কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৫

প্রশান্ত গুহমজুমদার

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩১


ফ্রেম

 

ভানুবাবুকে ফ্রেমে প্রথম দেখি এক দুপুরে। দূর থেকে, একা, ছোট্টখাট্টো, ঝুঁকে ঝুঁকে।

তার বেশ কিছুদিন পর।

-লোকটাকে চিনিস?

-কোন্‌ লোক!

-ঐ যে ঝুল পাঞ্জাবী, খুব রোগা, থেমে থেমে হাঁটছে।

-আরে কী লোক লোক করছিস! জানিস কোন্ বংশের ছেলে উনি? 

-না।

-ঐ হরিতলার ওপাশে যে ভাঙা প্রাসাদমত বাড়িটা আছে, ওই বাড়ির ছেলে উনি। আজ সত্যিই ওর কিছু নেই। উনি নিজেও একটা ফ্ল্যাটের গার্ড। কিন্তু যেটা আছে, তা ওনার বেহালা। এক রাত্রে তোকে নিয়ে যাবো ওই বাড়িতে। একটা ভাঙা ঘরে উনি থাকেন। সে সময়টাই ওর সময়। এক বোতল বাংলা, একটা লন্ঠন, একটা কালো কুকুর, বেহালা আর উনি।

আমাদের ভানুবাবু। ভণেন্দ্র নারায়ণ স্যান্যাল। একদা বর্ধিষ্ণু পরিবার, এখন একা একটা মানুষ। এই পৃথিবীতে তাঁর থাকা, না-থাকা একটা হলুদ পাতার মতন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে এই শহরের নতুন মানুষদের অনেক  কৌতূহল। কখনও নতুন বৌদের মধ্যে, কখনও সদ্য-আগত চাকুরেদের। তাঁর কোনো হেলদোল নেই। এই শহরে তিনি যেন একাই মানুষ। আর সব অবান্তর। সাড়ে তিন হাজারের গার্ডের চাকরি, একটা বেহালা, একটা কালো কুকুর। এই তাঁর পৃথিবী।

তাঁর ছেড়ে যাওয়া বৌ নতুন হয়ে ফিরে এলেন। কেন, তিনিই বলতে পারবেন। সে ছিল ঘন বর্ষার এক রাত্রি। খুব চেঁচামেচি, কুকুরের ডাক, কান্নাকাটি শোনা গেল তাঁর আবাস থেকে। সকালে হলুদ পেটিকোট, বাহারি  ব্রা-ব্লাউজ, ভেজা শাড়িতে ব্যাপারটা নিশ্চিত হ’ল।

ভানুবাবু এলাকায় আলোচনার বিষয় হয়ে উঠলেন।

আবার অন্যদিন। এবার ফ্রেমে দুটি বৌ। দোতলার ব্যালকনিতে।

-হ্যাঁরে, ঐ মানুষটা রোজ একই সময়ে দিনে দু’বার এদিক দিয়ে কোথায় যায়, বল্‌ তো?

-কোন মানুষটা!

-আরে ঐ যে টাকমাথা, লম্বা ঝুলের রঙিন পাঞ্জাবী, পকেটে হাত, একটু কুঁজো হয়ে হাঁটছেন?

-ও। উনি তো ভানুদা! দুবেলা একই সময়ে চা খেতে যান। খুব ভালো লোক।

-ভালো মানে!

-মানে ওই আর কি। নির্বিরোধী। গার্ডের ডিউটি আর নিজের মধ্যে থাকা। এক সময়ে ওনার পরিবারের খুব বোলবোলাও ছিল এই শহরে।

ফ্রেম বদলে যায়। এবার বিকেল।

-ভেনো! এই পাগ্‌লা, কই তোর ঝোলা?

-তোর বাবা পাগ্‌লা। তোর চোদ্দোগুষ্টি পাগ্‌লা।

ভানু বড়ো কষ্টে একটা পাথর তুলে নেন। মেঘলা আকাশ কৌতূহলে খুব দ্রুত নেমে আসেন নিচে। ছেলেগুলো দৌড় দেয়। পাথরটা পায়ের কাছে ফেলে আবার হাঁটতে থাকেন। কোনো তাড়া নেই।

রাত্রি। অন্ধকার। ভানুবাবুর ঘর। শুধু বেহালার কান্না।

সুরধনী আবাসন। গার্ডের চেয়ারে ভানুবাবুকে এক সকালে দেখতে পাওয়া গেল না। নানানভাবে খোঁজ, কিন্তু কোন পাত্তা নেই। জিডি করা হ’ল।

মন্টুর চায়ের দোকান। পরিতোষ এক সন্ধ্যায় জানাচ্ছে, বাঁধের ওপাশের বস্তিতে ভানুবাবুকে দেখেছে।

মহানন্দার চরে এক ভোর। ভানুবাবু শুয়ে আছেন। বালির মধ্যে মুখ। ফ্রেম জুড়ে কুয়াশা, সাদা চরাচর। ওপাড় থেকে আসা কাজের মেয়ে তাঁকে দেখছে, বিষণ্ণ। ছড়ানো আঙুলের পাশে তাঁর ছড়। পাশেই বেহালা। পরিচিত কুকুরটা এখানেও বসে আছে। অপেক্ষায়।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন