কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

তমাল রায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


গল্পের ডাকনাম, অপেক্ষা


 

তুমি তো আর আসো না মন খারাপ! বয়স তো ক্রমে বাড়তেই থাকে মন খারাপেরও বয়স হয়, জানো! সে ক্রমশ ঝিমুতে থাকে, দিনে-রাতে। অথচ সে শুতেই পারতো শোয় না পাছে ঘুমিয়ে পড়লেই তুমি আসো, আর ওঠার আগে চলে যাও!

তোমাকে বলা হয়নি, শহরে অপেক্ষার রঙ সবুজ সে অবশ্য আমার অপেক্ষাকে ঈর্ষার চোখে দেখে তোমাকে বলা হয়নি, শহরে মেঘ নামলে, ব্যথা পাই, বৃষ্টির ভয়ে নয়, 'ভয়' এর ভয়েই! কতদিন সে আসেনি অথচ তার হাত দিয়েই চিঠি দিয়েছিলাম তোমায় সে কি তবে চিঠি দেয়নি তোমায়?

                            

আজ সকাল হতেই থলি হাতে তিনি হাজির আমাদের মংপুর কথা বলছি মংপুকে মনে নেই? সেই যে খাদের পাশে ঘাপ্টি মেরে লুকিয়েছিলো! আমাদের জিপটা এগিয়ে যাচ্ছিলো দ্রুত আর তারপরই... 'কে তুমি অন্ধকার বলেই ডাকতে আমি আদর করে ডাকতাম মংপু ঘটনা বা দুর্ঘটনা যাই বল, সে'তো ওই মংপুতেই! তুমি বলতে চাইতে, দুর্ঘটনা! আমি বলতাম, ঘটনা!  ঈশ্বরের রাজ্যে যা ঘটে সবই ঘটনা বা দুঃ বলার সুযোগ কই! আর  প্রতিটি ঘটনার যেমন কার্যকারণ থাকে, তেমন থাকে কিছু অনিবার্য ফসলও সে এসেছিলো, ভাগ্যিস! নইলে এই দৃশ্যমান দুনিয়ার প্রতি আমার যে এত  মোহ, তা তো দুর্নিবার থেকে যেত আগেরই মতন মংপু একটা উপকার অন্তত করেছিলো মানুষ চিনতে শিখিয়েছিল প্রিয় অপ্রিয় কত কিছুই তো তার হাত ধরেই শেখা! যা বলছিলাম, আজ তো সকালই হয়নি চারদিক থম থম করছে, আর সকাল থেকে একনাগাড়ে বৃষ্টি অর্ফিউস তখনই হাতে নিয়েছে বীণা সুর তুলেছে... আর যা ঘটে, সব চিত্রবৎ! কিন্তু অর্ফিউস তো মিনাদদের বশ করতে পারেনি যেমন মংপু মংপু মূলত বাজার করতেই আসে আজ অবশ্য অনেকদিন পর তুমি জানো, আমি গন্ধ পাই, আঁচ পাই আজ ভোরেও পেয়েছিলাম ঠিকই অর্ফিউসের বীণা বাজানো তখন বন্ধমংপুও নেই এবার নিয়ে গেছে আমার জিভ! হ্যাঁ গো! সত্যি! আর কোনো  শব্দ নেই কিছুক্ষণ গোঁ গোঁ, এখানে তা অবশ্য প্রতিবাদের শব্দ। পরে ভেবে দেখলাম, প্রতিবাদ করেই বা লাভ কী! যে যাবার সে যাবেই! তাই বেশ  কিছুক্ষণ চুপ করে শুয়ে থেকে তোমায় লিখতে শুরু করলাম

                           

তুমি তো ডাকলেই আর আসতে পারো না! তোমার এখন অনেক কাজ!  কাজকে আমি আদর করেই ডাকি 'কাজল' চোখে কাজল পরলে, সব কিছুই কেমন মনোহরা এমনকি বিকিকিনির এই হাট! এত যে মায়া তোমার শরীরে, তা তুমি সারাটাক্ষণ কাজের কাজল পরো বলেই হয়ত! জানো,  দুনিয়ায় দু-শ্রেণীর মানুষ এক শ্রেণী আমার মত ভাবে, কিছু করে না দুই যারা করে, ভাবে না তুমি দ্বিতীয় তাই তোমার সন্তান, স্বামী হাবি জাবি, এমন কি শাড়ি গয়নাও… নইলে ডাকলে আসো না কেন? তুমি কি সত্যিই বুঝতে পারো না? অপেক্ষার বয়স বাড়ে, সে ক্লান্ত হয়, সে শয্যা খোঁজে, সে গাইতে চায়, জুড়াইতে চাই কোথায় জুড়াই...

সময় ঘড়ি বলছে এখন প্রায় দুপুর দুটো অথচ আলোর ছিটেফোঁটাও নেই কোত্থাও! সময়ে এই দ্বীপে একটা জাহাজ আসার কথা ওই যে অর্ফিউস জেসনের নেতৃত্বে আর্গো জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল স্বর্ণমেষের চামড়া আনার অভিযানে, মনে পড়ে? পাশে সাইরেনাম দ্বীপ, সেখানের সব অধিবাসীই গান গায়... ওরা ধ্বংস করতে চাইছিলো, গান শুনিয়ে আর্গোকেও পারেনি, সাথে যে অর্ফিউস! অর্ফিউস ফিরে এসেছে আমার  দ্বীপে বাজায় আমি শুনি একা আর বোকার জীবন যেমন হয়! আমার শ্রবণশক্তি কিন্তু তীব্র এখনও কিছু আগেও শুনছিলাম পাতা ঝরার শব্দ মনাস্ট্রিতে ঘন্টা বাজে, ড্রামের শব্দ গুম গুম গুম... শুয়ে শুয়েই সেখানে চলে যাই দেখি সার দিয়ে দাঁড়িয়ে লামার দল কেউ ছোট, কেউ বড় এমনকি শিশু লামাও ওদের কী একটা শোভাযাত্রা শুরু হয়েছে আচ্ছা, যা তৈরি হয়েছিল মানুষের মঙ্গলের জন্য, তাকে কেন এত দেখনদার হতে হয়?  দুনিয়ার যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের কথাই বল না কেন, অল সেইম! তবে কী ধর্মমাত্রই বেশ্যা? তাকে সেজেগুজে পথে নামতে হয়? না না বেশ্যাদের খারাপ ভাবি না তারা তো খিদে মেটাতেই পথে, কিন্তু ধর্ম, সে তো নিভৃতচারীর যাপন তার এত সোচ্চার বহিঃপ্রকাশ কেন! ওদের শোভাযাত্রাও অবশ্য থেমে গেছে এখন তো অর্ফিউস বীণা হাতে তাই পাতারাও থমকে ইতিমধ্যে মা এসেছিলো, পায়েস হাতে আমি খাইনি মা মা'ই, আমিও  জানি কিন্তু মা' করা অন্যায্য বিচারগুলোর কথা যে মনে পড়ে যায় আজ সারাজীবন পরের কথা ভাবলো, পরের সু বা কু নিয়ে ভাবাটা খারাপ কিছু না কিন্তু অত কিছু ভাবতে গিয়ে অভিশাপ কুড়নোর মানেই কী! কাকারা তাদের মত থাকতো, মানুষ একসাথে থাকলে ঝগড়া হয়, ভালোবাসাও মা'কে এত বিচার করবারই কে দায় দিয়েছিলো? শেষমেশ তো মা পাগলই হল! অর্ফিউসসে কথাই বলছিলো না খুশি হল পার্সিফোনে, না আফ্রোদিতি, এমন কী যাকে বাঁচাতে এত কিছু, সেই এডোনিসও না! হাতে রইল পেন্সিল যেই অর্ফিউস থেমেছে, অমনি মংপু আবার হাজির এবার চাইছে কান গড়তে সময় লাগে  ভাঙতে আর কতক্ষণ!  গেল সে যাক আমি তোমার পদধ্বনিও আর শুনতে পাবো না এবার?

                          

তুমি তো আর আসো না মনে মনে কত আলপনা আঁকি, তুমি আসলে পা রাখবে আমি জল দিয়ে পা ধুইয়ে দেব এদিকে এখন সন্ধ্যে পুইয়ে রাত রাতের দিকে আমি টাইম ট্রাভেলে বেরিয়ে পড়ি উনিশ শতকের ইউরোপে যাই যেখানে কাজ না থাকলে মানুষ মর্গে গিয়ে মৃতমানুষ নেড়ে চেড়ে দেখতো তুমি কী ভাবো? আমি মৃত না জীবিত? এত যে মায়ার ঘোরে বাঁচো, কে তোমার সন্তান, কে তোমার স্বামী? মৃতদেহ হলে কেউ ছুঁয়ে থাকবে? আগলে রাখবে তোমায়? তোমার কি মনে হয় না, এই পৃথিবীটাও কেমন মৃতবৎ! পচা গন্ধ বেরুচ্ছে গা থেকে! আর যারা প্রকৃত সৎ, মহাত্মা, তারা দ্রুত ছেড়ে যাচ্ছে এই মধূময় পৃথিবীর ধুলি... এখনও আসবে না? মৃত আর জীবিতর কি আদতেই কোনো তফাৎ থাকে? অর্ফিউস নেই এই ফাঁকে চলে গেছিলাম কুর্চির কাছে কত বড় হয়ে গেছে মেয়েটা আমার! ওর মা, আমার একমাত্র ধর্মপত্নী হয়ত তখন কোথাও কোনো পার্টিতে, পান আর হুল্লোড়, হাসি আর গালাগালের ফোয়ারায় ভাসছে, আর কুর্চি, বেচারা মেয়েটা বমি করছেকা! একাই তো ফিরে এসে উড পেন্সিলে আঁকছে নদী ফের মুছে দিচ্ছে আমায় চিনতে পারেনি আমি চেনাও দিইনি কী লাভ! এই যে গোপন গেরিলা জীবনে অভ্যস্ত হয়েছি ধীরে ধীরে, আর প্রকাশে কি'ই বা হয়! ছেঁড়া কাগজ জোড়া যায়, সময় কি করে জুড়বে?

                     

রাতের নদী বেয়ে লঞ্চ যাচ্ছে আসছে একটু আগেই দেখা হয়েছিলো, লাইকার সাথে, মহাশূন্য থেকে ফিরে আসা ইস্তক, ইশারায় আমায় শেয়ার করে চলেছে ওর দেখা ব্ল্যাকহোলের কথা আমি গেলে, সাথেই চলে যেন আমি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির, আর সে আমার একান্তু অনুচর ওই দেখালো, এরিস্টিউস কে এত হুল যার, এত মদনগুণও! সে গিলেছিলো কুর্চির মাকে এখন তোমাকেও... আমার খুব শীত করছিলো তাই পালিয়ে এসেছি... এখন চুপ করে শুয়ে আছি একটু পর শুরু হবে সিনেমা মাল্টিপ্লেক্সের সময় এখন শপিং মলের সময় রাত বারোটার শুরু হওয়া শেষ শো-এর টিকিট কেটে অপেক্ষা করি ওই যে অপেক্ষা, যা ছাড়া আমার আর কোনো ধর্ম ছিলো না!  

                          

এতবার বলার পরও তুমি আসোনি এবার আমি রওয়ানা হবো তোমার খোঁজে যাত্রার শুরুতেই স্বর্গে গিয়ে তোমায় পাইনি এবার তাই নরকে অপেক্ষার চোখ এখন আরও সবুজ একটা শপিং মল, একটা জেলে  নৌকো,  সম্পূর্ণত কালো সামনে নুলিয়া আরও কালো কপালের ওপর হাত রেখে, কী যেন দেখছে একটা কিউরিও শপ, রক্তচক্ষু মহিষের কাটা মুণ্ডু ছড়ানো পথে, একটা পানশালা, রাশি রাশি মদ কমোড, কমোডিটি, আগুন, ছাই, আমি তোমায় খুঁজছি পাগলের মত বিশু পাগলা কে যেন মারছে, কারা যেন কাঁদছে আর শুনতে পাই না যে! এ আশীর্বাদ, অভিশাপও! কানে আসছে না অর্ফিউসের বাঁশিও, সারি সারি সিট, সামনে গ্যালাক্সির পর্দা, ওই তো তুমি! এবার তোমায় দেখতে পেয়েছি। মুখে স্মিত হাসি। ব্যালকনিতে বসে বাদাম খাচ্ছো খোসা ছাড়িয়ে রাখছো ব্যাগে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তোমায় পাঁজাকোলা করে তুলেছি, দৌড়ে আসছি, দ্রুত... অনেক সিঁড়ি ভাঙা বাকি আমি পালাচ্ছি দৃশ্যরা পেছন দিকে দৌড়চ্ছে, আমি সামনে... হলের বাইরে বেরুবো, ব্যস শান্তি নরক থেকে আমিই তোমায় মুক্ত করব একটাই জীবন দুজনে মিলে কেটে যাবে দিব্যি জামা ধরে টানলো কে? ছোট হাত মনে হয়! আমার কুর্চি ফুলের গন্ধ... আহ! কতদিন কতদিন পর... কী তুমি তো ফের চলে গেলে হলের ভেতর! এবার? কান্না পাচ্ছে খুউব! লাইকা বার বার বলেছিলো, পেছন ফিরো না পথ চলতে পেছনে তাকাতে নেই... আহহ! মা কী তাহলে তোমারই অভিশাপ! পাখিরা, গাছেরা, ওই যে পথ সকল যারা আমায় ছেড়ে গেছে, সবাই আমার বন্ধু ছিল। মংপুও! তা নইলে এই শেষ রাতে মংপু  আবার আসে? এবার অবশ্য দল বল জুটিয়ে এসেছে...  আমায় আঘাত করছে ওরা, হে পিতা তুমি হাত বাড়াও, আমার বুকে খুব ব্যথা, হে আলোর দেবতা, প্লিজ একবার…  

                              

চলে যাচ্ছি তুমি তো জানোই দীর্ঘ অপেক্ষার শেষে আলপথ থাকে, যা আকাশে মিশেছে, আমি অপেক্ষা করব, একটা ভোরের, তোমারএখন নিস্তব্ধ পদচারণার মাঝে বলে যাই, আবার আসবো, যদি একবার হাত ধর সমস্ত অভিমান ভুলে আবার হেসে উঠবো, তখনও হয়ত গ্যালাক্সি থিয়েটারে চলছে, নতুন কোনো অপেক্ষার গল্প, যেভাবে গল্প লেখা হয়...


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন