কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৫

মধুবন চক্রবর্তী

 

কাজল সেনের গল্প যেন আধুনিক সমাজের আয়না

 


(গল্প সমগ্র ১ / কাজল সেন / চিন্তা প্রকাশনী / প্রচ্ছদশিল্পী রাজীব চক্রবর্তী / বিনিময় মূল্য ৬৫০ টাকা)

বাংলা ছোটোগল্প নানান পরীক্ষামূলক প্রক্রিয়ার পথ পেরিয়ে বাংলা সাহিত্যে ক্রমশ বেশ ঘরানা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। সাহিত্যের প্রবাহমান ধারায় বয়ে যেতে যেতে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা ছুঁয়ে, আধুনিকতার দিশা নিয়ে বিবর্তিত হয়ে  জন্ম নিয়েছে আবার এক নতুন ঘরানা, অণুগল্প। এসেছে ঝুরোগল্প। এভাবেই জন্ম নেবে হয়ত আরোও অনেক নতুন নতুন ঘরানা। তবু ছোটগল্প তার মহিমায় ভাস্বর থাকবে। সারাজীবন।

আমাদের আলোচনা এখানে ছোটগল্প নিয়ে। ছোটগল্পের সংজ্ঞা কী, সে তো রবীন্দ্রনাথের একটি পদ্য থেকে এক স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়--

"ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা

ছোট ছোট দুঃখ কথা

সহস্র বিস্তৃত রাশি প্রত্যক্ষ যেতেছে ভাসি

তারই দু চারটি অশ্রুজল"...

কবি যে ছোট ছোট দুঃখের কথা বলেছেন, তা আসলে ছোটগল্পের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক এবং সময়োপযোগী। ছোট দুঃখ তো আসলে বড় যন্ত্রণার বীজই বপন করে দিয়ে যায় হৃদয়ের অন্তঃস্থলে। সাহিত্যিক কাজল সেনের 'গল্পসমগ্র ১’ পড়তে পড়তে সেরকমই মনে হচ্ছিল। ছোট ছোট দুঃখগুলোকে তিনি বহন করেছেন নাগরিক সভ্যতার অন্তর্জালে। দুঃখগুলো একই রকম থাকলেও, বদলেছে সামাজিক প্রেক্ষাপট, বাজার অর্থনীতি। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের প্রভাবও তো আছে। সময়ের সাথে সাথে দুঃখর সংজ্ঞা যেমন পাল্টাচ্ছে, আখ্যান যেমন আধুনিক হয়ে উঠছে, তার ধারণ ক্ষমতাও ততোধিক বাড়ছে। গল্প প্রকাশভঙ্গিতে দুঃখ আধুনিকতার মোড়কে অনেক বেশি জটিল হয়ে উঠেছে এখানে। কাজল সেনের গল্প বলার ভঙ্গিতে কথোপকথনের যে ধারা, তাকে ছাপিয়ে গেছে গল্প বলার স্টাইল।

আধুনিক সমাজের সম্পর্কের মধ্যে বাসা বেঁধে থাকা সন্দেহের বীজ বিবিধ সংশয়ে আশঙ্কায় অবিশ্বাসে ছায়াছবির মত যেন খেলা করেছে গল্পের এ মোড়‌‌ থেকে ও মোড়ে। কঠিন বাস্তব চিত্রপ্রদর্শনী দেখছি প্রত্যেকটি গল্পের ক্যানভাস জুড়ে।

বাংলা ছোটগল্পের প্রাচীন এবং সুবর্ণিল প্রাঙ্গণে কাজল সেন নামটি অত্যন্ত সুপরিচিত এবং বলিষ্ঠ। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরেই তিনি পাঠক মহলে সমাদৃত। বাংলার সাহিত্য অঙ্গনের সঙ্গে তাঁর নাড়ির যোগ। ছোটগল্পের মধ্যে স্বকীয়ভঙ্গি ও  কাহিনীর কাঠামোকে আরোও যেন মজবুত করেছে। প্রথম গল্প 'অধরা মাধুরী'। সেখানে অর্ণা চরিত্রটি অদ্ভুত রহস্যময়তায় ঘেরা। অর্ণা প্রকৃত সুন্দরী। লাস্যময়ী। স্বাভাবিকভাবেই পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাঁর সৌন্দর্য। শরীরী আবেদন। বিয়ের জন্য বহু পাত্রই তার মা বাবা দেখে ফেলেছেন। কিন্তু কোনোও পাত্রকেই তার পছন্দ হয় না। যদিও পাত্রমহলে তার এই চাহিদা অর্ণাকে বেশ মজা দেয়। অন্তরের মধ্যে কোথাও যেন প্রচ্ছন্ন অহংকার বাসা বাঁধতে থাকে অর্ণার মধ্যে। সৌন্দর্য সম্পর্কে অতিমাত্রায় আত্মসচেতন সে। সেই অহংকার যেন নিমেষে ভেঙে খানখান হয়ে যায় শান্তনীলের কাছে যখন সে প্রত্যাখ্যাত হয়। এখানে লেখক 'না’ কথাটি বলিয়েছেন নায়কের মুখ দিয়ে। সাধারণভাবে মানুষ যা ভাবে, তা ঠিক ভাবছে না এখানে গল্পের মুখ্য চরিত্র। সে বলছে, অর্ণা প্রকৃত সুন্দরী বলেই তাকে তার পছন্দ নয়। অর্থাৎ চোখ ঝলসানো রূপ তার যে পছন্দ  নয়, সে তার দিদি জামাইবাবুকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে। বলেছে এত রূপসী তার পছন্দ নয়। এই কথা শোনার পর অর্ণা যথেষ্ট অপমানিত অসম্মানিত হয়। সে কূলকিনারা খুঁজে পায় না। ক্রমশ তার এই জটিল মনঃস্তত্ত্ব জানার ইচ্ছা বাড়তে থাকে মনের গভীরে। সে নিজেই দেখা করতে চায় পাত্রের  সঙ্গে এবং সামনাসামনি কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করে। এই আগ্রহের কথা শুনে নায়ক আবার হতবাক হয়ে যায় অর্থাৎ দুজনের চরিত্রের মধ্যে অদ্ভুত রহস্য ও বৈপরীত্য দেখিয়েছেন এখানে লেখক, যা খুবই আকর্ষণীয়। তাঁর গল্পে প্রত্যাখ্যাতা অর্ণা প্রচলিত নিয়মকে বদলেও দিয়েছে। পাত্রের মুখোমুখি এমন কিছু প্রশ্ন সে  করেছে যেখানে পাত্র হতচকিত হয়ে যাচ্ছে। দৈহিক সৌন্দর্যটাই যে সব নয়; বুদ্ধিমত্তা, মেধা অন্তরের সৌন্দর্যই যে অনেকটা ধরে রাখে ব্যক্তিত্বকে, সেটাই যেন বোঝাতে চেয়েছেন সাহিত্যিক। গল্প বলার স্টাইলটাই একেবারে ভিন্ন। শান্তনীলের সম্পর্কে আরোও কিছু জানার চেষ্টা অর্ণাকে প্রায় অস্থির করে তোলে। একেবারে শেষে গিয়ে মিলনাত্মক হয়েছে এটা ধরে নিয়ে আমরা এগোতে পারি। আসলে ‘অধরা মাধুরী’ এক প্রথা ভাঙার গল্প। মেয়েদের পক্ষে অধিকার অর্জন করার লড়াইয়ের গল্প। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যৌনতা, প্রেম, বিবাহ, সন্তান  ধারণ থেকে পুরুষবন্ধুর সঙ্গে প্রাকবিবাহে দেহগত মিলন ইত্যাদি বিষয়ে যে সামাজিক প্রথাগুলো রয়েছে, তা আজও মহিলাদের নিরন্তর প্রভাবিত করে চলেছে পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষভাবে। কাহিনীর কাঠামো, বিষয়বৈচিত্র আধুনিক সমাজে নারী পুরুষের অদ্ভুত রসায়নকে বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে খুব গুরুত্ব সহকারে দেখিয়েছেন।

আবার 'অপরিচিত' গল্পে তনুশ্রী উপলব্ধি করেছে এই পচাগলা সমাজের ক্ষয়িষ্ণু চেহারা। বিশেষ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যৌনতা বিষয়ে যে সামাজিক ট্যাবুগুলো আমাদের সমাজে রয়ে গেছে, সেই বিষয়গুলি বারবার উঠে এসেছে তাঁর বিভিন্ন গল্পের মধ্যে। কাঠামোগত দিক থেকে প্রত্যেকটা গল্পে একটা করে বক্তব্য রয়েছে বা বার্তা রয়েছে যা  সম্পূর্ণ নতুন কনসেপ্ট। পুরুষবন্ধু, খোলামেলা সেক্স আলোচনা, গোপন সঙ্গমে গর্ভবতী হয়ে পড়া নিয়ে বাংলায় অসংখ্য গল্প লেখা হয়েছে। তবুও সমাজ এই নারীকে অনেকাংশই পিছিয়ে রেখেছে, পুরুষ তাদের ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে, ক্ষমতা দেখিয়েছে। কাজল সেন ঠিক এই জায়গাটাতেই অনেকটা আলাদা। কনসেপ্টটিকে উল্টে দিতে চেয়েছেন তিনি, যা অতীত থেকে বর্তমান আজও চোরা স্রোতের মতন প্রবাহিত হয়ে চলেছে। সবরকম সামাজিক ট্যাবু বা সংস্কারে আবদ্ধ সেই ঘুণধরা সমাজের নগ্ন রূপটাই দেখিয়েছেন লেখক আধুনিকতার মোড়কে। নারী স্বাধীনতা যেমন বিপ্লবের কথা বলে, সেরকম আত্মপ্রত্যয় উচ্চারিত হয় তাঁর গল্পে।  কাজল সেনের 'এলা’ গল্পটাও একই সমস্যায় জর্জরিত। এলা তার গর্ভকে নিজের মনে করলেও, সন্তানসম্ভবা হয়েও সে ঔরসদাতাকে এড়িয়ে যাচ্ছে না। বরং গর্ভসঞ্চারের খবরটা দিয়ে গোপন পরিকল্পনায় তাকে বিয়ে দেবার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। এখানে 'এলা' হয়ে উঠেছে প্রকৃত এক স্বাধীন নারী।  আসলে সময় বদলায়, বদলায় মানুষের চেতনা। এই বদলের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন রকম সংকট জন্মায় যা ব্যক্তিকে, ব্যক্তির জীবনকে, সমাজকে প্রভাবিত করে। আর তার এই ইঙ্গিত থেকে যায় গল্প উপন্যাসে। সেরকমই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে কাজল সেনের 'গল্প সমগ্র ১'।

কাজল সেনের ছোটগল্পের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো চেতনার ভারসাম্য বজায় রাখা। যেরকম ‘অবগাহন’ গল্পটি। দিতিপ্রিয়ার জীবনে কো্নো পুরুষ নেই। সে নিজেই নিজেকে ধারণ করতে পারে। নিজের সঙ্গেই তার যত অন্তরঙ্গতা,  ঘনিষ্ঠতা, বন্ধুত্ব। নারী যে শুধুমাত্র পুরুষনির্ভর বা পরনির্ভরশীল নয়, সে স্বাবলম্বী আত্মনির্ভর,

সুকৌশলে সেই বিষয়টি তিনি উত্থাপন করেছেন তাঁর এই গল্পটিতে।

মধুবন চক্রবর্তী
আধুনিক মানুষের একাকীত্বের এই বিশিষ্ট রূপ তাঁর ক্ষুরধার লেখনীতে উজ্জ্বলভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে। প্রেমের মধ্যে ঢুকে পড়ছে কামগন্ধ, যৌনতা। পাশাপাশি ছেয়ে যাচ্ছে নিঃসঙ্গতাও। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ- মধ্যে দিয়ে প্রত্যেকটি গল্প তিনি যত্ন সহকারে পরিবেশন করেছেন পাঠকের কাছে। বদলে যাওয়া সমাজের বিভিন্ন রকম সংকট বা ক্রাইসিস নিয়ে যে চিন্তাভাবনা করেছেন সাহিত্যিক কাজল সেন, সেই চিন্তাকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করার জন্য অভিনন্দন জানাই ‘চিন্তা প্রকাশনী’কে। অভিনন্দন জানাই সাহিত্যিক কাজল সেনকেও।

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন