সমকালীন ছোটগল্প |
নবদিগন্ত
হ্যাঁ, প্রতিভাধর
বলা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে ঠিকই তবে অতি মেধাবী তো বলাই যায়। আমি অধীপের কথা বলছি। দু’বার তিনবার নয়, একবারই রেলওয়ে’র পরীক্ষায় বসতে হয়েছিল।
ব্যস, করণিকের চাকরীটি এখন হাতের মুঠোয়। আমাদের অধীপ কিন্তু সে অর্থে স্মার্ট নয় বরং
মুখচোরাই বলা যেতে পারে। তিন ভাই আর মাকে নিয়ে
ওরা চারজন। মা আছেন। দারিদ্র্য
নিত্যদিনের সঙ্গী। ওর এই রেলওয়ের
চাকরীটা যেন দৈব আশীর্বাদ হয়ে এলো পুরো পরিবারটির জন্য। নিত্য জীবনেও এল বিশাল না হলেও
উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। চাকরী পাওয়ার আগে বেশ কিছু ছাত্র পড়াতো অধীপ। তারা স্যরকে ছাড়বে না কিছুতেই। তাই এটা
এখন বাড়তি উপার্জন। দাদা চাকুরে তবে উল্লেখযোগ্য তেমন নয় কিছু। বয়স
বেড়ে যাচ্ছে বলে বিয়েটা করে নিতে হয়েছিল মা বাবার চাপে পড়ে।
দরিদ্র সংসার থেকে এসেছিল বৌদি কিন্তু স্বামীর ঘরে এসেও একই ধান ভানবে কেন? তাই দাদাকে নিয়ে বৌদি আলাদা বছর খানেকের মধ্যেই। ছোট ভাইটি মেজদার নেওটা বড়। গানপাগল এই ভাইটাকে
অধীপও চোখে হারায়। চাকরী পাবার আগে দুটো ট্যুশানি বাড়িয়ে নিয়েছিল কেবলমাত্র ভাইটার সঙ্গীত শিক্ষায় ব্যাঘাত না ঘটে সেই
কারণে। চাকরীটা পেতেই ভাইকে তার পছন্দের ওস্তাদের কাছে নিয়ে গেছে অধীপ।
এপর্যন্ত সব ঠিক। মাস
খানেকও হয়নি চাকরীর, মা হঠাৎ একদিন
বলে বসলেন, ‘আমার বয়স হয়েছে বাবা, বড়বৌ তো থেকেও নেই, চাকরী যখন পেয়েই
গেছিস বিয়েটা করে নে। বিয়ের কথা শুনেই
মাথায় বাজ। একে তো বৌদিকে নিয়ে এক
তিক্ত অভিজ্ঞতা তার উপর মেয়েদের ব্যাপারে ওর উদাসীনতাও একটা বড়
বাধা ওর বিয়ের প্রশ্নে। আত্মীয় স্বজনের মধ্যে মাসীপিসী তুতো ভাইবোনেরা
ছাড়া অন্য কোন মেয়ের মুখোমুখি হলেই, ব্যস, অধীপ গুটিয়ে কেন্নো।
অধীপের একটা ঠেক আছে। এক ইলেক্ট্রিশিয়ানের দোকান। অধীপও জানেনা কেন বিকেল হলেই কিছুক্ষণ সময় কাটাতে ইচ্ছে হয় ওই দোকানের বেঞ্চিটায় বসে। দোকানী ভদ্রলোক পঞ্চাস ছাড়িয়েছেন। কথায় ওস্তাদ। না হলে চলবেই বা কেন! খালি পসরা সাজিয়ে বসলেই তো হল না! কম্পিটিশনে টিকে থাকতে গেলে কাস্টমার টানার আর্টটিও রপ্ত করা দরকার। সেটি এই দোকানী মানে দত্ত বাবুর মধ্যে পুরো মাত্রায় বর্তমান। অধীপ সম্ভবত দত্ত বাবুর ওই বিদ্যেটির ভক্ত হয়ে পড়েছে দিনে দিনে। এটাই সম্ভবত কারণ, কথার মার প্যাঁচে কখন যে তার একটি প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে ফেলেছে বুঝেই উঠতে পারেনি অধীপ। দত্ত বাবুর একটি ভাগ্নী আছে। সুন্দরী নয় তবে চতুর বড়। নরানাং মাতুল ক্রম ---এ প্রবাদটি যদি সত্য হয় তবে দত্ত বাবুর ভাগ্নীটি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। একদিন দত্ত বাবু দোকান ছুটির দিনে ‘চল একটু ঘুরে আসি’, বলে অধীপকে নিয়ে সোজা হাজির তার দিদির বাড়ি। খবরটা আগেই দেওয়া ছিল। ঘরে ঢুকতেই একটা দম বন্ধ করা গন্ধ টের পেলো অধীপ। এমন অগোছালো ঘর! তার মানে ঘরে একটি মেয়ে থাকা সত্ত্বেও ঘরের সঙ্গে তার যোগ নেই। দত্ত বাবু অধীপকে বসতে বলে ভিতরে চলে গেলেন। অধীপ অপ্রস্তুত। দত্ত বাবু যে তাকে সোজা তার দিদির বাড়িতেই এনে হাজির করবে সেটা কোন ভাবেই সে আন্দাজ করতে পারেনি। আসার সময়ে কয়েকবার জানতে চেয়েছে গন্তব্যের কথা। জবাবে দত্ত বাবুর সেই একই কথা, ‘চলই না, দত্তদা তোমাকে আঘাটায় নিয়ে ফেলবে না’।
নিরুপায় অধীপ তখন উদ্দেশ্যহীন। কখনো দরজা দিয়ে বাইরের দিকে কখনো আবার ঝুলপড়া স্যাঁতাধরা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে সময় কাটাচ্ছে। ঠিক এই সময়েই আবির্ভাব রক্ষাকালীর। উঁচু ফাঁকা দন্তকৌমুদী বিকশিত। হাতে একগ্লাস জল নিয়ে প্রবেশ ঘটেছে তার। প্রায় গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে পড়ল সে। পারলে যেন নিজেই ঢেলে দেবে মুখে এমন করেই বলল সে, ‘নিন জল খান, আপনি দেখছি একটুতেই ঘেমে নেয়ে যান, সারা জীবন ঝক্কি ঝামেলা সামলাবেন কি করে?’ ওরে বাবা, এ কি মেয়েরে! এই ভাগ্নী রত্নকেই গছাতে চাইছেন দত্তদা! কখন, দত্তদা কখন আসবেন আপনি? বাঁচান আমাকে। আহা,এই কথাগুলো যদি চেঁচিয়ে বলতে পারত অধীপ!অস্ফূটে মুখ দিয়ে বেরিয়েও এলো শব্দটি, ‘দত্তদা’! রক্ষাকালী প্রায় জোর করেই অধীপকে গিলিয়ে দিল জলটা,বলল তারপর, ‘আসছে বাবা , আসছে আপনার দত্তদা, মা বাবার সাথে জরুরী কথা বলে আসছে কিছু। আপনি একটা পুরুষ তো না কি, এত ভয় নিয়ে সংসার করবেন কি করে আমাকে নিয়ে?’ অজান্তেই একটা ঢোক গিলে ফেলল অধীপ। আবার অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল দুটি শব্দ, ‘আপনাকে নিয়ে!’ ‘নয়তো কি,আপনি নিজেই তো মামাকে কথা দিয়েছেন, বিয়ে করলে আমাকেই করবেন’, অকপটে বলল রক্ষাকালী। কিছু বলতে যাচ্ছিলো অধীপ, এ সময়ে কিছু কথা কানে এল অধীপের। একটি স্বর খুব পরিচিত। দত্তদা’র। মনে হল কিছু বোঝাচ্ছিলেন দিদি জামাইবাবুকে।ওঁরা ভীতরে আসতেই শশব্যস্তে উঠে দাঁড়ালো অধীপ। মুখে আঁচল চেপে হেসে উঠল কালী। এই হাসিটা বড় অর্থহীন মনে হল অধীপের। শৈশব থেকে আজ পর্যন্ত সৌজন্য সহবতের যে শিক্ষা তাতে তো এটাই স্বাভাবিক যে গুরুজনদের চেয়ার ছেড়ে দিতে হয়। হতে পারে , ওর শশব্যস্ত ভাবটাই কালীর হাসির কারণ তা বলে অমন করে হেসে উঠতে হয়! কালীর মা বলে উঠলেন , ‘তখন থেকে ছেলেটাকে শুধু জল খাইয়ে রেখে দিয়েছিস, যা একটু চা বানিয়ে আন, আমরা একটু কথা সেরে নিই।’ কালী ঠোঁটে হাসিটি ঝুলিয়ে রেখেই ভীতরে চলে গেল। শুরু করলেন কালীর মা।তিনিও কালীর প্রথম সংস্করণ। বাবা গোবেচারি। স্ত্রীর কথায় কেবল মাথা নাড়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই যেন তার।বললেন কালীর মা, ‘সব শুনেছি আমরা তোমার সম্বন্ধে আমার ভাইয়ের মুখে।এমনই একটি পাত্র চাইছিলাম আমরা কালীর জন্য। তোমার পছন্দ তো আমার কালীকে? অবশ্য আমি আবার পছন্দ অপছন্দের কথা তুলছি কেন। ভাই তো বলল, তু্মি ওকে কথা দিয়েছ, আর জীবন গেলেও তুমি কথার খেলাপ করবে না। ভাইয়ের কাছে শুনেছি, দেখছিও, খুব শান্ত স্বভাবের তুমি। এত শান্তশিষ্ট হলে জীবন চলে না , তবে চিন্তা করো না, আমার কালী সব সামলে নেবে’।
কথা শেষ হল। আর সেই কথাতেই ভদ্রমহিলা আস্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেললেন অধীপকে। হ্যাঁ, আরও একটি কথা বলেছিলেন তিনি, ‘আমাদের তো একটিই সন্তা্ন, তার বর, জামাই বল ছেলে বল সবই তুমি। আরে এরা কি আমাকে ঘর জামাই করে রেখে দেবে? এমন কিছুই ভাবতে যাচ্ছিল অধীপ, এমন সময় প্রবেশ ঘটল রক্ষাকালীর। হাতে ধরা একটা ট্রে। তার উপর চারটি কাপে লাল চা। ট্রে ,কাপ আর চায়ের রং যেন মিলেমিশে একাকার। গত্যন্তরবিহীন অধীপকে গিলতেই হল চা নামক বস্তুটি। যেন অধীপের মতামত চাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। সে যে কথায় কথায় একদিন কথা দিয়ে ফেলেছিল দত্তদাকে সে-ই যেন বেদবাক্য, অন্যথা হবার জো নেই। মোটামুটি তারিখটিও ঠিক করে ফেললেন দত্তবাবু আর তার দিদি মিলে। অধীপ মিনমিন করে বলতে চেয়েছিল কিছু মায়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে।পাত্তা পেলো না অধীপের কোন ওজর আপত্তি।
ঘরে এসে সব কথা খুলে বলল অধীপ মায়ের কাছে। ছেলে বিয়েতে রাজী হয়েছে এটাই যেন কোন দুর্লভ বস্তুর প্রাপ্তির আনন্দ। তিনি সাগ্রহে সম্মতি জানালেন।ভাই অবশ্য বলল, ‘আমাকে একবার নিয়ে গেলি না দাদা, হবু বৌদিকে একটু বাজিয়ে দেখতাম’। কি আর বলবে অধীপ, কোন এক অশুভক্ষণে যে কথা দিয়ে ফেলেছিল দত্তদাকে! মুখ ফুটে কিছুতেই বলতে পারবে না অধীপ তার অপছন্দের কথা। কোন নারীকে অস্বীকার করা মানেই সেই নারীকে অসম্মান বা অপমান করা। এই নীতিতে বিশ্বাসী অধীপকে শেষ পর্যন্ত বসতেই হল বিয়ের পিঁড়িতে।
বিয়ের রাতে জড়সড় অধীপকে প্রথমেই জানিয়ে রাখল কালী, সে অধীপের বৌ হল বটে, তা বলে কেউ তার ওপর খবরদারী করবে সেটা সে কিছুতেই মেনে নেবে না সে। বুদ্ধিমান অধীপ বুঝতে পারল, তার ভুলের মাশুল গোণা শুরু হল সেই মুহূর্ত থেকে।
কালীকে নিয়ে ঘরে ফিরল অধীপ। কালরাত্রি কাটিয়ে বউভাত, তারপর এল সেই রাতটি যাকে সকলে জানে ফুলশয্যার রাত বলে।মা আর নিকট আত্মীয়-স্বজনের অভিজ্ঞ চোখে ধরা পড়ে গেল নতুন বৌয়ের আসল চেহারাটি। আড়ালে আবডালে আকারে ইঙ্গিতে সবার সেই একই প্রশ্ন , এ কাকে নিয়ে এল অধীপ।শান্ত স্বভাবের অধীপ নিরুদ্বেগ। ভীতরে ভীতরে ঝড় বয়ে গেলেও তার বিন্দুমাত্র আঁচ পেলো না কেউ। কৌতূহলী মেয়ে বৌরা যে যার জায়গায়।কোন উৎসাহই বোধ করছে না তারা আড়ি পাতার।কালী জানে, এই রাতে অতি আগ্রহী কেউ চুপটি করে লুকিয়ে থাকে খাটের নীচে।দরজা বন্ধ করে সে নিজেই পুরো ঘরটির আনাচ কানাচ সব দেখে নিয়ে নিশ্চিন্ত হল, অমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই। অধীপের নিজের ঘরে সে-ই যেন আগন্তুক।না, কোন রকম আকর্ষণই বোধ হচ্ছে না তার। ফুলশয্যার সাজে সাজলেও কালী তার স্বমহিমায় বিরাজিত। বলতে গেলে ওই সাজ যেন কালীকে আরও কুরূপ করে তুলেছে। কালী বসল এসে অধীপের গা ঘেঁষে।ফুলশয্যার রাতে কনের যে ব্রীড়াবনত ভঙ্গী যা রক্তে ঝড় তোলে তার দয়িতের মনে কালীর আচরণে তার বিন্দুমাত্র প্রকাশ নেই যে!উল্টে সে দায়ী করে বসল অধীপকে নপুংসক বলে। নপুংসক অপবাদ সয়ে নেওয়া কোন সক্ষম পুরুষের পক্ষেই কি সম্ভব? কি করে সত্যটা প্রকাশ করবে অধীপ যে কালী’র রূপ বা আচরণ কোনটাই কোন পুরুষকে আকর্ষণের যোগ্য নয়।কালী প্রথম সাক্ষাতের দিনই অধীপকে বুঝে নিয়েছিল তার মত করে। ফন্দি আঁটা শুরু হয়েছিল সম্ভবত সেদিন থেকেই। আগ্রাসী কালীর জৈবিক চাহিদা মেটানো অধীপের সাধ্যের বাইরে, একথা প্রথম দর্শনেই বুঝে গিয়েছিল কালী। কিন্তু ঐ যে, ফন্দি! এবার কালী উন্মুক্ত করল নিজেকে অধীপের কাছে। সম্পূর্ণ নিরাবরণ কালী। এ কাকে জীবনসঙ্গিনী করে ঘরে এনেছে অধীপ? এক ভয়ংকর অন্ধকার যেন গ্রাস করতে আসছে ওকে। আরও নির্লজ্জ হল কালী। চোখে ফুটে উঠল আহত সর্পিনীর প্রতিহিংসা।বলল, ‘এবার আমি দেখবো সত্যিই তুমি পুরুষ কিনা’।আশ্চর্য, বিন্দুমাত্র সংকোচবোধ নেই! ঝাঁপিয়ে পড়ে একে একে পাঞ্জাবী ধুতি এমনকি অন্তর্বাস পর্যন্ত কেড়ে নিয়ে সারা শরীরটা জরিপ করে নিল অধীপের। দেখল, মাথা নীচু করে লজ্জায় কুঁকড়ে আছে অধীপ। এমন একটি মুহূর্তে পুরুষের দেহে মনে আচরণে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া অনিবার্য তার চিহ্ন মাত্র নেই অধীপের মধ্যে। ব্যস। কালীর হাতের মুঠোয় এখন সে একটা জ্যান্ত পুতুল মাত্র।তাকে নিয়ে যেমন খুশী খেলবে কালী। কোনক্রমে ধুতিটা টেনে অধীপ আবৃত করতে চাইছিল নিজেকে। এক নিমেষে ধুতিটা কেড়ে নিল কালী। শ্লেষ ঝরে পড়ল কমলা লেবুর কোয়ার মত বিস্ফারিত দুই অধরোষ্ঠে।‘কি হিজরে মশাই,এত লজ্জা যখন বিয়ে করার শখ হয়েছিল কেন? বলে দেবো নাকি সক্কলকে গোপন খবরখানা?’ অধীপ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে এখন নিজের অবিমৃষ্যকারিতার ফল। একজন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার অসহায় অবস্থার কথা ভেবেই সে কোন ভাবনা চিন্তা না করেই কথা দিয়ে ফেলেছিল দত্তদাকে। কথার খেলাপ করে না অধীপ, এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে দত্তদা। তার সরলতা, বিশ্বাস সব নিয়ে খেলেছে সে।
লক্ষ্য করলো অধীপ, শাড়িটা জড়িয়ে নিচ্ছে কালী। এবার এগোচ্ছে দরজার দিকে। কি করবে সে
এখন? এত বড় মিথ্যেটাকে
সে সত্য বলে প্রকাশ করবে সকলের কাছে?কি মনে হল
অধীপের। সে নগ্ন অবস্থাতেই
উঠে গিয়ে হাত জোড় করে দাঁড়ালো কালীর সামনে। মিনতি ঝরে পড়ছে দুই চোখে। কালীর চোখে ষড়যন্ত্রীর ভাষা। ‘বলবো না, তবে আমার জীবনটা বরবাত করে দেবার মূল্য হিসাবে তোমার সমস্ত সঞ্চয়ের কাগজপত্রে আমাকে নমিনী করে দিতে হবে’। অধীপ কি
পাগল হয়ে যাবে? এ যে মাথা
থেকে পা পর্যন্ত বিষে ভরা
এক নাগিনী। আর কিছুক্ষণ এর সাথে
কাটালে তার মস্তিষ্কের সমস্ত কোষগুলি অসাড় হয়ে যাবে। ভাল মানুষ হবার এই মূল্য দিতে হচ্ছে
তাকে? নিরুপায় অধীপ অস্ফূটে জানালো , ‘তাই হবে কিন্তু এই তো কয়েক
মাস হল চাকরী পেয়েছি, তেমন কিছু
জমেনি তো এখনো’। ‘বললেই হল? আমাকে চার অক্ষর পেয়েছ? এতদিন যে হাজারটা টিউশানি করেছো, জমাওনি কিছু!দাও চাবিটা
,আর চাবি দিলেই ধুতি পরতে পাবে, দাও!’ আদেশের সুরে বোললো কালী।অকূল সমুদ্রে ডুবন্ত জাহাজের সাঁতার না জানা যাত্রী
যেন অধীপ। ধুতিটা ফিরে পাবে শুনে টেবিলের ড্রয়ারে রাখা চাবিটা বাড়িয়ে ধরল কালীর দিকে। ছিনিয়ে নেবার মত করেই কালি
নিয়ে নিলো চাবিটা নিজের মুঠোয়।আবার সেই মিনতি ‘ধুতিটা’! ‘এই নাও, আর অত
লজ্জার কি আছে, তুমি তো
না পুরুষ না মেয়ে’, তাচ্ছিল্যের সাথেই বলল কালী।
রাত শেষ হতে বেশী বাকী নেই আর। চাবির গোছাটা আঁচলে বেঁধে হাঁই তুলতে তুলতে একসময় গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়ে গেল কালী। শুয়ে পড়ার আগে সতর্ক করে দিল অধীপকে, তাকে যেন কেঊ বিরক্ত না করে। ঘুম না হলে তার মেজাজের ঠিক থাকে না, তখন যাকে যা খুশী বলে দিতে পারে। কিছুক্ষণের মধ্যে কালী’র নাসিকা গর্জন বিরাগ বিদ্বেষের মাত্রা বাড়িয়ে দিল আরও কয়েক গুন। অধীপের চোখে ঘুম? অসম্ভব। অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছে সে। কেমন একটা অপরাধ বোধে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে তার মন। তবে কি মানুষের উপর বিশ্বাস রাখা মূর্খতা? এখন কি করা কর্তব্য তার? মরে যাবে? মরার আগে যদি ভাইটাকে নমিনি করে যেতে পারত! তাও যে হবার নয়। বিয়ের পর সঞ্চিত অর্থ , চাকরী সব কিছুর উপরই যে স্ত্রী’র অধিকার। দত্তদাকে সব খুলে বলবে নাকি কাল? না, এ লজ্জার কথা কারোকে বলবার নয়। দত্তদাও যে এ ষড়যন্ত্রে শামিল নয় তাও বা কে বলতে পারে ! অবশ্য কারোকে দোষী সাব্যস্ত করার আগে নিজের দিকে তাকাতে হবে। এ তো তারই অবিবেচনার ফল। কেউ বললেই রাজী হয়ে যেতে হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছিল তাকে?
সারারাত নিজের মনের সঙ্গে লড়াই চলল। ভোর হতে বেশী বাকি নেই আর। যা করার ভোর না হতেই করে ফেলতে হবে। মনে মনে মা আর ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল অধীপ তারপর সন্তর্পনে দরজা খুলে পা বাড়ালো নিরুদ্দেশের উদ্দেশে। স্ত্রী বলে যাকে ঘরে নিয়ে এল, সে যে স্ত্রী বা বন্ধু কোন ভাবেই তার সহযোগী হয়ে উঠবে না কোনদিন সে তার আচরণেই স্পষ্ট করে দিয়েছে কাল। একটূ থমকে দাঁড়ালো অধীপ। এ কী করতে যাচ্ছে সে? কার কাছে রেখে যাবে সে তার মা ভাইকে? ভিতরে ভিতরে কঠিন হয়ে উঠছে অধীপ। বিচ্ছেদই হবে একমাত্র পথ কিন্তু সে তো একবছর পূর্ণ হবার আগে সম্ভব নয়! তবে?
নতুন এক অধীপের জন্ম হচ্ছে যেন! চোখ মুখে দেখা দিল অস্বাভাবিক এক কাঠিন্য। হাত মুষ্টিবদ্ধ হচ্ছে দৃঢ় কোন প্রতিজ্ঞায়। জাগছে পাখিরা। লালিমায় ছেয়ে গেছে পূর্ব দিগন্ত। না আর দেরী নয়। ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে গেল অধীপ। আদেশের স্বর বেরিয়ে এল কন্ঠ থেকে। ‘ভোর হয়ে গেছে, ওঠ কালী’। কালী তখনও অঘোর ঘুমে। একটু স্বর চড়িয়ে আবার ডাকল অধীপ, ‘কালী তোমাকে উঠতে বলেছি আমি’। ঘুমের ঘোরেই বলল কালী, ‘বিরক্ত করো না, সব্বাইকে বলে দেব তোমার গোপন কথা’। চেনা যাচ্ছে না এই অধীপকে। বেশ একটু কঠিন হয়েই বলল সে, ‘সেই জন্যই ডাকছি তোমায়, সব্বাইকে জড়ো করেছি তোমার কথা শোনার জন্য,অপেক্ষা করছে ওরা’। চোখ কচলে তাকালো কালী অধীপের দিকে। এ কোন অধীপকে দেখছে কালী! দু চোখে উপছে পড়ছে অপার বিস্ময়। এবার সোজা তাকালো অধীপ কালী’র দিকে। আবার কঠিন হল তার কন্ঠস্বর। বলল সে, ‘ঝটপট তৈরী হয়ে নাও, তোমার কথা শেষ হলে যেতে হবে যে!’ হারিয়ে গেল কালীর সমস্ত জারিজুরি। অনেক কষ্টে বলতে পারল, ‘কোথায়?’জবাবে বলল অধীপ, ‘তোমার মায়ের কাছে’। কথাটা কানে যেতেই প্রায় এক লাফে নেমে পড়ল কালী খাটের ওপর থেকে, পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল বারবার , ‘না না এমন করো না তুমি, এই নাও তোমার চাবি, বল, আমাকে কি করতে হবে’। ‘আপাতত তোমাকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ঠিকঠাক করে নিতে হবে তারপর ….’ অধীপের কথা শেষ হয়নি তখনো, দরজার বাইরে সমবেত ফিসফিস কথার আওয়াজ। একটু ভীতু মনে হল কি কালীকে! সে দাঁড়াল অধীপের কাছে মাথা নত করে, বলল, ‘আমি বলেছি তো, এখন থেকে তুমি যা বলবে তাই হবে, আমার কিছু বলার নেই, ওদের যেতে বল’।
দরজাটা হাট করে খুলে দিল অধীপ। ভাইবোন সম্পর্কের যারা তারা শয্যা তুলুনির দাবী নিয়ে দরজা আটকে দাঁড়িয়েছে। কালী ভেবেছিল, অধীপ ওদের জড়ো করেছে যাদের কাছে ওকে বলতে হবে অধীপ সম্পর্কে ও কোন গোপন কথা বলবে বলেছিল সে কথা বলার জন্য। তা নয় তো! কেমন এক মধুর আচ্ছন্নতায় ছেয়ে গেল কালী’র মন। একটি রাতের ব্যবধান অথচ কি অভাবিত পরিবর্তন দু’জনের কথায় আর আচরণে! অতি নম্র স্বরে বলল কালী, ‘দিয়ে দাও না ওরা যা চাইছে!’ চাবিটা কালী’র হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল অধীপ, ‘আলমারি খুলে তুমিই দিয়ে দাও না!’ আর একবার বিস্ময়ের ধাক্কা। ধীরে চাবিটা নিয়ে আলমারি খুলে দু’ হাজার টাকা বের করে এনে টাকা আর চাবি দুটিই দিয়ে দিল কালী অধীপের হাতে। খুশী হয়ে চলে গেল ওরা। কালী আবার জানতে চাইল, এর পর কি করবে সে। অধীপের বড় কষ্ট হচ্ছে কালীকে নির্দেশ দিতে তবু বলল সে, এখন স্নান করে এসে মাকে প্রণাম করে জেনে নাও কিছু করবার আছে কিনা। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে তোয়ালে নিয়ে বেরিয়ে গেল কালী বাথরুমের দিকে।
অধীপ প্রশ্ন করলো নিজেকে, সেকি কোন অন্যায় করছে কালী’র প্রতি? জবাব খুঁজে নিল নিজেই, যদি তার কঠিন আচরণ কালী’র পক্ষে মঙ্গলদায়ক হয় তবে সেটা অন্যায় হবে কেন। কে জানে এই কালীই হয়ত একদিন আদর্শ গৃহবধূ হয়ে উঠবে। আর যদি তা না-ই হয় তবে এক বৎসর পর দেখা যাবে! আইনের পথ তো খোলাই আছে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন