কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৫

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 


 

(৩৯)  

সেদিন রাত্রেই একটা অদ্ভুত ফোন এল।

হৃদয় বলছেন? একটি ছেলের গলা।

আমাকে চিনবেন না। সমিধা আপনাকে ফোন করতে বলল।

বলুন।

সমিধা বলল, ফুল নিয়ে অতলান্ত যেসব জোকস লিখেছে, সবই আপনার কাছে আছে। ওগুলো আমাকে একটু দিতে হবে।

হৃদয় খুব বিরক্ত হল। বলল, আপনি ওগুলো অতলান্তকে ফোন করেই চেয়ে নিন। ওর জিনিস ওর কাছেই থাকবে। আমার কাছে নেই। 

না, সেটা অসম্ভব। অতলান্ত এখন বিদেশে। তাছাড়া ও এখানে থাকলেও আমি ফোন করতাম না। অতলান্ত এখন সেলিব্রিটি। এসব তুচ্ছ কারণে ওকে ফোন করা যায় না। আপনি যদি পারেন...

হৃদয় বুঝতে পারল, ওকে অপমান করতেই কেউ ফোনটা করেছে। আর ফোনটা করিয়েছে সমিধাই। রেগে ও ফোনটা কেটে দিল। কিন্তু কেন এসব করছে সমিধা? কেন ও বারবার মনে করিয়ে দিতে চায়, হৃদয় ব্যর্থ হয়েছে? অথচ ও নিজে সফল হয়েছে। আগ্নেয় সফল হয়েছে। অতলান্ত সফল হয়েছে। সমস্ত সফল ব্যক্তিদের ও এক ব্র্যাকেটে রাখতে চায়। আর হৃদয়কে চায় কোণঠাসা করতে।

এই ফোনটা হৃদয়ের মনে জ্বালা ধরিয়ে দিল। একটা উটকো ফোন। রাতে বিছানায় শুয়েও ছটফট করতে লাগল। কিন্তু সমিধাকে কোনও শাস্তি দেওয়ার কথা মনে এল না। শায়েস্তা করার কথাও নয়। ও শুধু সমিধার থেকে দূরে সরে যেতে চায়। কিভাবে সেটা সম্ভব, সেটাই ভাবতে লাগল।

বিশ্রুত নাচের জন্য একটা পুরস্কার পেয়েছে। হৃদয়কে খাওয়াতে চায়। রেস্তোরাঁয় পৌঁছে হৃদয় দেখল সেখানে সমিধাও বসে আছে। একটু অস্বস্তি হল হৃদয়ের। ওকে দেখেই সমিধা বলল, তোর জন্যই বসে আছে। আমার একটু তাড়া আছে। বিশ্রুতকে বলেছিলাম একটু আগে আসব। আমার খাওয়া হয়ে গেছে। ভাবলাম, তুই এলে দেখা করেই চলে যাব...

সমিধা যে এখন একজন ব্যস্ত ও সফল মানুষ ওকে দেখলেই বোঝা যায়। অত্যন্ত দামী ও খোলামেলা পোশাক। ত্বক উজ্জ্বল ও পিচ্ছিল। দেখলে তাক লেগে যায়। হৃদয়ের ওকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করল। এটাই চেয়েছিল সমিধা। বুঝতে পারল ও সফল হয়েছে। হৃদয়ের মনে লোভ জাগিয়ে ও চলে গেল।

বিশ্রুত বলল, সমিধাকে আমি বলতে চাইনি বিশ্বাস কর। একদম শেষ মুহূর্তে...

তুই এসব আমায় বলছিস কেন? হৃদয় জানতে চাইল।

না, তোর কোনও অসুবিধা হোক আমি চাইনি।

তাহলে বললি কেন?

তুই আসবি শুনে ও নিজেই আসতে চাইল। উৎসাহ দেখাল।

বিশ্রুত, কেন ও এরকম করছে?

ও তোকে ভুলতে পারছে না হৃদয়। একের পর এক ছেলের সঙ্গে জড়িয়েছে। তবু...

কেন, কেন ভুলতে পারছে না? আমি তো ওকে ভুলতে চাই।

ও তোকে জীবনে অনেক উঁচুতে দেখতে চেয়েছিল। এখন তোকে ধ্বংস করতে চায়। ও এখন তোর প্রতিপক্ষ। একটু বেশীই ভালোবেসে ফেলেছিল তোকে। সহজে ছাড়া পাবি না...

হৃদয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

কেস স্টাডি ৬

The important ones aren’t the ones who leave, but the ones who stay.

Fidel Castro

কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের দেখলেই মনে হয়, তারা ভুল করে এই পৃথিবীতে চলে এসেছে। তারা এই পৃথিবীর কেউ নয়। এই পৃথিবীতে থাকলেও আসলে তারা দেবদূত। কেউ তাদের চিনতে পারছে না। নিজেদের মাপকাঠিতে তাকে বিচার করছে। কিন্তু সেই মাপকাঠির অনেক উঁচুতে তাদের জায়গা। শ্রমণ ছিল সেরকমই একজন মানুষ। শ্রমণকে ফুলের বাগানে নিয়ে এসেছিল সমিধা। বিশ্রুতর সঙ্গে সেই যে দূরের একটা দ্বীপে হঠাত খেয়ালের বশে চলে গিয়েছিল সমিধা, তখন থেকেই শ্রমণকে নিয়ে একটা ঘোর তৈরি হয় সমিধার মনে। অদ্ভুত একটা ভালো লাগার ঘোর। বেশ কিছুদিন খুব মেশামেশি চলে। শ্রমণ বাড়ির সবচেয়ে ছোটো ছেলে। লোকের ধারণা, ছেলেটি একদমই উচ্ছন্নে গেছে। দিনের বেশীর ভাগ সময়ে নেশা করে পড়ে থাকে। আর বাকি সময় বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে। সঙ্গীদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। মানুষের উপকার করে বেড়ায়। যদিও কোনও ভূতই শ্রমণের ঘাড়ে বেশীদিন টিকে থাকে না। বিপ্লবের ভূতও নেমে গেছিল অচিরেই। পরিবারে শ্রমণই ছিল একমাত্র ছেলে। তাকে নিয়ে তার চার দিদি ও একমাত্র ভাগ্নীর চিন্তার শেষ নেই।

সমিধা জানতে চেয়েছিল, ওরা তোকে অসম্ভব ভালোবাসে। তোর পরিবারের সবাই। আমি ওদের খুঁটিনাটি নজর করে দেখেছি। কেন?

সেটা ওরাই জানে। উড়িয়ে দিয়েছিল শ্রমণ। জড়িয়ে এসেছিল ওর গলা।

সমিধা হেসেছিল। ও নিজে কেন শ্রমণকে এত পছন্দ করে?

সমিধার কাছ থেকেই ফুলের বাগানের খবর জানতে পেরেছিল শ্রমণ। ও শুধু কৌতূহলী হয়েছিল দিশারীর কথা শুনে। খুঁটিনাটি শুনে বলেছিল, আমরা ছোটবেলার বন্ধু। একসঙ্গেই বড়ো হয়েছি। অনেকদিন আমাদের যোগাযোগ নেই। কেমন আছে ও?

একদিন একটা ঘটনা ঘটে। ফুলের একটা মেলায় গিয়েছিল শ্রমণ। সেখানেই ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় পুরোনো এক বন্ধুর। ছোটোবেলায় একই স্কুলে পড়ত ওরা। তখন থেকে হাত সাফাইয়ের কাজে বন্ধুটির নামযশ হয়ে গিয়েছিল। সেদিন কিছুক্ষণ একসঙ্গে ঘোরাঘুরির পর জরুরি কাজ আছে বলে বন্ধুটি অদৃশ্য হয়ে যায়। শ্রমণ ফুলের অনুরাগী। প্রচুর ফুল সে বাছে। বিল পর্যন্ত হয়ে যায়। কিন্তু টাকাটা দিতে গিয়ে দেখে পকেটে মানিব্যাগটা নেই। শ্রমণ অনেক খুঁজে বন্ধুটিকে বার করে। তারপর বলে, আমি জানি আমার মানিব্যাগ তুইই চুরি করেছিস। তোর টাকার দরকার থাকলে সরাসরি বলতে পারতি। আমি দিয়ে দিতাম। এখনও দিতে পারি। ওই মানিব্যাগে যে টাকা ছিল তা আমি  ফেরত নিতে আসিনি। আমি শুধু তোর মুখ থেকে তোর পাপের কথাটা শুনতে চাই। কেন তুই এরকম করলি? কেন কেউ এরকম করতে পারে?

বন্ধুটি বলে, আমি তোর মানিব্যাগ চুরি করিনি।

অবশ্যই করেছিস। আমি সেটা জানি। তুই স্বীকার কর।

তুই বোধহয় জানিস না আমার দাদা পুলিশে চাকরি করে। তোর কিন্তু বিপদ হতে পারে। আমার হাতঘড়িটা আজ মেলায় চুরি হয়েছে। আর তুই ছাড়া আর কেউ আমার সঙ্গে ছিল না। বন্ধুটি পালটা শাসায়।

শ্রমণ উত্তেজিতভাবে বলে, আমি তোকে ক্ষমা করতেই এসেছিলাম। কিন্তু সেটা বোধহয় আর সম্ভব নয়। তুই আমাকে সেই সুযোগ দিলি না...

আমার হাতঘড়িটা কিন্তু তোকে ফেরত দিতেই হবে। বন্ধুটি বলে। তারপর সোজা থানায় গিয়ে শ্রমণের নামে রিপোর্ট করে আসে।

সমিধা সেদিন শ্রমণের সঙ্গে দেখা করতে গেছে। একই দ্বীপে ওদের বাড়ি। পথেই শ্রমণের এক দিদির সঙ্গে দেখা। গোটা ঘটনাটি সে সমিধাকে জানায়। তারপর বলে, বন্ধুটির দাদা এখন পুলিশের গাড়ি চেপে শ্রমণকে ধরতে আসছে। থানা থেকে শ্রমণকে বাড়িতে থাকতে বলা হয়েছে। বেশ হাঁপাচ্ছিল সে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে যোগ করে, আমার ভাই ফুলের মতো নিষ্পাপ আর দেবদূতের মতোই পবিত্র এক মানুষ। ওর নামে যারা নিন্দা করে বেড়ায়, তারা ওর কড়ে আঙুলেরও যোগ্য নয়। কোনও পাপ ওকে কখনও স্পর্শ করতে পারবে না। ও ড্রাগ খেয়ে নেশা করে, মদ খায়, সারারাত বাইকে চড়ে হুল্লোড় করে, রাস্তায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে, মেয়েদের দেখলেই পাগলের মতো প্রেমে পড়ে, কিন্তু তবু বলছি ওর মনে একফোঁটা নোংরামি নেই। এই পৃথিবীতে এরকম পবিত্র মানুষ আমি আর দেখি নি। তুই আয় সমিধা, আমাদের তো ভরসা দেওয়ার মতো বিশেষ কেউ নেই...

শ্রমণদের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই সুরের ঢেউ আছড়ে পড়তে শুরু করল সমিধার কানে। একটু অবাকই হল ও। বাড়ির ভেতর ঢুকে রেকর্ড প্লেয়ারটা দেখতে পেল।

আমার বাবার। খালি গায়ে একটা সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিল শ্রমণ। সেই সোফার কাপড় বহু জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। আঙুল দিয়ে রেকর্ড প্লেয়ারটা দেখাল শ্রমণ।

গান শুনছিলি? সমিধা বলল।

মোৎসার্ট। ছোট্ট একটা শব্দ। তিরের মতো বিঁধল সমিধার কানে। আবার সেই ভালো লাগা। পুলিশ আসছে শুনেও শ্রমণের কোনও বিকার নেই। সে মোৎসার্টে ডুবে আছে।

পুলিশ এসে সত্যিই সেদিন শ্রমণকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সারা রাত লক আপে আটকেও রাখে। আর পরদিন ভোরবেলা চা খাইয়ে ছেড়ে দেয়। সেই সময় সেই বন্ধটির দাদা সেই বন্ধুটিকে ঠাস ঠাস করে গালে দুটো চড় মারে। কে সত্যি কথা বলেছে আর কে মিথ্যে ততক্ষণে প্রমাণিত হয়ে গেছে।

সমিধা বলেছিল, হৃদয়, এরকম আমি আর দেখিনি। একটু পরে পুলিশ আসবে, আর সে তখন বসে মোৎসার্ট শুনছে? হাসতে হাসতে বলছে, পুলিশের কাজ পুলিশে করবে। আমার কী? এখন আমার খুব মোৎসার্ট শুনতে ইচ্ছে করছে।

শ্রমণকে তুই এখানে নিয়ে আয়। ফুল ওর খুব প্রিয়। তুই বলছিলি না? হৃদয় বলেছিল।

শ্রমণ ফুলের বাগানে এসে যোগ দিল। এখানেই ওর সঙ্গে বিহানের দেখা হল। সমিধাই আলাপ করিয়ে দিল। বিহান পরে সমিধাকে বলেছিল, এই তোর শ্রমণ!

প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারেনি সমিধা। আসলে শ্রমণকে দেখে বিহান নিশ্চিন্ত বোধ করেছিল।

বিহানকে নিয়ে গোড়ার দিকে একটু সমস্যাতেই পড়েছিল হৃদয়। তার স্বাভাবিক জীবনযাপনে যেন ছন্দপতন ঘটল। বিহান নিজের ঘরবাড়ি ত্যাগ করল। থাকতে শুরু করল হৃদয়ের বাড়িতে। রাতে হৃদয়ের বিছানায় হৃদয়ের পাশেই শুয়ে থাকে। তখন এমনভাবে হৃদয়কে জড়িয়ে ধরে মনে হয় সেই বন্ধনে নিজের সবটুকু আবেগ ঢেলে দিয়েছে। ক্তহা বলার সময় ওর মুখের ভাব পালটে যায়। কী গভীর দরদে ও কথা বলে। ওর আচরণে একটা তীব্র নাটকীয়তা আছে। কিন্তু হৃদয় তখন স্নেহান্ধ। সেই নাটককে বোঝার ক্ষমতা ছিল না ওর। দিনের বেলা হৃদয়কে চোখে হারায় বিহান। হৃদয়ের মাও যেন ওকে বড়ো বেশী আপন করে নিলেন। দুজনে চারবেলা যখন একসঙ্গে খেতে বসে, মনে হয় আশৈশব যেন ওদের এভাবেই একসঙ্গে খতে বসার অভ্যাস। বিহান খেতে খুব ভালোবাসে। প্রচুর খায়। হৃদয়ের মা হাসিমুখে ওর খাওয়া থাকা শোওয়ার ব্যবস্থা করেন। বিহান যেন বাড়ির ছেলেই হয়ে উঠেছে। ওর সঙ্গে যে আলাপ মাত্র কদিনের, ওকে দেখে তা বোঝার কোনও উপায়ই নেই।

(ক্রমশঃ)  

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন