কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

ময়ূরী মিত্র

 

সমকালীন ছোটগল্প


এক মুঠো

 

মানুষের মুঠোয় মুঠোয় ভালোবাসার গল্প। তা গেঁথে আমার এ কাহিনী। উত্তমপুরুষ বা তৃতীয়পুরুষের উত্তম-মধ্যম গল্প। গুরুচণ্ড-দোষ তার জবানীতে, দায়ও তার।

 

(১)

 

দোকা হবার সাধ জাগে না জোছনায়। সেই ছেলেবেলা থেকেই। আকাশে যখন বিপুল বিশাল চাঁদ - মনে হয় একলাটি হয়ে যাই। একা একাই চাঁদ মাখি   সর্বাঙ্গে। মনের সবখানটিতে তখন ম ম করতে লাগে চাঁদ।

সেবার গিয়েছি সুন্দরবনে। সারাদিনের পাখি দেখা শেষ হয়েছে। বিকেল শেষে পাখি ঢুকেছে পাতার বাসায়। আমি পাখিরালয় নামক স্থানে। রাতের আকাশে চাঁদ জেগেছে। সেই চাঁদভাসায় চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুরছেন সে যাত্রার বাকি মানুষ - আমার সঙ্গীসাথী। পাখি, বাঘ, বাঁদর, কুমির - কত না আলোচনার বিষয় তাঁদের। বকেই চলেছেন - আগামীকাল ঠিক কোনটি আগে দেখবেন তাঁরা? বাঘ না কুমির? কত কথা! কত শব্দ! বাক্যছটায় বিমূঢ় নৈঃশব্দ্য!

আর আমি তাঁদের সাথে এক হতে না পেরে একা হয়ে যাচ্ছি। কেউ বলেনি আমায় - ভাই ময়ূর সুন্দরী, এ রাতে তোমার সাথে আলাপ করব না আমরা!  কেউ বলেনি। তবু সেই রাত আমায় একা করল। একটা মানুষের পক্ষে যতখানি একা হওয়া সম্ভব, হয়তো তার থেকেও বেশি।

কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে পথচলতি এক মাঝির পিছু ধরলাম আমি। মাঝি নিজেও জানেন না - পিছনে চুপচাপ এক উন্মাদিনী। মাঝি গিয়ে নৌকায় উঠলেন। আমিও। নৌকা ছাড়ল। ভাসলাম। থামলাম মাঝনদীতে। বাঘ থেকে বাঁচবার জন্য রাতভর নাকি নৌকা থাকবে নদীর মাঝে।

নৌকার ওপরের তলায় নাক অব্দি ঘোমটা টেনে আমি - চুপটি করে বসে। ভাবিনি সঙ্গীরা আমায় না দেখে এত দিশেহারা হবেন। খানিক পরে মাঝিই বা আমায় দেখলে কী ভাববে। কিচ্ছু ভাবিনি এসব। বাতাসে ভাসছে মাঝিদের দিন গুজরানের গল্প - তাতেও সেদিন কী তীব্র অনীহা আমার! সচরাচর মানুষে এই বীতরাগ আসে না আমার। সেদিন কিন্তু শরীর মন ভর্তি নিরাসক্তিতে। মনে হচ্ছিল, ডেকের ওপর চাঁদের চৌখুপ্পি কাটা আলো ছায়ার সব কটা ঘর ঘুরে ঘুরে মরি। মরি আর নিজেকে খুব আদর করি। অনেকক্ষণ ধরে, অনেকখানি যত্ন নিয়ে। কেবলই নিজেকে। চাঁদ তীব্র হচ্ছিল। উগ্র হচ্ছিল আত্মমুগ্ধ হওয়ার বাসনা।

শেষমেশ নৌকা থেকে নামতেই হল। ফিরতেই তো হয় ভূমিতে! যদিও ভূমির মানুষদের আপন ভাবতে অনেক সময় নিয়েছিলাম সেদিন। এতক্ষণ ধরে কী মায়ায় আমায় খুঁজছিলেন আত্মীয়জন! অথচ উদ্বিগ্ন মানুষগুলোকে দেখে কেমন এক বিরাগ ছেয়েছিল। তাঁদের আমায় নিয়ে ভাবা এতটুকুও মন গলায়নি। এতটাই স্বার্থপর করেছিল আমায়, আমার চাঁদ।

সব মিছে। মিছে রে সব! সত্য কেবল ছেড়ে আসা আলোর গোপন উল্লাস। চাঁদের আলো - সে তো দেখি মস্ত আলোকখণ্ড। ভূগোল বইয়ে আছে, তাও নাকি ধার করা! মিছে আলোর এত জোর!

 

(২)

 

ডোম মানুষ। মানুষ ডোম। তারা মরা মানুষ পোড়ায়। প্রকাশ্যে সকলকে সামনে রেখে তারা নির্বাহ করে তাদের জীবিকা। আবার অচেনা মৃতের আত্মীয়ের কান্নায় কখনো কখনো ব্যথিতও হতে দেখেছি তাদের।

অকালে চলে গিয়েছিলেন আমার সেজমামা। খুব বৃষ্টি সেদিন। শ্মশানে মৃতদেহের লাইন লেগে গিয়েছিল। সবার তো চুল্লিতে জ্বলবার সামর্থ থাকে না!  ফলে বৃষ্টিতে কাঠকুটোয় ঝলসাতে সময় নিচ্ছিল শরীরগুলো। আমায় জড়িয়ে পাথর হয়ে বসেছিল আমার আটবছরের ভাই। আমার প্রিয় সেজমামার প্রিয় ছেলে। ছোট থেকেই কেমন এক মুখচোরা - কথা কান্না সবই কম তার।

বর্ষাসাঁঝে পিতাহারা ছেলেটাকে নিঝুম দেখে এক চণ্ডাল-পিতা তার পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিল, ওঠ খোকা। বাবা চলে যাচ্ছে - একটু কাঁদ! তারপর আমার সাথে চল। ভয় কী? একপাশে তোর দিদি আর একপাশে আমি। বাবার মুখে আগুন দিবি। তারপর নাভি গঙ্গাজলী করবি। বাবা কত শান্তি পাবে তোর!

হ্যাঁ, এই কথাগুলোই বলেছিল শ্মশানের সেই ডোম। আত্মার শান্তি বিশ্বাস করিনি। মনে রেখেছি মরা পোড়ানো এক মানুষের মায়াটুকু। আপ্তবাক্যের মত আপ্তমায়া।

দুঃখ উগড়ে দিতে আকাশ দেখি ছোটকাল থেকে। সেদিনও ব্যতিরেক হয়নি। জলে নাভি ফেলতে গিয়ে মেঘের আকাশে দেখেছিলাম দু’একটি শকুন। উড়ছিল কাছ দিয়েই। ভাই ভয় পেল। নিষ্ঠাবান শ্মশানপিতা, সেই কর্মীপুরুষ তখনো সঙ্গে। হয়ত তখনো ভাইটা আমার কাঁদেনি বলে শিশুকে ছেড়ে যেতে বিলম্ব হচ্ছিল তার। হয়ত শিশুর পিতৃশোকের পরিচিত প্রকাশ না দেখে শঙ্কায় ভুগছিল শুধু প্যান্ট পরা নোংরা হাত পায়ের এক বাবা। শকুন দেখে ভাইকে কাঁপতে দেখে এবার নিশ্চিন্ত শ্মশানপিতা। বলল, ওরা ওড়ে রে। নামবে না দেখিস! চট করে কি ঠোকরাবে তোর বাবার নাভিতে? মানুষের অঙ্গ না?

মানবশরীর। সে শরীরের ঔরসজাত সন্তান। আবার শরীরের সৎকার কর্মী - তার পুত্র - পুত্রের পুত্র। আর অনেক অনেক মরা খাওয়া পক্ষী। দেখ রে কালী - ক্ষুধার সুতোয় সব কটাকে গেঁথেছি রাঙ্গাজবার মালা করে। মালাটা কেমন fantastic হয়েছে বল! Count করে নে সবকটা ফুল! দ্যাখ তো, কোনটায় নড়ছে এখনো প্রাণ? কান পাত, মন দে নড়াচড়ার শব্দে! ফুটন্ত রসে রসগোল্লার মত ফোটে ছানাদেহ। ফটফট।

এবার বল, কোনটাকে বাঁচাই?

Exactly কোনটাকে?

 

(৩)

 

ঝড় আসছে। ঝাক্কাস ঝড়। সল্টলেকে আমার মায়ের বাড়ির ছাদে বনবন ঘুরছি। এত বড় ছাদ আমি বলি, এ আমার দিগ্বিদিক প্রান্তর। এ ছাদে হাঁটলে মনটি খুলে যায়। কল্পনার হাত পা গজায়।

ছেলেবেলায় পরীক্ষায় যে উত্তর কিছুতে মুখস্থ হত না - ছাদে একবার  ঘুরপাক খেলে  সে উত্তর যেত মাথায় গেঁথে। মাঝে অনেক ক’টা দিন আমার আসা হয়নি এ ছাদে। এখন দেখছি, গোটা ছাদ জুড়ে বনসাইয়ের হুটোপাটি লাগিয়ে দিয়েছে মালি। কিছুতে বুঝিয়ে পারি না - যে জীব বাড়তে পারে না তাকে এত যত্নে জন্ম দেয়ার কী দরকার? বাটকুল গাছগুলো আমাদের বাড়বাড়ন্ত দেখে কেবলি লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলবে আর তাদের খাটো চেহারাগুলো আমাদের ঘরে দুয়োরে বেশি বাহারী ঠেকবে, এইসব লোভাতুরপনায় কেমন ঘিন জাগে!

আজো দেখো, আমার ছাদটিকে সাজিয়ে গুছিয়ে অসহায় রয়ে গেছে আধাবাড়ন্ত গাছগুলো! ঝড়ে ভালো করে গা দোলাতেও পারে না বেচারীরা! বৃষ্টিতে শরীর ভেজানোর সুখ পায় না। শরীর তো কড়েআঙুল - তো ভেজাবে কী!

আজও দেখুন বৃষ্টি আসছে, তবু যেন হুঁশ নেই বনসাইগুলোর! ভাবখানা এমন, আকাশ ভিজলেই বা কী আর কাঠশুকনো থাকলেই বা কী! আমরা আকাশ তো ছুঁতে পারব না কখনো! ঘাড় উঁচিয়ে দেখতেও পাব না! আকাশের হরেক মর্জিতে আমাদের কী বা আসে যায়!

নাহ! প্রকৃতির পরিবর্তনে বনসাইগুলোর এই ভালমানুষের মতো থ মেরে থাকা আর তো সহ্য হয় না! আয় ভাই বারিষ! জম্পেশ করে লাফঝাঁপ দে তো! দ্রুত খর্ব কর ক্ষুদ্র জীবকে নিয়ে মানুষের ফালতু আহল্লাদ। বড় হয়ে থাকার আত্মপ্রসাদ।

ও আকাশ! তোর যাবতীয় জল দিয়ে সাপটে ধর বনসাইগুলোকে। শৈশব ঝেড়ে পূর্ণ গাছ হোক তারা। ব্যাপক ব্যপ্ত সব গাছ। তাদের কাম বাসনায় আরো কত ডবকা গাছ! আহা হা! কী ঝাঁঝালো যৌবন তাদের!

ও মাগো! বাদামের খোসার মতো উড়ছে মাটির ধূলো। মাটি আজ পুণ্যের ভূমি হবে।

 

(৪)

 

দুপুরবেলা। প্রকাণ্ড জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম। এ বাড়ির জানলাগুলো এত  বড় আর সংখ্যায় এত বেশি, ভ্রম হয়, ঘরেই গড়াগড়ি খাচ্ছে বৃষ্টি, চাঁদ, সূর্য।  মন শরীরে একবার ঢোকার অপেক্ষা শুধু।  মনে হতে লাগে, এই রে এবার আকাশটা ঘরে ঢুকতে থাকবে আর ঢুকেই সাপটাবে আমার মস্তানী  শরীর। আকাশের বন্যায় বয়ে চলব আমি।

আজ কেন যেন আকাশের এই খামচাখামচি সহ্য হচ্ছিল না। জানালাগুলোকে এমন করে অগ্রাহ্য করে ঘরে ঢোকার দরকার কী তোর?

ক্ষ্যাপা কুত্তার মত চেঁচালাম, "নাহ! বড় যে হয়েই চলেছিস তুই! এত বাড় কবে বাড়লো রে তোর আকাশ! বড় হতে হতে শেষমেশ হাতের বাইরেই চলে যাবি নাকি রে অখাদ্য প্রিয়তম? আমা হতে দূরস্থিত! তবে রে! বাঁচতে দেব ভেবেছিস তোকে?"

দৌড়ে গেলাম দোতলার সিঁড়িতে। মুখ গুঁজে থাকা একখণ্ড কাঁচের জানালায়।  কাঁচ কবেই খুলে গ্যাছে। ফাঁকা ফুটোয়  মুখখানা সেট করলাম। বাইরের দুটুকরো পাতা ডালপালা আঘাত হানল প্যাঁচা মুখে। তবুও দেখতে লাগল প্যাঁচানি। দেখতে লাগল কাঁচের খুপরিতে টুকরো হওয়া আকাশকে।

ধরতে লাগলাম করতলে ঝরা বৃষ্টিকে। দেখতে দেখতেই গা পিঠ ভারী হল। চোখ ফোখ সব ভরে এল একেবারে। মন খুলল ঝপাং। আকাশ এবার তার বশের ছোকরা। এবার প্যাঁচানী জাপটে ধরবে তাকে।

বড় সুখ! বড় সুখ! কী সুখ! কী সুখ! এতক্ষণে সে পেয়েছে তার পছন্দের পুরুষ।    আধাখোলা সুঠাম শরীর! প্যাঁচানীর নাকের ডগায় বড়  ঘাম! তর সইছে না! ওহ আজি হারাল রুমালটা? কোথায় হারাল আজ!

 

(৫)

 

ভোর হয়নি তখনো। কী মনে হল খেলাটা খেললাম। মনে আছে তারপরই  লিখেছিলাম এ লেখা --

আমি সেদিন সল্টলেকে মায়ের কাছে। ফ্রেশ হচ্ছে নিশুতি। ফরসা হচ্ছে ভোর। শোবার ঘরের জানলা দিয়ে গাছভরা বাগান দেখছিলাম আমি। মায়ের এই বাগানে বড়ো বাড় বেড়েছে গাছগুলোর। যুবক ও চারালতা দুরকমই আছে। দূর থেকে মনে হয় অনেকগুলো সবুজশাড়ি প্যান্ট পরা বর বউ নাক ঘষাঘষি করছে। একে অপরকে খুবলে খাচ্ছে প্রবল বাসনায়। বুড়ো গাছ যুবতীকে যদি বলে --আয় তোকে ডাকি নীলি তো নীলি রসভরে চোখ পাকায় -- চ মরি। হাওয়া যত খেলে গাছে গাছে আসক্তি তত বাড়ে। কখনো কখনো গাছে মানুষেও।

এইসব দেখতে দেখতে যখন শরীর ভর্তি করে ডবকা উল্লাস জাগছে তখনই খেয়াল করলাম, বাগানের এককোণে রাখা টাটকা সবুজ পাতা। খসে পড়া ঝকঝকে পাতাগুলো বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে এদিক সেদিক। কখনো বা উল্টোবাতাসে ফের ঢিবি হচ্ছে এককোণে। অল্প আলোয় সবুজ রঙ বোঝা যাচ্ছে না। আবার সেগুলো যে সবুজ নয় এমনটাও ভাবা যাচ্ছে না।

মায়া হল। নিঝুম ভোরে ডালখসা পাতায় আকুল এক প্রেম জন্মাল ময়ূরাবতীর।  সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে মাটি থেবড়ে সে বসে গেল পাতার সামনে। একটি একটি করে পাতা হাতের তেলোয় নিয়ে দেখতে লাগলো ময়ূরা। প্রত্যেকটির আলাদা আকার। প্রতি সবুজের আলাদা আভা। একই সবুজের আলাদা সুবাস শুঁকে শুঁকে জীবন বুঝতে লাগল হতচ্ছাড়ি।

আর তারপর শুরু হল ময়ূরার অদ্ভুত সে খেলা। এক একটি পাতার কোনো একটা দিককে সামান্য মুড়ে কিংবা পাতার কোনো একটি ফাঁকে পরপর ছোট দুটো ফুটো করে, ফুটিয়ে তুলতে লাগল মানুষের চোখ। কখনো বা রাগে ফুলে ওঠা নাকের পাটা। কখনো আবার গোলপানা পাতার নিচে গোটা দশেক ফুটো করে বানাল হাসিমুখো বুড়িবুড়ো।

মরণাপন্ন আধশুকনো পাতায়ও জ্যান্ত হল মানুষ। ভারী তৃপ্তি আজ তার। এত সপ্রাণ করে ফেলছে সে সাধারণ কিছু পাতাকে! হঠাৎ কোথা থেকে গাছের ওপরে এসে বসল শুঁটকো ফিঙে। না খেয়ে খেয়ে এত হাড় জিরজিরে হয়ে গ্যাছে পাখিটা যে বিশাল লেজটাকে মনে হচ্ছিল একটা লিকপিকে কালো সাপ। পাখিটাকে এত বিষাক্তভাবে দেখার কোনো কারণ ছিল না ময়ূরার। তবু দেখল সে! ভেবে বসল   পাখি বুঝি ফাজলামি করছে তার গাছহারা মরা পাতায় জ্যান্ত মুখ ফোটানো দেখে।

বিড়বিড় করে অনেক গাল পাড়ল ময়ূরা, এই শালা মরা লোম বের-করা তেজপাতা পাখি! তুই কী বুঝবি পুষ্ট যৌবনের মহিমা! আমার কাজ যদি এতই অকাজ লাগে তোর, তো তা দেখায় এত ঝোঁকই বা কিসের? পায়ের কাছে ঘুরঘুর করছিস তো করছিসই!

ওমা! কী মিষ্টি একটা শ্বাস ছেড়ে একেবারে মগডালে চড়ে বসল তেজপাতা! আর তারপর আকাশে। তখন আরো আলো এসেছে আকাশে। সে আলোয় প্রাণভরে উড়ছে   লোমওঠা পাখিটা। উঠছে। সে আরো উঠছে। দাঁত মেজে চান করে শিশু যেমন রেডি হয় বড় হবার জন্য, মাঝ আকাশে অমনটাই তো লাগছে পাখিটাকে এখন! হাতের সবুজ পাতার রাশ মাটিতে পেতে দেয় ময়ূরা। সে পাতায় বেঁকেচুরে মৃত মানুষ। ফাটা ফাটা চোখ দাঁত। মাটিতে মুখ থুবড়ে মরা পাতা!

গাছের পাতায় চোখ রাখি

ছেঁড়া পাতা বলে --

পাখি তুই আরো তেজ ডল ডানায়।

নীলি বলে -- মরণ!

রঙ্গ দেখ বুড়িপাতার!

 

(৬)

 

মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশের সংযোগস্থলে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্রাম। তাহার একধারে জঙ্গল। অন্যধারেও পর্যাপ্ত গাছগাছালি এবং একটি বহমান দীঘি। আকারে দীর্ঘ বলিয়া মাঝে মাঝে দীঘিটিকে নদী বলিয়া ভ্রম হয়। হেথায় যুবক যুবতীরা সরল ও কঠিন। দারিদ্র্য তাহাদিগকে এই বিপরীতধর্মী গুণ দিয়াছে। তেমনই এক যুবক রাম। রাম জঙ্গলে পথপ্রদর্শকের কর্ম করে। মহারাষ্ট্রে যেদিন পা দিই সেইদিন হইতেই পিতৃমাতৃহীন এই যুবক অহরহ আমাকে আকর্ষণ করিয়া চলিয়াছে। নিজের শ্রমে কাহারও কাছে একটি কপর্দক ধার না করিয়া রাম একটি গৃহ গড়িয়াছে। গৃহমাঝে রামের বধূ ও কন্যা খুশিয়ালী। রাম কহে -- খুশিয়ালী তাহার জীবনে চিরখুশি অনিয়াছে। এক্ষণে পাঠকদিগকে কহি -- শ্রী রামচন্দ্রের নিষ্ঠ ভক্ত হইয়াও কিন্তু আমার রাম নিজহস্তে পিঁয়াজ কষিয়া মাংস রন্ধন করে। খুশিয়ালীকে খাওয়ায়। এ বিষয়ে রামের যুক্তি -- জীবের ধর্ম বড় হওয়া আর পিতার ধর্ম শিশুর বাড়বৃদ্ধিতে সহায়তা করা। যে কোনো তুচ্ছ প্রসঙ্গে রাম বিশবার ধর্ম আর রাম শব্দের উচ্চারণ করিবেই। বাস্তবিক ধর্ম ধর্ম করিয়া সে আমার কেশরাশির উকুনগুলিকে পর্যন্ত খেপাইয়া তুলিয়াছে। আরো বলি -- প্রত্যহ গ্রামের বহু পুরাতন হনুমান মন্দিরে পূজা দিয়া জঙ্গলের পথ ধরে ও ভ্রমণার্থীদিগকে হরিণ ময়ূর ইত্যাদি দেখায়। এ বিষয়ে হাজার বক্রোক্তি করিয়াও  রামকে বিন্দুমাত্র লজ্জিত করিতে পারি নাই। শেষমেষ ক্লান্ত হইয়া তাহার পিতৃদত্ত নাম বদলাইয়া তাহার নামখানিই রাম করিয়া দিয়াছি।

সন্ধ্যা আজ অপূর্ব করিয়া নামিতেছে। কিছু পূর্বেও বৃষ্টি হইতেছিল। হঠাৎ দেখিলাম আকাশ স্থানে স্থানে রক্তিমবর্ণ ধারণ করিতেছে। কোথাও বা পক্ক ধান্যের বরণ নিয়াছে। ততক্ষণে বনমাঝে শুষ্ক পত্রগুলি বারিষে ভিজিয়া ভিজিয়া আরো টকটকে হইয়া উঠিয়াছে। তাহার উপর যখন অস্তমিত সূর্য ঝলকাইতেছে  মনে হইতেছে  -- তাপদগ্ধ পত্রগুচ্ছ যেন মাতার নাভি। এক্ষণে নাড়ি ছিঁড়িয়া জন্ম লইবে নতুন এক সন্তান। আমার ভাবব্যঞ্জক কথা শুনিয়া রাম হাস্যমুখ হইল। কহিল, ভগিনী! জগতের কোথায় মাতার স্পর্শ নাই? ঋতু বদলাইলে এই মৃতপ্রায় বৃক্ষেই হয়ত দেখা দিবে সবুজপত্র। গত তিন চারিদিন ধরিয়া কেবলই দেখিতেছি, চেটাল বুকখানি বারংবার বাজাইয়া রাম নিজেকে সনাতন ধর্মাবলম্বী বলিয়া প্রমাণ করতেই ব্যস্ত। আজ তাহারই মুখে জীবধর্ম ও প্রকৃতির এই নিগূঢ় সম্পর্কের কথা শুনিয়া আমি থতমত খাইয়া যাইলাম। নগরের কালেজ হইতে পাশ দিয়াছি বলিয়া গ্রামীন ব্যক্তিবর্গকে নিকৃষ্ট করিয়া দেখা আমাদিগের বদস্বভাব। অতএব রামকে যারপরনাই খচাইবার উদ্দেশ্যে কহিলাম, ভ্রাতা তুমি কি যবনের গৃহেও মাতার স্পর্শ দেখ? রাম শান্ত স্বরে উত্তর করিল, কেন নহে? যবনের মাতাও আমার মাতা। ভগিনী, মনুষ্যজগত জীবজগতের একটি অংশ মাত্র। জীবজগতে যেমন নানাবিধ প্রাণী ও তাহাদিগের নানা বৈশিষ্ট্য, মনুষ্যেরও তাই। আপনার বৈশিষ্ট্য রাখিয়াও প্রাণীকূল দেখো কেমন একত্রে এক বনে কাল অতিবাহিত করে। ইহারা মিছে প্রেমের ভাব জানে না। সত্য বিরোধকে স্বীকার করেই পরস্পরকে ভালোবাসে। তবে বড় ও ছোটর বিভেদ মনুষ্যের ন্যায় জীবেও প্রবল। ব্যাঘ্র কেবলই হরিণ গিলিয়া ফেলে। চিল চকচকে মাছরাঙ্গার পিছে দৌড়াইতে থাকে। ভগিনী, বৃহতের এই ক্ষুদ্রকে খাইবার প্রচেষ্টা দেখিয়া শুনিয়া আমার হৃদয় টনটন করে। জঙ্গল হইতে পলাইয়া গৃহে তো ঢুকি, কিন্তু সমাজে এরূপ দেখিলে পলাইবার স্থান নাই। কেননা বৃহৎ ক্ষুদ্রের এই গেলনপ্রক্রিয়ায়  আমিও তো ঢুকিয়া বসিয়া আছি। হাসিয়া ফেলিলাম -- তোমার রামচন্দ্র কী বলেন? এ নিয়ম তো তাঁহারই। রুষ্ট হইয়া মনুষ্য রাম কহিল, ধর্ম না জানিয়া তাহা লইয়া পরিহাস করা সমীচীন? অস্বীকার করিতে গেলে কী অস্বীকার করিতে যাইতেছ, তাহা না জানিয়াই কি করিবে? শিবাজির দেশে আমার চারিদিবসের বসবাসকালে রামকে এমন করিয়া খেপিয়া সিঁদুর হইতে দেখি নাই। আহ! মরণ!

এরই মাঝে কখন নক্ষত্রখচিত আকাশ মাথার উপর উঠিয়া বসিয়াছে। অকস্মাৎ  বঙ্গদেশের এক পক্ষী ডাকিয়া উঠিল। বাল্য থেকে সে পক্ষীর ডাক শুনিয়াছি ঊষাকালে। আজ সায়াহ্নে শিবাজির দেশে পক্ষীটিকে ডাক ছাড়িতে দেখিয়া যে কী আমোদ হইল আমার! ফের কহিল রাম, পক্ষীর আদত আবাস বোধকরি আকাশ। তাই সে দেশে প্রবাসে ঘুরিয়া বেড়াইতে ভালোবাসে। ইহারা ভূমি খোঁজে না, কারণ স্থিত হওয়া তাহাদিগের ধর্মই নহে।

আমি স্তব্ধ রহিলাম। বুঝিলাম রামকে আজ কথায় পাহিয়াছে। সে জানিয়াছে, আমি কল্য চলিয়া যাইব। ওই আঁধারেই আমার পায়ের কাছে বসিয়া রাম তাহার জীবগাথার বন্যা বহাইয়া দিল -- জান ভগিনী, আজ জঙ্গলে গিয়া শুনিলাম এবার বিদেশীদের কাছে প্রদর্শনের জন্য ইরান হইতে ব্যাঘ্রশাবক আনিয়া জঙ্গলে ছাড়া হইবে। কহিলাম, এ তো ভাল কথা রাম! জঙ্গলের সুনাম হইলে জঙ্গলের পথপ্রদর্শক হিসেবে তোমারও তো কাজ বৃদ্ধি পাইবে! তোমার কন্যা খুশিয়ালিকে  খাওয়াইবার পরাইবার জন্য তোমার কি রোজগার বৃদ্ধির প্রয়োজন নাই? এমনিতেই লকডাউনে কত কষ্ট গিয়াছে তোমাদিগের। ফিসফিস করিয়া রাম কেবল কহিল, আর ব্যাঘ্রশাবকটি? মাতৃহারা হইয়া যে এই পরদেশের ঝড় বৃষ্টি  রোদে জ্বালাপোড়া হইয়া একাকী বনের মাঝে ঘুরিয়া বেড়াইবে? তাহার মাতৃস্নেহ,  মাতৃভূমির প্রয়োজন নাহি? খুশিয়ালি আমার সন্তান, আর ব্যাঘ্রশাবক সে কি কাহারো সন্তান নহে ভগিনী? মনুষ্যকূল কি এতই শ্রেষ্ঠ যে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে কেবল নিজেদের নয়নসুখের জন্য একটি পশুশিশুকে মা ছাড়া জঙ্গলে ঘুরাইয়া মারিতে হইবে? অনর্গল বকিতে বকিতে রাম এক্কেরে কাতর হইয়া গেল। তাহার কাতরানি খাঁটি।

ধীরে ধীরে দাওয়া হইতে নামিয়া রামের একেবারে পাশটিতে গিয়া বসিলাম।  বোধহয় নিজের জন্য কিছু মাতৃস্নেহ আদায়ের জন্য। অনাগত সেই শাবকের ভবিষ্যতচিন্তায় রামের ব্যথিত মুখ কেমন করিয়া আমার মনে এক ধারণা গাঁথিয়া দিতেছিল, মাতৃস্নেহ লিঙ্গনির্ভর নহে। উহা চিরকালীন এক জীবনধারা, ধারাপাতের মতো বহিয়া যাহা সর্বজীবকে সুষমায় ভরিয়া দেয়। আকাশে তখন অগণিত দীপ্তিময় নক্ষত্র। বোধহয় বৃহৎ আলোক মরিয়া যাওয়ায় ক্ষুদ্র অলোকের ঘুম ভাঙিয়াছে।

আজি কি তারকার তেজ অধিক?

বলা বাহুল্য -

ধর্মের কল নড়িয়াছে।

 

(৭)

 

কবে থেকে সবুজ একটা ফুল খুঁজে চলেছি। পাতায় যদি লাগে লাল বেগুনির বাহার তবে ধরাতলের এত সবুজের এক টুকরো কেন জোটে না ফুলের! বহুদিনের খোঁজের জবাব এল।

ক্লাসে এল সপ্তাহের সাতদিনের পাঁচদিন নিখোঁজ থাকা বালক। বাঁদরের চূড়ান্ত।  বছরে চল্লিশদিন মতো রেগুলার আসে ক্লাসে। বাকি সময়টা কখনো পান সিগারেট বিক্রি, কখনো পড়শীর লেটারবক্সের চিঠিপাটিগুলো বেমালুম  অদলবদল করে দেয়া। টিফিনবক্সে একগাদা লিটটি বানিয়ে সেদিন আমার কাছে হাজির হল সে। কামাই করলেই এইসব আনে আমার জন্য। টিফিনের আরো নানারকম ভ্যারাইটি আছে। সোডা-ওয়াটার, বেগুনসেদ্ধ ধনেপাতা দিয়ে, কাঁচা ডিমের রুটি। আর পরীক্ষায়? শুধু প্রথম প্রশ্নের নির্ভুল উত্তর। বল, শিকারি কোথায় থাকে? উত্তর -- শিকারি বনে থাকে।

আমার এই ছাত্র কথা বলতে পারে না, শুনতে পারে না। শোনা বলা দুইয়েরই অভাবে জগতের কত সত্য কত মিথ্যে ধরতেও পারে না সে। অথচ কী আশ্চর্য জানেন! এত সব না পারা ও না পাওয়ার মাঝে সে মুখিয়ে থাকে বন বাগানে সবুজ খুঁজতে। বন সংক্রান্ত প্রশ্নের সবসময় সঠিক উত্তর।

‘বনে কী থাকে রে?’

‘গাছ, গাছ।

গাছ তো গাছ। প্রতিবার গাছই হয় তার উত্তর। যেন এই বিশাল প্রাণিজগতের আর কিছুই থাকে না বনে। যেদিন সে আসে, ঢুকেই ক্লাসরুমের জানালাটা দেয় খুলে। দড়াম আওয়াজে চমকে উঠি। কোনো কোনোদিন মনে হয়, মেরে মেরে পাট করি সবুজখেকো ছেলেটাকে। মার খেয়েও ভ্রূক্ষেপ নেই, জানালার শিকে মুন্ডু ঢুকিয়ে এপাশে ওপাশে চারিপাশে খুঁজে চলেছে সবুজ। খোঁজে, শুধু খোঁজে।  যেন খুঁজলেই রোজ রোজ গজাবে নতুন সবুজ!

ক্লাসরুমের বাইরে একচিলতে উঠোন। অযত্নে জমেছে কিছু তৃণরাশি। ছেলেটা সেই অযতনকে বাঁচাতে চায় পরম মমতায়। বেলা একটার মধ্যে ছুটির জন্য আনচান করে তার শরীর। দুটো চড় সমেত ছুটি দেয়ার পর দেখি, সে গিয়েছে  উঠোনে। ঢিল ইঁট ইত্যাদি সব অসবুজকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে। কী আক্রোশ! এত জোরে শব্দ করে ফেলে, আমি শিওর, যে জঞ্জাল ফেলেছে সে, যদি ধারেপাশে কেউ থাকে, তো শিউরে উঠবে। ড্রইংখাতা ভর্তি হয় সবুজ পাতায়।

আজও ঐরকম আওয়াজে ঢিল ছুঁড়ছিল সে। তার নাকের ডগায় জমা ঘাম, তার সিঙ্গারা চুল, সব দেখে মনে হচ্ছিল, এবার যেন সে মাটি খুঁড়ে বার করবে সবুজ। ধরাভূমির সবুজে আর তুষ্ট নয় আমার সবজে খোকন। ঠিক তারই মতো করে ক্লাসঘরের জানলা দিয়ে মুন্ডু ঢোকাই। ঠিক তারই মতো করে।

‘ও ছেলে, দে, দে, দে তো দেখি আমায় একটা সবুজ ফুল!’

ভেবেছিলাম কথা বুঝবে না হাবা ছেলেটা। ওমা, দেখি ঘাসগুলোকে গার্ডার বেঁধে একটি ফুল বানাচ্ছে সে। সবুজ ছেলে গুঁজবে সবুজ ফুল! মায়ের মাথাগরম মাথায়! কথা বুঝল। ব্যথাও যে…

মায়ের সাধ পুরিল।

 

 


5 কমেন্টস্:

  1. ঠিক যেন নানা রঙের ফুল দিয়ে গাঁথা একটি সুন্দর মালা।

    উত্তরমুছুন
  2. অসাধারণ গল্পমালা !!

    উত্তরমুছুন










  3. ময়ূরী মিত্রের কলমের বৈচিত্র্যে আমি মুগ্ধ! কি নেই তাঁর এই একমুঠো লেখার ঝুডিতে! প্রকৃতি, মানুষ, প্রাণীকূল - তাদের প্রতি গভীর মমত্ববোধ - তাঁর লেখাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে! ময়ূরীর লেখায় প্রকৃতির সবাই - মানুষ, প্রাণীকূল, গাছ, আকাশ - সবাই প্রাণ পায়, যেন কথা বলে! আমরা যে সব একই বিশ্বব্রহ্মান্ডের খন্ড অংশ এবং একে অন্যের পরিপূরক - তার এমন সুন্দর প্রকাশ বড় কমই পাই!
    অপূর্ব!
    প্রতিটি অণুগল্পই সে অর্থে ব্যতিক্রমী - গভীর অনুভূতির সাবলীল প্রকাশ, বিভিন্ন আঙ্গিকে! কখনও তা নিজেকে নিয়ে, কখনও তা মানুষ, প্রাণীকূল, গাছ বা আকাশকে নিয়ে! তারই মাঝে আমরা পাই গভীর দর্শন! তাঁর লেখায় আকাশের বিস্তার, মানুষের খোলা হৃদয়, প্রকৃতির অকৃপণতা পরিস্ফুট - আমরা অবগাহন করি সানন্দে আর ঋদ্ধ হই!
    আর যে সব মানুষের কথা পড়লাম - তাঁরা সমাজের প্রান্তজন - মানে, সমাজ ( আমরা) যাঁদের প্রান্তজন করে রেখেছি আমাদের ইচ্ছেমত - যেমন, ডোম, রাম - তা মুগ্ধ করে!
    ময়ূরী মিত্র তাঁদের মধ্যেই ‘মানুষ’ খোঁজেন আর আমাদের সামনে তুলে ধরেন! তাঁর এই লেখার যা সদর্থক প্রভাব, যাঁরা তাঁর লেখা মন দিয়ে পড়েন, তাঁরাই বোঝেন!
    কালিমাটি অনলাইন কে অনেক ধন্যবাদ এমন এক অসামান্য গল্পগুচ্ছ আমাদের উপহার দেবার জন্য! 🙏
    সুচিত্রা সেন, কলকাতা

    উত্তরমুছুন
  4. পড়লাম রে। তোর কলমে জাদু ভর করে। স্যার।

    উত্তরমুছুন