দক্ষিণ ও দর্শন
চেন্নাই শহরটার যেন মেট্রো হয়ে উঠতে ভয়ানক আপত্তি। যেই না একটু ফাঁক পেয়েছে অমনি নানান ছলছুতোয় ফিরে গেছে পুরনো বাড়ির রোয়াকে। বড় রাস্তা ছেড়ে ডাইনে বাঁয়ে এদিক ওদিক একটু বেঁকেছ কি অমনি পাড়ার মোড়, মধ্যবিত্ত গলি, ছোটছোট দোকানপাট, জিরিয়ে গড়িয়ে ঘরগেরস্থালি সামলানো দুপুরের অবসরের মতো দিন। করপোরেটের ভাষায় বললে বলতে হবে "চেন্নাই ইস প্রেটি লেইড ব্যাক"। যাও তুমি দিল্লি কিম্বা মুম্বাই, নাকে দড়ি দিয়ে দৌড় করাবে জীবন। আমার তো নিদেন পক্ষে কলকাতায় গেলেই কেমন ভয়ভয় লাগে, এই বুঝি পিছলে গেল মাটি! এই বুঝি হারিয়ে গেলাম ভুল রাস্তায়। চেনা বিন্ডিং পার হয়ে যাই বারবার, তবু চোখে ঠাওর হয় না।
এখানে অবশ্য তেমন হওয়ার জো নেই। হাই রাইজ ব্যাপারটা এখনো পাত্তা পায়নি সেভাবে। আশপাশে দুয়েকটা একলাসুটি বড় বিল্ডিং চোখ এড়িয়ে পালানোর পথ পায় না। কোন এক সাবেকি বাজারের ভেতর পায়ে হেঁটে যাও, বেল জুঁই স্বর্ণচাঁপা গন্ধগুলো তোমার সাথে বন্ধুত্ব করে ফেলবে ঠিক। দুপা যেতে না যেতেই ঠিক দেখা হয়ে যাবে ওদের সাথে, ওরা ঠিক ডেকে নেবে কোন এক আম্মার ঝুড়ির সামনে। ঝুড়ির ভেতর নানান ফুলের মালা। জুঁইয়ের গন্ধটা নেশা ধরালে একটা জুঁই ফুলের মালা কিনে তখুনি চুলে লাগাতে ইচ্ছে হবে খুব। এর সাথে রঙ্গনের মালাটা জুড়ে ফেললেই দারুণ খোলতাই হবে সাজ। ইচ্ছে হবে উল্টোদিকের রাস্তায় দাঁড়ানো অটোর সাইড ভিউয়ারে একটিবার নিজেকে ঝালিয়ে নিতে। আর ঠিক তখনই সবার চোখের আড়ালে কারোর গাইতে ইচ্ছে হবে খুব "কাজরা লাগাকে গজরা সাজাকে বিজুরি গিরাকে যাইও না..."
নাহ্, সে গান শোনার জন্য সেখানে দাঁড়িয়ে পড়লে চলবে না। এগিয়ে যেতে হবে সোওজা । দুপাশের বিরিয়ানির খুশবু, কুলফি মালাইয়ের পিছুটান, মশলা চায়ের হাতছানি, মেদু বড়া'র নস্টালজিয়াকে পেছনের বেঞ্চে বসিয়ে রেখে ফুলেল রাস্তাটা ধরে চলে যেতে হবে যতদূর চোখ যায়। একসময় চোখ আটকাবে গোপুরমে। রাম সীতা হনুমান বিভীষণ নানান পোজে,পশ্চারে থাকে থাকে থেমে থাকবে গোপুরমের গায়ে; আর মন্দিরের গার্ড ঢোকার মুখে ধমক লাগাবে কষে... "স্যান্ডাল ভেলিলে পোটে ওয়াঙ্গে ম্যাডাম!"
উঁহু, শুধু চটি বাইরে খুলে এলেই হবে না, ওই যে ফুল তুলসী নিয়ে বসা আকা তোমার দিকে চেয়ে মুচকি হাসল, আর ভাঙা ভাঙা তামিল জানো শুনে এক্কেবারে পিঁড়ি পেতে দিল তার কাছে একটু ফুল তুলসী নিতেই হবে। বাহ্ রে, পুজো দিতে হবে না! এবার সেসব নিয়ে মন্দিরের মস্ত পেল্লাই দরজার গায়ে ভেবলে গিয়ে তাকাতে তাকাতে মন্দিরে ঢুকে পড়লেই দয়াধ্বজম কানে কানে ফিসফিস করে বলবে "সাবধানে যাও বাপু, এ মন্দিরের বয়স জানো তো? যীশুর জন্মের ঠিক ছশ বছরের মাথায় পল্লব রাজারা শুরু করেছিল এই মন্দির। "
শুনেটুনে ঢোঁক গিলে ফেলার আগেই ওপাশের মহামন্ডপম হেঁকে বলবে, "শোনো হে, তারপর চোল আর তারও পরে বিজয়নগরের রাজারা জুড়ে দিয়েছে এই মন্দিরের গায়ে গায়ে পিলার, মন্ডপ, বাগান আরও কত কী!"
পল্লব, চোল, বিজয়নগরের কথা শুনতে শুনতে মন্দিরের অন্ধকার মন্ডপ ধরে ভেতর এগিয়ে যাওয়াই দস্তুর। কিন্তু ওইখানে, ঠিক ওই উত্তর পূর্ব কোণটায় খানিক থামতেই হবে। ফুট ছয়েক জায়গা ঘিরে পদ্মলতার কোলাম। দেখে বাংলার সুখী গেরস্থের কথা মনে পড়বে খুব, মনে পড়বে চৈ চৈ হাঁসের পুকুর আর ছলছল সবজে ঢেউয়ের কথা, জল সইতে যাওয়া বউটির ঘোমটার হাসি আর মন খুঁজবে বং কানেকশন। আমাদের বিবেকানন্দ এক চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন তাঁর এক শিষ্যকে, এই মন্দিরে এসে পুজোঅর্চনা করার। মন্দিরে রাখা সেই চিঠির কপি দেখলেই বং কানেকশন কনফার্মড।
বাঙালি জাতটাই এমন পত্রে পল্লবে ছড়িয়ে আছে যে যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই , পাইলেও পাইতে বাঙালি রতন। বাঙালি হওয়ার সুবাদে নিজেকে এইমুহূর্তে রতন, মণিমুক্তো কিছুই ভাবা চলবে না। সামনে রেলিং দেওয়া লাইন বেয়ে ঢুকে পড়তে হবে মন্দিরের গর্ভগৃহে। দুয়েকজন মহিলার সাথে আলাপ হবে, হতেই হবে। আর ঠিক তখনই মুখজোড়া গোঁফ নিয়ে কটমট করে তাকিয়ে থাকবেন পেরুমল পার্থসারথি। কৃষ্ণের মুখে গোঁফ আঁকে কোন মূর্তিকার সেকথা ভাবতে ভাবতেই দরশনের সময় শেষ, তুমি নিজেকে খুঁজে পাবে লাইনের বাইরে।
"কপালে একটা টিপ পরালে তুমি কি খুব রাগ করবে?" রাগ করতে নেই। এমন প্রশ্নে একটুও রাগ করতে নেই। ওই যে খানিক আগে আলাপ হল সেই মহিলাটি এসে দাঁড়িয়েছেন পাশে। ফোনের কভারের ভেতর থেকে ছোট্ট টিপ খুলে কপালে পরাচ্ছেন যখন তখন কি একবার মনে হবে না কার টিপ, চামড়া কেমন ইত্যাদি? উঁহু ভালোবাসার এই ছোঁয়ার নাম গুড টাচ। এখন এসব মনে করতে নেই। টিপ পরিয়ে উনি যখন হেসে বলবেন, “যাও তো, মুখটা এবার দেখো দেখি”... এক নিমেষে বেহুলার কথা মনে পড়ে যাবে। কেন পড়বে সে বড় জটিল প্রশ্ন। কেউ কেউ বেহুলার জন্মসূত্র দক্ষিণে খুঁজেছেন। দক্ষিণের মন্দিরে মন্দিরে দেবসভা, দেবদাসী। ক্ষেমানন্দ তো বারবার লিখেছেন "বেহুলা নাচনী"।
"ঝাঁপ দিয়া জলে পড়ে বেহুলা
নাচনী
মনসার গায়ে লাগে গোড়ালির পানি"।
পাল যুগে যখন প্রথম মনসা মূর্তি পাওয়া গেল বাংলায় তার আগেই মন এ মঞ্চাম্মা সর্পদেবী হয়ে পুজো পাচ্ছেন দক্ষিণে। বেহুলার সাথে তার আগেভাগেই আলাপ পরিচয় থাকতে পারে না? পারে হয়ত, কিম্বা পারে না। তবে তামিল আর বাঙালির জুড়ে যাওয়া তাতে আটকায় না মোটে।
কপালের টিপ কেমন মুখ পাল্টে দিল তখুনি তা দেখা না হোক, ভারী ইচ্ছে হবে ধনেখালি তাঁতের খোলতাই পাড়, মিহিন আঁচল উড়িয়ে এককোণে এসে দাঁড়াতে। আমারও হল। থাইয়ার আসছেন দোলায় চড়ে, রাজবেশে। মাথায় তাঁর মস্ত ছাতা, মৃদঙ্গম বাজছে, বাজছে সানাই। ওই যে কোলাম আঁকা দিকে দিকে, তারই একটায় এসে বসবেন স্বর্গের দেবতা। তোমার কপালে যে বেহুলার অক্ষয় টিপ, চোখে কেয়াপাতার কাজল, চুলে পারিজাত ফুল। দেবসভার আল্পনায় নাচের আসর। এই কোলাম, এই দক্ষিণী আলপনার চলন মনে করাবে যক্ষপুরীর সদর দুয়ার – মনে করাবে নন্দদুলাল বসুর আল্পনার মতো ছবির কথা, কিম্বা আলপনার চলনে সুকুমারী দেবীর পেলব টানের কথা। আল্পনায় পদ্ম ফুলের মোটিফ নাকি বৌদ্ধ ধর্মের ছাপ। এই কোলামের অতলে মিশে মিশে যাওয়া দক্ষিণ, পূর্বের লোককথা উপকথার স্রোতে ভাসা মঙ্গলকাব্যের ডিঙা, আর তাতে বিলকুল বয়ে যাওয়া একলা মেয়েটি তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে, দাঁড়িয়েই থাকবে রঙ্গমন্ডপের ফাঁকা সিঁড়িটার ধাপে। রোদ পড়ে আসবে। রোদের রঙ তখন দেবতার কপালের সোনার টিপের মতো হলুদ।
ঘোর ভেঙে যাবে শিঙার আওয়াজে । থেনকালাই আর ভাদকালাই আয়েঙ্গাররা পুরনো ঝগড়া ভুলে দাঁড়িয়েছে জোড় হাতে। মালগুডি ডে'জ এর মতো ধুতির প্যাঁচের ওপর ঘের দেওয়া শাড়ি পরে মহিলারা এসেছে চুলের মালাটি দুলিয়ে। কারোর বা খোঁপাটিতে লাল দোপাটি না থাক, গোলাপ আছে লাল। কপালে কুমকুম চন্দনের দাগ। বয়সের রং এখানে সাদা নয়, গাঢ় উজ্জ্বল।
তিরুপতি বা পদ্মনাভনের মন্দিরের মতো কমার্শিয়ালাইজড হয়ে চরিত্র হারায়নি আপাত অখ্যাত এই পেরুমল মন্দির। ছড়িয়ে ছিটিয়ে মানুষগুলো বসে থাকে ঘর গেরস্তি সামলে, সুখ দুঃখের গল্প করে, ঠেলাঠেলি নেই, ঝাঁপিয়ে পড়ে পুণ্য জমানোর তাড়া নেই, ঠিক যেন গাঁয়ের সেই রাসমঞ্চ আর তার গায়ে আচার বড়ির রোদ সেঁকতে আসা ঠাকুমা দিদিমা মাসি পিসিদের দল। মন্দিরের গায়ে সনাতন দক্ষিণী গন্ধ। দেওয়াল, থাম, গর্ভগৃহের কালো হয়ে আসা সময়ের ছাপে কার আঙুলের দাগ কে জানে! হয়ত কোন পল্লব রাজা রানী, কোন চোল রাজপুত্তুর কিম্বা বিজয়নগরের কোন রাজপুরুষের উত্তরীয়খানি উড়ে এসে পড়েছিল দেবতার পায়ের তলে, আর শনশন বয়ে গেল সমুদ্দুরের মন্দিরের কোণে কোণে। সে হাওয়া গিয়ে সেঁধোল মন্দিরের গার্ড নাগরাজনের আস্তিনে।
নাগরাজনের মেজাজখানা রাজসিক। বেচারীর গোঁফ চুল দাড়ি কিচ্ছুটি নেই। নইলে অ্যাইসান পাগড়ী সাঁটাতো যে তুমি বাছাধন দশটা স্যালুট না ঠুকে যেতে কোথায়! পেরুমল দর্শনের পুণ্যের জোরে গার্ডও সদয় হয়ে যায় কোন কোন দিন। মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে, "কেমন দেখলেন?"
ওই মোহন হাসি দেখলেই বলতে ইচ্ছে করবে, "রম্বু নাল্লা পাতিটা"... কিন্তু সেন্টেন্সটা ঠিক কিনা সে সন্দেহ থাকলে বরং থাক, আর উচ্চারণের দরকার নেই। বরং নাগরাজন হিন্দিতে শুধোলে তাকে জিজ্ঞেস করা ভালো কোন দেশ হতে বয়ে এলো তব বাণী?
নাগরাজন হাসবে। হাসতে হাসতে মুম্বাই গুজরাট আর নানান দেশের কথা বলবে। বলতে বলতে ওর খুব ইচ্ছে হবে গোঁফজোড়া একবার পাকিয়ে নিতে। পারবে না।
মন্দিরের উঁচু বিমানটায় রাজ্যের কাক উড়ে এসে জুড়ে বসবে সেসময়। রামানুজনের গল্প করবে ওরা আর সন্ধ্যা নেমে আসবে মন্দিরের দরজায়।
বাড়ি ফিরতে হবে না?
অটোটা তাড়া দেবে খুব...
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন