সমকালীন ছোটগল্প |
ছুটিতে বেড়াতে যাবার অনুমতি
ব্যানার্জি আমাকে বলল, “চলুন, ছুটিতে বেড়ানোর অনুমতি নিয়ে আসি।”
আমি বললাম, “কী করে বুঝলেন?”
—— কী?
—— আমিও বেড়াতে যাব!
ব্যানার্জি উত্তর দিল না। সে চশমাটা ঠিক করল আর মাস্কটা খুলে ফেলল,
ফলে আমি দেখেছি তার নাকের গড়নটা। সেটা বেশ খাড়া। তার ওপর ভোঁতা। তায় সেটা লম্বা। এক
রকমের নাক আছে ব্যানার্জির। সেই দেখে কিছু মনে হয় না। কিছু মনে না হলে ব্যানার্জির
মুখের অন্যান্য অংশের দিকে তাকাতে থাকলেও কিছু মনে হয় না। ব্যানার্জিকে নিয়ে এই মুশকিল তাকে দেখে কিছু মনে
হয় না। তার সম্পর্কে নানান তথ্য আমি দিতেই
পারি, তাতেও তার সম্পর্কে কিছু মনে হওয়া খুবই সম্ভবপর নয় আরকি! এরকমই একজন হল ব্যানার্জি। খুবই
অসহায়ের মতো সে আমার কাছে এসেছিল আর বলল,
“চলুন তা হলে। যাবেন তো…
আর সব কাজই অনুমোদন করে ম্যাডাম। সেজন্য ম্যাডাম আমাকে চেনে। ম্যাডাম
বসকে চেনে। ব্যানার্জিকেও ম্যাডাম চেনে, তবে আমার সঙ্গেই ম্যাডামের যোগাযোগ বেশি বলে ও আমায় ধরেছে ছুটির সময় বেড়ানোর অনুমোদন
পাওয়ার জন্য যা ম্যাডাম দেবে। আমি ব্যানার্জিকে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি তো যাদবপুর?”
ব্যানার্জি বলল, “হ্যাঁ।”
—— ইঞ্জিনিয়ারিং?
—— হ্যাঁ।
—— এখানে কেন?
—— ওই পেয়ে গেলাম।
—— বাইরে গেলে পারতেন।
—— কোথায়? যে কোন জায়গায়।
—— দেশের যে কোন স্টেটে, বিদেশে।
—— বাইরে যেতে আমার ভালো লাগে না।
—— ছুটি পেলেই যে বেড়াতে যান?
—— বেড়াতে যাই না তো!
—— তবে?
—— ট্রেকিং করি।
—— ট্রেকিংও তো বেড়ানো।
—— ট্রেকিং বেড়ানো কী?
—— তা হলে ট্রেকিং কী?
—— ট্রেকিংয়ে হাঁটতে হয়।
—— তাও তো এক ধরনের বেড়ানো।
—— তা বলতে পারেন তবে।
—— সেটাই তো বলছি।
ব্যানার্জি চুপ করে যায়। সে মাস্ক পরে নেয়। তার নাক দেখা যায় না। মুখের
অনেকটাই ঢাকা। আমিও মাস্ক পরে নিই। দুজনে যেতে থাকি ম্যাডামের ঘরে। ছুটিতে বেড়ানোর
অনুমতি নিতে। লিফট এলে ব্যানার্জিকে ডাকি। ব্যানার্জি ছুটে আসে। আমি লিফটটা থামিয়ে
রাখি। ব্যানার্জি আর আমি উঠে পড়ি। লিফট ওপরের দিকে না উঠে তলার দিকে নামতে শুরু করে।
একটা একটা করে তলায় লিফট থেমে থেমে যেতে থাকে। প্রতিটা তলায় লিফট দাঁড়ায় আর লোক তোলে।
ব্যানার্জি বলে , “ব্যাপারটা কেমন হল?”
—— কী?
—— ম্যাডামের ঘর তো ওপরে।
—— তাতে?
—— লিফট তো নামছে তলায়?
—— তাতে কী?
—— তা হলে আমরা যাচ্ছি কোথায়?
—— তলায়।
—— তলায় কেন? আমাদের তো ওপরে যাওয়ার কথা!
—— তলা থেকে লিফট আবার ওপরে উঠতে শুরু করবে।
—— ব্যাপারটা তেমন কি?
—— তেমনই।
হয়ও তাই, লিফট তলা অবধি নেমে আবার ওপরে ওঠে। এবারও প্রতিটা তলা থেকে লোক ওঠে, লিফট থামে, আবার চলতে শুরু করে। ম্যাডামের
ঘরে পৌঁছতে অনেকটা হাঁটতে হয়। ব্যানার্জি জোরে জোরে হাঁটে, আমি ওর সঙ্গে পেরে উঠি না,
বলি, “অত তাড়া করবেন না।” ব্যানার্জি হাঁটা আস্তে করে দেয়। আমরা দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে থাকি। সবাই আমাদের দেখে সরে সরে
যায়। কেউ কেউ নমস্কার করে। চেয়ারে বসে থাকলে
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারা আমাদের বস্ মনে করে। বস্-কে আমরা বস্ মনে করি। বস্ আমাদের
বস্ মনে করে না। বস্ সাধারণ গ্র্যাজুয়েট। আমি সাধারণ গ্র্যাজুয়েট। এর মধ্যে কোথা থেকে
ব্যানার্জি জুটে পড়েছে। সে ইঞ্জিনিয়র। অন্য একটা দপ্তর থেকে আমাদের এখানে কাজ করতে
এসেছে।
আবার চলে যাবে কবে, কে জানে! আমি বলি, “আপনার আর এখানে কদ্দিন?” ব্যানার্জি
হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দেয় না। আমি আবার জিজ্ঞেস করি, “আপনার এখানে আর কদ্দিন?” ব্যানার্জি হাঁটা না থামিয়ে উত্তর
দেয়, “দেখা যাক কদ্দিন রাখে!” আমি বলি, “আবার আপনার জায়গায় কাকে দেবে কে জানে! সেও
কি যাদবপুরের হবে?” ব্যানার্জি উত্তর দেয় না। এর মধ্যে ম্যাডামের ঘর এসে যায়। বিশাল
ঘর। দরজা খোলা। ম্যাডামের চেম্বারের বাইরে পিএয়ের অফিস। অফিসে পিএ নেই। কেউ নেই। লিফটের
সামনে সিকিউরিটি দাঁড়িয়ে আছে, তাকে জিজ্ঞেস করি, “ম্যাডাম আছেন তো?” সে বলল, “হ্যাঁ,
আছেন।” আমরা দুজনে ঘরে ঢুকে পড়ি। একটা চেয়ারে ম্যাডামের ব্যাগটা পড়ে আছে। টেবিলে ফাইল
পড়ে আছে, অনেকগুলো চেয়ার, সব ফাঁকা পড়ে আছে। সেন্ট্রাল এসি ছাড়াও পাখা চলছে। ম্যাডামের বড়সড় চেয়ারটাও ফাঁকা। ব্যানার্জি আমাকে
ফিসফাস করে, “ম্যাডাম কোথায়?” আমি ভালো করে দেখি - সত্যিই ম্যাডাম নেই তো! তারপর বললাম,
“নিশ্চয়ই টয়লেটে গেছেন।”
—— টয়লেটে?
—— হ্যাঁ।
—— কিন্তু ব্যাগটা?
—— যেতেই পারেন।
—— কোথায়?
—— টয়লেটে যেতে পারেন না?
—— তা পারেন। তবে ব্যাগটা তো রয়েছে।
—— উনি কি ব্যাগ নিয়ে টয়লেটে যাবেন!
—— তা ঠিক। নাও যেতে পারেন।
—— চলুন বসি।
—— কোথায়?
—— বাইরে।
—— বাইরে?
—— হ্যাঁ।
আমরা ম্যাডামের চেম্বার লাগোয়া পিএয়ের ঘরে বসে বসে অপেক্ষা করছি। ছুটিতে
বাইরে যাবার অনুমতি চাওয়ার চিঠিটা দেখতে থাকি। কোন ভুল-টুল আছে কিনা দেখে নিতে থাকি।
ব্যানার্জিকে বলি, “দেখে নিন!”
—— কী?
—— অনুমতির চিঠিটা।
—— কেন?
—— যদি ভুল থাকে!
—— দেখে নিয়েছি।
—— তবু দেখুন!
আমারা দুজনে নিজেদের লেখা চিঠি দুটো বারবার পড়ে নিশ্চিত হয়ে নিই। আমি
একটা ছোট ভুল বের করি, তারপর ব্যানার্জিকে বলি, “আমি কিন্তু একটা ভুল বের করেছি।” ব্যানার্জি
বলে, “আমিও।” আমরা ছোটখাট সব ভুল সংশোধন করে আবার চিঠি দুটো পড়ছিলাম। বার কয়েক পড়ার
পর ব্যানার্জি আমাকে বলে, “ঘরের ভেতরটা দেখলে হয় না?”
—— আপনি দেখুন।
—— আমি?
—— হ্যাঁ।
—— আচ্ছা।
ব্যানার্জি উঁকি দেয়। তার পেছন পেছন আমিও। কেউ নেই। ব্যাগটা চেয়ারে
পড়ে আছে। ম্যাডামের পেল্লায় চেয়ারটা খালি। অনেকগুলো চেয়ার সব খালি পড়ে আছে। আমি বলি,
“টয়লেট সারতে এতক্ষণ!” ব্যানার্জি বলে, “টয়লেটে গেছেন তো?” আমরা আবার লিফটের সামনে
দাঁড়ানো সিকিউরিটিকে জিজ্ঞেস করি। সে বলে ম্যাডাম ঘরেই আছে। আমরা আবার যাই - ম্যাডামকে
দেখতে পাই না। আবার সিকিউরিটির কাছে যাই, লিফটের কাছে, কিন্তু কোন কথা বলি না। কিছু
জিজ্ঞেস করি না। ম্যাডামের আসার শব্দ শোনার
জন্য পিএয়ের ঘরে কান খাড়া করে বসে থাকি। সময় কাটে কিনা বুঝতে পারি না। হয়ত কাটে, হয়ত
কাটে না। হাতঘড়ির দিকে তাকাতে গিয়ে মনে পড়ে যায় অনেকদিন ঘড়ি পরি না। মোবাইল খুঁজতে
গিয়ে দেখি কোথায় ফেলে এসেছি। ব্যানার্জিকে বলি, “একটা ফোন করুন তো!” ব্যানার্জি ফোন
করে বলে, “বাজছে।” আমি ওর ফোনটা নিয়ে শুনি ওটা বেজেই চলেছে। বেজেই চলেছে। এইভাবে বুঝতে
পারি সময় কাটছে। সময় কেটে যেতে থাকে। আমি বলি, “মোবাইলটা কেউ তুলছে না কেন?” ব্যানার্জি
বলে, “ওটা আপনার চেম্বারেই পড়ে আছে। তুলবে কে?”
—— অন্য কোথাও পড়ে যায়নি তো?
—— না না, তা হবে কেন?
—— হলে?
—— না না, আপনার ঘরেই আছে।
—— কোথায় ফেললাম কে জানে! একটু জল খাই।
এইভাবে দুজনে ভুলে যেতে থাকি
ম্যাডামের ঘরে আমরা কেন এসেছি। দুজনে জল খাই। জল খেতে গিয়ে ব্যানার্জি খানিকটা জল উল্টে ফেলে। আমি বলি, “এটা কী করলেন? দিলেন তো
কার্পেটটা ভিজিয়ে!”
—— কার্পেট কোথায় পেলেন!
—— তবে?
—— আগে কার্পেট ছিল, এখন নেই।
—— ও।
এই সময় ম্যাডাম বাইরে থেকে চেম্বারে ঢুকতে গিয়ে আমাদের দেখতে পায়,
বলে, “তোমরা কখন এলে? সার্ভার রুমে গিয়েছিলাম। ভেতরে এসো।” ম্যাডাম হেঁটে যেতে গিয়ে
জলের ওপর দিয়েই যেতে থাকে। একদিন কার্পেট ছিল, এখন এমন টাইলস্ বসানো যে জলের ওপর দিয়ে
হেঁটে গেলেও বোঝা যাবে না। ম্যাডামও বোঝে না জল পড়ে গেছে। পেছন পেছন আমরা ঢুকি অভ্যাসবশত
পা টিপে টিপে। কেউই পেছলাই না। আমরা ভেতরে গেলে আরাম করে চেয়ারে বসে ম্যাডাম বলে,
“বলো।”
—— ছুটিতে বেড়ানোর জন্য আপনার কাছে এসেছিলাম।
—— এই ব্যাপার, ছুটিতে বেড়াতে যাবে যাও। আমিও তো যাচ্ছি।
এই বলে ম্যাডাম সই করে দেয়। আমি ব্যানার্জিকে বলি, “আপনারটা দিন।”
ব্যানার্জি বলে, “এই একটু ট্রেকিং আর কী!”
—— ট্রেকিং?
—— ছুটিতে যাব আর কী!
—— তাই বল, বেড়াতে যাবে।
—— না না, ট্রেকিং।
ম্যাডাম সই করে দেয়। আমি ব্যানার্জির দিকে তাকাই। যদিও মাস্ক পরা,
আমি স্পষ্ট ওর নাক দেখতে পাচ্ছিলাম। বেশ খাড়া অথচ ভোঁতা, তার ওপর লম্বা। দেখতে পেয়েও
আমার অন্যবারের মতো এবারও কিছুই মনে হয় না। ব্যানার্জিও আমার দিকে তাকিয়েছিল। তারও
আমাকে দেখে কিছু মনে হয় বলে মনে হচ্ছিল না। এর কারণ হল আমরা দুজনেই সেদিন ছুটিতে বেড়াতে
যাবার অনুমতি নিয়ে এসেছিলাম ম্যাডামের কাছ থেকে।
টান টান মেদহীন গল্প। শেষটুকু বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার মতো।
উত্তরমুছুনআমাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন বটে, তবে বড় ভালো লিখেছেন
উত্তরমুছুন