কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৫

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

দ্য ক্লাউড


 

(সপ্তম পর্ব)  

আমি আসলে মারা যাইনি। এইসব আনন্দের মৃত্যু সহজ কথা নয়! আরও পুঁজি! আরও মুনাফার পাহাড়! কেবল চাই! আরও চাই!

নিমচাঁদ, মানে পুরনো আমি বললাম-

ভাই আনন্দ, তুমি যে বললে, তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাসী! 

আনন্দ বলতে থাকলো, আরে দোস্ত, প্রতিটি মানুষের দু'টো হাত। টাকা কি একহাতে ধরা যায়? ঈশ্বর স্বয়ং এসে তার একহাতে টাকার যোগান দেন। মানুষ তার অপর হাতে টাকা ধরেন।

আমি, মৃত নিমচাঁদ দাগা বললাম, পারমার্থিক  ঈশ্বরকে ছেড়ে দিয়ে জাগতিক কামনায় পিষ্ট হয়ে তুমি তো পথভ্রষ্ট হয়ে গেলে হে!

জানি, একথা বলেই আনন্দ বলতে থাকলো, আমার সামনে তখন একটাই পথ। আর তা হলো টাকা টাকা, আরও টাকা !

আমি একথায় একটু অন্যমনস্ক হয়ে আমার নিজের জীবিতকালে চলে গেলাম।

ফাল্গুনী সর্ষের তখন অনেক দাম। তবে একই জমিতে তিন ও একভাগে যদি সর্ষে আর শিয়ালকাঁটার গাছ লাগানো যায়, তবে উভয়েরই বীজ একইরকম দানাদার হওয়ার জন্য এবং উভয় গাছই তৈলের আধারে নির্মিত হওয়াতে বাৎসরিক উৎপাদনের কস্টিংস কমে মুনাফার অঙ্ক বেড়ে যায়। মুনাফা একরকমের নেশা। প্রথম থেকে এতে লাগাম না পড়ালে একটা সময় এই ঘোড়া, বাঘ হয়ে মুনাফাখোরকে পিঠে নিয়ে দৌঁড়াতে থাকে। আর, সেই অনিবার্য পতনের কারণেই আজ আমি জাতীয় পতাকায় লটকে থাকা একটি অর্ধভঙ্গ আত্মা।

আনন্দের ডাকে চমক ভাঙলো আমার। আনন্দ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে কোড করে বলতে শুরু করলো আবারও -

"আমি মরিয়া যাহা জানিয়াছি, তুমি বাঁচিয়া থাকিয়া তাহা জানিবে, এ আশা ঠিক নয়।"

এলেম আছে বটে আনন্দের, আমি মনে মনে বললাম -

রবীঠাকুর থেকে কোটেশন ধার করছে এখনও! মৃত্যুর পরেও দেশপ্রিয় জননেতার উদ্ধৃতি ধার করে বেশি দামে ও যদি এখন-ও কাউকে বেচে দেয় এই অনন্তলোকে, তবে তো স্বর্গ মর্ত্য পাতাল নামের ত্রিভূবন বলে আর কিছুই থাকবে না! 

আমি চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম -

আজও আকাশ বেশ মেঘলা। এমন মেঘের আড়ালে সূর্য থাকলেও এইসব মেঘ মানেই একটা ভয়ঙ্কর উল্কার আঘাতে পৃথিবীর পৃষ্ঠার নথিপত্র সব উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হওয়া।

যাইহোক, আমার একমাত্র সঙ্গী আনন্দের কথানুযায়ী -

আনন্দ দুই পদের। এক, জীবনকে জীবন ভেবে, তার তাৎপর্য বুঝে উপভোগ করার নাম আনন্দ। আর, অপরপক্ষে অর্থহীন অনর্থক রাশি রাশি  অর্থের পেছনে ছুটে চলার নাম আরও এক আনন্দ।

জিজ্ঞেস করলাম, তুমি যে বললে তুমি সেদিন গাড়ি দূর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলে?

হাসলো আনন্দ। এই হাসিটা আমার কাছে কেমন যেন রাতজাগা পেঁচার কান্নার মতো শোনালো।

ওর ওই কান্নামেশা ভেজা গলায় ও যেটা বলতে থাকলো, তা হলো নিয়তির পরিহাসে সে তখন বাঘের পিঠে চেপে বসেছে। মন্ত্রী শান্ত্রী-পেয়াদা পরিবেষ্টিত কুবেররূপী আমীর আনন্দ। অবশ্যই সে আনন্দের কথানুযায়ী সে তখন ব্যাঘ্রবাহনও বটে।

আমি, মৃত নিমচাঁদ দাগা মনে মনে ভাবলাম, আনন্দের পাপ যদি ষোলো কেজি তেলের টিন হয়, তবে মানুষের খাদ্য ভোজ্যতেলে বিষ মিশিয়ে আমি যা পাপ করেছি, সেই পাপ সিকি চা-চামচ তেলের থেকেও নগন্য। তবে, যে কোনো পাপ তো পাপ-ই!

আমার সামান্য আত্মশ্লাঘা থেকেও আমি বেরিয়ে আসবার জন্য ছটফট করতে করতে বেশ বুঝতে পারছিলাম  যে, জাতীয় পতাকায় লটকে লটকে আমি যেন কখন জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছি।

জীবিতকালে চোখ থাকলেও অনেকেই দেখতে পায় না। আর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে আমি বেশ বুঝতে পারছি যে, অস্তিত্বহীন এই অনন্তর আমি, যার ঘুম নাই, খিদে নাই, যৌনতা সম্পর্কে কোনও ইচ্ছে বা আবেগ নাই, অর্থে লোলুপতা নাই। সেই আমার দুচোখের দৃষ্টিতে আজ থেকে এই আমি কেবলই বিচরণ করবো, এমন এক অনন্তে, যেখানে অন্যরকম একটা কিছু!  অর্থাৎ মৃত আমি বা মৃত আনন্দের পাপকর্মের বাইরে কোনো সৃষ্টিশীল কিছু।

(ক্রমশঃ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন