বড় পর্দায় ইংরেজী ছবি – দ্বিতীয় পর্ব
১৯৬৩-র ডিসেম্বরে স্কুলে প্রথম শ্রেণীর বাৎসরিক পরীক্ষা শুরু হবে। নভেম্বরে, মা লিখছেন, আমার টার্জান-প্রীতি দেখে মন অন্যদিকে ঘোরাবার জন্য আমায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই পূর্ণতে, রবিবার সকালে Scaramouche ছবির অসাধারণ তরোয়াল-খেলা দেখাতে।[1] রাফায়েল সাবাতিনির ১৯২১ সালের উপন্যাসের ওপর আধারিত ১৯৫২ সালের এই জমাটি ছবিটি অবশ্য উৎস-আখ্যান থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে, যা জেনেছি ১৯৭০/৭১ সালে ছবিটির পুনর্মুক্তির সময় বইটি পড়ে, যদিও ফরাসী বিপ্লবের প্রেক্ষাপট দুটিতেই আছে। ৬৩-তে সঙ্গে ছিলেন মা, মাসিমা, আর দাদা। সত্তরের দশকে মেট্রোতে আবার দেখলাম বাবা-মা’র সঙ্গে। ঐ একই দশকে এক রবিবার সেন্ট জেভিয়ার্সের প্রেক্ষাগৃহে তৃতীয়বার ‘স্ক্যারামুশ’ দেখলাম, মা ও এক খুড়তুতো দাদার সঙ্গে। ছবির চরম সময়ে নায়ক অঁদ্রে ও প্রতিপক্ষ দ্য মেইনের দ্বন্দ্বযুদ্ধ নাকি চলচ্চিত্রে দীর্ঘতম, প্রায় সাত মিনিট ধরে, যা রুদ্ধশ্বাসে দেখতে হয়! চাইলে ইউ-টিউবে এই যুদ্ধ দেখে নিতে পারেন।
তবে, সেই ১৯৬৩-তে, মূল ছবির আগে তো সেই টার্জানের ছবির ট্রেলরঃ Tarzan’s Fight for Life (১৯৫৮)! টার্জান লড়ছে এক প্রকাণ্ড অজগরের সঙ্গে! কিন্তু বিধি বাম! দাদা গম্ভীরভাবে বললেন, ওটা দেখানো হবে রবিবার ৮ তারিখে, আর তোমার পরীক্ষা শেষ সোমবার ৯ই! অতএব দেখা হবে না! সে দুঃখ ঘুচলো ৮০-র দশকে ব্রিটিশ টেলিভিশনে ছবিটি দেখে!
১৯৬৪ সালে দাদা ও আমার এক কাকার সঙ্গে লাইটহাউসে দেখলাম আমার প্রথম হারকিউলিসের ছবি, Hercules in the Center of the Earth (১৯৬১, এখন ছবিটি Hercules in the Haunted World নামেই বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যায়)।[2] হারকিউলিস (অভিনয়ে রেগ পার্ক) থিসিয়াসের সঙ্গে নরকে যাচ্ছেন বিস্মৃতির পরশপাথর আনতে যা দিয়ে তাঁর প্রায়-অচেতন প্রেমিকা ডিয়ানিরার চেতনা ফেরানো যাবে। প্রতিপক্ষ রাজা লিকো (রূপায়নে বর্তমান প্রজন্মের কাছে সারুমান আর কাউন্ট ডুকু, আর আমাদের কাছে ড্র্যাকুলা-রূপে-খ্যাত অসামান্য অভিনেতা ক্রিস্টোফার লী)। পরিচালক মারিও বাভা। দাদা নাক সিঁটকে রেগ পার্ক সম্বন্ধে বললেন, “স্টীভ রিভসের কাছে কিস্যু না!” পরে স্টীভ রিভসকে হারকিউলিস-রূপে দেখব।
হারকিউলিস সম্বন্ধে উৎসাহিত হয়ে এবার দাবী করলাম, ঐ লাইটহাউসেই (নাকি তার পাশে নিউ এম্পায়ারে?) আমাকে Jason and the Argonauts (১৯৬৩) দেখানো হোক। জেসন কিভাবে সুবর্ণ ভেড়ার লোম উদ্ধার করবে, তার গল্প, তার দলে আছেন হারকিউলিস (যদিও এখানে তিনি পার্শ্বচরিত্র)। কোন অজ্ঞাত কারণে (ছবিটি নাকি ভালো হয়নি!) আমার ইচ্ছে মঞ্জুর হলো না। বরং মাসতুতো বড়দার সঙ্গে পাঠানো হলো সেই পূর্ণতে স্যর ওয়ালটার স্কটের উপন্যাস-আধারিত ১৯৫২ সালের Ivanhoe দেখতে। আচ্ছা, বিদেশী ছবির একটা ব্যাপার কি আমার সমবয়সী পাঠকদের, ছোটবেলায় আমার যেমন অস্বস্তিকর লাগত তেমনই লাগেনি? একাধিক চুম্বনদৃশ্য! ‘আইভানহো’তে তো বটেই, এর আগে ‘স্ক্যারামুশ’ও বড়দের সঙ্গে বসে দেখতে এই কারণে কিরকম যেন লাগতো! এখনকার দর্শকরা হয়তো এ কথা শুনে খানিকটা কৌতুকই বোধ করবেন! ‘আইভানহো’র তারকা সমাবেশ কিন্তু দেখার মতোঃ রবার্ট টেলর, জোন ফনটেন, এলিজাবেথ টেলর, এবং প্রতিপক্ষের চরিত্রে জর্জ সান্ডার্স! ভালো কথা, সত্তরের দশকে মিনার্ভায় (পরে ‘চ্যাপলিন’) Jason and the Argonauts দেখার সাধ মিটিয়েছিলাম একাই!
১৯৬৪ বছরটি আমার ইংরেজী সিনেমা দেখার ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ! বাংলা ছবি দেখার স্মৃতিচারণে বলেছি যে আমার প্রথম দু-বার দেখা ছবি ছিল ১৯৬০-৬১-তে শেষ পর্যন্ত । এই ৬৪-তে দাদা স্কুলের ‘ফাদার’-এর কথা শুনে আমায় নিয়ে গেলেন লাইটহাউসে ১৯৬২ সালের ছবি Hatari দেখতে! ছবির তিনটি ‘চরিত্র’ আমার ঘুম কেড়েছিলঃ অভিনেতা জন ওয়েন, এবং তিনি যে গাড়িতে আছেন সেটি ঢুঁ মেরে ওল্টাবার প্রচেষ্টারত দুটি গণ্ডার! এদের মধ্যে গণ্ডার-দুটিই প্রাধান্য পেয়েছিল অনেকদিন ধরে! প্রথম দেখার পর আবার পাশের নিউ এম্পায়ারে যাই বাবার সঙ্গে গণ্ডার-দর্শনে! ১৯৬৬-তে বসুশ্রী সিনেমায় রবিবার সকালে বাবার সঙ্গে তৃতীয়বার ছবিটি দেখি। এরপর সত্তরের গোড়ার দিকে ‘হাটারি’ পুনর্মুক্তি পায় ‘এলিট’ সিনেমায়। আবার গেলাম বাবার সঙ্গে! আবার ৭৩/৭৪-এ মিনার্ভায় পঞ্চমবার! ৯ই ডিসেম্বর ১৯৬৪ তারিখ দিয়ে মা’ লিখেছেন যে ‘মাথায় হাটারির বীজ পুঁতে গেছে, এবার গাছ গজাবে।’ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫-তে মা লিখছেন যে মন্ত্র পড়ে গণ্ডারকে দেবতা বানিয়ে পূজাও করা হয়েছে। ‘রাত্রে শোবার সময়, “নমঃ গণ্ডারং – ভূতের হাত থেকে বাঁচাও গণ্ডার,” বলে শোয়!’ ঐ বছরে আমার জন্মদিনের কেকের ওপর একটি ছোট গণ্ডারের আকৃতি রেখে বাবা আমায় চমকে দিয়েছিলেন! ছবিটি এত হিট করেছিল যে ত্রিকোণ পার্কের উল্টোদিকে সেই সময় ‘হাটারি’ নামে যে রেস্তোরাঁটি খোলা হয়েছিল, তা মনে হয় আজও আছে!ছবির কথা অনেক হলো, আরও হবে। এবার প্রেক্ষাগৃহ-সম্বন্ধে কিছু বলি। লাইটহাউসে দেখলাম প্রথমে চকোলেট-রঙের পর্দা সামনে। একটা নির্দিষ্ট সময়ে সেটা দু-দিকে দু-ভাগ হয়ে সরে গেলো, সামনে এলো বিশেষ ‘ডিজাইন’-করা, লাল আলোয় উদ্ভাসিত আরেকটি পর্দা, আর বেজে উঠলো এক বিশেষ signature tune। মানে, প্রদর্শনী এবার শুরু হবে। সুরটি শেষ হলেই লাল পর্দা দু-দিকে সরে গিয়ে শো শুরু হতো – বিরতির আগে এবং বিরতির পরেও, মূল ছবি শুরুর আগে এই একই ভাবে দুটি পর্দা আর সুরের ইঙ্গিত চলতো। লাইটহাউস, নিউ এম্পায়ার, এবং চৌরঙ্গীর ওপর টাইগার – এই তিনটি প্রেক্ষাগৃহ ছিল একক মালিকানাধীন, নাম ‘হুমায়ুন থিয়েটার্স’। লাইটহাউস ছিল সবচেয়ে বিলাসবহুল, হলের মধ্যে মেঝের ঢাল ছিল স্ক্রীনের দিকে উঁচু, সেখান থেকে ঢাল ছিল নীচের দিকে। লাইটহাউসের দো-তলায় একটি পথ ছিল যা দিয়ে পাশের নিউ এম্পায়ারে যাওয়া যেত। নিউ এম্পায়ার ছিল অপেক্ষাকৃত কম বিলাসবহুল, একটিই লাল-আলো-ফেলা ডিজাইন করা দু-ভাগ হয়ে যাওয়া পর্দা দিয়ে স্ক্রীন ঢাকা থাকত। আর স্ক্রীনের পেছনে ছিল মঞ্চ। অনেক সময়, রাতের শো বাদ দিয়ে হতো নাটক বা সঙ্গীত/নৃত্যানুষ্ঠান। সবচেয়ে অভিনব ব্যাপার, অন্যান্য সিনেমা-হলে সবচেয়ে সস্তা আসন (তখনকার ভাষায় ‘দশ আনার সীট’) থাকতো একেবারে স্ক্রীনের সামনে। নিউ এম্পায়ারে এই আসনগুলি ছিল তিনতলায়! তাই, ইংরেজী ছবি দেখার জন্য এই হলের মাঝামাঝি জায়গায় আমাদের বাঁধা ১ টাকা ৪০ পয়সার সীট নিউ এম্পায়ারে খানিকটা মহার্ঘ হয়ে যেত। টাইগার ছিল সস্তার হল – বেতের চেয়ার, মাথার ওপর ঘুরতো পাখা। লাইটহাউস-নিউ এম্পায়ারের মতো শীতাতপ-নিয়ন্ত্রণের বালাই ছিল না! সাধারণত, লাইটহাউস, নিউ এম্পায়ারে হয়ে যাওয়া ইংরেজী ছবিই টাইগারে পুনর্মুক্তি পেত, যেমন পেয়েছিল ‘হাটারি’। এছাড়া দেখানো হতো অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহে আগে হয়ে যাওয়া ইংরেজী ছবি। টাইগারেও একটি ডিজাইন-করা পর্দা ছিল – আর স্ক্রীন সাধারণ চতুষ্কোণ থেকে ‘সিনেমাস্কোপে’ পরিণত হবার সময় টাইগারের স্ক্রীন জোরে ‘ক্যাঁচ ক্যাঁচ’ করে উঠত! Signature tune অন্য দুটি হলের মতোই বাজত। লাইটহাউস, অন্যান্য সিনেমা-হলের মতো দো-তলা, সবচেয়ে দামী আসন ছিল দ্বিতলে। ত্রিতলিকা নিউ এম্পায়ারের কথা আগেই বলেছি। টাইগার ছিল একতলা!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন