কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৫

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩১


আনুগত্য

 

সারা ক্যানভাস জুড়ে মেঘ। ধূসর-পোঁচ। ওয়াশের আবছা দাগে দাগে কালচে গাছ আর নুয়ে আসা ডাল।একটাই গাছ_কৃষ্ণচূড়া। রক্তের মতো কয়েকটি ছেঁড়া পাপড়ি মাটিতে পড়ে। স্কারলেট-রেড আর প্রুশিয়ান ব্লুর মিশ্রণ। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে গা শিরশির। হলটা ফাঁকা। এখন ভিজিটার্স টাইম নয়। থরে থরে তিনহাজার স্কোয়ার ফিটে সাজানো ছবি। হালকা আলো জ্বলছে। কতৃপক্ষ সন্ধ্যার আগে আলো অপচয় করে না। থামের ওপর নগ্ন হরিণা। দূরে অন্ধকারে শুধু সাদা কালো চারকোলের পোঁচ। সিরিজটা কিছুটা অবন ঠাকুর স্টাইল। শ্লথ পদক্ষেপে দেখছে অমৃতা। আসলে স্টুডিওতে এত রঙের কোলাহল থাকে আলাদা করে টের পাওয়া যায় না। এখন এই অন্ধকারে ওরা প্রত্যেকে তাকিয়ে দেখছে তাকে। মিশমিশে কালো নরনারী ভিড় করে। প্রেতের মতো। একেকটা মানুষ একেকটা ফ্রেম থেকে আলাদা আলাদা গল্প নিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। অমৃতার তুলি থেকে সৃষ্টি। যেমন গাছের নিচ থেকে শুধু একটা মুখ বেরিয়ে আছে। খাড়া নাক। ব্যক্তিত্বময়ী শীলামাসি। ঠায় দেখছে এখন ওকে। গাছের আড়াল থেকে উঁকি দেওয়া শীলামাসী। সেদিনও ওর দিকে চেয়েছিল ঠিক এভাবে। ওই শেষ। অমৃতা টিউশন করে ফিরছিল শুনশান পথ দিয়ে। চোখ দুটো কি  করুণ ছিল? এখানে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিটা। অষ্টমীর সকালে ওই কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় ছিন্ন ভিন্ন দেহটা পড়েছিল। অমৃতার তখন আটবছর বয়স। খুন নয়, ওই প্রথম নতুন শব্দ শুনেছিল, রেপ। এতবছর পর হঠাৎ  ক্যানভাসে এঁকেছিল কেন? অমৃতার মনে পড়ছে না। মুখ ফিরিয়ে নিতেই শীর্ণ কালো মূর্তিটা সোজা চোখ রাখল তার দিকে। বুকটা ধক করে উঠল অমৃতার। চেনা চেনা প্রাচীন মন্দিরের পেছনে জঙ্গল আর পরিত্যক্ত জঙ্গলের পর নদী এঁটেল মাটি আর লতাগুল্মের মাঝে বছর দশেকের অমৃতা। ওখানেই হারিয়ে গেছিল। অমৃতা অথবা মনুয়া। মড়মড় করে এগিয়ে আসছিল এই লোকটা। হারানকাকু। গাছের মতো। নিশ্ছিদ্র অরণ্য আর তীক্ষ্ণ একটা ডাক।

সবাই কেমন জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই অন্ধকার ঘরটায়। কালো-কালো প্রেতের মতো ছবিগুলো জীবন্ত। বল্লভপুরের অরণ্য বারবার উঠে আসে ক্যানভাসে প্রথম রক্তপাত।

ধূসর দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে আছে অমৃতা। সারা-হলঘরে অন্ধকারের ধবল রঙে মিশকালো ওরা। একটা বিরাট ছায়া এগিয়ে আসছে দূরের ক্যানভাসটা থেকে। মুখটা খোলা। চোখ দুটোয় পাতা নেই, হাতটা নুলো। অমৃতা কাঁপছে থরথর করে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। পেটের কাছ থেকে ফাঁকা অনেকটা সাদাগ্যাপ। নিচে সরু পা’দুটো ঝুলছে। অমৃতার ঠোঁট কাঁপছে। সর্বাঙ্গে ঘাম।

আমি, আমি খুন করিনি তমোনাশকে। শেষ দুবছর তো আমি সন্দীপের সঙ্গে থাকতাম আ_আমি, আমরা তো ডিভোর্সের কথাই বলেছিলাম।

তমোনাশের লাশ আমি দেখেছি। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে বসে পড়ে অমৃতা যেখানে ক্যানভাস থেকে উঠে এসেছে চেনা কালো ফিগারটা।

"ক্ষমা করো তমোনাশ তোমাকে সরিয়ে দেওয়া ছিল পার্টির সিদ্ধান্ত, আমি জেনে গেছিলাম, আমি জেনেও তোমাকে সতর্ক করিনি কারণ পার্টি আমাকে রেফার... তুমি জানো... আমার দিল্লী যাওয়া হতো না, জাতীয় পুরস্কার পাওয়া হতো না।"

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন