ধর্ষণ সংস্কৃতি ও ধর্ষকের
মনস্তত্ত্ব
যাপনচিত্র আটে আমি যে ঘটনাটা উল্লেখ করতে চাই সেটা
এইরকম। শহরতলি অঞ্চলের বাসিন্দা সত্তর বছর বয়সী এক বৃদ্ধা। রাস্তাঘাটে চলাকালীন
তিনি হঠাৎ লক্ষ্য করেন, কোন এক উৎসবের আবহাওয়ায় একটি মেয়ে তার মার সঙ্গে হেঁটে
যাচ্ছে। মেয়েটির পরনে ছোট গেঞ্জি এবং
জিন্স। কোনো এক বা একাধিক ছেলে রাস্তায়
তাকে কুমন্তব্য করে যার প্রতিক্রিয়ায় মা ও মেয়ে প্রতিবাদ করেন। মেয়েটি হাত উঁচিয়ে
প্রতিবাদ করে কিছু বলছিল। উপরোক্ত বয়স্ক মহিলা তার সেই হাতটা ধরে তাকে বলেন, ‘আঙুলটা
ওদিকে না তুলে নিজের দিকে তোলো’। বলে তিনি তার মাকে বলেন তার মেয়ের পোশাক আশাকের
দিকে যেন একটু নজর দেন।
নারীর পোষাক বা স্বভাব বা আরো অন্যান্য বিষয়গুলো যদি সত্যিই
ধর্ষণ করার কারণ হিসেবে আদৌ কোনো ফ্যাক্টর হত তাহলে শিশুকন্যা ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটত
কি? ঘটত না তো? তাই না?
বরং দেশে বিদেশে যেসব ধর্ষণ সংক্রান্ত গবেষণা ও সমীক্ষা হয়েছে সেখান
থেকে এই তথ্যই পাওয়া গেছে, লিঙ্গ অসাম্য ধর্ষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি কারণ। প্রায় প্রতিটি ধর্ষকের মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে
যে তারা নিজেদের নারীদের চেয়ে উচ্চতর বলে মনে করে। দেখা গেছে নারীদের পোষাক ও স্বভাব তাদের
উত্তেজনার উদ্রেক করেছে বলে তারা ধর্ষণ করে, এমন দাবী করেছে। দেখা গেছে নারীকে ধর্ষণ করে ‘নষ্ট’ করে দেওয়ার পর যেহেতু সমাজের অন্য
পুরুষ তাকে আর বিয়ে করবে না [কেননা সমাজের এটাই রীতি। নারীর চরিত্র পরিমাপ করা, পুরুষের চরিত্র পরিমাপ করার রীতিরেওয়াজ এ সমাজের নেই] তাই সেই ধর্ষকই আবার জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সেই ধর্ষিত নারীকে বিয়ে করে তাকে উদ্ধার
করবার মহৎ মতামত ব্যক্ত করেছে [এই প্রবন্ধের প্রথম দিকে মধুমিতা
পান্ডের তিহার জেলে ধর্ষণ সমীক্ষার যে ফলাফলের কথা উল্লেখ করেছি, সেই অংশটুকু পাঠককে আরো একবার মিলিয়ে নিতে অনুরোধ করি।]। একটু নজর করে দেখুন পাঠক, যাপনচিত্র আটে আমি যে বয়স্ক প্রতিবাদী নারীর কথা উল্লেখ করেছি
তার মনস্তত্বের সঙ্গে ও যুক্তির সঙ্গে ধর্ষকদের মনস্তত্ব ও যুক্তির কী অনবদ্য সাযুজ্য। এর পেছনে যে সবচেয়ে বড় কারণ সেটা এই
যে ধর্ষকদের মনস্তত্ব আসলে পিতৃতান্ত্রিক মনস্তত্বাত্বিক কাঠামোরই প্রতিচ্ছবি। পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা যে ভ্যাল্যু
সিস্টেমের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে সেটাই ধর্ষকদের মনস্তত্ব নির্মাণ করে। নারীর চরিত্র পরিমাপ করা, তার সতীত্ব নির্ধারণ বা উল্টো দিক থেকে তার গায়ে ‘কুলটা’ লেবেল এঁটে দেওয়া, নারীকে
নরকের দ্বার হিসেবে উপস্থাপন করা, পুরুষের সমস্ত স্খলনপতনের কারণ
হিসেবে নারীকেই দায়ী করা বা জীবনের সব ক্ষেত্রে সর্বত্র পুরুষই নারী জীবনের একমাত্র
মুক্তির উপায়, এই ন্যারেটিভ নির্মাণ আসলে পিতৃতন্ত্রেরই অস্তিত্ব
টিকিয়ে রাখার জন্য তারই বিছানো জাল। আর পিতৃতন্ত্র তার এই সংবহন বজায় রাখে নারীদের ব্যবহার
করে নারীদের সাহায্যেই অত্যন্ত সুকৌশলে।
যাপনচিত্র আটে আমি যে কিশোরী মেয়েটির কথা উল্লেখ করেছি সে ছোট গেঞ্জি বা জিন্স পরেছে এই জন্যেই যে তার পছন্দ মতো পোশাক পরার অধিকার তার আছে। এবং সেই অধিকারকে সম্মান জানানোর দায়িত্ব এবং কর্তব্য গোটা সমাজের সমস্ত সদস্যদের। নারী মানেই কোনো মাংসপিণ্ড নয়। নারীর যে শুধু শরীর আছে তা নয়। নারীর মন আছে, মেধা আছে, মনন আছে। নারীর সৌন্দর্যচেতনা আছে, নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সেই স্বাধীনতা ভোগ করবার অধিকার আছে, নারীর প্রতিভা আছে। নারীর অস্তিত্ব শুধু তার যৌনাঙ্গে ও জননাঙ্গে নেই। নারীর অস্তিত্ব তার ব্রেনে, সুসম্নাকান্ডে ও গোটা স্নায়ুতন্ত্র জুড়ে ছড়িয়ে আছে। সে কী ভাবে, কী পদ্ধতিতে ভাবে এবং সে তার ভাবনাচিন্তার দ্বারা গোটা সমাজ ও সভ্যতাকে কোন কোন দিশা দেখাতে পারে সেই সম্ভাবনাও তারই নারী অস্তিত্বের অঙ্গ। নারী কোনো বস্তু বা অবজেক্ট নয়। তাই নারীকে কোনো বস্তু হিসেবে দেখার, ভাবার ও ব্যবহার করার অর্থাৎ নারীকে অবজেক্টিফাই করার এই প্রবণতা এবং মানসিকতা যা এ যাবত কাল অব্দি আমাদের সমাজে চলে এসেছে পিতৃতন্ত্রবাহিত হয়ে, তাকে যে করেই হোক, যে কোনো মূল্যে প্রতিহত করতে হবে এবং তা করার জন্য মেয়েদের যুথবদ্ধ হতে হবে। প্রজন্ম প্রজন্ম বাহিত হয়ে গোটা পৃথিবীর সমস্ত সমাজ-সভ্যতা-পরিবারের প্রায় সমস্ত পুরুষ সদস্যদের মস্তিস্কে, চেতনায় যে চিন্তাচেতনা ও আদর্শ, যে সংস্কৃতি সংবাহিত হচ্ছে, হয়ে চলেছে সেই আবর্তনকে ভাঙতে হবে। যাপনচিত্র আটের কিশোরীটি এই গোটা প্রক্রিয়াটাকেই প্রশ্ন করেছিল, চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল জেনে অথবা না জেনে। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল এবং চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল কর্তৃত্ব অর্থাৎ পিতৃতন্ত্রকে সচেতনভাবে অথবা অসচেতনভাবে। সে চেষ্টা করেছিল তার অধিকার বুঝে নিতে, ঠিক যেমনটা করে চলেছে ইদানিং আরো অনেক নারীই। এবং সেটা করে বাহবা পাওয়ার বদলে তাকে পেতে হয়েছে তিরস্কার এবং সেটা করেছে পিতৃতন্ত্রের আদর্শে লালিত এক নারী। এবং তিনি মনে করছেন তিনি ঠিক করেছেন, তিনি একটি মহৎ কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। মৌলবাদের মহিমা এখানেই। তা কখনো কোনো যুক্তি-বুদ্ধি-বিশ্লেষণ মানে না। সে সব সময় গোঁড়া, অন্ধ।
যাপনচিত্র আটের ঘটনাটা আর একটু এগোলেই অর্থাৎ
আমি বলতে চাইছি, মেয়েটি প্রতিবাদ করেছে, বয়স্ক ভদ্রমহিলা তাকে তিরস্কার করেছে। যে ছেলেগুলো অভব্য কথা বলেছিল, আচরণ করেছিল তারা হয়ত এই তিরস্কারের ঘটনায় চেতনে বা অবচেতনে তৃপ্ত
হয়েছিল বা তাদের মনযোগ ঘুরিয়ে দিয়েছিল বা ঘটনার অভিঘাত অন্যমুখে চালিত করেছিল। তাই ঘটনাটা ওখানেই থেমে গেছিল। কিন্তু যদি মেয়েটি তার প্রতিবাদ আরো
প্রসারিত করত, ছেলেদের ইগো হার্ট হত। তারা মেয়েটিকে চিনে রাখত এবং তারপর
সুযোগ সুবিধে মতো তাকে ধর্ষণ করত, তাহলে নিশ্চিতভাবেই
কর্তৃত্ব সেই ধর্ষণের জন্য মেয়েটিকেই দায়ী করত, ছেলেগুলোকে নয়। কিন্তু যদি এমনটা হত ছেলেগুলোর বাবা
মায়েরা, বিশেষ করে তাদের এই চিন্তাচেতনায় শিক্ষিত করত
যে মেয়েদের সঙ্গে এ আচরণ করতে নেই, স্বল্পবাসের অধিকার পুরুষের
পাশাপাশি নারীরও আছে, যদি ছেলেদের শৈশব থেকেই সংযমের শিক্ষা ও
দীক্ষায় দীক্ষিত করত, যদি শেখাত নারীপুরুষ সমান ও সমান অধিকার
ও সম্মানের অধিকারী, তাহলে ঘটনাটা বদলে যেত। তবু যে কথা বলার, যে কাজ আগে করা যায়নি, তা অবিলম্বে শুরু
করতে হবে। এ দায়িত্ব বাবা মায়েদের, প্রধানত মায়েদের নিতে হবে।
এখানে একটা কথা না বললেই নয়, সাধারণভাবে এখনকার এই সমাজের বেশিরভাগ নারীই পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধে
শিক্ষিত ও দীক্ষিত। এবং এটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অসচেতনতার কারণে। জ্ঞানের যে চর্চা মানুষের মধ্যে সমাজ, সভ্যতা ও পৃথিবীকে এবং নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে অর্থ অনুধাবন
করতে একজন ব্যক্তিকে পারঙ্গম করে তোলে, মহাকাল ও মহাবিশ্বের সঙ্গে তার সংযোগ
অনুধাবন করতে শেখায়, সেই চর্চা চিরকালই সমাজের বৃহত্তর অংশের জীবনযাপন
ও জীবিকা নির্বাহের তাগিদে ইচ্ছেয় হোক, অনিচ্ছেয় হোক,
করা সম্ভব হয় না। তাই বর্তমান সমাজের মায়েরা লিঙ্গসাম্যের রাজনীতির নানা
জটিল কুটিল প্যাঁচপয়জার সম্পর্কে নিজেরাই অবহিত নয় এবং এটা মূলত গৃহশ্রমের কারণে, যেটা লিঙ্গ
অসাম্যের আরেকটি বড় দৃষ্টান্ত। প্রগতির সপক্ষে বা মানবমুক্তির আধুনিক চিন্তাচেতনা ও যুক্তিবুদ্ধিগুলো
সাধারণ নারী পুরুষ এমনিতেই এক প্রতিক্রিয়াশীল
উন্নাসিকতাজাত কারণে হতচ্ছেদ্দা করে থাকে। নারীমুক্তির স্বপ্নে আন্দোলিত নব্য
চেতনার নারীদের তাই যুথবদ্ধতার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক সচেতনতাও সৃষ্টি করতে হবে এই সমাজে
নতুন নতুন মূল্যবোধ যা পুরোনো মূল্যবোধকে ধূলিসাৎ করে মানবতার নতুন মহাসড়ক নির্মাণ
করতে আমাদের সহায়তা করবে। তা না হলে যেসব মায়েদের নিজেদেরই চিন্তাচেতনায় স্থবিরতা বাসা বেধে আছে, তারা আর
কী করে তাদের সন্তানদের নতুন চিন্তাচেতনা ও মূলবোধের
শিক্ষা দেবে? তারা তো যে কোনো নতুনকে যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে বিচার
করে সাদরে গ্রহণ করতে ভয় পাবেই অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকার
কারণে। তাই নয় কি?
[ক্রমশ ]
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন