সমকালীন ছোটগল্প |
কদম্বের ফুলতুবড়ি
সবাই জেনে গিয়েছিলো এবার কিছু একটা হবে। কি হবে, কোথায়
হবে, কারা করবে, কিভাবে হবে -- কেউ না জানলেও, একথা মুখে মুখে ঘুরছিলো, এবার কিছু একটা
হবে। বিষয়টা খুলেই বলি। তার আগে কিছুটা আপডেটের প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে বলতে গেলে, একটু
অপেক্ষা করতে হবে। ফোন থেকে একবার জেনে নিতে হবে। এ কথা বলেই যেই ঘরের বাইরে এসেছে,
লতিকা দাঁড়িয়ে। বরং বলা ভালো লতিকা ক্লায়েন্ট পটাচ্ছে। মেয়েটা যখন ব্যবসায় থাকে, কারও
কথাই ভাবে না বা কারও সঙ্গে দেখা হলেও চিনতে পারে না। ওর এই প্রফেশনাল স্যাংটিটিটা
তার বেশ লাগে। মোদ্দা কথা শরীরের বর্শী কাজে লাগিয়ে পয়সা রোজগারের জন্য খদ্দের গিঁথতে
চাইছে, বেশ করছে। জন্মস্থান ভাড়া খাটিয়ে লতিকা আজ অনেক পয়সার মালিক। নিজের গাড়ীতেই
ঘুরে বেড়ায়। উরুতে জোর আছে। আমি কদম্ব, লতিকার এই চ্যালেঞ্জিং জীবন জয়ের হেরোইজমকে
স্যালুট জানাই। চতুর্দিকে এখন বিশ্বায়নের জয়ঢাক চড়বড় ফাটছে। তা মামু, বিশ্বায়ন হবে
আর বেশ্যায়ন দূরে বসে মাকু টানবে! আমি দেবো, আমাকে দাও। ব্যাস। বড় বড় তত্ত্ব ফত্ত্ব
বেকুব বুড়োগুলো চটকে যাক, এখন রাজনীতিও পতাকাহীন ব্ল্যাকমেলিঙের রাজনীতি। কদম্ব একদিন
লতিকাকে বুঝিয়ে বলেছে, বালের কদিন তো জীবন, তার আবার দাঁতমুখ খিঁচিয়ে, টাক গরম করে,
পুলিশ মিলিটারির তাড়া খেয়ে কেউ হ্যাবলাগিরী করে? পয়সা ঝারো, তত্ত্বে সনাতন ধর্ম থেকে
শ্রমিক-কৃষকের একনায়কতন্ত্র, এক গালে চড় খেলে
অন্য গাল ইত্যাদি যা চাইবে ফুলঝুড়ি নামিয়ে দোবো। আর তুই মেয়েছেলে, প্রকৃতি তোকে খোলা
হাতে বানিয়ে দিয়েছে পুরুষকে পাগলা কুকুর বানিয়ে দিতে। যেখানে যেভাবে যেমন পাবি কামিয়ে
নে। আমরা ব্যাটাছেলেগুলো তো বেচারা, সারাজীবন লড়ে যেতে হবে। সে তুই দাঁতের মাজন বেচিস
নাকি গলায় ফাঁস ঝুলিয়ে কর্পোরেট মালিকের বুটের নীচে দাসস্য দাসগিরী করিস, যাই কর। তবে
মাজন বেচা দশ টাকাতেও ছড়িয়ে বাঁচার যে আরাম, সে তোর মালিকের বুটের নীচে মাথা রেখে দশ
লাখেও সেটা পাবি না।
হ্যাঁ যা বলছিলাম, ব্ল্যাকমেল ও রাজনীতি। কারণ পাব্লিক
অনেক দিন ধরে মুরগী হতে হতে বুঝে গিয়েছে -- পোতিশ্যুতির রাবড়ি মালাই স্বপ্নে কচলাতে
গেলেই মুরগী। দেখবি শালা তোর ঘাড়ে মই রেখে বেড়াল ছাদে পৌঁছেই মুতে দেবে। চিনবেই না
আর, পোতিশ্যুতি রক্ষা তো এমাজনের জঙ্গল। দেখলি না, কালাধোন চেটে এসে সবাইকে ১৫ নক্ষ
দিয়ি দিব, মার ছাপ। গামচায় মুক ঢেকি আঙ্গুল তো খোঁচায়ে দিলি, কি পেলি, আগে কাগজ কুড়ায়ে
আন, জানতি হবে এদেশি না বিদিশী তুই। বিদিশী হলি পাছায় নাথি। টাকা নেবে! মাড়িয়ে খা গে
যা! আর এই ঢপকেত্তনে মুতে দিয়ে পাব্লিক এখন সরাসরি ময়দানে একটিভ। আগে দিয়ে দেখা, পরে
তোকে বাঘ না বেড়াল বানাবো, আমরা বুঝে নেব। দেখলি না, মাস-আষ্টেক ধরে কৃষকেরা রাজধানীর
রাস্তায় বসে থাকলো, তোমার কালো আইন বাতিল করো নাহলে ফিরছি না। করব না চাষ, দেশের মানুষ
খেতে না পেয়ে মরতে বসলে বিদেশ থেকে অনেক বেশি টাকা ঢেলে মাল কিনে এনে তাদের খাওয়াও,
নইলে ভাগো। তাদের মিছিল, মিটিঙ অবস্থানে বাজার চলতি রাজনৈতিক দলের কোনও পতাকা চোখে
পড়েছে কখনও? না নেই, এই কর্পোরেটশাসিত সময়ে, পাব্লিকও শেয়ানা হয়ে গিয়েছে, পুরোনো মার্ক্সবাদ-গান্ধীবাদ-ফ্যাসীবাদ
সব গবায় ঢুকিয়ে সরাসরি ব্ল্যাকমেলিঙের রাজনীতি আশ্রয় করে নিয়েছে। রবীদাদুর নাটক-ফাটক
তো কিছুই পড়িস নি, কবে ওই ঠাকুরকবি লিখে গিয়েছেন "হাতের দান হাতে হাতে মিটিয়ে
নেওয়াই ভালো, নইলে শুকিয়ে যায়। আর হৃদয়ের দান যত অপেক্ষা করে তত বাড়ে"। তোরা পড়বিও
না, বুঝবিও না, তাইলে তো যা আছে বেচে খাবি, এটাই তো ধম্ম। এই দেখ না, এখানে ডাক্তারগুলো,
সহকর্মীনি ধর্ষিতা ও খুন হয়েছে অন-ডিউটিতে, ব্যাস, বসে পড় রাস্তায়। বিচার চাই বিচার
দাও। না দিলে নড়ছি না। কারা বলছে, সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার মানে জনস্বাস্থ্যের সরাসরি
কারিগর। তাদের ছাড়া সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সর্ষে ফুলে। কর্পোরেট-চিকিৎসা কিনতে হয়,
সাধারণ মানুষ সেটা পারে না। কিন্তু সরকারি চিকিৎসা মুফতে। তাই হাসপাতালে চিকিৎসা না
পেলে, ঝাড়ফুঁক ভরসা কোরে, শিকড়বাকড়, হাতুড়ে চিকিসস্যে এসবই তখন বাচ্চা-বুড়ো-মেয়েছেলে-জোয়ান
মরদ সকলেরই ভরসার ঠাঁই। তো সবকিছু লাটে উঠিয়ে, থোকা থোকা মিথ্যে পাব্লিককে বুঝিয়ে,
ডাক্তাররা সেই ব্ল্যাকমেলিঙের রাজনীতিতে সরকারকে চাপ দিয়ে এখন তাদের দাবিদাওয়া মেটাতে
চাইছে। সরকার প্যাঁচে পড়ে গেছে। তাদের ছাড়া জনস্বাস্থ্য কানা আগেই বলেছি। তাই বাবা
বাছা, হাতজোড়, পায়ে ধরা, চা খাও, ফুলুরি বেগুনী চাইলেও সরকার দেবে কিন্তু দমনপীড়নে
বা শাস্তির দিকে যাওয়া যাবে না। একেই বলে শেয়ানে শেয়ানে টক্কর। ডাক্তাররাও বুকে চাঁটি
দিয়ে ব্ল্যাকমেলিঙের রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। পতাকা নেই, পার্টি দালালদের সামনে ভিরতে
দিচ্ছে না-- আমাদের চাহিদা মেটাও, আমরাও আমাদের সার্ভিসে ফিরবো। একেবারে কর্পোরেট স্টাইল।
পয়সা ফেলো, মাল কেনো। মানবতা ফানবতা বোকচন্দরের ঘ্যানঘ্যানানি। বিশ্বায়নের হাত ধরে,
চরম বেশ্যায়নের হাতে গরম নমুণা। আমার মাল আছে মানে দেহ বা দক্ষতা, দক্ষতাও যেহেতু একটা
পণ্য, আমি বেচব, তুমি কেনার যোগ্যতা থাকলে কেনো। কর্পোরেট ব্যবস্থা। আন্দোলনের এই নতুন
পন্থা আন্তর্জাল নির্ভর কোরে, আন্তর্জালিক নতুন প্রজন্মের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
কর্পোরেট নির্দেশিত এই পথে যারা আন্তর্জাল নির্ভর কারিগরি বিদ্যায় যত এগিয়ে থাকবে,
তাদের পাল্লা ভারি। সত্যকে মিথ্যা এবং মিথ্যাকে সত্য কিম্বা শুধুই মিথ্যা, সত্যের
ছদ্মবেশে নিমেষে ছড়িয়ে দিতে হবে, মাইলেজ পেয়ে যাবে তারা। একেবারে হাতেগরম নমুণা ছড়িয়ে
পড়লো আমাদের ঘরের পাশে ডাক্তারদের আন্দোলন ঘিরে। তাই বলছি, সেই টালির চাল, দর্মার বেড়ার
ঘরে লন্ঠন জ্বালিয়ে সন্ধ্যার পার্টি অফিসে মার্ক্সবাদ আলোচনা ও শিক্ষার দিন আজ শেষ।
ওসব তত্ত্ব দিয়ে আর ভোট জেতা যাবে না। ভরসা টেকনোলজি, ভরসা কর্পোরেট।
লতিকাও সরেস জিনিষ। বোঝাবুঝির ন্যাপকিন গ্যাঁটের পয়সা
খরচা কোরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়, তার থেকে মোছামুছির টিস্যু পেপারে বহুৎ লাভ, বহুৎ। সাথে
একটু ভালোবাসা কয়েকদানা মিশিয়ে দিলে ঘেঁটে ঘাসুরাম। পারলে এটিএম কার্ডটাও তুলে দেবে
চ্যাটচেটে হাতের তালুতে। নীতি যে কপচাবে, সে তো আর খেতে দেবে না। যে খেতে দেবে তার
নীতি একটাই-- আমায় ন্যাংটো করতে দে, আমি পয়সা দেব। চু ত্রা, লাগা ধামাকা। লতিকা গিঁথে
ফেলেছে মালটাকে। পাশ দিয়ে একবার লাট খেয়ে আসতে গিয়ে কানে গেলো, ঘন্টায় হাজার। উরি ত্তারা,
ক্ষমতা আছে মাইরি! যাকে গিঁথেছে, দেখে তো মনে হচ্ছে একবার নামিয়েই নেতিয়ে যাবে। মানে
১০ মিনিটেই ব্রহ্মলীলা খতম। পকেট থেকে একটা বিড়ি বার কোরে চোয়াল চিপে টানতে টানতে নিজেকে
এতই অপদার্থ লাগছে, ধুর বাল, সারাদিন সস্তা কোম্পানির মালের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাড়ি
বাড়ি ঘুরে বেচে, দিনশেষে ২০০ টাকাও কামাই হয় না। আর খানকীগিরী কোরে একঘন্টায় ১০০০!
বিড়িটাকে রাস্তায় ফেলে জুতো দিয়ে মাড়িয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকে দেখলো, যে যার মালের ব্যাগ প্রায়
গুছিয়ে ফেলেছে। রোগা পাতলা মেয়েটা প্রতিদিনই কম কোরে মাল নিয়ে বেরোয় কিন্তু তার কামাই
খারাপ নয়। দেখেই মনে হয় চোখেমুখে চোস্ত। বাংলা হিন্দী ইংরিজী (ভুলভাল বলে) একেবারে
তাক লাগিয়ে দিতে পারে। এক অলৌকিক ক্ষমতা। মনে হলো একবার বলি, এই আজেবাজে মাল না বেচে,
লতিকার লাইন নিয়ে নে না। নাঃ, কেস খেয়ে যাবো। উপযাচক হয়ে কারও ভালো ভাবতে নেই। কেউ
আপনার ভালো ভাবছে বা ভাবার চেষ্টা করছে মনে হলেই নিশ্চিত থাকতে পারেন, আপনি কর্পোরেটের
টার্গেটে মুরগির একটা স্যাম্পল হয়ে গেছেন। জবাই আপনাকে হতেই হবে, আজ না হোক দুদিন পরে
অন্য কোন অজুহাতে। আসলে মাল কেনাবেচার এই সভ্যতায় আপনার ভালো সেই ভাববে, যার কিছু বেচার
আছে। এখন এই বেচার জন্য হরেক রকম মাল, চোখে কিছু দেখা যায়, ছোঁয়া যা্য়, গন্ধ পাওয়া
যা্য়, জিভ ঠেকিয়ে স্বাদ নেয়া যায় ইত্যাদি। এখানেই শেষ নয়, এরপর আছে দেখা যায় না, ছোঁয়া
যায় না, গন্ধ নেই, স্বাদ নেই তবুও সে আছে এমন কিছু কিছু মাল যেমন আপনার অতীত, আপনার
অনুভব, আপনার সমৃদ্ধ পরম্পরা, আপনার স্বপ্ন। সবই এখন কমোডিটি। মাল মানে পণ্য। আর প্রতিদিনের
এই বেচাকেনার পৃথিবী দিয়ে ছুটতে ছুটতে আপনি ভুলেই গেছেন ছোটবেলায় আপনার ঘুম ছিলো, ঘুমে
স্বপ্ন ছিলো, স্বপ্নে রাজকন্যে ছিলো, রাক্ষস ছিলো, তলোয়ার হাতে রাক্ষসদের সঙ্গে আপনার
যুদ্ধ ছিলো-- ছোটবেলায় ছিলো এইসব, সকলেরই থাকে, আপনারও ছিলো। আজ নেই। শেষ কবে স্বপ্ন
দেখেছেন, বলতে পারবেন না। যদিও দেখে থাকেন সেটা পেটের বায়ু জমার নিমিত্ত দুঃস্বপ্ন।
ফ্রয়েডবাবু সে স্বপ্ন গুরুত্ব দেবেন নাকি ফিল্টার করে নেবেন ইত্যাদি।
মালফাল গুছিয়ে ব্যাগটা পিঠে টাঙিয়ে বের হতে যাবে, পেছন থেকে ক্যাবলা চেঁচিয়ে উঠলো--
ও’ কদম্ববাবু, কি একটা বড় কিছু ঘটবে বলছিলেন, বললেন না
তো খুলে?
কদম্ব একটু ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো, বলতে হবে না, ঘটে গেলে
নিজেই বুঝতে পারবি।
তবু একটু হিন্টস! মানে, আমাদের কাজটা থাকবে তো নাকি থাকবে
না?
কদম্ব বুঝতে পারে, ক্যাবলা প্রকৃতই একটা সৎ ছেলে। মধ্যবিত্ত
চরিত্রের বৈশিষ্টই এটা, পৃথিবীর কাছের দূরের যেখানে যা কিছুই ঘটে যাকনা কেন, আগে সে
বুঝে নিতে চাইবে, ঘটনা পরম্পরায় তার নিজের কোনও স্বার্থচ্যুতি ঘটছে কি ঘটছে না! স্বার্থহানির
সম্ভাবনা থাকলে প্রতিক্রিয়া জানাবে কি জানাবে না, প্রতিক্রিয়া দেখাবে কি দেখাবে না--
সে ব্যাপারে সে ১১০ বার ভাববে। ক্যাবলা বাধ্যত, সরাসরি, ধানাই পানাই না করেই তাই নিজের
অবস্থানটা স্পষ্ট করে দিলো। কদম্বও অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই ক্যাবলার প্রশ্নের উত্তরে
বলে বসলো, বড় কিছু ঘটলে, ছোটখাটো অনেক কিছুরই আর কোনো হিসেব থাকে না ক্যাবলাবাবু। আপনি,
আমি, আমাদের মতো মানুষের প্রতিদিনের জীবন টেনে নিয়ে যাবার জন্য, প্রতিদিনের ফেরিওয়ালার
এই কাজ, খুবই ছোটো কাজ রে ভাই। কিন্তু আমরাই সংখ্যায় কোটিকোটি, অনেক-- অনেক। বড় কিছু
ঘটলে আমাদের ওপর তার প্রভাব তো পড়বেই, কিন্তু ইতিহাসে আমরা অপাংক্তেয়। কদম্ব জানে মেরেকেটে
দৈনিক ২০০ টাকা রোজগারে ক্যাবলার পরিবারে পাঁচজন লোক বেঁচে থাকে। বাবার ওষুধ, মায়ের
ডাক্তার, অবিবাহিতা বোনকে বিয়ে দেবার দায়, ভাইয়ের পড়ার খরচ ক্যাবলা ভরসা। তার টিফিনে
তাই মুড়ি বাতাসার বেশি আর কিছু কখনও থাকেনা। দুশো রোজগার না হলে পরদিন টিফিনই থাকে
না। ক্যাবলার কাছে বড় কিছু ঘটা তাই কোনও স্বপ্ন নয়। আশঙ্কা ও ভয়ে মেশানো এক বুক ঢিপঢিপ!
কদম্ব বেরিয়ে গেলেও ঘরটার মধ্যে তাই কেমন হিসহিস ফিসফিস কোরে একটা চাপা উদ্বেগ ক্রমেই নানাজনের কাছে নানারকম ডালপালা মেলে মাথায় শিকড় নামাতে থাকলো। যে যেটুকুনি ভাবতে পারে তার মতো করেই ঘটবার একটা জলছবি বানিয়ে নিতে চাইলো। আর ক্যাবলার মাথায় খেলতে থাকলো পড়াশুনো করা বন্ধুদের কাছে শোনা এক পড়াশুনো বিষয়ক তত্বকথা। বিধান নামের পাড়ার এক বন্ধু একবার সেলসম্যানের কাজ করবো শুনে, তাকে বগলদাবা কোরে পুকুরপাড়ে বসিয়ে বাংলা খেতে খেতে বুঝিয়েছিলো--
--শোন, বাজারে এখন আমেরিকান বিজনেস ম্যানেজমেন্টের তত্ত্ব
হেবী খাচ্ছে। ওদের মাল বেচার এক মনস্তাত্ত্বিক ফর্মুলা হলো, সব মানুষই ভাবে আগামীকাল
এক সোনা দিন আসবে। দুঃখ কষ্ট সব ভ্যানিশ হয়ে গিয়ে ঝকঝক করবে সৌভাগ্যের দিন, সেই আশা
নিয়েই সব জিভ বার কোরে কুকুরের মতো পরিশ্রম করছে। সেই দুর্বল জায়গাটা খুঁচিয়ে দিয়েই
তাকে তোর মাল গছাতে হবে। কি ভাবে সেটা করবি, তোর ক্যালি।
কেন যেন কদম্বের কথাটাও এমনই এক তত্ত্ব বলেই মনে হলো ক্যাবলার।
আসলে যার যতটা পয়সার প্রয়োজন, সারাদিন ব্যাগ ঘাড়ে ছোটাছুটি করেও তার ন্যূনতম অংশও রোজগার
করতে না পেরে তারা প্রায় সকলেই খুব ক্লান্ত, কিন্তু তথাপিও প্রতিদিন ঘুরে ঘুরে এসে
হাজির হয় যদি এটুকুও হারাতে হয়, সেই ভয়ে। এ শুধু ক্যাবলার বা তাদের সহকর্মীদেরই সমস্যা
নয়, এ সমস্যা এমন নিম্ন মধ্যবিত্ত, দরিদ্র কোটি কোটি মানুষের। তারা সবাই মনেপ্রাণে
যেন বড় একটা কিছু ঘটে যাওয়া চাইছে, পরিত্রাণ চাইছে প্রয়োজনের তাগিদে প্রাত্যহিকতার
এই চাকার নিচে প্রতিদিন পিষ্ট হওয়ার নির্যাতন থেকে। চাহিদা আর যোগানের যোগ্যতায় প্রতিদিন
এই পিছু হটা, এই অসহায়ত্ব অসহ্য যেন। হয়তো এভাবে প্রকাশ করতে জানেনা, কিন্তু প্রত্যাশা
জুড়ে বড় একটা কিছু ঘটে যাওয়া, নিয়মতান্ত্রিকতার শিকল থেকে ছিটকে যাওয়ার স্বপ্ন প্রায়
সকলেরই অবচেতনে নিরন্তর গুঙিয়ে চলেছে।
একসময় ঘরের সবাই প্রায় বেরিয়ে যায় যে যার মালের ব্যাগ
পিঠে ঝুলিয়ে। এবং স্বতঃসিদ্ধ সত্যটি প্রত্যেকের কাছে একটাই, বেশি না হলেও অন্তঃত ২০০
টাকা যেন আজ রোজগার করতে পারে। কদম্ব ঘরের বাইরে এসে দেখে লতিকা নেই। তার মানে পার্টি
ক্যাচ কট কোরে ঢুকে গেছে হোটেলে। ভাবতেই মনটা কেমন ফুরফুর কোরে ওঠে কদম্বর। একঘন্টায়
একহাজার। একেই বলে প্রফেশন। আর সে তৃতীয় বিশ্বের ভোদাই জনতার এক অপদার্থ জীবন্ত ফসিল,
পিঠে ঝোলা বেঁধে দশ পাঁচটাকার কমিশন কুড়োতে চলেছে গোটা একটা দিন ভোগে পাঠিয়ে দিয়ে।
পকেট থেকে মোবাইল খামচে তুলে খুব দ্রুত গুগলে একবার দেখে নেয়, গাজা বা বেইরুটে নতুন
কোনও শরণার্থী শিবির বা হাসপাতালে ইসরায়েল আজ বোমা ফাটিয়ে গুঁড়িয়ে দিলো কিনা! সর্বোপরি
তার জানার প্রধান আগ্রহ, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে নিউক্লিয়ার বোমাটা কেউ আজ ফাটালো কিনা,
ফাটালেই ব্যাস...
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন