পালক শিল্প ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ী
পৃথিবীর সেই আদিকালে যেদিন থেকে
মনুষ্য প্রবৃত্তিতে সৌখিনতার বোধ জাগতে শুরু করেছিল, সেইদিন থেকেই শুরু হয়েছিল প্রথমে
অঙ্গসজ্জা ও তার পরে গৃহসজ্জার আগ্রহ। ফলে প্রায় সব দেশের আদিম অধিবাসীরা হাতের কাছে
পাওয়া পাখির পালক, ফুল এবং পাতার সাহায্যে নিজেদের সুসিজ্জত করতে শুরু করে। কোনো কোনো
সমাজে গাছের ছাল বা বাকল দিয়েও এই সজ্জার উপকরণ তৈরি করা হত। পাখির পালক দিয়ে গৃহসজ্জা,
পোশাকের অঙ্গসজ্জা এবং শিশুদের খেলনা তৈরি অতি প্রাচীন ঐতিহ্য। যে নিদর্শন গুহাচিত্র,
মাটি বা পাথরের ঘরের গায়ে ও শিলাচিত্রতেও পাওয়া যায়। ইউরোপ ও আমেরিকা-সহ বৃহত্তর
পৃথিবীর বিভিন্ন পুরোহিত-তান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে এই শৈল্পিক প্রবণতা দেখা যায় ব্যাপকভাবে।
আমেরিকার পুরোহিত-তান্ত্রিক রাজ্যগুলির মধ্যে
ইনকা ও আজটেক সভ্যতা পাখির পালক দ্বারা শিল্পকর্মকে অত্যন্ত উৎকর্ষমানের করেছিল। শুষ্ক পেরু উপত্যকার বালুকাময়
এলাকা ঢেকে যাওয়ার কারণে ইনকাদের শিল্পকর্মকে সংরক্ষণ করা হতো। আজটেকদের শিল্পকর্মগুলো
ছিল মাত্র দুটো পালক দিয়ে। তারা শিল্প সংরক্ষণ করত। মায়া উপজাতিদের কোনো কেন্দ্রভুক্ত
রাজধানী ছিল না, তাই কেন্দ্রের মধ্যে কোনো হস্তশিল্প সংস্থার কথা তারা ভাবতে পারত না।
খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ বছর আগে দক্ষিণ মেক্সিকো, গুয়াতেমালা ও বেলিজ এবং হন্ডুরাসের পশ্চিমাংশ ও এলসাল ভাদর-এর বিশাল এলাকা জুড়ে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সভ্যতা মায়া সভ্যতা নামে পরিচিত। এরা প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্কৃতির মানুষ হিসেবে বসবাস করত। পাখির পালক বুননকারী শিল্পী আজটেকদের মধ্যেও ছিল এবং কেন্দ্রভুক্ত পাখিশালা থাকার জন্য সেখানে তারা পাখির পালকের জন্য পাখি পালন করত। মায়া উপজাতিদের পাখি পালনের বা সংরক্ষণের কোনো প্রয়োজন হত না। কারণ তাদের ভূখণ্ডে স্বাভাবিক ভাবেই প্রচুর পাখির প্রজনন হত। ইউকাটান-এ বিচিত্র বর্ণের লেজ বিশিষ্ট মটমট পাখি দেখা যেত। ইউকাটানে দুই প্রজাতি দেখা যেত। এরা দলবদ্ধ ভাবে বহু দূর পর্যন্ত আকাশে উড়ত। নীল পালকের এই ধরনের বিভিন্ন পাখি পাওয়া যেত। তিতির, কাঠঠোকরা রং-বেরঙের পাখি এবং হলুদ ঝুটিওয়ালা কোরিসা প্রজাতির পাখি যাদের নীল ও কালো পালক উচ্চ মর্যাদার ধর্মযাজকদের কারুশিল্পে রূপান্তরিত হত। মায়া উপজাতির ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হত বনমোরগের রং-বেরঙের পালক। পাতিহাঁস, সারস, বক এদের পাওয়া যেত সাগর উপত্যকাতে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় ছিল তোতাপাখি, লোটন পায়রা, আর কুইটজাল পাখি যা থেকে সোনালি-সবুজ বর্ণের লেজের দুটো লম্বা পালক পাওয়া যেত। এরা বাস করত উঁচু এলাকায়। এদের পালকগুলো ছিল খুবই মূল্যবান। পাখি ধরার আঠা দিয়ে পাখি ধরা হতো কিংবা বায়ুপ্রবাহ চালানো নল দিয়ে মাটি থেকে বাতাস নিক্ষেপ করে পাখিকে জীবন্ত অবস্থায় ধরা হতো। পাখিকে না মেরে পাখি ধরার এটি একটি বিশেষ পদ্ধতি ছিল।
পাখির পালক বুননের এই শিল্পকৌশলটি ব্যবহার হতে লাগল কাপড়ের তাঁত বুননের মাধ্যমে। মূলত কাপড় বুননকারী তাঁতিরা ক্রেতাদের পছন্দ অনুযায়ী ডিজাইনে কাপড়ের উপর পাখির পালকগুলি সাজিয়ে এক একটি অসাধারণ শিল্প সৃষ্টি করতেন। তাঁদের এই দক্ষতার নিদর্শন দেখে জানা যায় যে, তাঁরা বুননের কাজ সম্পন্ন করার সময় মানানসই পাখির পালকগুলি তাঁতে, টানা সুতো ও পোড়েনের সুতোর সঙ্গে বেঁধে দিতেন। মায়া উপজাতিদের শিল্পকর্মেই পাখির পালকের ব্যবহার বেশি দেখা যায়। মহিলাদের লম্বা ঝুলের গাউন জাতীয় পোশাক, গায়ের জামার হাতায় এবং পিঠের দিকে এবং পুরুষদের পাঞ্জাবি টাইপের জামার হাতার শেষে কলারের প্রান্তে এবং পায়জামার ঝুলের শেষে এই সব পালকসমৃদ্ধ কারুকাজের নিদর্শন পাওয়া যায়। খুব যত্ন ও সৌন্দর্যের সঙ্গে এই পালকগুলি সজ্জিত করা হত। ধর্মযাজক ও গোষ্ঠী দলপতিরা সুতো দিয়ে বোনা কুটইজাল পাখির জমকালো সোনালি-সবুজ বর্ণের পালক শিরস্ত্রাণে ব্যবহার করত। অভিনেতা ও নৃত্যশিল্পীরাও পাখির পাখার পালকসমৃদ্ধ পোশাক ব্যবহার করত। গৃহে এবং গৃহের বাইরের প্রাঙ্গণ পোকামাকড়ের উপদ্রব থেকে মুক্ত রাখতে খুঁটির উপর পাখির দীর্ঘ পাখা বেঁধে রাখার প্রচলন ছিল। বোনামপাকের প্রাচীর চিত্রে এগুলো দেখতে পাওয়া যায়। জুল উৎসবে বিভিন্ন কারিগর পাঁচটি পাখির পালক দ্বারা বোনা জমকালো কাপড়ের পতাকা উপহার দিত।
পাখির পালকের কারুকার্য সজ্জিত যোদ্ধাদের ‘দি ম্যাজিক ফ্লুট’-এর ধর্ম গুরুর মতো দেখাত। আজটেক রাজা আবুই জটেনের জন্য তৈরি ঢালের মতো পাখির পালকের ঢালও ছিল। ১৫০৩ খ্রিস্টাব্দে ব্যবহৃত এই ধরনের ঢাল এখনও ভিয়েনায় সংরক্ষিত আছে। বিশিষ্ট গবেষক ডি এগো ডি লান্ডা এগুলি পর্যবেক্ষণ করে লিখেছেন যে, অনেক নাচের অনুষ্ঠানে পাখির পালকের পোশাক ব্যবহার করা হত। পাখির পালকে সজ্জিত মহিলারা জনসাধারণের জন্য নৃত্য পরিবেশন করত এবং জমিদারেরা একপ্রকার তুলা ও পাখির পালক দ্বারা তৈরি জ্যাকেট পরিধান করে সেইসব অনুষ্ঠানে যোগ দিত। বিভিন্ন ধরনের পাখির পালনের মধ্যে কুইটজাল পাখির পালকই ছিল সব থেকে আকর্ষণীয় ও সুন্দর এবং মূল্যবান। বলাবাহুল্য, সেগুলির মূল্য এতটাই বেশি ছিল যে এগুলি টাকার মতো ব্যবহার করা হত।
প্রত্নসভ্যতার এই পালক শিল্পের হাত ধরেই পরবর্তী কালে বিভিন্ন দেশেও পালক শিল্পের নানা কারিগরি বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। শুধু পোশাকআশাকেই নয় পাখির পালকের শিল্পসমৃদ্ধ প্রসার ঘটেছে আরও বিভিন্ন ধরনের সাজসজ্জার ক্ষেত্রে। যার মধ্যে প্রধান ছিল ঘর সাজাবার বিভিন্ন উপকরণ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মঞ্চ সজ্জার বাহার। কিন্তু কালে কালে এই প্রবণতার রসদ জোগাতে গিয়ে বিপন্ন হয়ে পড়েছে, এইসব পক্ষিকুলের প্রজনন ধারাবাহিকতা। ফল স্বরূপ ক্রমেই কুইটজাল পাখির মতো আরও সব আকর্ষণীয় পক্ষিকুলের বিনাশ সূচিত হয়েছে। আধুনিক সভ্যতায় এই অশনি পরিণাম রুখতে নানা ব্যবস্থা নেওয়া হলেও এখনও বন্ধ হয়নি পালকের জন্য পক্ষী নিধন। ক্রমে এই পালকশিল্পকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণির লোভী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। আজকের যুগে এই শিল্প যতটা না শিল্পের স্বার্থে ব্যবহার হচ্ছে, তার থেকে অনেক বেশি হচ্ছে অর্থকরী বাণিজ্যের স্বার্থে। ফলে পালক শিল্পের সেই প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে এই অর্থনৈতিক মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের অভীপ্সার সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন