কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৫

অভিজিৎ মিত্র

সিনেমার পৃথিবী – ৪১


 

২০২৪ পুরনো হয়ে শেষ হয়ে গেল। নতুন বছর জানুয়ারী মেলে ধরেছে। পুরনো এই ধারাবাহিকও আজ এখানেই শেষ। সেই ২০২০-র কোভিড আচ্ছন্ন গরমের ছুটিতে এই লেখা শুরু করেছিলাম, কাজলদা চেয়েছিলেন কোভিডের ওপর সিরিয়াস একটা লেখা, আমি চেয়েছিলাম কোভিডের মত ভাইরাস নিয়ে যে কয়েকটা সিরিয়াস বিদেশি সিনেমা হয়েছে, সেগুলোর মোটামুটি একটা পর্যালোচনা পাঠকের সামনে তুলে ধরতে। ফলে ‘আউটব্রেক’ (১৯৯৫) ও ‘কন্টাজিয়ন’ (২০১১)। সেই লঘুচালে শুরু করার পর ৫ নম্বর পর্বে কোরিয়া নিয়ে আলোচনা শেষে মনে হয়েছিল লেখাটা সিরিয়াসলি অনেকদূর এগোনো যায়, যেহেতু ক্যামেরার পেছনে চোখ রাখা আর সিনেমা দেখা আমার ভাললাগার সাবজেক্ট। ফলে এতদিন দীর্ঘ ৪০ পর্বে সিনেমায় পৃথিবীর পঞ্চভূত নিয়ে বিভিন্ন রকম আলোচনা করেছি। সিনেমার আগা-ল্যাজা কেটে প্রচুর কচকচি। ক্লাসিক-কনটেম্পোরারি, ভাল-খারাপ, সুস্বাদু-অখাদ্য, লাইট-ক্যামেরা-সাউন্ড-অ্যাকশন, শট-সিনেমাটোগ্রাফি-কাট, পুরস্কারের যোগ্য-অযোগ্য, এইসব সাত-সতেরো নিয়ে সমালোচকদের নানা মত এবং সেসব ছবি দেখে আমার নিজের অনুভূতি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কোন্‌ কোন্‌ সিনেমা একদম শুরুর দিকে রয়েছে। এইসব ছবি থেকে কি কি শিক্ষনীয়। তার থেকেও বড় কথা, দেখতে দেখতে আগের ৪০ পর্বে ২০০-র বেশি ছবি নিয়ে আলোচনা, পৃথিবীর ৬টা মহাদেশের অন্তত ২৫টা দেশের সিনেমা, অন্তত ৫০ জন জীবিত-মৃত নায়ক নায়িকাদের নিয়ে মশলা মাখা, প্রায় ৫০ জন পরিচালকের ছবি নিয়ে আগাপাশতলা এবং ১৫ জন ক্যামেরাম্যানের সিনেমাটোগ্রাফির ওপর ছুরি-কাঁচি। আমার মত এক কবিতা/ছোটগল্প লেখকের হাত দিয়ে এই দীর্ঘ লেখা বের করে নেওয়ার সিংহভাগ ক্রেডিট কাজলদার। এবং আজ শেষবেলায় শেষ করব আবারো ‘আমার’ পছন্দ দিয়ে। তাহলে শেষের কবিতা শুরু করি?

দেখুন, আমাকে যদি সিনেমার একশ কুড়ি-পঁচিশ বছরের ইতিহাস ঘেঁটে বলতে বলা হয় আমার চোখে সেরা তিন, তাহলে গ্রিফিথের ‘দ্য বার্থ অব আ নেশন’ (১৯১৫) বলুন আর দাদাসাহেব ফালকের ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ (১৯১৩) বলুন, যেখান থেকেই হাঁটতে শুরু করি, আমার চয়েসঃ ১) টেকনিকাল প্রতিভার জন্য অরসন ওয়েলেসের ‘সিটিজেন কেন’ (১৯৪১), ২) শুধুমাত্র থিম, স্টাইল ও মনস্তাত্তিক ফিলোজফির জন্য ইংমার বার্গম্যানের ‘সেভেন্থ সিল’ (১৯৫৭), এবং ৩) দুর্দান্ত থিম ও সিনেমাটোগ্রাফির জন্য স্ট্যানলি কিউব্রিকের ‘2001: এ স্পেস ওডেসি’ (১৯৬৮)। খুব কাছাকাছি রাখব ফ্লেমিং-এর ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ (১৯৩৯) শুধুমাত্র টেকনিকালার ব্যবহারের কারণে। এবং আমার সেরা পরিচালকের নাম ইংমার বার্গম্যান, যেটা আমি আগেও  বিভিন্নবার বলেছি। ওনার প্রতি ছবির সাইকোলজিকাল ফিলোজফি আমাকে চুম্বকের মত বসিয়ে রাখে। ভাবায় এবং উপভোগ করায়। তবে ওনার খুব কাছাকাছি রাখব স্ট্যানলি কিউব্রিক-কে। উনি যত ছবি বানিয়েছেন, তার প্রতি সিনে এত অসাধারণ  ডিটেলিংয়ের কাজ এবং বুদ্ধিমত্তা আমি অন্য কারো সিনেমায় দেখিনি। তো, এইসব সিনেমা বা বার্গম্যান বা কিউব্রিক নিয়ে আমি আগেই আলোচনা করেছি। ফলে আজ ভাললাগা অন্য কিছু সিনেমা নিয়ে বলব যেগুলো এতদিন আলোচনায় রাখিনি বা বড়জোর উল্লেখ করেছি। তবে এখানেও একটা সাবধানবাণী শুনিয়ে দেওয়া ভাল। আমি সিনেমার ক্ষেত্রে বেশ জটিল। আজ যা ভাল লাগে, কাল হয়ত তার থেকে অন্য কিছু ভাল লাগে। অন্য কোন দৃষ্টিকোণ থেকে। কারণ আমরা তো রোজ কোন নাকোন নতুন ছবি দেখি, নতুন কিছু শিখি – ক্যামেরার কাজ, যে কোন শটের ডিটেলিং-কনস্ট্রাকশন-অ্যাবস্ট্রাকশন, সংলাপ, আবহ ইত্যাদি। ফলে আমার ভাললাগার ছবি কিন্তু সময় থেকে সময়ে বদলে যাবে। আপাতত যেগুলো বলতে পারি, সেগুলো হল গতানুগতিক সিনেমা পেরিয়ে একটু অন্য ভাবনার। যেগুলোর মধ্যে দিয়ে এটাও বোঝাতে চাই যে এদ্দিন যত মুভি নিয়ে কচকচি করেছি, তার বাইরেও প্রচুর ভাল ভাল সিনেমা রয়েছে যেগুলো দীর্ঘ ৪০ পর্বে আলোচনায় আসেনি। এবং আমার পছন্দের লিস্ট বেশ দীর্ঘ। সেজন্য বিভিন্ন জেনারের ১৭-টা ছবির মধ্যেই নিজেকে আপাতত গুটিয়ে রাখি যাতে শেষ আলোচনায় পেন চালাতে না হয়। এবং ভারতীয় সিনেমায় এদের বিকল্পগুলোও রাখলাম যেগুলো আমার হিসেবে এদের পাশে এক সারিতে বসানো যায়।

আমার চোখে, ছোটদের ছবিঃ ‘দ্য কিড’ (১৯২১, হলিউড) [বাংলা সিনেমায় এর বিকল্প হিসেবে বেছে নেব ‘কাবুলিওয়ালা’ (১৯৫৭)], থ্রিলারঃ ‘স্পেলবাউন্ড’ (১৯৪৫, হলিউড) [হিন্দিতে ‘য়ো কৌন থি’ (১৯৬৪)], ড্রামাঃ ‘ব্রিফ এনকাউন্টার’ (১৯৪৫, ব্রিটেন) [বাংলায় ‘ভুবন সোম’ (১৯৬৯)], যুদ্ধেরঃ ‘দ্য ক্রেনস আর ফ্লাইং’ (১৯৫৭, রাশিয়া) [বাংলায় ‘ওরা ১১ জন’ (১৯৭২)], কল্পবিজ্ঞানেরঃ ‘লা জেটি’ (১৯৬২, ফ্রান্স/জার্মানি) [তামিল ‘কাদু’ (১৯৫২)], হাসিরঃ ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জলাভ’ (১৯৬৪, ব্রিটেন) [হিন্দিতে ‘জানে ভি দো য়ারো’ (১৯৮৩)], ভয়েরঃ ‘কোয়াইদান’ (১৯৬৪, জাপান) [বাংলায় ‘মণিহার’-তিনকন্যা (১৯৬১)], প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্কঃ ‘দারসু উজালা’ (১৯৭৫, রাশিয়া) [কন্নড় ‘চেলুভি’ (১৯৯২)], নায়কোচিতঃ ‘গান্ধী’ (১৯৮২, ব্রিটেন) [বাংলায় ‘নায়ক’ (১৯৬৬)], ডকুমেন্টারিঃ ‘শোয়া’ (১৯৮৫, ফ্রান্স/জার্মানি/পোল্যান্ড) [হিন্দি ডকু ‘চিলড্রেন অব দ্য পায়ার’ (২০০৮)], দাঙ্গা/বর্ণবৈষম্য/ইতিহাসের দলিলঃ ‘মিসিসিপি বার্নিং’ (১৯৮৮, হলিউড) [বাংলায় ‘কলকাতা ৭১’ (১৯৭২)], সোশাল ব্ল্যাক-কমেডিঃ ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ (১৯৯৫, সার্বিয়া) [হিন্দিতে ‘ওম দর-বদর’ (১৯৮৮)], অ্যাডভেঞ্চারঃ ‘কাস্ট-অ্যাওয়ে’ (২০০০, হলিউড) [বাংলায় ‘অযান্ত্রিক’ (১৯৫৮)], অস্তিত্ব-মনস্তত্বঃ ব্ল্যাক সোয়ান (২০১০, হলিউড) [হিন্দিতে ‘বাঘ বাহাদুর’ (১৯৮৯)], সম্পর্কের জটিলতাঃ ‘দ্য হান্ট’ (২০১২, ডেনমার্ক) [বাংলায় ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ (১৯৯৩)], ভালবাসারঃ দ্য বাটারফ্লাই’জ ড্রিম (২০১৩, তুর্কি) [বাংলায় ‘দীপ জ্বেলে যাই’ (১৯৫৯)], রহস্যঃ ‘লবস্টার’ (২০১৫, আয়ারল্যান্ড/গ্রিস) [বাংলায় ‘কুহেলি’ (১৯৭১)] এবং সবশেষে সান্মানিক বিভাগেঃ ‘ইকিরু’ (১৯৫৭, জাপান) [বাংলায় ‘জলসাঘর’ (১৯৫৮)]।

ওপরে যতগুলো ছবির কথা লিখলাম, ১৮+১৮ = ৩৬ টা, সেগুলো সময় সুযোগ মত দেখুন। ভাল লাগবে। শুধু একটাই অনুরোধ, যখন দেখবেন, খোলা মনে দেখবেন, নানারকম সম্ভাবনা থেকে ছবির ভাল-মন্দ বিচার করবেন, সাহসী সিনেমাকে বাহবা জানাবেন।

যাইহোক, আজ এতগুলো ছবির ভেতর মাত্র দুটো ছবি নিয়ে কাটাছেঁড়া করব। এই লেখার ২৪ নম্বর পর্বে আমি বলেছিলাম এক ক্লাসিক রাশিয়ান ছবি ‘দ্য ক্রেনস আর ফ্লাইং’ নিয়ে কোন একদিন লিখব। আজ সেই কোন একদিন। এছাড়াও সাম্প্রতিক এক তুর্কি ছবি আমার বেশ ভাল লেগেছে, ‘দ্য বাটারফ্লাই’জ ড্রিম’। এই ছবি নিয়েও কিছু বলা দরকার। ১৯৫৭ এবং ২০১৩। এই দুটো পাশাপাশি আরো এক কারণে  রাখতে চাই – পুরনো বনাম নতুন – আমার চোখে অনেকটা কবিতার মত।

মিখাইল কালাটোজভের দেড় ঘন্টার সাদা-কালো যুদ্ধবিষয়ক ছবি ‘দ্য ক্রেনস আর ফ্লাইং’। ভিক্টর রজভের এক বিখ্যাত নাটক ‘লাইফ ইটার্নাল’-এর ওপর আধারিত। সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন সের্গেই উরুসেভস্কি। মুখ্য চরিত্রে অ্যালেক্সি বাটালভ ও তাতিয়ানা সময়লোভা। এই ছবি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের ছবি, ভেরোনিকা আর বরিসের অপূর্ণ প্রেমের ছবি, প্রতিশ্রুতি মৃত্যু খুন ধর্ষণ অবক্ষয় আনুগত্য স্বীকার ও কর্তব্যের ছবি, যুদ্ধের ফল হিসেবে সমাজ ও জীবন ধ্বংসের ছবি। কালাটোজভ এই ছবির ক্যানভাসে সূক্ষ্মভাবে এক শাশ্বত সত্যি ফুটিয়ে তুলেছেন। আজ অবধি একমাত্র সোভিয়েট ছবি যা কান ফিল্ম ফেস্টিভালে গোল্ডেন পাম পুরস্কার পেয়েছিল।

থিম বাদ দিলে প্রথমেই এই ছবির ক্যামেরার কাজ আলোচনায় উঠে আসবে। উরুসেভস্কি স্পেসিয়াল প্রক্সেমিক্স ও আলোছায়ার কাজ নায়িকার মুখের ওপর এমনভাবে দেখিয়েছেন, যা ভোলা যায় না। আরো একটা পয়েন্ট না বললে অনুচিৎ হবে। বরিস তার সঙ্গে দেখা না করেই যুদ্ধে চলে গেছে শুনে ভেরোনিকা যখন তাকে খুঁজতে বাসে চেপে যুদ্ধের র‍্যালির সামনে উপস্থিত। বাস থেকে নেমে একদৌড়ে সাঁজোয়া ট্যাঙ্কের সারি টপকে সে রাস্তার ওপাড়ে যায়। ক্যামেরা অনেক ওপর থেকে তাকে হারিয়ে না যেতে দিয়ে ফলো করে। আমার মতে গোটা সিনটা উরুসেভস্কি করেছেন একটা হাতে নেওয়া ক্যামেরায়, বাস থেকে নেমে তাতিয়ানার পেছনে ছুটে গিয়ে চেপে পড়েছেন এক ক্রেনে, তাতিয়ানা যখন দৌড়ে ট্যাঙ্কারের র‍্যালি পেরোচ্ছেন, তখন উরুসেভস্কি আস্তে আস্তে উঠে যাওয়া ক্রেনে শক্ত করে ধরে রেখেছেন সেই হ্যান্ডিক্যাম। অদ্ভুত! অনবদ্য!

এই সিনেমা আরো এক কারণে মনের কোণে লেগে থাকবে। ছবির নায়িকা তাতিয়ানা  সময়লোভার জন্য। সাবলীল অভিনয়। কেউ ভাবতে পারেনি এটাই ছিল ওনার প্রথম অভিনয়। এই সিনেমার জন্য কান ফিল্ম ফেস্টিভালে তাতিয়ানাকে বলা হয়েছিল ‘most modest and charming actress’। হলিউড থেকে অনেক অফার এসেছিল। দুর্ভাগ্য, তৎকালীন সোভিয়েত সরকার ওনাকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। এবং আগেও বলেছি, ষাটের দশকের পর উনি হঠাৎ ছায়াছবি জগৎ থেকে এবং লোকচক্ষু থেকে উধাও হয়ে যান। বহু পরে, নব্বইয়ের দশকে আবার ওনাকে দেখা যায়।

তুর্কি ছবি ‘দ্য বাটারফ্লাই’জ ড্রিম’ নিয়ে লিখতে গিয়ে প্রথমেই বারীনদার (ঘোষাল) একটা কবিতা মনে পড়ে গেল, অ্যাশট্রে। ‘এখনো সাজানো অ্যাশট্রে রাখা আছে / ব্যবহৃত হবে বলে / ব্যবহৃত, আমার গৃহিণী / নিজেও সে সাজতে ভালোবাসে /  হাসপাতাল থেকে ফিরে রোজ ছাই খোঁজে / ভরে উঠবার কাছে ভেঙে যায় / প্রতিবার অ্যাশট্রে সংক্রান্ত কিছু শিখে এসে / নিজেকে সাজায়’। ইলমাজ আর্গোদানের ১৩৮ মিনিটের ছবি দ্য বাটারফ্লাই’জ ড্রিম। ক্যামেরায় গোকান তির্য়াকি (আমি এর আগে ওনার কাজ দেখিনি)। মিউজিকে রহমান আলতিন, যিনি এই ছবির জন্য পাবলিক চয়েস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন। মুখ্য ভূমিকায় কিভাঞ্চ তাতলিতুগ, ম্যাত ফিরাত ও বেলচিম বিলগিন। এই ছবি ছিল ৮৬-তম অস্কার পুরস্কারে তুর্কির অফিশিয়াল এন্ট্রি, যদিও শেষ অবধি এটা নমিনেটেড হয়নি।

যাইহোক, যে কারণে এই ছবি আমার কলমে। এবং কেন এই ধারাবাহিকের একদম  শেষলগ্নে। দেখুন, আপনারা কেউ কেউ হয়ত জানেন যে আমি মূলত ‘কৌরব’  পত্রিকার লেখক। সেই ‘কৌরব’ পত্রিকা, যা বারীনদা আর কমলদা সত্তরের শুরু থেকে চালিয়ে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন - আশির দশকে কমলদার প্রতিকবিতা, বারীনদার যতিচিহ্নহীন নতুন কবিতা, শক্তি সুনীল বিনয় উৎপল জয় মৃদুল – এদের সবার কৌরবের পাতায় আত্মপ্রকাশ, এগুলো এখন ইতিহাসের পাতায়। ২০০৪ সালে কৌরব ১০০ সংখ্যা হয়ে যাবার পর যখন বারীনদা কমলদা কৌরব বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন তখন আর্যনীল আর আমি ছাপা কৌরবের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়েছিলাম, কারণ সেই ১৯৯৯ থেকে আর্যনীল আর আমি অনলাইনে ছাপা কৌরবের শুধু কবিতা সেকশন তুলে ধরতাম। কবিতার প্রতি সেই অকৃত্রিম ভালবাসা   নিয়ে আমরা অনেক বছর চালিয়েছি। আর্যনীল এর মাঝে circumference poetry নামক এক নতুন ধরনের কবিতার ধারণা তুলে ধরেছিলেন কৌরবে। কবিতার ফর্ম আর কনটেন্ট নিয়ে আমরা সবাই কৌরবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছি। তো, কবিতা ও প্রচলিত কবিতার মুক্তি আমাদের রক্তে। সুতরাং আমরা তো কবিতা আন্দোলনের ছবি নিয়ে উৎসাহিত হবই, তাই না? সেই কারণেই এই ছবি। চল্লিশের দশকে তুর্কির এক  বিশেষ কবিতা আন্দোলন ‘গারিপ’ এই ছবি রোমান্টিক আবহে তুলে ধরেছে। তিনজন তরুণ তুর্কি কবি লেখাপড়া শেষ করে ১৯৩৬ সালে তুরস্কের আঙ্কারায় ফিরে আসেন  ও তুর্কির প্রচলিত কবিতার ধারণা ধূলিসাৎ করে দেন। জোর দেন শব্দ থেকে উঠে  আসা ভাব প্রকাশের ওপর, তিনজন একসাথে প্রকাশ করেন ‘ভার্লিক’ নামক এক কবিতা ম্যাগাজিন যা আজো কবিতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। এই ছবির প্রধান যে দুই চরিত্র, কিভাঞ্চ ও ম্যাত, তারা সেই ‘গারিপ’ আন্দোলনের কবি।

১৯৪১ সালের পটভূমিকায় এই ছবি। মুশকিল, প্রধান দুই তরুণ কবি এই ছবিতে  ক্যানসার আক্রান্ত, যদিও দুজনেই ভাল থাকার চেষ্টা করে। এবং দুজনেই একজন নারীর প্রতি আকৃষ্ট, বেলচিম। দুজনেই চেষ্টা করে যুবতীর হৃদয় জেতার। সেখান থেকেই এই ছবির টুইস্ট। তারা কি পারবে? তারা কি আদৌ বেঁচে থাকবে? তারা কি কবিতা লেখা চালিয়ে যাবে? সিনেমাটা দেখুন। ভাল লাগবে।

থিম বাদ দিলে পড়ে থাকে অভিনয়, ডায়লগ। এই তরুণ তুর্কিদের থেকে সেটাও যথাযথ। এবং সিনেমাটোগ্রাফি। আউটডোর শুটিং-এ ক্যামেরাম্যান গোকান তির্য়াকি যথেষ্ট ভাল কাজ করেছেন। সমালোচনা করার মত আমার কিছুই নেই। তবে হ্যাঁ, সব ছাড়িয়ে যে কথা আমার বারবার মনে হয়েছে, এই ছবির মাধ্যমে পরিচালক আর্গোদান প্রায় ৭০ বছর পরে এক হারিয়ে যাওয়া কবিতা আন্দোলনকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তাই কবি হিসেবে এই লেখার মাধ্যমে আমি ওনাকে কুর্নিশ জানালাম।

ব্যস্‌, পাঠক, সিনেমার পৃথিবী এই অব্ধিই। আর নয়। এই লেখার শেষ ৪০ পর্বে আমি সিনেমা সম্বন্ধে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আপনাদের মতামত তৈরি করতে চেয়েছি, চোখ-কান খুলে দিতে চেয়েছি – আমার নিজের দেখা সিনেমাগুলোর ন্যারেশানের মাধ্যমে। তবুও যদি এই লেখার কোন পর্বে কোথাও মনে হয়, আমি ন্যারেটিভ না হয়ে অ্যাসার্টিভ হয়ে উঠেছি, নিজগুণে ক্ষমা করবেন। মোদ্দা কথা হল, আপনি কোন্‌  সিনেমাকে মাষ্টারপিস হিসেবে আপনার মনের অন্দরমহলে তুলে রাখবেন, সেটা আপনার ব্যাপার। তাহলে শুরু করুন নিজের সিনেমার জগৎ তৈরি করার। এবং সেই জগতের ভেতর নিজের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার। হ্যাঁ, যদি হঠাৎ এই শেষ লাইনে এসে মনে হয়, “...নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ, অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে...”, তাহলে চিঠি বা মেসেজের মাধ্যমে কাজলদাকে জানিয়ে দেবেন। সেক্ষেত্রে কয়েক মাস পরে আমি আবার বাংলা সিনেমার লুকিয়ে থাকা মণিমুক্তো নিয়ে আরেক ধারাবাহিক শুরু করব। আর এই অবধি এসে যদি মনে হয়, নাহ্‌, এই কচকচি মাস্টারের থেকে সিনেমার ঘোল আর নেওয়া যাচ্ছে না, তাহলে কমপ্লিট ফুলস্টপ।

হেডি ওয়েস্টের ১৯৬১ সালের সেই বিখ্যাত গান 500 miles মনে আছে তো?

  

2 কমেন্টস্:

  1. কবিতা রচনা করবার পর যদি তার উপরে ব্যাখ্যা লেখা হয় কিংবা সিনেমা দেখে আসবার পর, তা হিন্দি ইংরেজি তেলুগু বাংলা সিনেমা ইত্যাদি যাইই
    হোক না কেন, সেই সিনেমা নিয়ে দৃষ্টি কোণ তৈরি করবার প্রচেষ্টা করা হয় বা উক্ত সিনেমার নায়িকার চোখের ভাব নায়কের শক্তি অভিব্যক্তি নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করে কোনো নতুন আঙ্গিক করবার প্রয়োজন দেখা দেয় তবে সেই সিনেমা তৈরি র পেছনে যাবতীয় তাগিদ ইচ্ছা তাড়না ভাবনা ব্যর্থ বলে মনে হয়। অন্তত পরিচালক যে যে ভাব নিয়ে উক্ত সিনেমা টি তৈরি করেছেন বা করতে চেয়েছিলেন অথবা যা চেয়েছিলেন পুরোপুরি তা যেন শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠল না সেই অসমাপ্ত ভাব গুল সব যাবতীয় দেশগুলো কেমন হিজিবিজি হয়ে যায়, যে হিজিবিজি র বেঁচে থাকাটা ঐ সিনেমার বেঁচে থাকার চাইতে অনেক বেশি জরুরি।
    সিনেমা বিষয়ক এই দীর্ঘ লেখা টা পড়েছি আবার কখনও বিদ দিয়ে অন্যান্য লেখা পড়েছি কাজলশাহ পত্রিকা র জন্য দীর্ঘ লেখা অবশ্যই জরুরি তবে লেখা যেখানে সত্যর কাজ করবে সেখানে নয়।
    ধন্যবাদ।
    ঝুমা চট্টোপাধ্যায়।
    নিউ দিল্লি

    উত্তরমুছুন
  2. প্রথম মন্তব্য এ কিছু ভুল শব্দ হয়েছে যেগুলো এখানে শুধরে নিতে চাই।
    শক্তি - শক্তি শালী
    দেশগুলো - রেশগুলো
    বিদ _ বাদ
    কাজলশাহ - কাজলদা
    ধন্যবাদ।
    ঝুমা চট্টোপাধ্যায়

    উত্তরমুছুন