর্য রং! বাতাস, সূর্য আর বৃষ্টি  তিনজনে যেন এক বিশাল ক্যানভাসে ছবি এঁকে রেখে গ্যাছে। সে কোথাও কৃষ্ণ কালো কোথাও বা শ্রী রাধার মতো গৌরবর্ণ। মাথার ওপরে উড়ছে সোনালী ঈগল।  সেই রূপ দেখে আমার চোখ ফেটে জল আসছিল।




'হাথক দরপণ মাথক ফুল |

নয়নক অঞ্জন মুখক তাম্বুল ||

হৃদয়ক মৃগমদ গীমক হার |

দেহক সরবস গেহক সার ||

পাখীক পাখ মীনক পানি |

জীবক জীবন হাম ঐছে জানি |

তুহু কৈছে মাধব কহ তুহুঁ মোয় |

বিদ্যাপতি কহ দুহু দোহাঁ হোয় ||'

মাধব, তুমি আমার হস্তের দর্পণ, মস্তকের ফুল, চক্ষের অঞ্জন, মুখের তাম্বুল। তুমি আমার  হৃদয়ের কস্তরী লেপন, কণ্ঠের হার, দেহের সর্বস্ব, গৃহের সার। মাধব তুমি  পক্ষীর পাখা, মৎসের জল, জীবনের জীবন, আমি তোমাকে এমনটাই জানি। মাধব, তুমি আসলে কেমন, তোমার আসল রূপ কি... তা তুমি আমাকে বলে দাও। বিদ্যাপতি বলেন রাধা মাধব এবং মাধব রাধা দুইজনেই আসলে দুইজন। রাধা কখনো মাধব, আবার মাধব কখনো রাধা।

একটা আশ্চর্য রাস্তা দিয়ে চলেছে বাজ বাহাদুর। এর নাম ব্যাডল্যান্ডস লুপ রোড। কখনো দুপাশে ধু ধু প্রান্তর আবার কখনো বা  রুক্ষ পর্বতাবলীর ওপরে রঙিন তুলির আঁচড়।  হঠাৎ রাস্তার বাঁ দিকে একটা টিলার মাথায় দেখি কারা যেন হাঁটাহাঁটি করছে। না হাঁটাহাঁটি ঠিক নয়, পাহাড়ের চূড়োয় চূড়োয় যেন ভেসে বেড়াচ্ছে ব্যালেরিনার মতো। আমি কাছে গিয়ে দেখি বিগহর্ন শীপের প্রমিলাবাহিনী। এদের আদি বাড়ি ছিল সাইবেরিয়া। হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে তারা এই দেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। ব্যাডল্যান্ডস ন্যাশানাল পার্কে এদের আগমন ঘটে ১৯৬৪ সালে। পুরুষ বিগহর্ণের পাকানো গোঁফের মতো শিং জোড়া তার শরীরের ওজনের প্রায় ২০%! মেয়েদের ওসব মস্ত শিং ফিংগের বালাই নেই। তাদের তো আর ঝাড়পিট করে হারেম জোগাড় করতে হয় না! তা ছেলেরা এই বিকট শিং ঠোকাঠুকির জন্য তাদের মুন্ডুটা এমনভাবে তৈরী করেছে যে দমাদ্দম গোত্তায় অক্কা পায় না। যে হারে সে চুপচাপ দলছুট হয়ে সরে যায় আর পরবর্তী সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। শোনা যায় এখানে বিজ্ঞানীরা নাকি পুরুষ বিগহর্ন শীপের মাথার আদলে গোত্তামারা আমেরিকান ফুটবলের হেলমেট তৈরী করে। তা সে যাই হোক দেখি একদল গিন্নিবান্নি গোছের বিগহর্ণ তাদের ছানাপোনা নিয়ে পাহাড়ের গায়ে ব্যালে প্র্যাক্টিস করছে। পুরুষেরা তাদের কর্ম সম্পাদন করে পাকানো গোঁফে তা দিয়ে কেটে পড়ে। আবার তাদের দেখা পাওয়া যাবে পরের বসন্তে।

 


'বাতাসে বহিছে প্রেম,

নয়নে লাগিলো নেশা

কারা যে ডাকিলো পিছে,

বসন্ত এসে গেছে

মধুর অমৃতবানী বেলা গেল সহজেই

মরমে উঠিল বাজি বসন্ত এসে গেছে।'

বাজ চলেছে ব্যাডল্যান্ডস লুপ রোড ধরে। আমার চারিদিক যেন একটা ওয়েস্টার্ন সিনেমার জন্য তৈরী করা সেট। ওল্ড ওয়েস্ট থেকে ভেসে আসছে কাউবয় আর বন্দুকবাজদের শব্দ। তাদের পায়ে চামড়ার বুটজুতো, গালে তামাকপাতা, মাথার টুপি একপাশে হালকা কান্নি মারা, গলায় কেরচিফ আর মুখে একটা বিষতেতো ভাব। ওরা যে কোনোদিন নলেন গুড়ের গরম পায়েস খায়নি তা মুখের ভাবে স্পষ্ট। পান  থেকে চুন খসলেই ঢিস্ক্যাও ঢিস্ক্যাও গুলি। সব ঠিক ছিল, কিন্তু মাঝে মাঝেই ক্লিন্ট ইস্টউডের কথা মনে করে মনটা উদাসপানা হচ্ছিল।

 


ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। একটা অপার্থিব আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে  মাকো সিকা। পাথরের ওপরে কোমল হচ্ছে স্পর্শ। সামনের আকাশের রং কেমন অদ্ভুতভাবে আমার পেছনদিকের আকাশেও প্রতিফলিত। মনে হচ্ছে কে যেন আকাশে আয়না ধরে রয়েছে। আমি এমনটা আগে কক্ষনো দেখিনি। এক প্রান্তরের পাশে বাজকে থামিয়ে পাশের সিট্ থেকে সাবওয়ে স্যান্ডউইচের প্যাকেট খুলে চুপচাপ হানি মাস্টার্ড দেওয়া টুনা স্যান্ডউইচ খাচ্ছি আর এইসব আলোর আঁধারের খেলা দেখছি। ওমা! হঠাৎ শুনি পরিচিত কণ্ঠস্বর। লুপ রোড ধরে একটা বিন্দু স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে। তার গায়ে হালকা রঙের পাঞ্জাবি, পরনে সাদা পাজামা। পড়ন্ত রোদের আলোয় কেউ এগিয়ে আসছে লুপ রোড ধরে। সে গাইছে ...

 

'कहीं दूर जब दिन ढल जाये

साँझ की दुल्हन बदन चुराए

चुपके से आये

मेरे ख्यालों के आँगन में

कोई सपनों के दीप जलाए...'

 


(ক্রমশ)

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন