কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

মৌসুমী মুখোপাধ্যায়

 

অবলা নারী : এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র




 

নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/কেন নাহি দিবে অধিকার/হে বিধাতা’ – এই কথা বলেছিলেন যে কবি, সেই রবীন্দ্রনাথও  কিন্তু বলেছিলেন দুর্বলের হাতে শাসন, সেটা বড় ভয়ঙ্কর হবে প্রকৃত প্রস্তাবে আধুনিক নারী সত্যি সত্যিই অবলা কেননা তাকে মাথা নত করে থাকতে হয় সার্থকের পথ সে নিজে চিনে নিতে পারে না সন্ধানের রথও সে তেজে ছোটাতে পারে না পারে নাদুর্গমের দুর্গ হতে সাধনার ধনআহরণ করতে প্রাণ করি পণ বরং সে আজও যায়বাসরকক্ষে বধূবেশে বাজায়ে কিঙ্কিণী’, দুর্বল লজ্জার আচ্ছাদন আজও সে ফেলে দিতে শেখেনি, যতই কবি নারীকে সবলা করে গড়ে তোলার  ইন্ধন যোগান না কেন! প্রতি পদে পদে বারণ, প্রতি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতেনা’, তোমার জন্য এটা না, তোমার জন্য ওটা না, তোমার জন্য সেটা না, বস্তুত তোমার জন্য সব কিছুতেই না হ্যাঁ, এইরকমই আজও মেয়েদের পৃথিবী তার জন্য জীবন ও জগতের সমস্ত দরজাই বন্ধ ছিল একটা সময় পর্যন্ত, যতক্ষণ না কেউ কেউ এসে (বলা বাহুল্য  কোন মেয়ে) একটা একটা করে দরজা ভেঙে খুলে কোন ঐতিহাসিক মুহূর্ত  তৈরী করেছে সেটা কখন সানিয়া মির্জা, কখন বাচেন্দ্রী পাল, কখন কল্পনা চাওলা, আবার কখন পি টি ঊষা থেকে মেরি কম।

সভ্যতার দান অবলা নারী। কিন্তু যখন সভ্যতা ছিল না, মানুষ  যাযাবর জীবনযাপন করত, তখন কিন্তু নারী অবলা ছিল না। তখন সে ছিল রীতিমত সবলা। পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হায়না-শকুন-শেয়াল-সিংহের সেই ভয়ংকর পৃথিবীতে, প্রাগৈতিহাসিক ডায়নোসরের পৃথিবীতে অবলীলায় শিকার করত। কিন্তু যেদিন প্রমাণ হল তার মাতৃত্বই একমাত্র ওই ভয়ঙ্কর আদিম পৃথিবীতে মনুষ্য প্রজাতির অস্তিত্ব রক্ষা করতে, সংকট মোচন করতে সক্ষম, সেইদিন থেকে সে হল গৃহবন্দী। তারপর কত শত সহস্র বছর কেটে গেছে  নারীর মাতৃত্বকে ব্যবহার করে এই এত বড় সভ্যতার সাম্রাজ্যের বৃহদায়তন অট্টালিকা নির্মিত হয়েছে, কিন্তু সেই কৃতঘ্ন তার বিনিময়ে নারীকে তো কোন কৃতজ্ঞতা দিয়ে সম্মানিত করেইনি, বরং আজ তাকে ঘর থেকে টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করছে! কারা ধর্ষণ করছে? না সেই পুরুষরা যাদের সে তার শরীরের মধ্যে দশ মাস দশ দিন ধারণ করে এই পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে এবার তাহলে সেই নারী, মাতৃরূপেণ সংস্থিতা, তারা কোথায় যাবে? এই এত শত সহস্র বছর ধরে ঘরে থাকতে থাকতে সেই নারী তো হারিয়ে ফেলেছে তার প্রকৃতি প্রদত্ত শক্তি! সে যে পালটা রুখে দাঁড়িয়ে লড়াই করবে, সে পথ তো বন্ধ তাহলে? তাহলে এবার সে কী করবে? কী করে রক্ষা করবে সে নিজেকে? এখন তো আর তাকে জন্তুজানোয়ারদের হাত থেকে রক্ষা করতে আদিম পুরুষ নেই পুরুষ তো এখন বদলে গেছে

পাঠকদের এখানে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আমি বলে নিতে চাই সেটা হল প্রায় মোটামুটি সব জায়গায়ই পুরুষ বলতে আমি গোটা পুরুষ জাতিকে বা সব পুরুষকেই উদ্দেশ্য করে বলছি না যেমন ধর্ষণ করে পুরুষ তার মানে কিন্তু কখনই এটা নয় যে গোটা পুরুষ জাতিটার সব পুরুষই ধর্ষক আমার মতে এটা বলা বা ভাবাটা চূড়ান্ত মুর্খামি হবে যেমন, সেই সঙ্গে সঙ্গে সত্যকেও বিকৃত করা হবে, যেটা আমি কখনই করতে চাই না

সবলা নারী কীভাবে অবলা হল সেকথা বলেছি এখানে এবং অন্য একটা লেখায় যে কারণে নারীর এই গৃহবন্দী জীবন শুরু হয়েছিল যাযাবর জীবনপর্বে,  সেটার মধ্যে আমি কোন ষড়যন্ত্র ছিল তেমনটা আদৌ বলছি না বরং সেই সময় ওই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা  তখনকার দিনে আদিম মানুষের পক্ষে অভূতপূর্ব এক বিচক্ষণ ও বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত ছিল কিন্তু তারপর সভ্যতার কোন এক পর্যায়ে নারীকে পর্দানসীন রাখা হত নারীর জীবনযাপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক বিধিনিষেধ আরোপ করা হত আমি অতীতের মূলত এই পর্যায়গুলোকেই নারীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছি এই পর্বটা বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন রকম ছিল তাই এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ আছে এই লেখার মধ্যে আমি সে আলোচনায় যাচ্ছি না তবে অতীতের চেয়ে বর্তমানের ওপর নজর দেওয়াটা বিচক্ষণতার কাজ তাই পাঠক, চলুন আমরা একটু দেখে নিই এখনকার নারীদের প্রাত্যহিক জীবনটা কেমন

ছোট থেকে আমরা পড়ে এসেছি, খেলাধুলার মধ্যে দিয়ে শরীরচর্চা হয় আর এ কথা কে না জানে শরীরচর্চাই হল শক্তির প্রধান উৎস! কিন্তু আমাদের  সমাজে  শরীরচর্চা তথা খেলাধুলার সুযোগ মেয়েরা সত্যি সত্যিই কতটা পায়? শৈশবেই মেয়েদের হাতে পুতুল আর রান্নাবাটির সরঞ্জাম খেলার উপাদান হিসেবে তুলে দেওয়া হয়, ঠিক যখন কিনা একজন ছেলেকে দেওয়া হয় ক্রিকেট কিম্বা ফুটবল খেলার ব্যাট বল এইসব আর এই খেলা ও খেলাধুলার সামগ্রীগুলোই তাদের পরবর্তী জীবনের ব্যক্তিত্ব ও ভবিষ্যত নির্মাণ করতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় তার চাইতেও বড় কথা ক্রিকেট ও ফুটবল বা এই ধরনের আর নানারকম  খেলাগুলো শিশুর শারীরিক বিকাশে যতটা সহায়ক হয়, পুতুলখেলা ও রান্নাবাটি খেলা কিন্তু  তার মধ্যে কোন শক্তিরই বিকাশ ঘটায় না  খুব বাচ্চা বয়স থেকেই কীভাবে, কত কৌশলী উপায়ে নারীর শক্তি বিকাশের পথ রোধ করা হয়, দেখেছেন! অথচ ফুটবল, ক্রিকেট, বাস্কেটবল, টেনিস – এই ধরনের খেলাগুলো শরীরের পেশীগুলোকে দৃঢ করে, নার্ভাস সিস্টেমকে অন্যভাবে চালনা করে। একজন শিশু নারীকে ইচ্ছে করে ঘরের মেয়েলি কিছু খেলনাপাতি দিয়ে আটকে রাখাটা ষড়যন্ত্র নয়? বরং পুতুল আর রান্নাবাটি দিয়ে খেলিয়ে ছোট থেকেই তাকে শেখানো হয়, রীতিমত তার মানসিক গড়নের বিকাশকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় যাতে বড় হয়ে তারা ওই কাজগুলোই বাস্তব জীবনে করতে পারে, সেটাই তার চৌহদ্দি বলে জেনে নিতে শেখে।

আমাদের সকলেরই বাড়ির আশেপাশে দেখতে পাব কম বয়সী ছেলেরা ব্যাট  বল নিয়ে ক্রিকেট, ফুটবল খেলে কিন্তু সেই খেলায় মেয়েদের দেখা যায় না অথচ এখনকার কো-এডুকেশনের জমানায় শিশুদেরও ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে  উপরোক্ত খেলাগুলোয় খেলাধুলো করার কথা কিন্তু খুব কৌশলে ছোট থেকেই শিশুদের মধ্যে এক ধরনের ভেদাভেদ ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে তারা আলাদা, তাদের অধিকার ও চাওয়াপাওয়াগুলোও সব আলাদাআর এখান থেকেই যেন ঠিক হয়ে যায় কে হবে ধর্ষিতা আর কে হবে ধর্ষক এটা ষড়যন্ত্র নয়? স্কুলে যারা একসঙ্গে পড়াশোনা করতে পারে, বাড়ি ফিরে খেলার সময়  তারা কেন একই সঙ্গে এক খেলা খেলতে পারবে না? কেন একটা মেয়েকে পুতুল নিয়ে খেলতে শেখানো হবে? কেন তাকে রূপচর্চায় আগ্রহী করে তোলা হবে, যখন কিনা তারই সমবয়সী ছেলেরা দাপিয়ে মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট খেলে? সেটা কি এই জন্যে  নয় যাতে একটা মেয়ের গায়ে কী করে দুর্বল, অবলা, শক্তিহীনএই লেবেলগুলো এঁটে দেওয়া যায়? কিন্তু একটি শিশুকন্যাকে যদি ছোট থেকেই ফুটবল, ক্রিকেটের মত খেলাগুলো খেলতে দেওয়া হত, তাহলে আমি হলফ করে বলতে পারি একটা মেয়ের শরীরেও সেই প্রতিরোধ শক্তিটা গড়ে উঠতে পারত

শুধু তাইই নয়। ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে খেললে ছেলেমেয়েদের মধ্যেও একটা বন্ধুত্বসুলভ সমানাধিকারের ধারণা গড়ে উঠতে পারে, যা থেকে একটা ছেলে  মেয়েদেরকে আর অন্য দৃষ্টিতে দেখবার, ভাববার পরিস্থিতিটা পেত না। কিন্তু তাতে আমাদের সমাজের একদল মানুষের অনেক ক্ষতি হয়ে যেত। তারা পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে খেতে পারত না। বিনা পয়সার কাজের লোক বা যৌনতা নিবৃত্তির জন্য কোথাও কোন দাসীবাঁদী পেত না। তাই মেয়েদের শৈশব থেকেই আলাদা করে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়।

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন