কবি গৌরাঙ্গ মোহান্তের ‘করোটিমঞ্চে খেমটাওয়ালি’: নাগরিক নৈঃশব্দ্য-চেতনা
বলয়ের কাব্য
বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি গৌরাঙ্গ মোহান্ত। একাধারে তিনি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক ও কবি। তিনি প্রায় চার দশক ধরে লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত। তাঁর সাম্প্রতিক প্রকাশিত গদ্যকবিতার বই ‘করোটিমঞ্চে খেমটাওয়ালি’ (আগস্ট ২০২৪)। এ কাব্যে স্থান পেয়েছে চল্লিশটি কবিতা যার অধিকাংশই চূর্ণ কবিতা। কবিতাগুলির রচনাকাল ২০১৮ সালের আগস্ট হতে ২০২৩এর ডিসেম্বর।
সময়ের দাবি মেনে সব শিল্প-প্রকরণ বদলে যায়। যেকোনো সংবেদনশীল শিল্পীকে সময়ের দাবিকে মান্যতা দিতে হয়। বিশ শতকে ইংলণ্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে মানুষের হাতে সময় কমে আসে। বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ‘দৃশ্যকাব্য’ তথা নাট্যশিল্পকেও হতে হয় সংক্ষিপ্ত ও পরিমিত। জন্ম হয় একাঙ্ক নাটকের। একবিংশ শতাব্দীতে গ্লোবালাইজেশন, মোবাইল, ইন্টারনেট প্রযুক্তি বদলে দেয় সমগ্র বিশ্বকে। অ্যানড্রয়েড ফোন, ইমেল, ইন্সটাগ্রাম, ফেসবুক, হোয়াটস্অ্যাপ-এর প্রভাব শিল্প-সাহিত্যকে বদলে যেতে বাধ্য করে। অ্যানড্রয়েড ফোনের স্ক্রিন-এর মাপে কবিতা, গল্প ও গদ্য চর্চার নতুন পরিসর গড়ে ওঠে। শিক্ষিত নয়া কর্পোরেট সংস্কৃতিতে কর্মব্যস্ত পাঠকের দীর্ঘ গল্প, কিংবা দীর্ঘ কবিতা পাঠের ধৈর্য আর নেই। এই উত্তরাধুনিক সময়ে জন্ম নিলো অণুগল্প, অণুকবিতা, মিম (meme) ৷ সময়ের দাবিকে মান্যতা দিতে কবি শিল্পীরা আপস করতে বাধ্য হলেন। প্রায় এক দশক ধরে মোবাইল স্ক্রিনের মাপ অনুযায়ী লেখা কবিতাগুলি হল ‘ভাইরাল’৷ অবশ্য সর্বত্র যে এমনটা হয়েছে তা নয়, তবে এই সময়ের অধিকাংশ কবি যুগের দাবিকে মান্যতা দিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে নির্মাণ করেছেন কবিতার শরীর ও শৈলী।
এই উত্তরাধুনিক ‘অণুকবিতা’ শৈলীর অনুরণন কিছুটা হলেও গুঞ্জরিত হয়েছে কবি গৌরাঙ্গ মোহান্তের ‘করোটিমঞ্চে খেমটাওয়ালি’ কাব্যগ্রন্থে। দ্রুত পড়ে ফেলা যায় এ কাব্যের সবকটি কবিতা। পাঠক এক লহমায় কল্পনায় মানস ভ্রমণের স্বাদ পেয়ে যেতে পারেন। সংক্ষিপ্ত পরিসরে দিনলিপির মতো কবি, টানা গদ্যে লিখে গেছেন নৈঃশব্দ্য অনুভববেদ্যতার কাব্য। ‘করোটিমঞ্চে খেমটাওয়ালি’ কাব্যের পরতে পরতে রয়েছে চেতন-অবচেতন, নৈঃশব্দ্য, শূন্যতা, যন্ত্রণার নীরব গান। মানব মস্তিষ্কের ‘চেতনা বলয়ের নৃত্য’কে কবি দৃশ্যত অনুভব করিয়েছেন। ‘জলসত্তা’, ‘সেরিব্রাম’, ‘শূন্যতা’, ‘দ্বীপগৃহ’, ‘নিস্তব্ধতার দিকে’, ‘নিঃসঙ্গ যাত্রা’, ‘স্বপ্ন’, ‘তরঙ্গ-অস্তিত্ব’ প্রভৃতি কবিতার শিরোনামগুলি লক্ষ করলে সহজেই পাঠক অনুভব করবেন ‘বিরূপ বিশ্বের’ তাপ-উত্তাপ ও চেতনার অবিশ্রাম খেমটা নৃত্য। 'করোটি’ শব্দবন্ধে প্রাচীন শৈব অঘোরপন্থী ভাব উদয় হলেও আসলে কবি আধুনিক সময়ে যন্ত্রণাবিদ্ধ নাগরিক চেতনার আড়ালে প্রতিমুহূর্তে মানুষের সংগ্রামী প্রয়াসকে ‘খেমটাওয়ালি’র সস্তা বিনোদনের সাযুজ্যে মিলিয়ে দিয়েছেন।
উত্তরাধুনিক মানুষ কেবলই অষ্টপ্রহর জেগে থাকে, আর এক অদৃশ্য ইশারায়, প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও ‘খেমটাওয়ালি’র মতো পুতুল নাচ নেচে বেড়ায়। কবি গৌরাঙ্গ মোহান্ত লেখেন— 'মানুষ ক্ষতবিক্ষত হয়; প্রদাহ নিয়ে তারা হেঁটে চলে ৷ হাঁটতেই হয়, চোখের জল মুছতে মুছতে হাঁটতে হয়; বিক্ষত পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধতে বাঁধতে হাঁটতে হয়। পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে থাকবার কোনো জায়গা নেই৷’ (দাঁড়িয়ে থাকবার জায়গা নেই) কবি মনে করিয়ে দেন, সবাই যেন সিসিফাসের প্রেতাত্মা। এই গতানুগতিক বৃত্তাকার অ্যাবসার্ড-অদ্ভুত জীবন হতে কারো নিস্তার নেই। কবি লেখেন—'ভূমণ্ডল আকুঞ্চিত হয়ে এলে করোটির ওপর নির্মিত মঞ্চে খেমটাওয়ালির মুদ্রা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে; তুমি নিস্পন্দ একটি শরীর নিয়ে বসে থাকো অন্ধকার তুন্দ্রাগৃহে।’ (নীল বরফের নিচে) কবি উপলদ্ধি করেন, 'সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডে প্রতিধ্বনিত সুরের ভেতর জেগে থাকে ক্রন্দন’ (নারকেল বনের এসরাজ)। আর তাই, কবি চলে যেতে চান সবুজঘেরা মাঠের নির্জনতায় —'আমি উড়ে চলি শ্যামল মাঠের দিকে যেখানে মৈত্রেয়ী দাঁড়িয়ে থাকে।’ (পার্পল দল ও পল্লব)। কবি, মৃত্যুর নীল রঙের রোমান্টিকতায় গা-ভাসিয়ে দেন, প্রকৃতির কাছে কিংবা ‘প্রতিকূল আকাশের নিচে’ হেঁটে বেড়াতে চান। ‘বনসুপারির যৌগিক পত্রে’, ‘নারকেল বনে’ কিংবা, ‘পেঁপেফুলের মেহনশুভ্রতা’য় খোঁজেন শান্তির আশ্রয়। কবি প্রতিকূলতার মাঝে খোঁজেন উজ্জীবনের মন্ত্র— 'পৃথিবীর সবকিছু ক্রমশ নিস্তব্ধতার দিকে এগিয়ে যায়। তবুও বস্তুর অভাবনীয় অবয়ব নির্মাণের ভেতর দিয়ে আমরা আনন্দ তরঙ্গে ভেসে যেতে থাকি।’ (নিস্তব্ধতার দিকে)।
কবি গৌরাঙ্গ মোহান্ত আদ্যন্ত নাগরিক কবি। পৃথিবীর নানান মিথ ও ইতিহাসকে আধুনিক সময়ের সাযুজ্যে নিরীক্ষণ করেছেন। মানুষের নাগরিক ক্লান্তি তিনি যেমন প্রত্যক্ষ করেছেন, তেমনি নাগরিক মানুষের লোভ-লালসা তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। অসামান্য এক কাব্যপংক্তিতে তিনি তা ব্যক্ত করেছেন যা, প্রবাদের সমতুল—'মোহরের ভেতর শরীরী আকাঙ্ক্ষা তরঙ্গিত হয়ে ওঠে’ (শরীর ও মোহর)৷ সত্যিই তো! অর্থরাশি জমা হলে কামনার বহ্ণি জ্বলে ওঠে সব বয়সের, সব মানুষের মনে৷ তখন মোহর দিয়ে মানুষ ‘খেমটাওয়ালি’র নাচ দেখার স্বপ্ন সত্যি করে পাঁচতারা হোটেলের রাতপরীদের সঙ্গে।
‘করোটিমঞ্চে খেমটাওয়ালি’ কাব্যে কবি নীল রঙের অনুভবকে ভিন্ন মাত্রা প্রদান করেছেন। নীল রঙ-এ কাব্যের সারা শরীরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। বোঝা যায় কবি নীল রঙের প্রতি অনুরাগী। ‘নীল,' 'নীলকণ্ঠ’ মৃত্যুর রঙ। কবি যেন মৃত্যুর বহুমুখী ব্যঞ্জনাকে বাঙ্ময় করে তুলতে কাব্যপংক্তিতে, নীল রঙের সচেতন প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। প্রসঙ্গত দু’একটি উদ্ধৃতি চয়ন করা যেতে পারে— 'সমস্ত নীলের ভেতর দিয়ে প্রসারিত তার দৃষ্টি’ (পার্পল দল ও পল্লব), ‘তরল নীলে... নীলের গাঢ়ত্ব... নীলের গন্ধ... নীলগন্ধী’ (সানডায়ালের নোমান), ‘নীল মাঠের দক্ষিণে’ (বাগান-পথের সিক্ততা), ‘অগণিত রেখার নীলত্বের ভেতর আমি নিমজ্জিত হই’ (স্বপ্ন), ‘এ পথ ধরে নীলকণ্ঠ পাখি উড়ে যায় দূর মাঠে (সংকেতময় মাঠ), ‘সিনট্যাক্সের ভেতর অসংখ্য নীল ব্রিজ’ (আকাশে পদ্মতন্তু), ‘নীল পপির গানে কাঁপে সীমাশূন্য মাঠ’ (গ্যালাটিয়া), ‘পৃথিবীর নীল বাক্যাবলির রহস্য... ভূমণ্ডলে নীল মৌলিক রং’ (লোকযাত্রার সূত্র), ‘নীলসারে সঞ্চিত মাঠের ধুলো’ (নিঃসঙ্গ যাত্রা), ‘তোমার যাত্রাপথের দুধারে কৃষক বুনে চলেছে নীলগাছ’ (পেঁপেফুলের মেহনশুভ্রতা), ‘মেঘের দ্রুতির ভেতর আকাশে ছড়ায় নীলের গাঢ়তা’ (মেঘের ফিলিগ্রি), ‘আকাশের নীলে ছড়িয়ে দিচ্ছে সুরের রজত সম্ভার’ (গুলাচি ও ডালসিমার), ‘নীলের ভেতরে উত্তরঙ্গ গান’ (নীলের ভেতরে উত্তরঙ্গ গান), ‘অগ্নির নীল শিখা দিয়ে ... অসীম নীলত্বের সাথে মানুষের ঘর ক্রমশ মিশে যেতে থাকে’ (নেক্রপলিস)।
গৌরাঙ্গ মোহান্ত |
‘করোটিমঞ্চে খেমটাওয়ালি’ কাব্যের কবিতাগুলি পড়তে পড়তে মনে আসতে পারে, কবি অরুণ মিত্রের টানা লিখন পদ্ধতিকে লেখা কবিতাবলি। কিংবা শব্দ চেতনায় জীবনানন্দীয় উত্তরাধিকার। একাব্যের অনেক কবিতায় পাঠক অনুভব করবেন, জীবনানন্দের দৃশ্য-স্পর্শ গন্ধময় জগত৷ অনেক কবিতায় জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ (‘আমরা দ্বীপের প্রশান্ত গৃহে ফিরে যাই’ দ্বীপগৃহ) কিংবা ‘নগ্ন নির্জন হাত’ স্মরণে আসতে পারে৷ জীবনানন্দ যেমন ‘রূপসীবাংলা’ কাব্যে মনসামঙ্গল কাব্যের চাঁদসদাগর-বেহুলা লখিন্দরের আখ্যানকে নতুন ভাষারূপ দিয়েছিলেন, অনুরূপ ভাবে কবি গৌরাঙ্গ মোহান্ত তুলে ধরেছেন ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের কালকেতুর অকথিত আখ্যানকে। জীবনানন্দ দাশ, কোলরিজ প্রমুখ রোমান্টিক কবিদের মতোই কবি শান্তির খোঁজে অতীতচারী হয়েছেন। মৌলিক চেতনায় কবি গৌরাঙ্গ মোহান্ত লিখেছেন— 'কালকেতুর পথে হেঁটে মিশ্রকেশীর কাছে যেতে চাই’ (মিশ্রকেশীর কাছে যেতে চাই)। জীবনানন্দের উত্তরাধিকারকে পাথেয় করেই কবি সমকালের বেদনাবোধকে যেমন প্রত্যক্ষ করিয়েছেন, তেমনি পাঠককে নিয়ে গেছেন অতীতে শ্যামল নীলিমা ঘেরা সবুজে শান্তিতে, এক হেলেনিক সৌন্দর্য উপলদ্ধিতে। কবি গৌরাঙ্গ মোহান্তের কবিতায় রঙের বর্ণিলতার অনুষঙ্গে স্মরণে আসে কবি আলোক সরকারের উত্তরাধিকার। কবি আলোক সরকারের মতই কবি তাঁর কাব্যের একাধিক কবিতায় বাংলার পরিচিত অঞ্জন, পদ্ম, গামারি, কামিনী, পেঁপে, বনকামিনী, স্বর্ণচাঁপা, রাধাচূড়া, জারুল, সোনালু, কাঞ্চন প্রভৃতি ফুলের ডালি সাজিয়েছেন। আবার কবিতার ক্রমিক বিন্যাসে, দিললিপির ঢঙ এবং ভাব অনুযায়ী কাব্যের আঙ্গিক পরিকল্পনায় স্মরণে আসে রবীন্দ্রনাথের ত্রয়ী কাব্য ‘রোগশয্যায়’-‘আরোগ্য’-‘জন্মদিনে’ কাব্যের স্মৃতি। কবি বিষ্ণু দে’র মতো তিনি রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করেছেন অন্য মাত্রায়।
অরুণকুমার সাঁফুই |
(অরুণ কুমার সাঁফুই, সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাবিভাগ, মুন্সী প্রেমচাঁদ মহাবিদ্যালয়, শিলিগুড়ি, পশ্চিমবঙ্গ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন