কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / প্রথম সংখ্যা / ১২৮

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / প্রথম সংখ্যা / ১২৮

মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৫

নীতা বিশ্বাস

 

সমকালীন ছোটগল্প


পরিবর্তন

 

এখন রাতের শেষ প্রহর। একটু পরে ঝাপসা আঁধার একটু একটু করে সরিয়ে ভোরের দখল নিয়ে আর একটা দিন শুরুর ঘোষণা করবে অস্পষ্ট সূর্যালোক। আর আয়নায় নিজের মুখটাকে নিজের কাছেই হয়তো  একটু অচেনা লাগবে সাহিত্যিক ছন্দবাণী মুখোপাধ্যায়ের। এই মূহূর্তে তাঁর বিছানা জুড়ে অবিন্যস্ত ছড়িয়ে  রয়েছে তাঁর এতদিনের সাহিত্যজীবনের প্রপ্তিগুলো। শিল্ড মেডেল সার্টিফিকেট আর সম্বর্দ্ধনার নান্দনিক উত্তরীয়্র সম্ভার, সেইসঙ্গে নিজের লেখা গল্প-উপন্যাস-কবিতার বইগুলো। জীবনের এইসব পরম  স্বীকৃতিগুলো কার না ভালো লাগে! এগুলো ছন্দবাণী দেবীকে তাঁর সাফল্যের গল্প শোনায় যখন তখন। কাঁচের শোকেসে   এইগুলো যত্নে সাজিয়ে রেখেছে তাঁর পুত্রবধু ঈশিকা। বাড়ির কাজের মেয়েদের এগুলোতে হাত লাগাতে দেয় না ঈশিকা। নিজের এতখানি ব্যস্ত জীবনেও সে সময় বার করে নিজের হাতে ঝাড়ামোছা করে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে। এই নিষ্ঠার মধ্যে ছন্দবাণী তাঁর প্রতি মেয়েটির শ্রদ্ধা আর সম্মানের নিশ্চুপ বহিঃপ্রকাশ দেখতে পান। মনে মনে সম্মানিত হন তিনিও। আসলে হুল্লোড়ের মধ্যে এইসব সংবেদনশীল অর্পণে  আন্তরিকতা থাকে না, বরং বড্ড বেশী লোকদেখানো মনে হয় তাঁর। যদিও দলবদ্ধ সাহিত্যযাপনে পরস্পরের ভাববিনিময়ের মধ্যে দিয়েও সাহিত্যযাপনের গুরুত্ব অস্বীকার করতে পারেন না তিনি। দলবদ্ধ তরুণেরা তাদের চোস্ত সার্প মস্তিষ্ক দিয়ে কত কি ভয়ঙ্কর রকমের ক্রাইম করতে পারে, সে তো অহরহই কাগজের শিরোনামে। এই তরুণের দল সেভাবে সহজে শিরোনামে আসার লোভকে উপেক্ষায় পাশ কাটিয়ে সাহিত্যচর্চায় মেতেছে, সাইবারক্রাইম বা ব্যাংকডাকাতির জালিয়াতিকে সযত্নে উপেক্ষা করে, ছন্দবাণী দেবীর  কাছে এটাই অনেক বড় কথা। এইভাবেই উনি ভাবতে অভ্যস্ত।

তো সেদিন একজন কবির কাছে শুনলেন, প্রতিটি সাইবারক্রাইম একেকটা ছিলাকাটা হিরের মতো দুর্দান্ত ও ঝকঝকে হিরন্ময় কবিতা। আর ব্যাঙ্কজালিয়াতি একেকটা নিপুণ হার্ট-সার্জারি। এইসব প্রতিভাকে সেলাম। চমকপ্রদ এই মন্তব্যে তাঁর চিন্তাজগতে একটা আলোড়ন তুলেছিল। ভাবতে ভাবতে তাঁর মনে হয়েছিল, একুশ শতক কি এইরকম সাহিত্যসৃষ্টির জন্য সমৃদ্ধ জমি প্রস্তুত শুরু করে দিয়েছে! কতখানি চোখ কান খোলা সতর্কতা না থাকলে এইসবকে শিল্প করে তোলা যায়, সেটা ভাববার কথা বটে!

এইসব কথা নিয়ে মনে মনে বেশ আলোড়িত হচ্ছেন যখন, সেইসময়েই একটা নামকরা পাক্ষিক পত্রিকায় একটি গল্পে ঈশিকা মুখার্জীর নাম দেখে অবাক হলেন! আমাদের পুত্রবধু ঈশিকা কি সাহিত্যচর্চাও করে! ভাবা এ্যাটোমিক রিসার্চ সেন্টারের মতো একটা সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব সামলিয়েও এসব করা যায়! সারাদিনে কখন লেখার সময় পায় সে! সঙ্গে সঙ্গেই ভাবলেন একদা একটা কলেজের প্রিন্সিপ্যালের দায়িত্ব সামলে তিনিও তো এতদিন ধরে লেখালিখি করেছেন! যে লেখে সে সব অবস্থার মধ্যেই লিখতে পারে। আবার ভাবলেন একই নাম পদবীর অনেক মেয়েই থাকতে পারে। এ কিছু আশ্চর্যের বিষয় নয়। ওকে জিজ্ঞাসা করে দেখবো কি একবার! নাঃ। থাক। বরং খেয়াল রাখি। খোঁজখবর নিই।

ছন্দবাণী গল্পটি নিয়ে বসলেন এবং পড়তে পড়তে উত্তরোত্তর বিস্মিত হতে লাগলেন! মঙ্গলগ্রহে বসতি স্থাপনের মিশন নিয়ে বেশ কয়েক মাস ধরে উড়ে চলেছে যে ভারতীয় মহিলা জেসমিন বেঞ্জামিন মহাকাশ যানে থাকার চারমাস পূর্ণ হলো। খুব আশা নিয়ে যাচ্ছে সে। পৃথিবীর ধনীতম মানুষ এলেন মাস্ক এই নতুন বছরে চাইছে অসুস্থ পৃথিবী ধ্বংসের আগেই বেঁচে থাকা পৃথিবীর মানুষদের অন্য কোনো সুস্থ নিরাপদ গ্রহে আস্তানা দেওয়ার। সেই মিশন নিয়ে মহাকাশযানে পাড়ি দিতে প্রস্তুত এক ভারতীয় মহিলা। ইতিমধ্যে  মহাকাশে অনিতা উইলিয়ামস্‌ অনির্দিষ্টকালের জন্য মহাশূন্যে ঘুরে চলেছে। যান্ত্রিক গোলযোগ তাকে আটকে রেখেছে। অনিতা ক্রমশঃ নিজের ওজন হারাচ্ছে। শরীরের হাড় ক্ষয়ে ক্ষয়ে নরম হয়ে যাওয়াতে ক্রমশঃ কুব্জ নুব্জ হয়ে চলেছে সেই সাহসী মেয়েটি। চামড়ায় বলিরেখায় প্রত্যেকদিন বৃদ্ধ হয়ে চলেছে সে। এই প্রেক্ষাপটে মঙ্গলগ্রহে অভিযাত্রী মেয়েটির মানসিক জগতের জটিল ও সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম চিন্তার অনুপুঙ্খের গভীর নিষ্ঠায় মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণের সাথে সাথে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঈশিকা! তার প্রত্যেক বাক্যগঠন ছন্দবাণী  দেবীর কাছে  কেমন এক অচেনা ছন্দে বাজছে! শব্দবন্ধ এই পৃথিবীর, কিন্তু যেন এই পৃথিবীর নয়, এমন তাদের প্রয়োগের আশ্চর্য মহিমা। এই লেখার জগতের খবর তো তিনি জানেন না! এই চিন্তাজগতের! এই টাটকা সবুজ প্রাণময় লেখ্যভাষার! এই রহস্যমাখা যাদুকরী বিন্যাসের! পড়তে পড়তে লেখিকা ছন্দবাণী মুখোপাধ্যায় কেমন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর যেন মনে হতে লাগলো এই লেখা তাঁদের ঈশিকারই। কিন্তু তিনি ওকে জিজ্ঞাসা করতে পারলেন না। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো তাঁর। তাঁর অজান্তে কবের থেকে এই পরিবর্তন! সারাটি দিন এক গভীর  আচ্ছন্নতায় কাটিয়ে রাতের নির্জনতায় কেমন ভয় ভয় করতে  লাগলো তাঁর। সারারাত ধরে নির্ঘুম ছন্দবাণী এতদিনের পাওয়া সম্মাননার স্থির বস্তুসকল, এতদিনের সাহিত্যসম্ভারের দিস্তা টেনে টেনে বের করে বিছানায় নামিয়ে এনে দেখলেন সেখানে তাঁর আর বসবার জায়গা নেই। এইভাবেই হয়তো আগামী ভবিষ্যতের সাহিত্যজগতে তাঁর আর বসবার জায়গা থাকবে না! তিনি তো এতদিন ধরে শুধু রান্নাঘর আর বিছানার আর কুঁদুলে সংসারের গল্প লিখেছেন ঘরোয়া শব্দের ভাষায়! সে জগত দেখতে দেখতে পাঠক এতদিনে ক্লান্ত হয়ে গেছে। ভাবতে ভাবতে একটা নতুন সকাল নামলো তাঁর মনের মধ্যে। কিন্তু ছন্দবাণী কিছুতেই তাঁর পুত্রবধুকে  ডেকে জিজ্ঞাসা করতে পারলেন না, গল্পের লেখিকা  ইশিকা মুখার্জী সে কি না! মনে মনে একটা ঈর্ষাবোধ তাঁকে  বিচলিত করে তুললো কি!

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন