কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ২৩    




আজ হলিউডের স্বর্ণালী যুগের প্রিয় অভিনেতাদের নিয়ে আলোচনা করব যারা আমাদের মাঝে আর নেই। অবশ্য এই লিস্ট আমার কাছে বেশ দীর্ঘ কারণ সেই  সময় অনেক অভিনেতাই ছিলেন যাঁদের অভিনয় আমার পছন্দের তালিকায়  একদম ওপরের দিকে। এবং তখন আরো একটা কারণ ছিল (যেটা একটু পরে  বলব) যার জন্য একজন নায়ক আরেকজনের কোন এক বিখ্যাত অভিনয় হয়ত স্বচ্ছন্দে করে দিতে পারতেন, কিন্তু চুক্তিবদ্ধতার জন্য তা করে উঠতে পারেননি। তো, যাইহোক, স্বর্ণালী যুগের প্রিয় অভিনেতাদের প্রথম নাম বাছতে গেলে তিনজন নায়কের নাম উঠে আসবে – হামফ্রে বোগার্ট, ক্লার্ক গ্যাবল ও জেমস্‌ স্টুয়ার্ট। এঁরা প্রত্যেকেই প্রায় সমসাময়িক দিকপাল অভিনেতা, প্রত্যেকের  ঝুলিতে প্রচুর হলিউড ক্লাসিক। ক্লার্ক গ্যাবলের ‘ইট হ্যাপেন্‌ড ওয়ান নাইট’ ও ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ নিয়ে এবং জেমস্‌ স্টুয়ার্টের ‘ইটস্‌ আ ওয়ান্ডারফুল লাইফ’  নিয়ে আমি আগেই আলোচনা করেছি। কিন্তু নিজের অভিনয় আর ক্যারিশমা দিয়ে প্রায় প্রতি ছবি হিট করানোর জন্য আমার প্রথম পছন্দ হামফ্রে বোগার্ট। দ্বিতীয় পছন্দ বেছে নিতে গেলেও বেশ কয়েকটা নাম আসবে – স্পেন্সার ট্রেসি, কেরি গ্রান্ট ও মার্লন ব্রান্ডো। এখান থেকেও বেছে নেওয়া কঠিন। কিন্তু কঠিন চোয়াল ও পাওয়ার-হাউজ অভিনয়ের জন্য আমি বাছব মার্লন ব্রান্ডো। তৃতীয় পছন্দ বাছতে গেলেও দুটো নাম আসবেই – লরেন্স অলিভিয়ার এবং গ্রেগরি পেক। কিন্তু এই স্থানের জন্য নায়কোচিত উপস্থিতি ও ভরাট গলার গ্রেগরি পেক আমার একমাত্র পছন্দ। ওপরে উল্লিখিত আটজন নায়ক ছাড়াও সিডনি পয়টিয়ার-কে এই লিস্টে রাখতে পারলে ভাল লাগত। তো, প্রথম তিন স্থানে ওপরের যাদের রাখতে পারলাম না তারা সবাই রইলেন স্পেশাল মেনশন লিস্টে। আর চলচ্চিত্রের নির্বাক জমানায় সিনেমাকে জনপ্রিয় করার জন্য স্ল্যাপস্টিক কমেডির প্রাণপুরুষ চার্লি চ্যাপলিন ও বাস্টার কিটোনকে প্রথমেই আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।

তবে বোগার্টকে দিয়ে শুরুর আগে কয়েকটা কথা। যেটার ইঙ্গিত একটু আগে দিলাম। হলিউডের খানিক ইতিহাস দিয়েই শুরু করতে হবে, নইলে খেই থাকবে না। ১৯১৮ সালে হলিউডে এক বড় প্রোডাকশন হাউজ শুরু হয় – ওয়ার্নার ব্রাদার্স। এর সমসাময়িক আরো দুটো স্টুডিয়ো একে একে চালু হয় – প্যারামাউন্ট পিকচার্স এবং ফক্স ফিল্ম। ১৯২৩ সালে ওয়াল্ট ডিজনি শুরু করলেন ডিজনি স্টুডিয়ো। ১৯২৪ সালে বিখ্যাত মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ার। এরা বেশিরভাগ সিনেমা বানাতে শুরু করে। এরপরে পরেই ১৯২৫ সালে স্বাধীনভাবে কাজ করতে থাকা কিছু প্রোডিউসার এবং এইসব বিখ্যাত প্রোডাকশন হাউজের ভেতর এক লড়াই শুরু হয়। এরপর হলিউডের স্বর্ণালী যুগে (মোটামুটি ১৯২৮ থেকে ১৯৪৯ অব্ধি যখন সবাক চলচিত্র পুরোদমে চলছে) গিয়ে এইসব প্রোডাকশন হাউজ ভেঙে বা জুড়ে দিয়ে আটখানা মুখ্য স্টুডিয়ো বা প্রোডাকশন হাউজ পড়ে থাকে যারা সিনেমা বাজারের ৯৫ শতাংশ নিজেদের অধিকারে নিয়ে নেয়, অর্থাৎ এরাই বেশিরভাগ হলিউড ছবি বানাতে শুরু করে। ছোটখাট প্রোডিউসাররা হারিয়ে যায়। সেই আটখানা স্টুডিয়ো হল – এম-জি-এম, প্যারামাউন্ট, ফক্স (যারা ১৯৩৫ সালে জুড়ে গিয়ে ‘20th সেঞ্চুরি ফক্স’ হয়ে  যায়), ওয়ার্নার ব্রাদার্স, আর-কে-ও, ইউনিভার্সাল, কলাম্বিয়া এবং ইউনাইটেড আর্টিস্টস। ১৯৩০-এর দশকের শুরুতে এই আটখানা স্টুডিয়ো একবছরে ৩৫৮টা ছবি প্রকাশ করেছিল। বোঝাতে পারলাম, এরা সিনেমার বাজার কীভাবে কুক্ষিগত করে রেখেছিল? এরা কী করত, কোন এক নায়ক বা নায়িকাকে বেশ  কিছু বছরের জন্য মোটা টাকার বিনিময়ে চুক্তিপত্রে সই করিয়ে রাখত, ফলে সেই সময় সেই নায়ক বা নায়িকা অন্য কোন স্টুডিয়োর সিনেমায় কাজ করার অনুমতি পেত না। সেই সময়ের জন্য সে হয়ে যেত ঐ স্টুডিয়োর বেতনভুক কর্মচারী। যেমন হামফ্রে বোগার্ট, শুরুতে কিছু বছর ফক্সের সঙ্গে থাকলেও তারপর উনি চুক্তি করেন ওয়ার্নার ব্রাদার্সের সঙ্গে, ফলে ১৯৪৯ অব্ধি উনি কিন্তু ওয়ার্নারের ডিস্ট্রিবিউশনে যুক্ত থাকা ছবিই শুধু করে গেছেন, অন্য কোন স্টুডিয়োর নয়। আবার ক্লার্ক গ্যাবল চুক্তিবদ্ধ ছিলেন মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ারের সঙ্গে। ওনার প্রায় সব ছবিই এই স্টুডিয়ো থেকে। অবশ্য ‘ইট হ্যাপেন্‌ড ওয়ান নাইট’-এর সময় এম-জি-এম ওনাকে কিছু মাসের জন্য কলাম্বিয়া পিকচার্সের  কাছে ধার দিয়েছিল। যদিও তার জন্য এম-জি-এম মোটা টাকা নিজের পকেটে পুরেও ছিল (সেটা একটা অন্য গল্প, এখানে বলার দরকার নেই)। এই চুক্তির কারণেই আমি এখনো মনে করি যে স্বর্ণযুগের বিভিন্ন সময় তৎকালীন নায়ক বা  নায়িকারা যে যে ছবিতে অভিনয় করেছেন, তা হয়ত আরেকজন অনায়াসেই করে দিতে পারতেন, বা আরেকটু ভালোও করতে পারতেন – শুধুমাত্র চুক্তির কারণেই সেই সময় করে উঠতে পারেননি। ফলে মাত্র কোন এক বিখ্যাত সিনেমার ওপর নির্ভর করে সেই সময়ের নায়ক-নায়িকাদের বিচার করা উচিৎ নয়।

হামফ্রে বোগার্ট (১৮৯৯-১৯৫৭) ছিলেন যেমন প্রতিভাধর, তেমনি বিশৃঙ্খল। প্রচন্ড সিগারেট ও মদ্যপান করতেন। ফলে উনি ক্যানসারে মারা যান মাত্র ৫৭ বছর বয়সে। নইলে আরো কিছু অনবদ্য ছবি দর্শকরা ওনার থেকে নিশ্চয় পেত। অবশ্য ওনার উল্লেখযোগ্য সিনেমার লিস্ট দেখার মত - হাই সিয়েরা (১৯৪১), মল্টিজ ফ্যালকন (১৯৪২), কাসাব্লাঙ্কা (১৯৪২), টু হ্যাভ অ্যান্ড হ্যাভ নট (১৯৪৪), দ্য বিগ স্লিপ (১৯৪৬), ট্রেজার অব সিয়েরা মাদ্রে (১৯৪৮), ইন আ লোনলি প্লেস (১৯৪৯), দ্য আফ্রিকান কুইন (১৯৫১), দ্য কেইন মিউটিনি (১৯৫৪), সাব্রিনা (১৯৫৪) ইত্যাদি। যদিও একটু আগেই বললাম যে মাত্র একটা ছবি দিয়ে কোন নায়ক-নায়িকার বিচার করা উচিৎ নয়, কিন্তু আপাতত স্থানাভাবের জন্য আমরা ওনার একটাই ছবি নিয়ে আলোচনা করব – দ্য আফ্রিকান কুইন।

এই ছবি আমি কতবার দেখেছি এখন মনে নেই। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হলে ল্যাপটপে এই ছবি চালিয়ে চা খেতে খেতে দেখতাম। আমার অন্যতম ফেভারিট ছবি। জন হাস্টনের সিনেমা, সুতরাং উত্তেজনা থাকবেই। এবং অ্যাডভেঞ্চারের পেছনে চার্লি ও রোজের (ক্যাথরিন হেপবার্ন) অব্যক্ত প্রেমের কাহিনী। রোজ ও  তার দাদা আফ্রিকার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে মিশনারি হিসেবে বাচ্চাদের লেখাপড়া  শেখান এবং প্রতি সপ্তায় তাদের জীবনধারনের প্রয়োজনীয় সরবরাহ করে এক মাঝি চার্লি, তার ‘আফ্রিকান কুইন’ নামক এক ছোট বোটে। ব্রিটিশ ও জার্মানির  যুদ্ধ আরম্ভ হলে চার্লি দু’ভাইবোনকে বলে সেই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু  তারা সেই পরামর্শ কানে তোলে না। ফলে জার্মান সেনার হাতে রোজের দাদা অত্যাচারিত হয় এবং কিছুদিন পরেই মারা যায়। তারপর চার্লি রোজকে তার সেই ছোট বোটে নিয়ে পালিয়ে যায় এবং প্রতিজ্ঞা করে তারা অত্যাচারী জার্মানদের শিক্ষা দেবে। মূলত সেখান থেকে এই অ্যাডভেঞ্চার ছবি শুরু হচ্ছে। এবং শেষ হচ্ছে মৃত্যুদন্ডের মুখে দাঁড়িয়েও যখন বোগার্ট ও হেপবার্ন বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। সিনেমাটা আপনাদের দেখা দরকার। বিশেষ করে চার্লি হিসেবে বোগার্টের ডাউন-টু-আর্থ মেক-আপ।       

মার্লন ব্রান্ডো (১৯২৪-২০০৪) যে কোন সমালোচকের পছন্দের তালিকায় একদম ওপরের দিকেই থাকবেন কারন স্তানিস্লাভস্কি-র ‘মেথড অ্যাক্টিং’-এর  একদম শুরুর দিকের উল্লেখযোগ্য অভিনেতা বললেই ব্রান্ডোর নাম আসতে বাধ্য। এই মেথড অ্যাক্টিং ব্যাপারটা সাধারণ অভিনয়ের থেকে খানিক আলাদা।  শিল্পের নিরিখে অভিনয়কে ‘আর্ট অব রিপ্রেজেন্টেশন’ হিসেবে দেখানো হয়, কিন্তু সেটাই মেথড অ্যাক্টিং ‘আর্ট অব এক্সপেরিয়েন্সিং’ হিসেবে তুলে ধরে। কোন এক  চরিত্রের অভিনয় ফুটিয়ে তোলার জন্য সচেতন-অবচেতন মনে সেই চরিত্রে ঢুকে যাওয়া, তাকে অনুভব করা, তার জন্য দরকার পড়লে সিনে কিছু অদলবদল ঘটানো, সেই হল মেথড অ্যাক্টিং। ব্রান্ডো সেই ঘরানার একদম প্রথম দিকের অভিনেতা। (আগের কয়েক পর্বে এখনকার যাদের অভিনয় নিয়ে লিখেছি, তাদের মধ্যে ডাস্টিন হফম্যান, রবার্ট ডি-নিরো, গ্যারি ওল্ডম্যান, কেট ব্ল্যাঞ্চেট এই মেথড অ্যাক্টিং-এর উল্লেখযোগ্য নাম। ভারতীয় অভিনেতা প্রয়াত ইরফান খানের অভিনয়ও মেথড অ্যাক্টিং।) ব্রান্ডোর মেথড অ্যাক্টিং ছড়িয়ে আছে অন্তত ৪০টা ছবিতে, যার মধ্যে আমার পছন্দ - এ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার (১৯৫১), ভিভা জাপাটা (১৯৫২), জুলিয়াস সিজার (১৯৫৩), অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট (১৯৫৪), সায়োনারা (১৯৫৭), মিউটিনি অন বাউন্টি (১৯৬২), আগলি আমেরিকান (১৯৬৩), দ্য গডফাদার (১৯৭২), লাস্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস (১৯৭২), অ্যাপোক্যালিপ্স নাউ (১৯৭৯), এ ড্রাই হোয়াইট সিজন (১৯৮৯) ইত্যাদি। যদিও শেষদিকের সব ছবিতেই উনি পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছেন। অলোচনার জন্য ওনার যে ছবি সমালোচকরা চোখ বুজে বেছে নেন, সেটার নাম ‘দ্য গডফাদার’। কারণ এই সিনেমায় ওনার দুর্দান্ত অভিনয় এবং সাহসের সঙ্গে  অস্কার পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়া, দুটোই ছিল। কিন্তু আমি আজ বাছব কাজানের ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’, যেটা না দেখলে বোঝা সম্ভব নয় গডফাদারের শেকড়  কোথায় লুকিয়ে। অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট আরো এক কারণে উল্লেখযোগ্য। এই ছবির থিম নিয়ে পরবর্তীকালে কত যে সিনেমা হয়েছে, সেটা গোনা যাবে না।  

টেরি মালয় একজন ফাইটার এবং বর্তমানে ডকে কাজ করে। জাহাজের ডকের  দুর্নীতিগ্রস্থ মালিক জনির বিভিন্ন অসাধু কাজ দেখে এবং এক নিরীহ কর্মীর খুন দেখে সে জনির বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। সাহসে ভর করে কোর্টে গিয়ে সাক্ষী দেয়। ফলে তাকেও চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়। কিন্তু এবার কর্মীরা সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠে, তারা টেরিকে না নিয়ে কাজে যাবে না ঠিক করে। টেরির নেতৃত্বে কাজ শুরু হয়। এই ছবির মুখ্য পাওনা কাজানের পরিচালনা, ব্রান্ডোর অভিনয় এবং তার যোগ্য সঙ্গতে নবাগতা নায়িকা ইভা মারি সেইন্ট। একটা সিন এখনো মনে পড়ে। ডান ভুরু কাটা মেক-আপে পুরো ডকভর্তী লোকের সামনে ব্রান্ডোর সেই চিৎকার ‘ডু ইউ হিয়ার দ্যাট? আয়াম গ্ল্যাড হোয়াট আই হ্যাভ ডান’। পাওয়ারহাউজ। ওনাকে ছাড়া গডফাদার মানায় না।  

হলিউডের উত্তমকুমার যদি কাউকে বলতে হয়, তাহলে সেটা একমাত্র গ্রেগরি পেক (১৯১৬-২০০৩)। যেন নায়ক হবার জন্যই জন্মেছিলেন। ওনার নায়ক সত্ত্বা মাঝে মাঝেই ওনার অভিনেতা সত্বাকে ঢেকে দিয়েছে। মনে রাখার মত অনেক  সিনেমা আছে, কিন্তু তার ভেতরেও আমার বাছাই হল - দ্য কিইজ অব দ্য কিংডম (১৯৪৪), স্পেলবাউন্ড (১৯৪৫), দ্য ইয়ারলিং (১৯৪৬), ক্যাপ্টেন হোরেশিও হর্নব্লোয়ার (১৯৫১), ডেভিড অ্যান্ড বাথশিবা (১৯৫১), দ্য স্নোজ অব কিলিমানজারো (১৯৫২), রোমান হলিডে (১৯৫৩), মোবি ডিক (১৯৫৬), গানস অব নাভারোন (১৯৬১), কেপ ফিয়ার (১৯৬২) এবং টু কিল এ মকিংবার্ড (১৯৬২)। আজ এই শেষ ছবি নিয়েই আলোচনা করব।

অ্যাটিকাস ফিঞ্চ নামক এক উকিল, আলাবামার এক বিপত্নীক দু’সন্তানের বাবা, কোর্টে ডিফেন্ড করছেন এক কালো মানুষকে যার বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে  ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়েছে। এবং বাড়িতে তিনি সন্তানদের শেখাচ্ছেন কুসংস্কার থেকে দূরে থাকার জন্য। এই নিয়েই ‘টু কিল এ মকিংবার্ড’। কোর্টে উত্তমকুমারের জাজ হিসেবে ও উকিল হিসেবে ছবিগুলো যে যে পাঠকের পছন্দের তালিকায় একদম ওপরে, তাদের কাছে অনুরোধ এই সিনেমা দেখুন। মনোযোগ দিয়ে দেখুন একদম শেষদিকে কোর্টে পেকের সাড়ে ছ’মিনিটের একটানা সংলাপ (ক্লোজিং আরগুমেন্ট) যা মাত্র একটাই টেকে নেওয়া হয়েছিল, এবং মূলত যে অভিনয়ের জন্য পেক অস্কার পেয়েছিলেন। 

হলিউডের প্রাক-স্বর্ণযুগ প্রসঙ্গে একজনের কথা না বলে পারছি না। বাস্টার কিটোন (১৮৯৫-১৯৬৬)। স্ল্যাপস্টিক কমেডির প্রাণপুরুষ। আরেক প্রাণপুরুষ চার্লি চ্যাপলিনের কথা আমরা সবাই জানি। এমনকি ওনার ‘মডার্ন টাইমস’  আমি এক হলিউড ক্লাসিক হিসেবে এর আগে আলোচনাও করেছি। কিন্তু কিটোনের নিঃশব্দ ছবি নিয়ে কখনো কিছুই লিখিনি। বিশেষ করে কিটোনের ওয়ান উইক (১৯২০), কপ্‌স (১৯২২), শার্লক জুনিয়র (১৯২৪), দ্য জেনেরাল (১৯২৬) এবং দ্য ক্যামেরাম্যান (১৯২৮) অনবদ্য বললেও কম বলা হয়। এর ভেতর আমার ফেভারিট ‘দ্য জেনেরাল’ কারণএই সিনেমায় আমেরিকার গৃহযুদ্ধ  অদ্ভুতভাবে কমেডির মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আমার মতে এই সিনেমাও পৃথিবীর প্রথম ২০-২৫ ক্লাসিক লিস্টে থাকা উচিৎ। 

এইসব অভিনেতাদের পাশাপাশি গোটা পৃথিবীর স্বর্ণালী যুগের চারজন অভিনেতাকে বেছে নেব যাঁরা আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। সেই হিসেবে  প্রথমেই এই তালিকায় আসবেন ফেলিনির পছন্দসই ইতালিয়ান অভিনেতা মার্সেলো মাস্ত্রৈয়ানি, তারপর বার্গম্যানের প্রিয় সুইডিশ অভিনেতা ম্যাক্স ভন সিডো, সদ্যপ্রয়াত ফ্রেঞ্চ অভিনেতা জাঁ লুই তান্তিনিও, এবং এশিয়া থেকেও একজন আসবেন এই লিস্টে – কুরোশাওয়ার বেশিরভাগ ছবির জাপানি চরিত্রাভিনেতা তোশিরো মিফুনে।

মার্সেলো মাস্ত্রৈয়ানি (১৯২৪-১৯৯৬) বললেই ইতালির এমন এক অভিনেতাকে বোঝায় যিনি প্রায় ছ’দশক ধরে প্রায় ১৫০টি ছবিতে অভিনয়ের ছাপ রেখেছেন।  ওনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা অন্য এক কারণেও বটে – বিভিন্ন দেশের অভিনেতারা  খ্যাতি পাবার পরেই হলিউডের ডাকে সেখানে পাড়ি দিতেন, কিন্তু উনি কোনদিন সেটা করেননি। ইতালির অভিনেতা হিসেবেই থেকে গেছেন। মাস্ত্রৈয়ানি বললেই যে যে সিনেমা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তা হল - লা ডোলচে ভিটা (১৯৬০), ডাইভোর্স ইতালিয়ান স্টাইল (১৯৬১), লা নোটি (১৯৬১), দ্য অ্যাসাসিন (১৯৬১), এইট-অ্যান্ড-হাফ (১৯৬৩), ইয়েস্টারডে টুডে অ্যান্ড টুমরো (১৯৬৩), ম্যারেজ ইতালিয়ান স্টাইল (১৯৬৪), সানফ্লাওয়ার (১৯৭০), দ্য বিগ ফিস্ট (১৯৭৩), এ স্পেশাল ডে (১৯৭৭) ইত্যাদি। খুব প্রাণচঞ্চল অভিনেতা ছিলেন। সোফিয়া লোরেনের সঙ্গে আটখানা ছবিতে অভিনয় করে হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছিলেন। ওনার ‘লা ডোলচে ভিটা নিয়ে এই ধারাবাহিকের ১৩ নম্বর পর্বে আলোচনা করেছিলাম, সুতরাং আজ আর ওনার অন্য কোন ছবি নিয়ে লিখব না।

ম্যাক্স ভন সিডো (১৯২৯-২০২০) বললে আমার চোখে প্রথমেই দুটো ছবি ভাসে – বার্গম্যানের সুইডিশ ছবি ‘সেভেন্থ সিল’ আর উইলিয়ম ফ্রিডকিনের হলিউড ছবি ‘দ্য এক্সরসিস্ট’। সেভেন্থ সিলের সাহসী নাইট যে মৃত্যুর সাথে দাবা খেলছে  আর এক্সরসিস্টের সেই ধর্মযাজক যে অশুভ আত্মা তাড়াতে এসেছে। এক্সরসিস্ট আমার জন্মেরও আগের ছবি, কিন্তু তার ভয়াবহতা যেন প্রতি প্রজন্মকেই ভীত করে তোলে। আমি এই ছবি প্রথম দেখেছিলাম স্কুলজীবনে। সত্যি বলছি, একমাসের ঘুম নষ্ট হয়ে গেছিল। যাইহোক, যে যে সিনেমায় সিডো মনে রাখার মত কাজ করেছেন, সেগুলো - দ্য সেভেন্থ সিল (১৯৫৭), ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ (১৯৫৭), দ্য ভার্জিন স্প্রিং (১৯৬০), থ্রু এ গ্লাস ডার্কলি (১৯৬১), উইন্টার লাইট (১৯৬৩), শেম (১৯৬৮), দ্য প্যাশন অব আনা (১৯৬৯), দ্য এক্সরসিস্ট (১৯৭৩), পেলে দ্য কনকারর (১৯৮৭) ও এক্সট্রিমলি লাউড অ্যান্ড ইনক্রেডিবলি ক্লোজ (২০১১)। এখান থেকে যে কোন একটা ছবি নিয়ে লেখা যায় কারন সবকটা ছবিই বেশ ভাল। কিন্তু কিছুদিন পরেই আমি প্রিয় পরিচালকদের নিয়ে আলোচনা করব, যেখানে বার্গম্যান থাকবেন। তখন এর ভেতর একটা ছবি বেছে নেব।

যিনি প্রায় পাঁচ দশকের বেশি সময় ফ্রান্সের ছবিতে অভিনয় করেছেন, ফ্রান্সের নব্য-বাস্তব ঢেউ বললে যার অভিনয় প্রথমেই ভেসে আসে, তিনি জাঁ লুই তান্তিনিও (১৯৩০-২০২২)। ওনার সেরা ছবিগুলো আমায় বাছতে বললে -  অ্যান্ড গড ক্রিয়েটেড ওম্যান (১৯৫৬), দ্য ইজি লাইফ (১৯৬২), এ ম্যান অ্যান্ড এ ওম্যান (১৯৬৬), দ্য গ্রেট সাইলেন্স (১৯৬৮), দ্য ম্যান হু লাইজ (১৯৬৮), মাই নাইট অ্যাট মডস্‌ (১৯৬৯), Z (১৯৬৯), দ্য কনফরমিস্ট (১৯৭০), দ্য লাস্ট ট্রেন (১৯৭৩), থ্রি কালারসঃ রেড (১৯৯৪), দ্য সিটি অব লস্ট চিল্ড্রেন (১৯৯৫) এবং অ্যামোর (২০১২)। দ্য কনফরমিস্ট নিয়ে আমি আগেই আলোচনা করেছি। কিন্তু আরেকটা সিনেমা নিয়ে সামান্য একটু আলোচনা না করলে তান্তিনিওর কেরিয়ারের সেই মাইলস্টোন ছবি বাদ পড়ে যাবে - এ ম্যান অ্যান্ড এ ওম্যান। ক্লদ লুলুশের ১০২ মিনিটের রোমান্টিক ছবি। এক বিপত্নীক ও এক বিধবা, দুজনে তাদের বাচ্চাদের স্কুলে একে অপরকে দেখে ও প্রেমে পড়ে। কিন্তু প্রেম এগিয়ে চলার সাথে তাদের বিবাহিত জীবনের স্মৃতি তাদের প্রেমের পথে এসে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অনবদ্য রং ও ক্যামেরার কাজ। কিন্তু এই ছবির আসল বাঁধুনি এর অভিনয়ে, যেটা খুব নিপুণভাবে নায়ক-নায়িকা ফুটিয়ে তুলেছেন। এই সিনেমার পরেই তান্তিনিওর নাম আন্তর্জাতিক মহলে ছড়িয়ে পড়ে।  

মাস্ত্রৈয়ানির জাপানি সংস্করণ বললে এককথায় তোশিরো মিফুনে-র (১৯২০-১৯৯৭) নাম উঠে আসবে। সারা জীবনে ১৫০-র বেশি সিনেমায় অভিনয়, কুরোসাওয়ার সঙ্গে ১৬টা ছবি এবং জীবনের বেশির ভাগ সময় জাপান ছেড়ে হলিউডে পা না বাড়ানো। অবশ্য, ৬০ বছর বয়সে উনি আমেরিকায় গিয়ে ‘শোগান’ নামক এক সিরিয়ালে অভিনয় করেছিলেন। মিফুনে প্রধান যে যে  ছবিতে অভিনয়ের স্বাক্ষর রেখে গেছেন - ড্রাঙ্কেন অ্যাঞ্জেল (১৯৪৮), রসোমন (১৯৫০), সেভেন সামুরাই (১৯৫৪), সামুরাই ট্রিলজি (১৯৫৪-৫৫-৫৬), থ্রোন অব ব্লাড (১৯৫৬), দ্য হিডন ফোর্ট্রেস (১৯৫৮), য়োজিম্বো (১৯৬১), হাই অ্যান্ড লো (১৯৬৩), রেড বিয়ার্ড (১৯৬৫), রেবেলিয়ন (১৯৬৭) ইত্যাদি। এর বেশিরভাগ ছবিতেই অবশ্য মিফুনে যোদ্ধার চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন যেটা তার স্বাভাবিক দক্ষতা ছিল। কুরোসাওয়া ছাড়াও উনি হিরোশি ইনাগাকির প্রচুর সিনেমায় অভিনয় করেছেন। যদিও প্রায় সব সমালোচক ওনার রসোমন বা সেভেন সামুরাই নিয়েই আলোচনা করেন, আমার বাছাই কিন্তু ‘য়োজিম্বো’।  বুদ্ধিদীপ্ত থিম, কোন এক গ্রামে সাঞ্জুরো নামক এক সামুরাই (যোদ্ধা) এসে দেখেন সেখানে দুই ক্ষমতালোভী গ্যাং-এর ভেতর লড়াই। আর সেই লড়াইয়ে সাধারণের প্রাণ ওষ্ঠাগত। উনি ঠিক করেন এই দুই গ্যাং-কে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেবেন যাতে ওরা নিজেরা লড়াই করে শেষ হয়ে যায় আর সাধারণ মানুষ শান্তিতে থাকতে পারে। এখানে লড়াই ঝগড়ার খারাপ দিক ও ক্ষতিকর দিকগুলো কুরোসাওয়া নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যাতে সাধারণের মনে হিংসার ভয়াবহতা ভেসে ওঠে। মিফুনের অভিনয় অনবদ্য। সেই কর্কশ গলা, যা যোদ্ধা হিসেবে ওনাকে আরো গ্রহ্ণযোগ্য করে তোলে। এবং মিফুনের নিয়মানুবর্তিতা – রোজ সকাল ছ’টায় মেক-আপ সমেত সিনেমার সেটে পৌঁছে যাওয়া।    

তাহলে এই অব্ধি। সবাই পুজোর উৎসবের দিনগুলো আনন্দে কাটান। পুজোর পর আমরা আবার আলোচনার টেবিলে ফিরব স্বর্ণযুগের অস্তমিত নায়িকাদের অভিনয় নিয়ে। 

 

 

 


3 কমেন্টস্:

  1. খুব আগ্ৰহ নিয়ে পড়লাম। সম্প্রতি মৃত গোদার নিয়ে একবার আলোচনা করবেন? আর এই লেখাটা কি আমি ওয়ালে শেয়ার করতে পারি?

    উত্তরমুছুন
  2. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন