বড় পর্দায় হিন্দী ছায়াছবি
পরপর বড়
পর্দায় আমার দেখা বাংলা এবং ইংরেজী ছায়াছবির ইতিহাস যখন লিপিবদ্ধ করেছি, তখন হিন্দী
ছবিই বা বাকী থাকে কেন? তবে প্রথমেই কিছু তুলনামূলক তথ্য দিইঃ আমার মার স্মৃতিচারণের
খাতা অনুযায়ী আমাকে প্রথম সিনেমা দেখতে নিয়ে যাওয়া হয় মেট্রোতে ১৯৫৯ সালে, আমার দু’বছর
বয়স পূর্ণ হবার কয়েকদিন আগে। ছবিটি ছিল ১৯৫৮ সালের Tom Thumb, যার কিছুই আমার মনে নেই। যে ইংরেজী (আদতে ইটালীয়, ইংরেজীতে
dub করা) ছবি দেখার কথা আমার প্রথম মনে পড়ে তা ষাটের দশকের গোড়ায় – ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩-র
মধ্যে – লাইটহাউসে Trojan War অথবা The Trojan Horse। আবার, মার খাতায় লেখা আছে
যে ১৮ই জুলাই ১৯৬০-এ আমাকে প্রথম বাংলা ছবি দেখানো হয়ঃ সম্ভবত কালীঘাট অঞ্চলের ঊজ্জ্বলায়
উত্তমকুমার অভিনীত সখের চোর। এরও কিছু মনে
নেই। প্রথম যে বাংলা ছবির কথা মনে আছে সেটি হলো ডিসেম্বর ১৯৬০-এ ভবানীপুরের ইন্দিরায়
দেখা ছবি বিশ্বাস, বিশ্বজিৎ, সুলতা চৌধুরী অভিনীত শেষ পর্যন্ত।
প্রথম পর্বঃ ১৯৬৪/৬৫
আমার দেখা প্রথম হিন্দী ছবি ১৯৬৪ সালে, ধর্মতলার জ্যোতি প্রেক্ষাগৃহে জাহানারা। ইতিহাস-আশ্রিত এই বিয়োগান্ত প্রেমোপাখ্যানে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন মালা সিনহা। প্রেমিক মীর্জা চাঙ্গেজী হয়েছিলেন ভারত ভূষণ, সম্রাট শাহজাহানের ভূমিকায় পৃথ্বীরাজ কাপুর, এবং মমতাজ হয়েছিলেন অচলা সচদেব।
দাদা ছবিটি দেখে এসে তার ভূয়সী প্রশংসা করায় তাঁর সঙ্গে মা আর আমি যাই দেখতে। ততদিনে, দাদার প্রভাবে আমি হয়ে উঠেছি হিন্দী ছায়াছবির গানের ভক্ত, সবচেয়ে প্রিয় কণ্ঠ মহম্মদ রফির। মূল ছবির আগে ট্যালকম পাউডার ‘হিমালয়া বুকে’-র বিজ্ঞাপনে আশা ভোসলের গলা শুনে চমৎকৃত হয়েছিলাম। মদন মোহনের সুরে, রাজেন্দ্র কৃষণের লেখা মূল ছবির গানগুলি আজও কানে বাজে। কিছুদিন পর আমার এক কাকার বিয়ের পর তাঁর কাছ থেকে উপহারস্বরূপ ছবির একাধিক গানের রেকর্ড আদায় করেছিলাম। বাড়িতে অতিথি সমাগম হলে, বিশেষ করে তাঁরা যদি অবাঙালি হতেন, অনুরোধ পেলে এগুলির মধ্য থেকে যে গানটি গেয়ে শোনাতাম, সেটি ছবির প্রথম গান, মীর্জা চাঙ্গেজী-রূপী ভারত ভূষণের মুখে, মহম্মদ রফির গলায় ‘কিসী কি ইয়াদ মে দুনিয়া কো হ্যায় ভুলায়ে হুয়ে’। ছবিটি সম্বন্ধে পড়তে গিয়ে দেখি যে গানের মধ্য দিয়ে তখন রফির পাশে অস্তগামী শিল্পী তালাত মাহমুদকে আবার সামনে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল। ঘটনা, যে মীর্জা চাঙ্গেজীর মুখে প্রথম দুটি গানের পর মহম্মদ রফির বদলে তিনটি একক ও একটি দ্বৈত গানে তাঁর কণ্ঠ হয়েছিলেন তালাত। ইস্কুলে একবার তালাতের গাওয়া ‘ফির ওহী শাম, ওহী গম’ গেয়েছিলাম। একই ভাবে জাহানারার কণ্ঠ তাঁর গলায় প্রথম এবং তালাতের সঙ্গে দ্বৈত গানে লতা মঙ্গেশকর হলেও, মাঝে আরেকটি দ্বৈত গানে মীর্জা চাঙ্গেজী-রফির সঙ্গে জাহানারার কণ্ঠ হয়েছিলেন সুমন কল্যাণপুর।
ছবিটি
সেই সাত বছর বয়সে মন্দ লাগেনি, তবে শাহজাহান রূপী পৃথ্বীরাজ কাপুরের কণ্ঠস্বর কানে
পীড়াদায়ক লেগেছিল। মার ছবিটি একেবারেই ভালো লাগেনি এবং তিনি মাঝেমাঝেই ওই কণ্ঠের নকল
করে বর্ষীয়ান অভিনেতাকে ভ্যাঙ্গাতেন। ইতিহাস-আশ্রিত ছবি হিসেবে উল্লেখযোগ্য ঔরংজেব
চরিত্রের উপস্থিতি। সাধারণত মোগল যুগের প্রেক্ষাপটে যেসব ছবি এর আগে হয়েছে, যেমন ১৯৬৩
সালের তাজ মহল বা ১৯৪৬ সালের শাহজাহান, সেগুলিতে হয় ঔরংজেবকে দেখানো হয়েছে
শাহজাহান/খুররমের শিশুপুত্র রূপে (তাজ মহল)
বা ছবিতে সে চরিত্রের উপস্থিতিই নেই (শাহজাহান)।
জাহানারা-তে একটি নাটকীয় দৃশ্যে জ্যেষ্ঠা
ভগ্নীর ক্রোধজনিত তীব্র ভর্ৎসনার মুখে পড়তে দেখা যায় নতুন মোগল সম্রাটকে, যে ভর্ৎসনা
নতমস্তকে মেনে নেন তিনি। তাতে অবশ্য ঔরংজেবের কৃতকর্মে কোন প্রভাব পড়েছিল তা নয়, ছবিতেও
তেমন কিছু দেখানো হয়নি।
মালা সিনহা
ফিল্মফেয়ারের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন, তবে জেতেননি। ছবিটি শ্রেষ্ঠ
শিল্প পরিচালনার (রঙিন) পুরস্কার পেয়েছিল।
এর পরের
বড় পর্দার হিন্দী ছবিও দেখি সেই জ্যোতিতেইঃ ১৯৬৪ সালের সাদা-কালোয় তোলাদোস্তি, যা পরে জেনেছিলাম বাংলা লালুভুলু (১৯৫৯)-র রূপান্তর। প্রশংসিত ছবিটির
টিকিট কেনার ব্যাপারে এক অভিনব ছাড়ের ব্যবস্থা হয়ঃ ইস্কুল থেকে চিঠি নিয়ে গেলে টিকিটের
দামে students’ concession পাওয়া যাবে। ইস্কুলের ফাদার প্রিফেক্ট চিঠি টাইপ করে দেন।
দাদার সঙ্গে সোৎসাহে জ্যোতির টিকিট কাউন্টারে গেলাম। দাদা চিঠিশুদ্ধু হাত ঢুকিয়ে দিয়ে
বললেন, “Students’ Concession!” পত্রপাঠ টিকিট বিক্রেতা জোরে হাত নেড়ে জানালেন যে ওটা
হবে না! কেন তা মনে নেই। পরে অবশ্য ওই চিঠি ব্যবহার করে, ছাড় নিয়েই দাদার সঙ্গে ছবিটি
দেখেছিলাম। ছ’টি গানের মধ্যে পাঁচটিই আমার তৎকালীন প্রিয় গায়ক মহম্মদ রফির কণ্ঠে। মজরু
সুলতানপুরীর লেখা, লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলালের সুরারোপিত প্রত্যেকটি গান মুগ্ধ করা। ১৯৬৫
সালে অবশেষে বাবা আমাকে উপহার হিসেবে 4-speed record player, HMV কোম্পানীর
Playmate কিনে দেন – এতদিন বাড়িতে রেকর্ডে গান শুনেছি দম দেওয়া গ্রামোফোনে, শুধু ৭৮ গতির রেকর্ড বাজিয়ে। এবার ‘প্লে মেট’-এর সুবাদে
বাড়িতে এল ৩৩.১/৩ গতির ‘লং প্লে’ Gems from
Tagore, এবং ছোট্ট ৪৫ গতির ‘ই পি’ বা extended play যাতে ছিল দোস্তি ছবির চারটি গান, চারটিই রফির কণ্ঠে। প্রত্যেকটি গান গলায় তুলে নিয়েছিলাম।
দোস্তি সে বছরের শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পায়, এবং ফিল্মফেয়ার
পুরস্কারের জন্য সাতটি বিভাগে মনোনীত হয়ে ছ’টি বিভাগে জয়ী হয়ঃ শ্রেষ্ঠ ছবি, শ্রেষ্ঠ
সঙ্গীত পরিচালনা, শ্রেষ্ঠ গীত রচনা, শ্রেষ্ঠ নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী (মহম্মদ রফি), শ্রেষ্ঠ
কাহিনী এবং শ্রেষ্ঠ সংলাপ। ১৯৬৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দী ছবির মধ্যে দোস্তি ছিল বক্স অফিসের হিসেবে তৃতীয় সফলতম
ছবি।
বাবা ভারতীয়
সৈন্যদলে থাকার সুবাদে সে সময় আমাদের বাসস্থান ছিল বালিগঞ্জ ময়দান ক্যাম্পের মধ্যে
একটি বড় বাড়ি। এইরকম সময়ে সেখানে মাঠে পর্দা খাটিয়ে ১৬ মিলিমিটার প্রোজেকশানে ছবি দেখানো
শুরু হয়। এই পরিসরে প্রথম যে ছবি দেখি তা হলো ১৯৫৯ সালের ষষ্ঠ সফলতম ছবি দিল দেকে দেখো। গল্পের ল্যাজামুড়ো যে খুব একটা
বুঝেছিলাম তা নয়, কিন্তু গানগুলো মনে ধরেছিল আর খুব ভালো লেগে গিয়েছিল নায়ক-নায়িকা শাম্মী কাপুর এবং আশা পারেখকে।
শেষোক্ত সপ্তদশবর্ষিণীর নায়িকারূপে নাকি এটিই প্রথম ছবি ছিল। যেটা উল্লেখ্য, আমার সঙ্গে
ছবিটি দেখেন আমার বাবা, এবং তাঁরও শাম্মী কাপুরকে ভালো লেগে যায়!
এই ছবির
কথা এই জন্য বললাম যে দোস্তি-র পর সিনেমা
হলে গিয়ে যে ছবি দেখি, তারও নায়ক ছিলেন শাম্মী কাপুর – দেশপ্রিয় পার্কের পাশে প্রিয়া
সিনেমায় সেই ১৯৬৪ সালের রাজকুমার, যদিও
মনে হয় ছবিটি দেখেছিলাম ১৯৬৫-তে। ইংরেজী ছবি নিয়ে স্মৃতিচারণার শেষ পর্বে বলেছি কিভাবে
বাবা ১৯৬৫ থেকে সিনেমা
দেখার ব্যাপারে এক নির্মম-সদয় রীতি চালু করেন। বছরের নির্দিষ্ট সময় জ্বর-উৎপাদক এবং
অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক T. A. B. C. ইনজেকশন নিতে হবে, এবং তার কষ্ট ভোলার জন্য সিনেমা
দেখা যেতে পারে! রাজকুমার দেখা এই পীড়াদায়ক
প্রতিষেধক নেবার পরিণতি! গিয়েছিলাম দাদার সঙ্গে, এবং অত্যন্ত উপভোগ্য ও দৃশ্যতই প্রচুর
ব্যয় করে তোলা এই রঙিন ছবির (দোস্তি আর
দিল দেকে দেখো দুটিই ছিল সাদা-কালো) একটি
দৃশ্যে দাদা অট্টহাসি হাসতে হাসতে আমার যন্ত্রণাক্লিষ্ট হাতে একটি ঘুষি বসিয়ে দেন!
এই প্রথম হিন্দী ছবিতে তলোয়ার খেলা দেখলাম নায়ক রাজকুমার ভানুপ্রতাপ-শাম্মী কাপুর আর
খলনায়ক নর্পত সিং-প্রাণের মধ্যে। ভানুপ্রতাপের পিতা মহারাজের ভূমিকায় শাম্মী কাপুরের
বাস্তব জীবনে যিনি পিতা, সেই পৃথ্বীরাজ কাপুর আর সৎ-মার ভূমিকায় অচলা সচদেব – জাহানারা-র পুনরাবৃত্তি! রামানন্দ সাগরের লেখা
গল্প – যেখানে বিদেশ থেকে ফেরা রাজকুমার বন্ধু কপিলের সঙ্গে পরামর্শ করে ভাঁড়ের মতো
আচরণ করছে, যার আড়ালে সে আবিষ্কার করতে চায় তার বাবার বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র চলছে কিনা
– এখন খুব আবছাভাবে হলেও কালজয়ী বিয়োগান্ত নাটকের নায়ক হ্যামলেটের আচরণকে মনে পড়ায়।
রাজকুমার অবশ্য পুরোপুরি মিলনান্তক এবং
শাম্মী কাপুরের ভাবমূর্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অনেকটাই কৌতুকরসে জারিত। বক্স অফিসের
হিসেবে রাজকুমার ১৯৬৪-র পঞ্চম সফলতম হিন্দী
ছবি।
১৯৬৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত
আরেকটি ছবি দেখব সুদূর ভবিষ্যতে, ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪-র মধ্যে, যখন আমি যতীন দাস পার্ক লাগোয়া
শ্যামাপ্রসাদ কলেজে অধ্যাপনারতঃ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রযোজিত ও সুরারোপিত সাদা-কালো
ছবি কোহরা। এর উৎস-কাহিনী ড্যাফনে ডু মোরিয়ারের
১৯৩৮-এ প্রকাশিত রেবেকা উপন্যাস, এবং তার
থেকে ১৯৪০ সালে হওয়া হিচককের বিখ্যাত ছবিটি। ১৯৬২-তে বিশ সাল বাদ হিট করতে, পরের ছবিতে পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার বীরেন নাগ খানিকটা
বাহুল্যবর্জনের পথে হাঁটলেন। কোহরা-র আবহ
অনেক বেশী অবিমিশ্রভাবে রোমাঞ্চকর। এখানেও আগের ছবির মতো সেই নারীকণ্ঠে ভীতিজনক গান,
শিল্পী অবশ্যই লতাঃ ‘ঝুম ঝুম ঢলতি রাত’। ছবির শুরুর দিকে গানটি গাইছে নায়কের প্রথমা
স্ত্রী পুনম, যার মুখ আমরা সারা ছবিতে একবারও দেখতে পাবো না, শুধু চোখ দুটির ওপর ক্যামেরা মাঝে-মাঝে zoom in করবে! আর পুনম কিন্তু
বাকি ছবিতে বাংলা জিঘাংসা-র মঞ্জুশ্রী (১৯৫১) বা বিশ
সাল বাদ-এর রাধার (১৯৬২) মতো নকল ভূত নয়! পুনমের পূর্বসূরি হলো ১৯৫৮ সালের মধুমতী
ছবির নায়িকা (বৈজয়ন্তীমালা), যে ছিল আসল প্রেতাত্মা। তবে, মধুমতীর প্রেত ফিরে এসেছিল
তার হত্যাকারী উগ্রনারায়ণকে (প্রাণ) তার অপরাধ স্বীকার করাতে। পুনমের ভূত তাড়া করে
ফিরেছে নায়ক অমিত সিং-এর দ্বিতীয় স্ত্রী রাজেশ্বরীকে। মধুমতীর ভূত, প্রাসাদের যে আলসে
থেকে উগ্রনারায়ণের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মধুমতী আত্মহত্যা করেছিল
(জিঘাংসা মনে পড়ে?), সেখান থেকেই প্রেমিক
আনন্দকে (দিলীপকুমার) লাফিয়ে পড়তে বলে। ভূত পুনমও মানুষ সতীন রাজেশ্বরীকে দ্বিতীয়বার
‘ঝুম ঝুম ঢলতি রাত’ গেয়ে অমিতের প্রাসাদের ছাদে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে লাফিয়ে পড়তে বলে।
শেষ মুহূর্তে অমিত রাজেশ্বরীকে বাঁচায়। বলতে দ্বিধা নেই, এই দ্বিতীয়বার গাওয়া গানটির
রেকর্ড বাড়িতে শুনে সেই ৭/৮ বছর বয়সে বেশ ভয় পেতাম! তুলনায় এর আগের আপাত-ভৌতিক গানগুলি (মহল, মধুমতী, বিশ সাল বাদ) অতটা ভীতির উদ্রেক করে না।
কোহরা-র সম্পদ রাজেশ্বরীর ভূমিকায় ওয়াহিদা রেহমানের আর
দাই-মা’র ভূমিকায় ললিতা পাওয়ারের অভিনয়, আর সবার ওপরে হেমন্তর সুরে একের পর এক গান।
হেমন্তর প্রথম প্রযোজনা নীল আকাশের নীচে-র
(১৯৫৯) গান ‘ও নদীরে’ এখানে প্রায় অপরিবর্তিতভাবে লতাকণ্ঠে শোনা গেছে ‘ও বেকারার দিল’
গানে। তবে, উৎস বাংলা গানটিতে তো নদীর প্রতি এক ধরনের উদাস ভালোবাসার অভিব্যক্তিই ছিল। কোহরা-য়
নায়িকার মনে জমে থাকা দুঃখ, হতাশা হঠাৎ প্রেমের ছোঁয়ায় কিভাবে অভিমান-ভরা উচ্ছ্বাসে
পরিণত হয়েছে, হেমন্তর সুর আর লতার গায়কীতে তা মনকে মুগ্ধ করে দেয়। এক টুকরো আগুন (১৯৬৩) ছবিতে হেমন্তর সুরে উৎপলা
সেন গেয়েছিলেন ‘হে বিরহী, সরে থেকো না’। গানটির আস্থায়ীর সুরটুকু নিয়ে বিশ্বজিতের মুখে
হেমন্ত গাইলেন ‘রাহ বনি খুদ মঞ্জিল’। আর, বোধহয় সবার ওপরে ১৯৫৯ সালের দীপ জ্বেলে যাই ছবির সেই সম্মোহক ‘এই রাত তোমার
আমার’-এর আস্থায়ী ব্যবহার করে, যা ছিল একাকী প্রেমিকের প্রেমিকাকে অনুভবে-পাওয়ার গান,
তাকে হেমন্ত ও কবি-গীতিকার কইফি আজমি বদলে দিয়েছেন মুগ্ধ স্বামীর সামনে-উপস্থিত স্ত্রীর
প্রতি সেই সম্মোহক ভালবাসার বহিপ্রকাশে। গানের চিত্রায়নও প্রশংসনীয়। বাংলা গানটির ভিডিও
ক্ষতবিক্ষত! তাই শুধু হেমন্তর কণ্ঠে ‘এই রাত তোমার আমার’ এবং তার পরেই ‘ইয়ে নয়ন ডরে-ডরে’-র
পূর্ণ দৃশ্য-সম্বলিত ভিডিওটিই সম্বল ইউটিউবে।
কোহরা বাণিজ্যিক সাফল্য পায়নি। হয়তো বিশ সাল বাদ-এ ব্যবহৃত ‘ফরমুলা’-র পুনরাবৃত্তি
– সেই এক প্রাসাদ, তাকে ঘিরে বা তার মধ্যে
– বিশ সাল বাদ-এ আপাত, এখানে আসল, মহিলা
প্রেতাত্মার কণ্ঠে গান, এবং চিত্রায়নে ১৯৬২-র
ছবিটির বহির্দৃশ্য গ্রহণের জায়গাগুলি অবধি অনেকটা এক থাকা, এবং সেই এক নায়ক-নায়িকা
জুটি – দর্শকদের একঘেয়ে লেগে থাকতে পারে। অবশ্য ওই ১৯৬৪-তেই মুক্তি পেয়ে, আবার স্ত্রীকণ্ঠে
(আপাত) ভৌতিক গান ব্যবহার করে বিশ সাল বাদ-এর
সঙ্গে যুক্ত ধ্রুব চ্যাটার্জী রাজ খোসলার ও
কৌন থী ছবিতে দারুণ বাণিজ্যিক সাফল্য পান। দুটি ছবির কোনটি আগে মুক্তি পায়, অন্তর্জালে
তা নিয়ে পরস্পর-বিরোধী তথ্য রয়েছে।
এছাড়া, চিত্রনাট্যে
যে ত্রুটি ছিল তা হেমন্ত আঁচ করলেও সঠিক দোষটি ধরতে পারেননিঃ
… সিনেমা লাইনের লোকের কাছে ফুলমার্ক
পেল ‘কোহরা’।[1]
কিন্তু আমার মনে তবু সংশয়। ছবিটার সব ভালো কিন্তু তবু একটা বিরাট ত্রুটি রয়ে গেছে গল্প
বলার কায়দায়। একটা ধোঁয়াটে ভাব রেখে দিয়েছেন পরিচালক … তাই আমি বীরেনবাবুকে বললাম,
‘সবই ঠিক আছে, কিন্তু প্রেতাত্মার ব্যাপারটাকে দর্শকের কাছে অস্পষ্ট রাখছেন কেন। স্পষ্ট
বলে দিন না ওটা প্রেতাত্মা। তাহলেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়…’
কিন্তু বীরেনবাবু আমার কথা মানলেন না।
রাজি হলেন না এতটুকু বদলাতে। (আনন্দধারা,
৮১)
ছবিটি দেখার পর বলতে
বাধ্য হচ্ছি যে প্রেতাত্মার ব্যাপারে কোন অস্পষ্টতা নেই। সমস্যা একমাত্র পুনমের ভূতের
আচরণ![2]
রাজেশ্বরী অমিত সিং-এর
দ্বিতীয় পক্ষ হয়ে আসতেই দাই-মা তার প্রতি বিরূপতা প্রদর্শন করতে থাকে, কারণ রাজেশ্বরী
পুনমের মতো অভিজাত নয়। পুনম প্রাসাদের যে মহলে বাস করতো, রাজেশ্বরী সেখানে গেলে মৃতা পুন মের উপস্থিতি অনুভব করে, তার হাসি
শুনতে পায়, এমনকি আয়নার সামনে তার ছায়ামূর্তিকে বসে থাকতেও দেখে। ঘটনা চরমে ওঠে পুনমের
প্রেত যখন গান গাইতে-গাইতে রাজেশ্বরীকে তাড়া
করে নিয়ে যায় ছাদের আলসেতে এবং ফিসফিস করে তাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলে। আতঙ্কিত, সম্মোহিত
রাজেশ্বরী তাই করতে যাচ্ছিল, এমন সময় অমিত তাকে ধরে ফেলে বাঁচায়। আমরা দেখেছি যে পুনমের
জীবতাবস্থায় তার একাধিক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। তা, এরকম স্বৈরিণী নারী যে মৃত্যুর
পর কোপনস্বভাব হয়ে নিরপরাধ সতীনের ওপর চড়াও হবে, এমন ভূতের গল্প, মনে হয়, অনেক আছে।
কিন্তু এবার স্পয়লার-সতর্কতা
দিয়ে বলিঃ আমরা প্রথমে জানছি যে প্রথম স্ত্রীর ব্যাভিচারে ধৈর্য হারিয়ে অমিতই পুনমের
মদ-খেয়ে-সংজ্ঞাহীন শরীরের ওপর গুলি চালিয়ে দেয়। তারপর গাড়িসহ পুমের দেহ জলায় ডুবিয়ে
দেয়। এই পরের দৃশ্যটি হিচককের সাইকো (১৯৬০)
থেকে অনুপ্রাণিত। স্ত্রীহত্যার দায়ে অমিত গ্রেপ্তার হয়, থানায় যাবার আগে বিহ্বল রাজেশ্বরী
অমিতের পায়ে লুটিয়ে পড়ে। এই দৃশ্য দেখে দাই-মা ছুটে এসে আদালতে কবুল করে যে অমিত পুনমের
মৃতদেহের ওপর গুলি চালিয়েছিল। দেবতুল্য স্বামীর
প্রতি পুনমের অবজ্ঞা দেখে দাই-মা স্বয়ং পুনমের মদে বিষ মিশিয়ে তাকে হত্যা করে!
গুলি চালালো স্বামী;
বিষ দিল দাই-মা। পুনমের ভূত এই দু’জনকে একবারের জন্যও কিছু করল না, তার যত রাগ নিষ্পাপ রাজেশ্বরীর ওপর! আর, রাজেশ্বরীকে
মারতে বিফল হয়ে পুনমের ভূত একেবারে হাওয়া হয়ে গেলো, অমিত-রাজেশ্বরী প্রাসাদে ফিরে সুখে
সংসার করা শুরু করল!
কোহরা বড় পর্দায় দেখেছি, আশির দশকে, দু’বার। প্রথমবার
ভবানীপুরের বিজলী সিনেমায় দুপুরের শো-তে। হলে পৌঁছে দেখি ছবি শুরু হয়ে গেছে, গান চলছে
‘ঝুম ঝুম ঢলতি রাত’। অতএব দ্বিতীয়বার গেলাম মধ্য কলকাতায়, কলকাতা কর্পোরেশনের লাগোয়া মিনার্ভায়
(যার নাম পরে বদলে হয় ‘চ্যাপলিন’; কোহরা
দেখার সময় এই পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল কিনা মনে নেই)। সেখানে ছবিটির রোজ তিনটি প্রদর্শনী
ছিল। তৃপ্তি করে গোড়া থেকে ছবিটি দেখেছিলাম। হাতে গোনা যে ক’টি হিন্দী ছবি একাধিকবার
দেখেছি, সেগুলির মধ্যে কোহরা তৃতীয়।
লক্ষ্যণীয়, সাম্প্রতিক
সময় অবধি বিজলী শুধুই বাংলা ছবি আনত। আর মিনার্ভা/চ্যাপলিন মাঝে-মধ্যে হিন্দী ছবির
আগ্রাসনের কাছে মাথা নত করলেও ষাটের দশকের শেষে পুনর্যাত্রা শুরু করেছিল ইংরেজী – মূলত
কলম্বিয়া কোম্পানীর – ছবির মুক্তিস্থান হিসেবে!
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন