সমকালীন ছোটগল্প |
কতই রঙ্গ
আদালত চত্বরে যে মুহূর্তে বিপদ
ভঞ্জন চোঙদারকে দেখেছিলেন বিশম্ভর বক্সী - তখনই তাঁর বোঝা উচিত ছিল বিপদ ঘনাতে পারে। বেস্পতি বিলক্ষণ নয়ের ঘরে আর কেতু বায়ু রাশিতে না
হয়েই যায় না। নিদেন পক্ষে অশ্লেষা আর মঘা গলাগলি করছে কোথাও। বিপদ ভঞ্জন চোঙদারকে তাদের বন্ধু মহলে বি বি সি
বলা হয়। যেকোনো এক দানা পোস্তর মত ইঙ্গিত পেলেই তাঁর মগজের কারখানা চালু হয়ে যায়। তারপর
মুখরোচক বড়া বানিয়ে, চোঙ্গা ফুঁকে - লোককে
খাইয়ে দিতে তার তেল গরম করতেও হয় না। আরেকটি প্রিয় শখ বন্ধুদের থেকে টাকা ধার করা।
ধার না বলে অবশ্য তোলা সংগ্রহই বলা যেতে পারে। কারণ সে টাকা তাঁর নিজের উন্নয়নে লেগে
যায়। ঘুরে আসে না। এমন নয় যে তাঁর দিন আনি
দিন খাই অবস্থা। বহু রকমের দালালি করে তাঁর মাসিক রোজগার বিশম্ভরের থেকে কম হবে না।
তবু সে একরকম অভ্যাসের দাস। বিশম্ভরেরর থেকেও দশ হাজারের ধার নবীকরন শুল্ক হিসেবে চেয়ে
রেখেছে। কিন্তু এবার বিশম্ভর 'গোম্বুজা সিমেন্টের' মত কঠিন, 'ঠাঠা' লোহার ছড়ের মত নমনীয় হয়নি। তাঁর সাফ সওয়াল, আগের প্রায়
ছত্রিশ হাজার কবে পাওয়া যাবে? না পেলে এবার আর উপুড় হস্ত নয়। প্রাথমিক ভাবে ব্যর্থ
বিপদ ভঞ্জন ফিরে গেছে তবে আশা ছাড়লে তো দালালির ব্যাবসা ডকে ওঠে, তাই ...।
প্রায় চুয়াল্লিশ ইঞ্চি ভুঁড়িওয়ালা একজন উকিলবাবু আর তার পেছনে অ্যাসিস্ট্যান্ট - হাতে গোটা সাতেক রেফেরেন্স ভলুম । ঠিক যেন ধীরে চলমান চিত্তোর গড় আর পেছনে তাঁর কীর্তি স্তম্ভ। তাদেরই পেছনে লুকিয়ে প্রথমবার পার পেয়েছিলেন বক্সীবাবু। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে গোল খেয়ে গেলেন। পান খেতে নিচে নামতেই পানওয়ালার পিছনের আয়নায় সহাস্য বি বি সি। পালাবার রাস্তা নেই, বিরস মুখে বক্সীবাবু মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন -
- 'পান খাবে না কি হে?’
চোঙদারের হাসি চওড়া হল।
- 'বিলক্ষণ। জানো তো পানে আমার
কখনো না নেই। অবশ্য আমি তরলের কথা বলছি না, সেটা সান ডাউনের আগে ... হে হে হে হে '।
এ রকম পচা রসিকতার গন্ধে গা গুলিয়ে
ওঠার কথা। জর্দার খুশবু দিয়ে সেটার মোকাবিলা করে বক্সীবাবু বললেন -
- 'তা এ দিকে কি মনে করে'?
- 'সেটা তো আমি তোমাকেই জিজ্ঞাসা
করব ভেবেছি। আমার তো সকালটা এ চত্বরেই কাটে। দশ ধান্দায় থাকি ভাই। ডাক্তারি, মোক্তারি
যা যখন হাতে আসে। তোমাদের মত পাখার নিচে বসে দিন কাটানো তো সবার কপালে নেই। সেই হাজার
দশেকের ব্যাপারের কি ভাবলে'?
- 'যা বলার সে দিন বলেছি ভাই। আগের
ছত্রিশ...'।
- 'আহা সে তো আছেই। এক কাজ করো।
তুমি একটু বাড়িয়ে চোদ্দই দাও। পুরোপুরি পঞ্চাশ হবে। তা ধর আগামী জুলাইয়ের মধ্যে...'
- 'এমন কথা আগেও হয়েছে চোঙদার।
তুমি মাসটা বল কিন্তু বছরটা বল না কখনো। আমার দালালি নেই ভাই। মাস গেলে বাঁধা রোজগার।
এবার খ্যামা দাও'।
- 'আহা অমন করে কাঁদছ কেন। ঠিক
আছে থাক। বল আছো কেমন? চার নম্বর এজলাসে যেন দেখলাম তোমাকে? ও দিকে কি মামলায়'?
- 'সে - একজনের জন্যে আসতে হয়েছিল।
আবার ডেট পড়েছে সামনের মাসে'।
- ' হুঁ উ উ উ ম। চার নম্বর কোর্টে
এসেছ - তাও আবার অন্য একজনের জন্যে। হরি হে কৃপা সিন্ধু। তোমার মত ভালো লোককেও এ রোগ
ধরল। তা কত দিন চক্কর কাটছ'?
- 'সে অনেক দিন হল। বছর দুয়েক তো
হবেই'।
- 'আচ্ছা? সুপ্রিম কোর্টের লেটেস্ট
ভারডিক্ট বলছে তেরোর বি লাগালে তো আজকাল ছয় মাসও লাগার কথা নয়। ভালো কালো কোট ধর'।
- 'আমি কেন ধরতে যাব? বললাম না
অন্যের কেস'।
- 'আরে সে কি আর আমি জানি না ।
অন্য ভাবলেই এসব কেস হয়। নিজের ভাবলে - হত না। আমি সাহায্য করতে পারি'।
- 'দোহাই ভাই । তোমার সাহায্য লাগবে
না। আগের বার গাড়ি বিক্রি করতে গিয়ে অনেক গাঁট গচ্চা দিয়েছি। এ কেস মনে হচ্ছে এবার
ফয়সালা হয়ে যাবে'।
- 'ও রকম মনে হয়। নিজের মনে করেই
বলেছিলাম। না নিলে আর কি করা। বৌদি কোথায় এখন'?
- 'নিজের বাড়িতেই থাকবে। যাবে আর
কোথায়'?
- 'হুঁ? অর্থাৎ বাপের বাড়িতে। তবে
তো ১৪২ সেকশন সহজেই লেগে যাবে। দেরি হচ্ছে কেন'?
- 'দেখো ভাই আমি আইন কানুন কিছু
কম বুঝি। আসতে হয় আসি। তোমার কথা আমার পাল্লার বাইরে। আমি চলি। পরে কথা হবে'।
- 'এস । যা হবার তাই হবে। তবে আমাকেও
দেখতে হচ্ছে একটু। হরি হে দীন বন্ধু'।
মেসির কায়দায় বিবিসির পাস কাটিয়ে বিশম্ভরবাবু বাইরে এলেন। গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে একটু হেসেও নিলেন। চোঙদারের পানে বোধহয় জর্দা একটু বেশী পড়ে গেছে। কি সব যে বকে গেল বোঝাই গেল না। থাকগে বুঝেও কাজ নেই। এড়ানো গেছে, বাঁচা গেছে। দশ হাজার তো বাঁচল।
কিন্তু সত্যিই বাঁচল কি? এগিয়ে
দেখা যাক।
সারাদিনে অফিসের ছেষট্টি রকমের ঝামেলায় ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিলেন। মনে পড়ল বাড়ি এসে। তিন দিন হল স্ত্রীর সঙ্গে কথাবার্তা নেই। মাসে বার দুয়েক এমন হয়। ছেলে মেয়ের বোঝার বয়স হতে দুজনেই এক প্রচ্ছন্ন সমঝোতায় অদৃশ্য সাক্ষর করেছিলেন। এদের সামনে চেঁচামেচি করে ঘরটাকে পাড়ার কলতলা করে তুলবেন না। পরিবর্তে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রিতে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে থাকা, নানা রকম ভ্রু নাচানো, দাঁত চেপে মন্দ্র সপ্তকে চোখা চোখা সংলাপ, খানিকটা মূকাভিনয়, শেষে কিছুদিন কথার বিরতি। প্রথম প্রথম পারছিলেন না দুজনেই। গলার ভলুম বেড়ে যাচ্ছিল। শেষে কয়েক সপ্তাহ বাংলা সিরিয়াল দেখে ব্যাপারটা রপ্ত করে নিলেন। অবশ্য হুবহু মেলান গেল না। একদিকে বিশ ভরি গয়না, বেনারসি আর অন্যদিকে ডিজাইনার পাঞ্জাবী পরে সারা দিন ঘরে বসে কূট কচালি - না সে রকম করা গেল না। তাছাড়া সিরিয়ালের সম্প্রচারে যা দুই তৃতীয়াংশ জুড়ে থাকে - অর্থাৎ তিন দিক থেকে বার বার ঝ্যাং ঝ্যাং মুখ দেখান এটাই তো বাস্তবে করা যায় না। যা পাওয়া গেল তাই সই।
দীর্ঘ সাধনায় এখন দুজনেই মতানৈক্য হলে চুপ করে যান। তুচ্ছ কারণে মতবিরোধ কিছু দিন পুচ্ছ নাচায়। তারপর মিলিয়ে গিয়ে মিশিয়ে দেয়। মোটামুটি নীরবতার দৈর্ঘ্য স্থায়ী হয় দিন তিনেক। সেই হিসেবে আজ চায়ের জায়কা ভাল হবার কথা। ওটাই বরফ গলার প্রথম সঙ্কেত। এরপরে 'জিভ লকলক রেস্তরা'র কবিরাজি কাটলেট সঙ্গে লাল সস, আলুভাজা। কিন্তু আজ সে রকম হল না।
বদলে গিন্নী এসে সামনের সোফায় বসলেন।
তারপর ডান হাতের তর্জনী দিয়ে কাঠের হাতলে গুনে গুনে চারটি টোকা দিলেন। এই সঙ্কেতের
মানে বিস্ফোরক কিছু সংলাপ আসছে। কিন্তু এ তো সিরিয়ালের পাইলট প্রজেক্টে আসার কথা, এপিসোড
এক্সটেনশন হল না কি? কিন্তু কেন?
- 'তুমি আজ কোর্টে গিয়েছিলে'?
- 'হ্যাঁ। কিন্তু তুমি কি করে...'।
- 'সেটা জরুরী নয়। কিন্তু কোর্ট
পর্যন্ত যেতে হল'?
- 'সে তো মাঝে মাঝেই যেতে হয়। অফিসের
কাজে। তা ...'।
- 'অফিসের কাজ! সে কাজের মধ্যে
সেই এজলাসও পড়ে যেখানে ডিভোর্সের শুনানি হয়ে থাকে'?
- 'হ্যাঁ। মানে না। মানে আজকেরটা
সেরকমই ছিল। আমাদের উকিল বলল ...'।
- 'এটাই জানতে চেয়েছিলাম। তবে কথাটা
আমার সঙ্গে না বলে সোজা কোর্টে যাওয়ার দরকার ছিল না। মিসেস মুখার্জি আজ ফোন করে বার
বার আমাদের ঝগড়া কি নিয়ে তা জানতে চাইলেন। প্রয়োজনে মহিলা মঞ্চের সাহায্য দেবার কথাও
বললেন। আমি অবাক হতে বললেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকার দরকার নেই। তাকে মিসেস চোঙদার ফোন করে
সব জানিয়েছেন। তারপর মিসেস বাটালিওয়ালা, কাউর, সচদেবা, নন্দিতাদি - মনে হয় সারা ভারত
- একই কথা বলে যায় ফোন করে। আমাদের চব্বিশ
বছরের বিবাহিত জীবনে আমি অন্তত এমন কিছু করিনি যা পাড়ার লোকে জানতে পারে। আজ সবাই জেনে
গেল অথচ আমি...। ঠিক আছে তুমি যদি চাও তাই হবে। আমি অন্তত সবার সামনে কোন সিন ক্রিয়েট
করতে পারবো না'।
গিন্নি হাতলে ছোট্ট চাপড় মেরে উঠে
গেলেন। বক্সীবাবু বোকাবাক্সের হাঁ করা ঢোঁড়া বুড়োর মত বাক্যহীন বসে রইলেন। শুধু পিছনে
বেহালা না বেজে রান্নাঘরের বাসন পত্র বাজতে লাগলো। অর্ধ সত্য কত ভয়ঙ্কর হতে পারে পরিচালকরাও
জানেন না। এ কথা সত্যি যে তিনি সে রকমই একটা মামলায় গিয়েছিলেন। তবে বাদী বা বিবাদী
হিসেবে নয়। সাক্ষ্য দিতে। তাদের অফিসের একজন অস্থায়ী মহিলা কর্মীর বিবাহ বিচ্ছেদের
মামলা চলছে। সেখানে তাঁর স্বামী খোরপোষ দিতে চায় না কারণ মহিলার কিছু রোজগার আছে। এখন
আদালত তাদের অফিসকেও পার্টি করেছে। পক্ষ রাখার জন্যে বক্সীবাবুকে মামলার দিন এসে কিছু
কাগজপত্র দিয়ে যেতে হয়। সেই ভুল তিলকে চোঙদার তাল করেছে। কতজনকে ইতিমধ্যে বলেছে কে
জানে।
ভাবতে ভাবতেই ফোন আসতে লাগলো। আদর্শ জুড়ি হিসেবে বক্সী দম্পতির নাম আছে। আজ সেখানে অন্য গন্ধ পেয়ে সহানুভূতির মোড়কে কৌতূহলের জলস্তম্ভ উঠতে লেগেছে। সবাইকে বোঝাবার প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও ফাস্ট রাউন্ডে বক্সীবাবু স্ট্রেট সেটে হারতে লাগলেন। রাত দশটা নাগাদ এলো বিবিসির ফোন -
- 'আহা বক্সী। কি হল বল তো? আমি
তো ফোন নামাতে পারছি না। একজন ছাড়লেই আর একজন।
তোমার যে কত শুভানুধ্যায়ী এ শহরে তা তুমি ভাবতেও পারবে না। তা ভাই চা টা খেয়েছ
তো? না কি চাঁটা খেলে... হে হে হে হে '।
- 'এই সর্বনাশটা কেন করলে চোঙদার'?
- 'তোমাকে বোঝালাম চোদ্দ হাজারের
আসল মূল্য কতটা। আগে তো দশেই হয়ে যেত'।
- 'তাই বলে এ রকম অন্যায় ...'।
- 'স্কুলে একবার ফাউল করে আমার
পা মচকে দিয়েছিলে - মনে পড়ে বক্সি'?
- 'আটত্রিশ বছর পর তাঁর প্রতিশোধ?
তাও এমনি করে'?
- 'মাধবায় নম। প্রতিশোধের কথা উঠছে
কিসে? আমি বোঝাতে চাইছি অভীষ্ট লাভের পথ পুরুষকার দিয়েই খুঁজে নিতে হয়। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ
কি বলেছেন'?
- 'কি বলেছেন'?
- 'সে এখন মনে পড়ছে না তবে...'।
- 'থাক। বুঝলাম। ঠিক আছে। তোমারই
জিৎ। কাল এসে দশ নিয়ে যেও। কিন্তু আজকের মধ্যেই এই অপপ্রচার ...'।
- 'ধীরে বন্ধু ধীরে। ঝড়কে আবার
উল্টে বাগে চালানোর খরচ কি আর আগের মত হয়। বাড়বে না? অন্তত ডবল? আচ্ছা থাক। তুমি পুরনো
দেনদার - পনেরো দিও। আমি এবার উল্টো পাক দেওয়া শুরু করি। শুভ রাত্রি'।
দিন দশেক কেটে গেছে। বক্সিবাবু সদ্য সদ্য দশ দিয়েছেন চোঙদারকে। বাকি পাঁচ পরের মাসে দেওয়ার কথা। চোঙদার দীপক রাগ গেয়ে যে আগুন লাগিয়েছিল - মল্লার গেয়ে আবার সে আগুন নিভিয়েছে। বন্ধুরা আফসোসের সঙ্গে ফোন করা ছাড়লেও ছোঁক ছোঁক ছাড়েননি। বক্সীগিন্নি ছলছল নয়নে মাপ চেয়েছেন। কিন্তু বক্সিবাবুর মনের জ্বালা কমেনি। সেই কথাই তিনি ভাগ করে নিচ্ছিলেন প্রাণের বন্ধু নটবর নায়েকের সঙ্গে। নটবরবাবুর নাটকই দিবা রাত্রির ধ্যান। অফিসে কোন রকমে চাকরি বাঁচিয়েই তিনি দৌড়ান মহড়ায়। সেখান থেকে মাঝে মধ্যে ঢুঁ মারেন বক্সিবাবুর বাড়ি। আজ সেরকম একদিন। নানা রকম ভাবে মুখ ভঙ্গী করে বক্সি বাবুর মন ব্যথা শুনছিলেন নটবর। মাঝে কথা থামিয়ে বক্সি বাবু বললেন-
- 'ও রকম মুখ ব্যাঁকাচ্ছ কেন বল
তো? আমার বোকামির গল্প শুনতে ভাল লাগছে না - না'?
নটবর বিলিতি কায়দায় কাঁধ ঝাকালেন।
- 'না হে তা নয়। আমি সব সময়েই ঘটনাবলী
ভিজুয়ালাইজ করে অভিনয়ের অ্যাঙ্গেলে কেমন হতে পারে সেটা অনুশীলন করেনি। তোমার গল্পটাতে
খাসা নাটক হয়। বহু ভাবের সমন্বয়। ব্রেক্ষটের সঙ্গে যেন ইবসেন পাঞ্চ করা...'।
- 'থাক তোমাকে আর শুনতে হবে না।
নটবর নাটুয়াকে আমার বলাই ভুল হয়েছে'।
- 'দেখ দেখি চটে যাচ্ছ। কিন্তু
তোমার এক্সপ্রেসনে কোনো অবস্থান্তর ঘটছে না। লাইম লাইটে চার্লি...'।
- 'আবার'?
- 'ঠিক আছে, ঠিক আছে। আচ্ছা তুমি
মাউস্ট্র্যাপ নাটকটার নাম শুনেছ? ষাট বছর ধরে চলছে লন্ডনে। আগাথা ক্রিস্টির পারফেকট
মার্ডার মিস্ট্রি'?
- 'না। তাঁর সঙ্গে আমার দুর্দশার
কি সম্পর্ক'?
- 'নাটকটাতে প্রথমেই একটা মার্ডার
হয় তারপর গল্প এগোয়'।
- 'তো'?
- 'এখানেও প্রথমেই একটা মার্ডার।
না না শারীরীক নয় চারিত্রিক। আর কি নিপুণ ভাবে করা। হ্যাটস অফ টু বিবিসি'।
- 'তোমার ওকে প্রশংসা করতে ইচ্ছে
করছে। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমার বন্ধু'।
- 'দেখো খারাপ কাজও যদি নিপুণ ভাবে
করা হয় - সেটা প্রশংসার যোগ্য। তুমি কোনো আভাসই পেলে না আর ও ওর কাজ ঠিক করিয়ে নিল। তবে এক মাঘে শীত যায়
না। আমি আর একটা নাটকের কথা ভাবছি'।
- 'আবার নাটক'?
- 'হ্যাঁ। আচ্ছা তোমার প্রভঞ্জন
পাইককে মনে আছে? এখন সি বি আই-তে আছে'?
- 'হ্যাঁ। কিন্তু তাকে কেন। আমি
থানা পুলিশ করতে পারবো না'।
- 'আহ। ভাবনাটাকে শুধু একমূখী করে
রেখ না তো। ওর থেকে একটা জিনিস নিতে হবে। ভালো কথা চোঙদার পরের পাঁচ কবে নিতে আসবে
যেন'?
- 'এই তো সামনের দু তারিখে। কেন
বল তো'?
- 'রাই ধৈর্যং রহু ধৈর্যং। বলব
তোমায়। একটু রাতের দিকে ওকে ডেকো। মনে হচ্ছে তোমার টাকা উদ্ধারের একটা উপায় হবে আর
চোঙদারও চুপ মারবে। আজ চলি। একটা চিত্রনাট্যের খসড়া লিখতে হবে'।
দিন দশেক পরের রাত দশটা সাতান্ন। শিস দিতে দিতে আপাত নির্জন পথে হাঁটছে বিপদভঞ্জন। পকেটে বক্সির দেওয়া কড়কড়ে পাঁচ। শুধু যে আদায় করা গেছে তাই নয় বক্সিকে একেবারে বাক্সবন্দী করা গেছে। এক ফসলি জমি যেমন ঠিকঠাক সার পড়লে দো ফসলি, তিন ফসলি হয়ে যায় - বক্সি এখন তেমনই সুফলা। ভবিষ্যতে আবার চাষ করা যাবে। মাটি ফুঁড়ে জনা চারেক ষন্ডা লোক চোংদারকে ঘিরে দাঁড়াল। একজনের হাত খুব সন্দেহজনক ভাবে জামার মধ্যে ঢোকান। একজনের হাতে মোবাইল উঁচু করে ধরা। তৃতীয়জনের হাতে কাঁচের পাত্রে জল। আর একজন সেই অস্পষ্ট আলোয় কি একটা ধাতব ব্যাজ তুলে দেখাল।
- 'মিস্টার চোঙদার'?
- 'হ হ হ্যাঁ। আমিই। কি ব্যাপার'?
- 'আমরা সি বি আই থেকে'।
- 'সি সি সি বি আই'?
- 'একটা সি। আপনার পকেটে যে দশটি
পাঁচশোর নোট আছে তাঁর নাম্বার আমাদের কাছে রয়েছে। দিন ওগুলো। এই তো সব মিলে যাচ্ছে।
এই জলের পাত্রে হাত ডোবান। ডোবান বলছি'।
- 'হ্যাঁ হ্যাঁ ডোবাচ্ছি। একি জলের
রং এমন গোলাপি হয়ে যাচ্ছে কেন'?
- 'ব্যানার্জি ঠিক মত ভি ডি ও শ্যুট
হয়েছে? গুড। গোলাপি হয়েছে কারণ আপনার পকেটের নোটগুলোতে আগে থেকেই ফেনপথেলিন লাগানো
ছিল যেটা আমাদের স্যলুসনের সংস্পর্সে গোলাপি হয়ে যায়। সো ইট ইজ প্রুভড দ্যাট উ হ্যাভ
টেকেন ব্রাইব ফ্রম মিস্টার বক্সি'।
- 'আ আ আমি ঘুষ খাবো? আমি কোনো
চাকরিই করি না। কিছু ভুল হচ্ছে স্যার'।
- 'কিছু ভুল নেই। চাকরি করেন না
কিন্তু দালালি করেন। কারো বকলমে নিয়েছেন আজ। জানা যাবে। নাও লেটস মুভ'।
- 'ক ক কোথায়'?
- 'আপাতত কাস্টডিতে। তারপর জেলে'।
- 'স্যার নির্ঘাত কিছু ভুল হচ্ছে।
আমি ... আমি'।
- 'যা বলবার ইন্টেরোগেসনের সময়
বলবেন। আপনার ব্ল্যাক মেলিং-এর ব্যবসা আপাতত শেষ'।
- 'ব্ল্যাক মেলিং? আমি... কাকে
...'?
- 'কাকে নয়? অ্যামেরিকানা আন্ড
অ্যামেরিকানার ডাইরেক্টর মিস্টার চিটার্সন,
স্লাই ফক্সির কমরেড ঠকাক্সি, ফরেব এ আদার জনাব ঝুঠা মিয়া ... কত বলব। একেবারে ইন্টারন্যাশনাল
র্যাকেট। আর রেসেন্টলি শ্রীবিশম্ভর বক্সী। চলুন গাড়িতে বসে কথা হবে'।
যে কালো জীপ গাড়িটা দাঁড়িয়েছিল গাছের নিচে তাতে উঠল সবাই। চোঙদার মা, বাবা আর সেই সঙ্গে আরো আশিজন দেবতার পায়ে মনে মনে মাথা ঠুকতে লাগলো। আর প্রকাশ্যে কাকুতি মিনতি। মিনিট দশেক যাবার পরে যেন তাঁর আর্তনাদেই অতিষ্ঠ হয়ে গাড়ি থামালেন এদের নেতা।
- 'আপনি কি সত্যি এদের চেনেন না'?
- 'মা পাতালঘোরার দিব্যি কাউকে
জীবনে দেখিনি, টাকা নেওয়া দূরস্থান'।
- 'কিন্তু আমাদের কাছে খবর আছে
আপনি প্রায়ই এর ওর থেকে টাকা নেন, কিন্তু ফেরত দিতে কেউ দেখে না। যদি ব্ল্যাক মেইলিং
না হবে তবে ওরা টাকা দেয়ই বা কেন আর ফেরতই বা নেয় না কেন। আপনার বক্তব্য কি'?
- 'সব ধার নিয়েছি স্যার। বাবা ঝড়েশ্বরের
শপথ সব টাকা ফেরত দিয়ে দেব স্যার। কালই দিয়ে দেব স্যার'।
- 'সব টাকা কালই দেবেন? খর্চা করেননি
এক টাকাও? আবার আমাদের ঠকাবার চেষ্টা'?
-‘আমার আলাদা আক্যাউন্ট আছে স্যার
এই সব ধারের টাকার। খর্চা করি না - জমাই। এটা আমার শখ বলতে পারেন। নাক কান মুলছি স্যার
আর করবো না'।
- 'ব্যানার্জি এ রকম স্যাম্পেল
দেখেছ না কি আগে? শখ করে লোক ঠকায়? না না আপনাকে ছাড়া যাবে না। চলো হে '।
- 'না স্যার ছাড়া যাবে। আমি আপনাকে
আমার অ্যাকাউন্ট দেখাচ্ছি। কোনো এ টী এম-এর কাছে গাড়ি থামান স্যার। স্টেটমেন্ট নিয়ে
দেখাচ্ছি'।
- 'হুঁ ইন্টেরেস্টিং। ব্যানার্জি
গাড়িটা একটা এ টি এম-এর সামনে দাঁড় করাও তো... এই যে এসে গেছে... দাঁড়ান হাজার দশেক
বার করুন... তারপর স্টেটমেন্ট ... হিম্মত সিং ভাগ না পায়... সাবাস'।
- 'এই নিন স্যার দশ হাজার আর এই
স্টেটমেন্ট'।
- 'মাই গড। ব্যানার্জি দেখেছ তিনলাখ
চব্বিশ হাজার টাকা। স্রেফ ধার করে ফেরত না দিয়ে। কত দিনের কারবার আপনার'?
- 'তা স্যার ধরুন বছর সাতেক'।
- 'তো এখন তো মনেও নেই কার থেকে
কত নিয়েছেন। ফেরত কি করে দেবেন? ব্যানার্জি জীপ চালাও'।
- 'না স্যার না। বাড়িতে একটা লাল
ডাইরিতে সব ডেট দিয়ে লেখা আছে। পাই পয়সা ফেরত দিয়ে দেব'।
- 'হুম। আপনারও লাল ডাইরি আছে।
ডাইরির ব্যাপারটা ইদানীং খুব পপুলার হয়েছে। রেইড করলেই রেড ডাইরি। কি করি ব্যানার্জি?
একে দুদিন সময় দি? পালাবে কোথায়? আদি বাড়ি মশা গ্রামে। সে দিকে উড়তে গেলে ... হিম্মত
সিং...'।
- 'কোথাও উড়বো না স্যার । আপনি
দু দিনের মধ্যেই খবর নিয়ে নেবেন। এবার যাই স্যার'?
- 'ঠিক আছে আজ ছাড়লাম। রেইডটা বেকার
গেল। আপনার বাড়ি তো সামনের গলিতে ঢুকে বাঁ দিকে , হলুদ চুনকাম করা। সব খবর নিয়েছিলাম
ঠিকঠাক... জলে গেল। ব্যানার্জি কাল বিশম্ভর বাবুকে ফোন করে নিও একবার দুপুরের দিকে।
সাহায্য করার জন্যে ধন্যবাদও দিও। উনি তো রাজিই হচ্ছিলেন না। বলছিলেন বন্ধু মানুষ,
বিপদে পড়ে ধার নিয়েছে। আপনি কি চিজ সে তো আর তিনি জানেন না। যাক গে আমরাও জানাবো না।
কিন্তু যদি ভবিষ্যতে আবার আপনার এই শখ চাগাড় দেয় ...'।
- 'মা বাপ দাদু দিদা সবার দিব্যি
স্যার। নাকে খত কানে খত আর কোনদিন...'।
- 'দিব্যিগুলোও মরা মানুষের দিলেন।
আপনি মশাই বাঁধিয়ে রাখার মত পিস। যাক আজকের কথাগুলো আশা করি মনে থাকবে। নামুন। হ্যাঁ
ঠিক আছে। আমি খবর পেয়েই যাব। ব্যানার্জি চালাও'।
একটু পরে বক্সিবাবুর বাড়িতে হাসির হররা উঠল। মিসেস বক্সী সবার জন্যে জিভ লকলক রেস্তরা'র কবিরাজি কাটলেট সঙ্গে লাল সস, আলু ভাজা আনিয়েই রেখেছিলেন। নটবরবাবু আর তাঁর নাটক দলের সঙ্গী সাথীরা মেকআপ মুক্ত হয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। ব্যানার্জি ওরফে কুঞ্জর কাকাতি হাতজোড় করে বলল -
- 'আপনার লেগ ডাস্ট নিতে হবে নটবরদা।
গলা চেঞ্জ করে এতক্ষণ চালিয়ে গেলেন। চোঙদার একবারটি বুঝতেই পারলো না। আমরা তো পারতামই
না'।
স্যার আশুতোষের মত ঝাঁপিয়ে পড়া
নকল গোঁপ খুলতে খুলতে নটবর বললেন -
- 'তাই তো তোমাদের কোনো কথা বলতে
দিইনি। কন্ঠস্বরটা অবহেলা করার জিনিস নয়। নাট্যাচার্য্য শিশির কুমার থেকে উৎপলবাবু
সবাই এ ব্যাপারে জোর দিতেন। তবে আজকের নাটক সুপার ডুপার হিট। এই নাও বিশম্ভর তোমার
পাঁচ, বাকি কাল সকালেই বিপদভঞ্জন পড়ি মরি পৌঁছে দিয়ে যাবে। আজকের বিপদটাও আশাকরি আজীবন
ভুলবে না। আর আমার রইল চোরের উপর বাটপাড়ি করা দশ। গাড়িভাড়া, কস্ট্যুম, মহলার চা সিঙ্গাড়া
বাদ দিয়েও যা থাকবে মনে হচ্ছে পরের নাটকের বেশ খানিকটা আগাম হয়ে গেল। থ্যাংক ইয়ু বৌদি।
আজ চলি। চল রে সবাই'।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন