কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩১ |
সাগরতীরের ঘর-দুয়ার
ম্যাঙ্গালোরের দিকের সমুদ্র আমার তেমন ভালো লাগে না। পাটকিলে ধরনের ধূধূ সমুদ্র, নীল জলরাশি-ফাসি কিস্যু নেই। ঢেউই বা কোথায়? এক-আধটু ছলাৎ ছলাৎ করছে, ব্যাস। তার সঙ্গে চিটচিটে গরম। সমুদ্রের হাওয়া খেতে বিকেলে বালুতটের দিকে এসেছিলাম।
বাবা-মার সঙ্গে আসা কটা বালকবালিকা যাদের নানাভাবে লোভ দেখাচ্ছে এক বেলুনওয়ালা, জলের কাছ বরাবর কয়েক জোড়া ঘন হয়ে বসা প্রেমিক-প্রেমিকা – সাগরতীরের এসব সাধারণ দৃশ্যের মধ্যে অন্য একটা জিনিস নজরে পড়ল। বালির ওপর পাতলা কাঠের মানে প্লাই উডের একটা পার্টিশন মতো। গোটা পনেরো ফুট উঁচু আর বহরে ফুট বিশেক। প্লাই উডের পার্টিশনে চার বাই দশ মতো একটা দরজা কাটা রয়েছে। দরজার এদিকে বা ওদিকে অবশ্য কিছুই নেই। কে এটাকে খাড়া করল! কারণটাই বা কী?
বালি যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে মাছভাজা আর বিয়ারের ছোট্ট একটা দোকান। ধূসর নিস্তরঙ্গ সাগরের একঘেঁয়েমি কাটাতে একটা ঠাণ্ডা বোতল নিয়ে সেখানে বসে পড়লাম। সমুদ্র ঢেউহীন নিস্তেজ হলে কী হবে, এদিকের বিয়ারে বেশ তেজ। আধ-বোতল শেষ হতে না হতেই একটা ঝিমঝিমে ‘সিদ্ধিপ্রাপ্ত’ ভাব এসে গেল। চোখের দেখা ছাপিয়ে আরও কিছু যেন টের পাচ্ছিলাম।
প্রথমেই বুঝলাম সমুদ্র দুরকম। এক হলো আকাশ অবধি ছড়ানো ধূসর সীমাহীন জলরাশি। আর এক রূপ বোঝা যায় ওই দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলে। এখানে সাগর একটা চৌকো সীমানার ভেতর আটকা পড়েছে। যেন ফ্রেমে বাঁধা ছবি। একটা মাছধরা ট্রলার যাচ্ছিল – মনে হলো ছবির একদিক দিয়ে এসে অন্যদিক দিয়ে ধীরে প্রস্থান করল। একঝাঁক পাখি ছবির কোণ ধরে ঢুকল আর কয়েক মুহূর্ত পাখা ঝাপটিয়ে মিলিয়ে গেল। দরজার চৌখুপি দিয়ে সমুদ্র অতটা খাঁখাঁ করছে না। সুন্দর লাগছে।
সন্ধের মুখে প্লাই-উডের দেওয়ালে চিকিমিকি আলো জ্বলে উঠল। ওহো, এই ব্যাপার! বুঝলাম এতক্ষণে। বিয়ের আগে আজকাল ফটো-সেশন হয়, এটাকে পশ্চাৎ-পট রেখে তাই হতে যাচ্ছে। মজে গেলাম, আর একটা বিয়ার নিতেই হলো।
স্যুট, বো-টাই পরা ছেলে, আর হবু বৌ পরেছে ফ্রক আর টপ। নানান ভঙ্গিতে ছবি উঠছে … ছেলেটা দেখলাম বারবার পটের বাইরে নিয়ে যেতে চাইছিল মেয়েটিকে। মেয়েটির অবশ্য ভেতরই পছন্দ, ফটো-ওয়ালও তাইই চাইছিল। ওরে ছেলে, থাক না বাবা দরজার কাছে। আগেপিছে কিছু নেই, মাঝে শুধু ভাগ্যের জোরে একটা দরজা-কাটা দেওয়ালের আড়াল পেয়েছিস তোরা। তাতে দ্যাখ কী সুন্দর সুখীসুখী মেজাজের ছোট ছোট আলো।
খালি বোতলটা ঠক করে টেবিলে রেখে মনে মনে বললাম – অনেক শুভেচ্ছা, অনেক আশীর্বাদ রইলো রে তোদের জন্য! তোদের একটা ঘর হোক, সারাজীবন ঘরের মজায় মজে থাকিস তোরা। ও ছেলে, তোর দেখছি বড় বাইরের টান। আজকালকার চালু কথা ‘স্কাই ইস দ্য লিমিট’ – ওসবে কান দিসনে। দরজার ফোকরটুকু দিয়েই বাইরেটা দ্যাখ – এত বড় সমুদ্রও কেমন বাঁধা পড়েছে দরজার মায়ায়। ওসব অসীম-অনন্ত কবিতা-গানেই মানায় রে! মানুষের আসলে কী চাই জানিস – একটা ঘর, ব্যাস, শুধু একটা ঘর।
খুব সুন্দর লেখা। পড়ে ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন