কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

হে নেপথ্যচারিণী




 

(৬)

 

শব্দ

 

চালতাবাগানের দোতলার অতিথিঘর রীতিমতো দই ইলিশের গন্ধে ম ম করছে। আমি আর আশুদা দেরি না করেই অত্রি আর সুচন্দ্রার সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে বসে পড়লাম। বেলা গড়িয়েছে অনেক। আশুদার কথামতো ওদের কাছে আমাদের লালবাজার অভিযানের কথা গোপন রাখা হল। খাবারে রসনা স্পর্শিত হতেই বুঝলাম সুচন্দ্রা অতিরন্ধনপটীয়সী। সকালের উদ্বিগ্নতা আর যেন নেই। তবু ছাইচাপা অমাগুনের মতোই এই তরুণ দম্পতিটির অবচেতনে যে এক অজানা উৎকণ্ঠা ধিকধিক করে জাগ্রত রয়েছে, একথা অনুভব করতে পারছিলাম। মাঝে মাঝেই আমার চোখ নিজের অজান্তেই চলে যাচ্ছিল ঘরের আবলুশ কাঠের প্রাচীন শো কেসের দিকে। তার মাথায় হেলান দিয়ে বসে আছে রেশমী। মনসুর গাজি যে ভুডু পুতুল নিয়ে ঘোরে, তার অবিকল কপি। খেতে খেতে ভাবছিলাম, সত্যিই কি এই আত্মার প্রতিস্থাপন সম্ভব? একটি পুতুলের ভিতর একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষের অস্তিত্ব পুরে ফেলা সম্ভব? কে জানে!

খাওয়াদাওয়া সাঙ্গ হলে অত্রি আমাদের পাশেই বসবার ঘরে নিয়ে এল। সেখানে এখনও কড়িকাঠের ছাদ। ঘরের ভিতর কুমিরের চামড়া দিয়ে বাঁধানো সোফাসেট। আর দেয়াল ধরে সারবদ্ধ বই আলমারি। আশুদার পায়ের তলায় সর্ষে। বই দেখলে তার মন স্থির থাকতে পারে না। আলমারিতে বই দেখতে দেখতে সে অত্রিকে বলল।

-এইসব বই তোমার?

-নাহ। ওই একপাশে একটা ছোট আলমারিতে কয়েকটা মেডিক্যাল বই ছাড়া বাকি সব বইই বাপির।

-তোমার বাবা তো বেশ সঙ্গীতসচেতন ছিলেন বলতে হয়। বেহালা বাজাতেন বুঝি? আলমারির এক কোণে একটা বেহালার টেইলপিস আর পেগবক্স রাখা আছে দেখছি।

-তা ছিলেন। একসময় তো রীতিমতো গানের দল ছিল বাপির। আপনাদের বলি। সুচন্দ্রার মা শকুন্তলা মুখোপাধ্যায় একসময়ের অসামান্যা গায়িকা ছিলেন। ওর বাবা আর আমার বাপি ছিলেন বন্ধু। ওনারা একসঙ্গেই গানবাজনা করতেন। ওনাদের একটা দল ছিল। নাম 'চিত্রকূট অপেরা'...

কথা বলতে বলতে লক্ষ্য করলাম অত্রি হঠাৎ সচেতনভাবেই দরজার দিকে তাকাচ্ছে। ঘরে তখনও সুচন্দ্রা আসেনি। বোধহয় বাসনকোষণ গোছগাছে রয়েছে।আমাদের এই নিমন্ত্রণ উপলক্ষে অত্রিরা তাদের পরিচারিকা বাণীদিকে ডেকে নিয়েছে। সুচন্দ্রা বোধহয় সেই তদারকিতে ব্যস্ত। সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে অত্রি গলা নামিয়ে আমাদের বলল।

-সুচন্দ্রা আসার আগে একটা কথা আপনাদের বলি। ওর সামনে বলা যাবে না।

আশুদা বলল,"বলে ফেল।"

-ওর মার সঙ্গে আসলে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায় যার ফলে আমাদের সমস্ত কিছু জীবন যাপন পাল্টে যায় আমূল। একটা গ্যাঙরেপ...

আশুদা আর আমি চোখাচোখি করে নিলাম এক মুহূর্তে। আশুদা বলল।

-আমরা জানি সেকথা।

অত্রি অবাক হয়। তারপর তার সেই বিস্ময়ভাব মিলিয়ে যেতে সময় লাগে না। আশুদার মেধা ও আশ্চর্য বিশ্লেষণক্ষমতার কথা সে এর আগেও শুনেছে অনেক। তাই সে বলে চলে।

-আসলে ঘটনাটা ওর চোখের সামনে ঘটে। ওর বয়স তখন আট। ওর বাবা তারপর অপ্রকৃতিস্থ হয়ে জেলে কয়েদ হয়ে যান। বুঝতেই পারছেন। শিশুমনের উপর একটার পর একটা আঘাত। আজও সেই ক্ষত শুকায়নি। তাই আমার একটি অনুরোধ। সুচন্দ্রাকে ওর বাবা মায়ের কথা কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। ও খুব ভায়োলেন্ট হয়ে যায় ওই বিষয়টা শুনলে। সামলানো যায় না।

আমি আর আশুদা দুজনেই অত্রিকে আশ্বস্থ করলাম। আশুদা বই আলমারি ঘাঁটতে ঘাঁটতে আবার পূর্বপ্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে বলল,"এই আলমারিতে বাংলা বৈঠকী গান আর রামনিধি গুপ্তর টপ্পার উপর বেশ কয়েকটি বই দেখছি। তোমার বাবা টপ্পার বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন বুঝি?

বুঝতে পারছিলাম আশুদা কথার খোলসে অত্রির অবচেতনের ভিতরের স্তরে প্রবেশ করছে ক্রমশ। তার এখনকার গন্তব্য সম্ভবত মহিষাদল। আমার এই অনুমান অমূলক যে নয় তাও প্রায় তৎক্ষণাৎ প্রমাণিত হল।

কথোপকথনের ভিতরেই সাংসারিক কাজ সেরে সুচন্দ্রা ঘরে ঢুকল। ফলত প্রসঙ্গ পরিবর্তন করতেই হল। আশুদা বলল।

-অত্রি। তোমার বাবার কিন্তু গোয়েন্দা গল্পর উপরেও বেশ আগ্রহ বুঝতে পারছি বই আলমারি দেখে।

এইবার উত্তর দিল সুচন্দ্রা।

-বাবাকে কখনও বই ছাড়া দেখিনি। জেলে ডিউটির সময় বসে বসেও বইই পড়তেন। উনিই প্রথম আমাকে আর অত্রিকে একসাথে বসিয়ে এডগার অ্যালান পো, বা আগাথা ক্রিস্টির গল্প শোনান।

-ভেরি ইন্টারেস্টিং।

বলে আশুদা এইবার সোফায় ফিরে এসে বসে পড়ল।সুচন্দ্র বলল।

-আপনার কতো গল্প শুনেছি। বই পড়ার অভ্যাস তো আমাদেরও ধরিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। আপনার নৈর্ব্যক্তিক, মরণকূপ, সাহেববাঁধ রহস্য কতোবার দুজনে মিলে পড়েছি। আজ সেই সব কথা শুনব।

-না।সেসব কথা পরে হবে। আজবরং তোমাদের কথা শুনি।

আশুদা যেন বল অন্য কোর্টে ঠেলে দিল স্বচ্ছন্দে।

-বলো। সুচন্দ্রা। অত্রি।কীভাবে দেখা হল তোমাদের? শুনি সেইসব।চালতাবাগানে অত্রিদের প্রাচীন সাবেকি বসার ঘরের দুই উত্তরমুখী জানলার খড়খড়ির আড়াল দিয়ে মধ্য দুপুরের রোদ্দুর ঘরের ভিতরে এক অতিনাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করছে যেন। সুচন্দ্রা তার বেড়ে ওঠার কথা বলছিল আমাদের। সেই বেড়ে ওঠার কাহিনীতে তার প্রারম্ভিক দশ বছরের স্মৃতি অনুপস্থিত। আশুদার সঙ্গে থাকতে থাকতে আজকাল এইসব ছোট ছোট আলোআঁধারির উৎস আমার অধরা থাকে না। আটবছরে মায়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু। তার পর বছর গড়াতে না গড়াতেই পিতৃবিয়োগ। খুব স্বাভাবিকভাবেই কিশোরী সুচন্দ্রার মনে এক ভয়ানক রৌরবের জন্ম দিয়েছে নিশ্চিত, যার মুখোমুখি সে সচেতনভাবেই হতে চাইছে। ইশুদার মনস্তাত্ত্বিক ব্যবচ্ছেদে এর নাম হবে 'ডিনায়াল'। সে হোক। কিন্তু দশ বছর থেকে যুবতী জীবনের সেই স্মৃতি কথাও নেহাত কম রোমাঞ্চকর নয়। আর সেই আখ্যানে নাট্যরঙ্গমঞ্চে সে অচীরেই এক নতুন চরিত্র নিয়ে এল যে তার ছোটমাসি। তার নাম অনুসূয়া গাঙ্গুলী। ঘটনার বিবরণ অনুসরণ করতে করতে মনের ভিতর যে ছোটগল্পর খসরা তৈরি হচ্ছিল, তা একে একে জুড়ে তৈরি করে ফেললাম সুচন্দ্রার বড় হয়ে ওঠার কাহিনী।

দশ বছর বয়সে অকালে বাপ মা হারানো সুচন্দ্রার জীবনে প্রবেশ করল অনুসূয়ামাসি। তিনি সম্পর্কে তার মায়ের খুড়তুতো বোন। সম্পর্ক খুড়তুতো হলেও দুই বোনের বেড়ে ওঠা যেন সহোদরার মতোই। তার আরেক কারণ, অনুসূয়ার বাবা ও মা ওপার বাংলা থেকে এপারে আসার পর ছত্রিশগড়ের মানা বেসক্যাম্প ঘুরে কলকাতা ফিরে আসে যখন, তখন ম্যালেরিয়ার প্রকোপে এবেলা ওবেলা তাদের অকালবিয়োগ ঘটে। অনুসূয়ার প্রতিপালন বড়দিদি  ও জামাইবিবু অলোককৃষ্ণই সম্ভবত করেছিলেন। ফলত, সুচন্দ্রার বয়স যখন দশ, অনুসূয়া মাসির সঙ্গে তখন সে ছত্রিশগড়ের জগদলপুরে সরকারপ্রদত্ত বাঙালি কলোনি পাড়ার বাড়িতে চলে আসে। কাকতালীয়ভাবে তখন অত্রির বাবা ডাঃ মুরারী পালচৌধুরীর পোস্টিংও জগদলপুর জেলখানায়। মুরারীবাবু জেলখানার কাছেই একটি দোতলা বাড়ি নিয়েছিলেন। ততোদিনে অত্রিও তার মাকে হারিয়েছে। ফলত অন্তরঙ্গ বন্ধু অলোককৃষ্ণর কন্যা আর তার  নিজের ছেলে প্রতিবেশী হয়েই বেড়ে উঠতে লাগল। বরং বলা ভালো, ছোটবেলায় অত্রি বাবা  জেলের ডিউটি চলে গেলে অত্রিও বেশির ভাগ সময় সুচন্দ্রার বাড়িতেই চলে যেত। দুজনের পঠনপাঠন রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পরমমমতায় পালন করত অনুসূয়ামাসি।আর ওদের সকলের অর্থনৈতিক প্রতিপালনের ভার নিজ কাঁধে তুলে নিতেন অত্রির বাবা মুরারী। অত্রি অনুসূয়ামাসির নাম দিয়েছিল 'কাম্মা'। একসঙ্গে বড় হতে হতে হঠাৎ একদিন দুইজনেই আবিষ্কার করল তারা স্কুলের গণ্ডি পার করেছে। কাম্মার কেরিয়ারটিও নেহাত খারাপ ছিল না। হয়তো দিদির প্রতি তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে করতে একদিন অসহায় মা মরা দুটি ছেলেমেয়ের জীবনে সে 'মা' হয়ে উঠতে পেরেছিল। অত্রি রায়পুর মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার সুযোগ পেলে এরপর বেশ কিছুদিন তাকে রায়পুর চলে আসতে হল। মুরারীও কলকাতা বদলি হয়ে গেলেন। ফলত তার কাম্মা আর সুচন্দ্রা চলে এল কলকাতায়। সেখান থেকেই স্কুল ফাইনাল, তারপর গ্রাজুয়েশন। ডাক্তারি পাশ করার শেষ বছরে অত্রি তার বাবাকে হঠাৎ হারালো।সে মৃত্যুর ধরনও বেশ অদ্ভুত ও আকস্মিক। শীর্ণকায়  মানুষটি জীবনে কখনও কোনও নেশা করেননি। শরীরে রোগ ছিল না তেমন। শুধু মাঝেমাঝে চোখ অন্ধকার করে পড়ে যেতেন। মৃত্যুর দিনও সকালে ডিউটিতে বেরিয়ে ছিলেন। চালতাবিগান থেকে আলিপুর নিজেই ড্রাইভ করে যেতেন। কর্মস্থলে পৌছে গাড়ি থেকে নামবার সময় জেলের সান্ত্রী লক্ষ্য করল সামনের গিড়িদরজা অর্ধেক খুলে ডান পা মাটিতে নামিয়ে ডাক্তারবাবু বিশ্রাম করছেন। মিনিট কেটে ঘন্টা হল। সন্দেহ হতেই ছুটে কাছে গিয়ে দেখা গেল গাড়ির চালকসীটে ডাঃ মুরারী পালচৌধুরী স্থির দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। একটি সরু লালার রেখা তার বাম গালে ঠোঁটের কোণা বেয়ে নেমে বুকের মাঝখানটা ভিজিয়ে দিয়েছে। সারাজীবন তোটকের মতো দৌড়ে গেলেন মুরারী পাল। শেষ মুহূর্তে মৃত্যুও যেন ঠিক সেই তোটকের মতোই তাকে হরণ করে নিয়ে গেল সবার অলক্ষ্যে। অত্রি তখন রায়পুর। সংবাদ শোনামাত্র সে কলকাতা ফিরল। তারপর রায়পুর ফিরে পাকিপাকি চলে এল চালতাবাগানে। সুচন্দ্রা তখন যাদবপুরে অনুসূয়ামাসির ভাড়া করা ফ্ল্যাটে থাকে। তারপর হঠাৎ আবার দেখা।পরিণয়। বিবাহ।

-এতোকিছু আমাদের ভিতর এক। এতো স্মৃতি। এতো মুহূর্ত। তাই ভাবলাম। চলাটাও একসঙ্গে হোক।

আমি বললাম,"কিন্তু প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল আমার সঙ্গে তোমার, তুমি বলেছিলে অত্রির সঙ্গে তোমার বিয়েটা বাড়ি থেকে দেখাদিখি করে..."

একে অপরের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি বিনিময়ের পর সুচন্দ্রা বলল।

-অনুসূয়া মাসিই প্রথম প্রস্তাবটা নিয়ে যায় অত্রির কাছে। অত্রির তখন গার্জেন বলতে কেউ নেই। ও রায়পুর চলে যাবার পর আমার আর ওর জীবন ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করেছিল। তাদের ধরন ও গতি দুইরকম। তাই অনুসূয়ামাসি ঘটকালি না করলে বিয়েটা হতো না।

আশুদা ততক্ষণে আবার বই আলমারির কাছে ফিরে গেছে। একটি চটি বই বের করে আবার সোফায় বসে বলল।

-তোমাদের অনুসূয়ামাসি এখন কোথায় আছে? যোগাযোগ হয়?

অত্রি আর সুচন্দ্রা দুজনেই ঘাড় নাড়ে। সুচন্দ্রা বলে।

-হয় তো। রোজ রাতে হয়। মাসি এখন পেনসিলভানিয়া আছে। সেখানকার ইউনিভার্সিটিতে মোজাভ আদিবাসী আর মৃত্যু উপত্যকা নিয়ে গবেষক। মাসি যখন ফোন করে, তখন ওদের ওখানে সকাল। আর আমাদের গভীর রাত।

-অত্রির স্ফপ্ন দেখার ব্যাপারটা মনসুর গাজি ছাড়া আর কে কে জানে?

সুচন্দ্রা খানিক ভেবে বলে, "আর তেমন কারোকে বলিনি তো আমি। এই আপনারা জানেন। ব্যাস।"

-ছোট থেকেই তো চিনতে অত্রিকে। কখনও ওকে কোনও অস্বাভাবিক আচরণ করতে দেখোনি?

সুচন্দ্রা ঘাড় নাড়ে। কখনও সে এমন দেখেনি আগে। আমাদের উঠে পড়তে হল। পঞ্চব্যঞ্জনে সেই ওঠা যদিও সহজ ছিল না। বরং খানিকটা যোগনিদ্রাই বাঞ্ছনীয় ছিল। আশুদা তার হাতে নেওয়া বইটি অত্রি আর সুচন্দ্রাকে দেখিয়ে বলল, "এক সপ্তাহের জন্য এই বইটা একটু নিতে পারি? আমি নিজে ফেরত দিয়ে যাব। কথা দিচ্ছি।"

ওরা দুজনেই আপত্তি করল না। আমি আড়চোখে দেখলাম আশুদার হাতে আগাথা ক্রিস্টির প্রথম উপন্যাস,"দ্য মিস্ট্রি অ্যাফেয়ার এট স্টাইলস"। এতো বই থাকতে হঠাৎ এই বইটির ভিতর আশুদা কোন অরূপরতন খুঁজে পেল কে জানে!

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আশুদা সুচন্দ্রাকে হঠাৎ বলল।

-একটা কথা জানতে ইচ্ছা হল। ওই মনসুর গাজীকে সত্যিই কি তুমি ডেকে এনেছিলে? না লোকটা জোর করে এসেছিল।

আশুদার প্রশ্নের উত্তরসন্ধানে সুচন্দ্রার চোখের মণির দিকে তাকাতেই শিউরে উঠলাম আমি। সেই চোখে একধরনের রক্তিম অপ্রকৃতিস্থ ভয়ানক আভা সামান্য ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল যেন। সে সামলে উঠে বলল।

-বাবা আর মায়ের কথা মনে পড়ে খুব। অনেক চেষ্টা করেও জীবনের প্রথম দশ বছর মনে করতে পারি না আমি। আমি তেমন মিশুকে নই। বন্ধুবান্ধব তেমন নেই। যা কিছু এই অত্রি আর অনুসূয়ামাসিকে নিয়েই। ওদেরকে জিজ্ঞেস করলে ওরাও কিছু বলে না। অথচ সেই কথা চিন্তা করলেই মাথার ভিতর দপদপ করতে থাকে। অসম্ভব রাগ হয়। মনসুর গাজী অত্রিকে দেখেছে আপনার কলেজে হয়তো। তারপর ফলো করে একদিন আমার কাছে আসে। ওর একটা পুতুল আছে। রেশমি। মানুষের মনের ভিতর লুকিয়ে রাখা গোপন সব কথা ওই পুতুলটা বলে দিতে পারে। লোকটা বলল অত্রির খুব বিপদ। কিন্তু ও এর সমাধান জানে। লোকটা তারপর আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল সে আমার ছোটোবেলার কথাও নাকি ওই পুতুলের ভিতর দিয়ে বলে দিতে পারবে। তাই ওকে ডেকেছিলাম আজ। যদি জানতে পারি আমার বাবা মায়ের কী হয়েছিল, কেমন ছাল তারা, এইসব।

-বুঝলাম।

ঘরে ফেরার পথে আশুদা শিয়ালদহের কাছে দুটো কাপড়ের পুতুলের দোকানের সামনে দাঁড় করিয়ে একটি সাদা ঘাঘড়া পরা পুতুল কিনল। পুরোপুরি রেশমির মতো দেখতে না হলেও রেশমির আত্মীয়পরিজন বলে চালিয়ে দেওয়াই যায়। বাকিটুকু পথ নিস্তব্ধ। কোনও কথা বলা নিষেধ। আশুদার মুখচোখ দেখে মনে হল, সে যিন পুতুলের ভিতর সত্যিই কারও প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছে। অজস্র 'কিন্তু-কেন' ভাবতে ভাবতে আমরা সাদার্ন অ্যাভিনিউতে আমাদের ঘরের সামনে ফিরে এলাম আবার।

ঘরে ঢুকে সোফার উপর বইটি সযত্নে নিক্ষেপ করে কালার স্ফিয়ারের দিকে তাকিয়ে আশুদা চেয়ারে বসে পড়ল। তারপল আমাকে বলল।

-মঞ্চনির্মাণের সময় কনস্তানটিন স্তালিস্নাভস্কি কী বলতেন জানিস? আমার পারিপার্শ্বিক জগতে দেখা ঘটনাগুলো সবকটিই যদি সত্যি হয় তাহলে আমাদের করণীয় কী? স্তালিস্নাভস্কি এই করণীয় উপাদানকে বলতেন 'ম্যাজিক ইফ'। 'ঐন্দ্রজালিক যদি'। মঞ্চক্রিয়া সৃষ্টির উপাদান হল প্রদত্ত পারিপার্শ্বিকতা। এই যেমন ধর গল্প, প্রট, গান, সময়, ঘটনার কাল। এইসব। আর এইসবকে যুক্তিপূর্ণভাবে খাড়া করার চেষ্টা করার প্রক্রিয়া ওই 'ম্যাজিক ইফ'। এই বিষয়ে গবেষণা করতে গিয়ে একটি নাটকে পুরো মঞ্চটাই অগোছালো করে দিয়েছিলেন তিনি। সেই নাটকের নাম আঙ্কল ভানিয়া'।

-আজ অত্রি আর সুচন্দ্রার কথোপকথনে কী কী 'ম্যাজিক ইফ' পেলে তুমি?

-অনেকগুলো মোটিফ পেলাম। ওদের দুজনের ছত্রিশগড় আর জগদলপুর একটা মোটিফ।

-অত্রির স্বপ্নর সঙ্গে যোগ?

-নিশ্চয়ই থাকবে। কিন্তু এখনও সেই যোগ কতোটা সংযুক্ত তা বের করার যথোপযুক্ত উপাদান তথ্য আমাদের হাতে নেই।

-বেশ। আর?

-মনসুর গাজী আর অনুসূয়া গাঙ্গুলী একটা মোটিফ। তোকে টাস্ক দিলাম। আমেরিকার পেনসিলভানিয়ায় মৃত্যু উপত্যকা আর মোজাভ আদীবাসীর ওপর কী কী গবেষণা হয়েছে, তার একটা তালিকা আমার চাই।

আমি ডগমগ হয়ে উঠি। এই রহস্য রহস্য ব্যাপারটায় ওয়ার্কলিস্ট নিতে আমার বরাবর ভালো লাগে।

-বাল্যবন্ধু। দত্তার মতো। আবার বিচ্ছেদ। তারপর আবার দেখাশোনা করে শুভপরিণয়। সুচন্দ্রার জীবনটা বেশ অদ্ভুত কিন্তু।

-মায়াবনবিহারিনী হরিণী।

-মানে?

-ওর জীবনের থেকেও অদ্ভুত ওর হরিণের মতো চলন। বড় মায়াময়।

-কোনও ক্লু পেলে? সেই পায়ের চিহ্ন?

-ভালো মনে করালি। এই রবিবার কাজ রাখবি না। কয়েকটা কাজ সারতে হবে। সর্বানন্দকে বলে শম্ভুবাবু লেনে অলোককৃষ্ণর ঘরটা একবার আমাকে দেখতেই হবে।

-এতো বই থাকতে হঠাৎ ওই বইটা কেন নিলে বলো দেখি? আমাকে বললেই তো কলেজস্ট্রিট থেকে এনে দিতাম।

আশুদা গোলক চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। তারপর বলে।

-পুতুলটার নাম ঠিক করেছি একটা। মনসুরের পুতুলের নাম 'রেশমি' হলে আমার পুতুলের নাম হবে 'দত্তাত্রেয়'।

-সে তো অনুসূয়ার পুত্র বিষ্ণু।

-ব্রাভো অর্ক। ঠিক পাকড়েছ।

-বইয়ের কথাটা এড়িয়ে গেলে।

-ওই বইটার ভিতর এমন কিছু কিছু 'ম্যাজিক ইফ' আছে যা তোর কলেজস্ট্রিটের নতুন বইয়ের পাতায় থাকত না। ঠিক ঠিকভাবে সেগুলো সাজিয়ে নিলে সেই 'ইফ'গুলো আমাদের এই রহস্যর শেষ সমাধানবিন্দুতে নিয়ে যেতে পারবে এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কিন্তু এখনই আমি সেসব কিছুই তোকে বলব না। কারণ বইটা আমাকে আরেকবার খুঁটিয়ে পড়তে হবে।

-আর অত্রির নেপথ্যচারিণী?

-সেও তো লুকিয়ে আছে এই কালার স্ফিয়ার আর ডিমার যন্ত্রের কোথাও। হিউ, ভ্যালিউ আর ক্রোমার বাইরেও কোথাও একটি শিশু তার শিশুমনের কল্পনা নিয়ে রঙ সৃষ্টি করে চলেছে আপনমনে। সেই রঙটুকু খুঁজে যতক্ষণ না পাচ্ছি, এই নেপথ্যচারিণীর মুখ অন্ধকারেই ঢাকা থাকবে।

-অতঃ কিম?

-অতঃ লালবাজারের তথাগত অধিকারীর ফোনের অপেক্ষা করা। কী আছে ওই ফ্লপিটায়। জানতেই হবে।

রাত বাড়ে। জোনাকীর মতো শহরের আলোগুলো চিন্তার চারপাশে স্তালিস্নাভস্কির 'ম্যাজিক ইফ' হয়ে ঘুরপাক খায়। সাড়ে এগারোটায় তথাগতর ফোন এল আশুদার কাছে। ফোনে বেশ কিছুক্ষণ 'হুঁহুঁ' করার পর আশুদা কেটে দিয়ে বলল, "অর্ক। রহস্য যে আরও জমে উঠছে রে।"

-কী বলল তথাগত? বের করতে পেরেছে কী আছে ফ্লপিটায়?

-পেরেছে বইকি। ওই ফ্লপিটায় একটা গানের লিরিক্স আছে। একটিই মাত্র গানের লিরিক্স।

-কোন গান?

-১৯৭১ সালে গীতা দত্তর রেকর্ড করা গান। 'কোই চুপকে সে আআ কে'...

 

(ক্রমশ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন