কবিতার কালিমাটি ১৪১ |
সেই সব শববাহকেরা
সেই সব শববাহকেরা যারা নষ্ট পূর্ণিমার আলোয়
রাস্তা হাঁটতে গিয়ে রুক্ষ জমিতে
মুখ থুবড়ে পড়েছিল, যারা জানত
না কবীরের
দোঁহা কাকে বলে! কাকে বলে ভানুসিংহের পদাবলী!
যারা কেবল জাতপাতহীন, শ্রেণীহীন
দেহ কাঁধে
ক’রে হেঁটেছে ব্যাবিলন থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত!
সিন্ধুর জল ছুঁয়ে আচমন করেছে,
যতবার পড়েছে ততবার উঠেছে,
যতবার উঠেছে ততবার পড়েছে,
তবুও থামেনি, সংঘাত, আঘাত, রিরংসায়
পর্যদুস্ত সমাজে তারাই একমাত্র ‘সত্য’ অবলম্বন,
যারা মানুষের দেহ কাঁধে করে নিয়ে যায়
দূর শ্মশানে— জাতের
পরোয়া করে না।
সেই সব শববাহকেরা আজ যদি রাষ্ট্রের কাছে,
সমাজের কাছে চরম শ্রাদ্ধের দিনে আসে—
কী পাবে? পরিচয়! শ্মশানবন্ধুর পরিচয়!
আর কোনও আলাপ, মীড় জীবনের
বীণায় বাজবে না।
কোনও পরিচয়েই তাদের আসক্তি নেই
তারা অনাসক্ত, কেবল স্পন্দনের গভীরে
চেতনার অনিমেষে কাজ করে!
এই শ্রমের মূল্য সবাই দেয়ও না, হয়ত বা
ভুলেও যায়, কেউ কেউ মনেও রাখে।
যেভাবে মনে থাকে পাখির আলাপ,
গিরগিটির মতো সময়ে অসময়ে রং
বদলে ফেলা মানুষ, বাতিঘরের নিঃস্পন্দ
আলো, ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া মহানগরের
নীতা অথবা দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া রেলের কামরা—
সেভাবেই মনে থাকে রাজদ্বারে, শ্মশানে
বিপদে, মহাঝড়ে, সর্বনাশের প্রলয়ে,
ঝঞ্ঝায়, আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে
যাওয়ার আগে অবিনশ্বর হয়ে থাকা শববাহকদের!
বড় বিস্ময়! অসাধারণ বাঙ্ময় অভিব্যক্তি!
মৃত মানুষের জন্য এত ভালবাসা, এত অশ্রুজল—
শববাহক তোমরা কী শুধুই মানুষ? মানবরূপী দেবতা
নও?
আমি তো মনে করি দেবতাই—
তোমাদের চলার ছন্দে মৃত নদীও বেগবতী,
মৃতবৎসা গাভীও সন্তান প্রসব করে, খরাপীড়িত
দীন মাটিতে বর্ষার নতুন জলের ধারা—
প্রাণ পায় বীজের উচ্চারণ, জন্মায়
চারা!
শববাহক ব্যাবিলন থেকে সুমেরু, সুমেরু
থেকে ইন্দোনেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া
থেকে
বাংলাদেশ, বাংলাদেশ থেকে শ্রীলঙ্কা,
জাপান, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সীমানা ছুঁয়ে
তোমরা এগিয়ে চলেছ—
কাঁধে মৃত কোনও মানুষ, কূল, শীল, গোত্রহীন,
জাতপাতহীন, সহৃদয় সম্বলহীন কপর্দকশূন্য
এক ‘মানবশিশু’,
কোনও একদিন ধনী ছিল, মহাধনী
আজ শূন্যতার গভীরে নিমজ্জিত,
প্রাণ চলে গিয়েছে নিখুঁত জ্যোতিপুঞ্জের মাঝে,
কিছু সময়ের অপেক্ষা—
আগুন, পবিত্র আগুন গ্রাস করবে দেহ,
পুড়ে যাবে, নষ্ট হবে, দেহ নশ্বর,
পড়ে থাকবে ছাই,
অনন্ত ‘বিভূতি’ হয়ে সেই
ছাই
ভূমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়বে,
যা কিছু নশ্বর তাই তো ছাই,
তাই তো পোড়ে, দগ্ধ হয়,
শুদ্ধ হয়।
আগুন সর্বভূক, সবই গ্রহণ
করে,
অঞ্জলি পেতে অগ্নিদেব পচন, গলন,
স্খলন, পতন, বিচ্যুতি, ত্রুটি
গ্রহণ ক’রে
মৃত্যুর উপকথা লেখেন,
যে উপকথায় মানুষ আবার পবিত্র
আত্মায় পরিণত—
শববাহক, আত্মা-পরমাত্মার মিলনে
অগ্নিকে সাহায্যকারীর ভূমিকায় সমাহিত,
এ কাজ সহজ নয়, কঠিন।
দুর্গম রাস্তা পার হতে হয়,
হাতে বাঁশি থাকে না, থাকে গভীর রুদ্রাক্ষ।
সেই রুদ্রাক্ষের পরাকাষ্ঠায় লেখো শববাহক
ভারত প্রেমকথা, লেখো নব
মার্কণ্ডেয় পুরাণ,
লেখো সেই মহাকাব্য -- যেখানে মানুষ আত্মার
ঔচিত্যে নিজেই বৈভব!
সে তো নিজেই কর্মগুণে ঈশ্বর,
জল বয়ে যাচ্ছে। কৈলাস থেকে কন্যাকুমারিকায়,
সিন্ধু থেকে হরপ্পায়, টেমস্ থেকে
মিশরে,
পারস্য উপত্যকায় সিন্দবাদ নাবিকের গল্প শেষ
হলে চাঁদ নেমে আসে সূর্যের কাছে—
শববাহক এসব তোমায় দেখতে হবে না।
তুমি এগিয়ে চলো, সামনে আরও
সামনে।
পৃথিবী শ্মশান হয়ে যাচ্ছে,
সব পুড়ছে, শব পুড়ছে,
শ্মশানের মাটি নাকি পবিত্র! শুদ্ধ!
চলো সেই মাটি নিয়ে আসি, নিয়ে
আসি ছাই, বিন্দু বিন্দু ছাই ছড়িয়ে দেব
মহাপৃথিবীতে, তৈরি করব বিশ্বপ্রেমকথা,
এক হাতে চিতাকাঠ, অন্য হাতে
আগুন,
শববাহক আমাদের পরিশুদ্ধ করো।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন