কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৫

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

হে নেপথ্যচারিণী

 


(১৬)      

অবিদ্যা

রাত হয়ে গেলে নক্ষত্রর মতো মৃদু আভা নিয়ে আমার বসার ঘরে সারারাত ধরে জেগে থাকে আশুদার রঙের গোলক। সেই আভা থেকে স্খলিত চেতনার মতো আলো গলে গলে মিশে যায় ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে। সেই বিভাকে নিয়েই যেন আমার এই ছোট্ট আশ্রয় বেঁচে রয়েছে। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। দত্তপুকুর থেকে কিনে আনা ডাক্তার সবিতা আগরওয়াল আবিষ্কৃত আশ্চর্য ওষধি 'অস্মিতা' কথামতো পরখ করা হয়নি আমার। আশুদা পরখ করেছে কিনা কে জানে! কিন্তু মধ্যরাতের এই অনিদ্রা আমার কাছে অপরিচিতার মতোই। বাইরে সামান্য ঠাণ্ডা পড়েছে। ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে গিয়ে দেখি সোফার উপর আশুদা জেগে একদৃষ্টিতে রঙের গোলকের দিকে চেয়ে বসে আছে। টেবিলের ওপর 'অস্মিতা'র ওষুধের কিনে আনা স্ট্রিপগুলো ছড়িয়ে রাখা। আমার উপস্থিতি তার সেই ধ্যানভঙ্গ করল হয়তো।

-কীরে? ঘুমোসনি?

-তুমিও তো ঘুমোওনি!

-ঘুম আসছে না জানিস। একটা সম্ভাবনা সম্পর্কে কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছি না জানিস অর্ক।

--কী আশুদা?

--এই বিস্ময় ওষধি! কী আছে এর ভিতর যার জন্য দোকানদারেরা একে বাজারে চারগুণ বেশি দামে অনায়াসে বিক্রি করছে! আমার অবচেতন মন বলছে আমাদের এই ত্রিনেত্র রহস্যর সঙ্গে এর একটা যোগ আছে। কিন্তু কোন সে যোগ বুঝতে পারছি না। ডঃ অয়ন শ্রীবাস্তব মুম্বাইয়ের সেন্ট্রাল ফারমাকোলজিকাল ল্যাবের হেড। আমার বন্ধু। ভাবছি কাল ওকে এই ওষুধগুলো ডাক যোগে পাঠিয়ে দেব। ও রিসার্চ করে দেখুক। এই ওষুধের কেমিক্যাল কম্পোজিশন আমাদের জানতেই হবে।

-আর?

-আর একটা অদ্ভুত বিষয় অর্ক। এটা অবশ্য সরাসরি আমাদের রহস্যের সঙ্গে যুক্ত নয়। এটা শুধুই একটা অনুভূতি। ক্রমশ যতো দিন যাচ্ছে, মানুষের দুচোখ থেকে ঘুম সরে যাচ্ছে। মানুষ ঘুম খুঁজছে। আবার সেই ঘুমের মধ্যেও কেউ অত্রির মতো ঘুমন্ত শহরের পথে ঘাটে নিশাচরের মতো হেঁটে চলেছে। এই শহর যেন এক ঘুমের শহর। যেখানে জোছনা গলিত নীল মাখনের মতো।

-নীল মাখন!

-আমার কথা নয় রে। কিংবদন্তি ঔপন্যাসিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা। 'কুবেরের বিষয় আষয়' পড়িসনি? যাক গে। যাহ। শুয়ে পড়। কাল সকালে তুই কলেজে যাবার আগে একবার থানায় যাব। রফিক আহমেদের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

আশুদা আবার রঙের গোলকে মগ্ন হয়ে উঠল। আমি জোছনা, কুবের আর অস্মিতার ধাঁধালি ভাবতে ভাবতে ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম।

পরদিন একটু সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম আশুদাকে নিয়ে। তথাগত অধিকারী থানাতেই ছিল। আশুদা বলতে রফিককে একটা ঘরে ডেকে আনা হল। মাঝারি বয়স। চোখ দেখলে বোঝা যায় গেল কয়েকদিন ঘুম নেই তার। আশুদা বলল-

-ঘটনার রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?

-আমার ডিউটি রুমেই ছিলাম স্যার।

-সেইদিন রাতে সেটে কাজ হবে আপনি জানতেন?

-হ্যাঁ জানতাম। আমাদের নোটিস দিয়েছিল অফিসে।

-সেটে কে কে ছিল বলতে পারবেন?

-রাত আটটা অবধি কেউই ছিল না। তারপর ওই ম্যাডাম ঢুকলেন। আই ডি দেখালেন। আমার কাছে ইনফরমেশন ছিল দুজন আসবেন।

-কে কে?

-একজন মধুরা ম্যাডাম। আর একজন সোহরাব চক্রবর্তী। কিন্তু সেদিন ম্যাডাম একাই এসেছিলেন।

-বেশ। তারপর?

-তারপর ম্যাডাম পুকুরঘাটে ওই আলো জ্বালিয়ে সেট সাজাতে লাগলেন।

-গেটে সেদিন আপনি ছাড়া আর কেউ ছিলেন?

-না। আসলে চারিদিকে ভাসান চলছিল তো। সবাই ছুটিতে ছিল। রস্টারে আমার নামটাই ছিল।

-তারপর?

-তারপর রাত দশটা নাগাদ আমি একটা ওষুধ খাই। সারাদিনের ক্লান্তি আজকাল খুব দুর্বল করে দিচ্ছিল আমাকে। তাই ওষুধটা সপ্তাহখানেক নিচ্ছিলাম। এর আগে সমস্যা হয়নি। সেদিন একটা নতুন ওষুধ নিয়েছিলাম। চোখ লেগে গেল।

-তারপর?

-তারপর...

ভয়ে ভয়ে রফিক এদিক ওদিক তাকিয়ে মাথা নীচু করে চুপ করে গেল। আশুদা বলল-

-তারপর কী রফিক?

-তারপর হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। সদর গেটটা বন্ধ করে রেখেছিলাম ম্যাডাম ঢুকে যেতেই। চোখ খুলে দেখলাম গেটটা আধখোলা। ডিউটি রুম থেকে বেরিয়ে দরজাটা বন্ধ করতে গিয়েই দেখলাম...

-কী দেখলেন রফিক?

-পুকুর ঘাটে ম্যাডাম পড়ে আছে্ন। তাঁর কপাল থেকে রক্তের রেখা গড়িয়ে পড়ছে। দৌড়ে কাছে গিয়ে  নাকের সামনে আঙুল রাখতে দেখলাম শ্বাস নেই। আমি কিছু করিনি স্যার। আমাকে ছেড়ে দিন। আমি কিছুই জানি না।

-তারপর পুলিশে জানালেন না কেন? কী করলে্ন তখন?

-খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম। মাথা হ্যাং হয়ে গেছিল। মেইন গেট আটকে স্টেশনের দিকে হাঁটা লাগালাম। মনে মনে ঠিক করেছি, আর কলকাতায় ডিউটি নয়।

-সে তো হলো রফিক। আপনি এবার আমাকে বলুন তো সেইদিন রাতে ঠিক কী ওষুধ খেয়েছিলেন?

-নাম তো জানি না। ওরা যা দিয়েছে তাই খেয়েছি।

-ওরা মানে?

-একটা অ্যাপ আছে স্যার। যাদের ঘুমের সমস্যা আছে তাদের জন্য। আমাকে আমার এক বন্ধু সোহেল জানায়। আসলে বুঝতেই তো পারছেন। আমাদের এই লাইন। একটা শুকনো নেশার চক্করে পড়ে গিয়েছিলাম। বিবি নিষেধ করল, ভয় দেখালো ছেড়ে চলে যাবে। তাই নেশা ছেড়ে দিলাম। দিতেই শরীরে রোগ ধরে গেল। ক্ষিদে নেই, ঘুম নেই। খালি ঝিম মেরে থাকে।

-কোন অ্যাপ?

-দেখাচ্ছি স্যার। এদের বলুন আমার মোবাইলটা দিতে।

আশুদা ইশারা করতেই তথাগত রফিকের সিজ করা মোবাইলটা নিয়ে এল। রফিক ফোন অন করে  খানিকটা খুটখুট করার পর আমাদের সামনে ফোনটা মেলে ধরল। মোবাইলের স্ক্রিনজোড়া একটি ধ্যানমগ্ন মানুষের ছবি। তার নীচে ইংরাজি হরফে লেখা 'নিদ্রা'। আশুদা জিজ্ঞাসু চোখে চাইতেই রফিক বলল-

-এই অ্যাপে নিজের নাম, বয়স, ফোন নম্বর দিলেই নিজস্ব প্রোফাইল খুলে যাবে। প্রথমে খুব ভালো ভালো সাজেশান দিত। কিন্তু সেসব মেনে কাজ না হতেই দু’এক দিনের ভিতর আমাকে ওষুধ খেতে বলল।

-কিন্তু ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া আপনি এই ওষুধ দোকান থেকে কিনবেন কী করে?

রফিক হেসে বলল, "কিনতে হয় না স্যার। অনলাইনে অর্ডার করলে ওরা বাড়ি এসে দিয়ে যায়। দাম একটু বেশি। কিন্তু আমার সমস্যাটাও তো বেড়ে উঠছিল। ডিউটিতে দিনের বেলায় ঢুলতাম, সারারাত জেগে থাকতাম। নাইটডিউটি না থাকলেও। প্রথম ওষুধে তেমন ঘুম এলো না। সোহেল বলল, 'লেভেল টু' তে যেতে। সেই ওষুধে কাজ না হলে ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা।

-ডাক্তারের নাম?

-সেসব তো জানি না স্যার।

-যে ওষুধটা সেদিন খেয়েছিলেন, তার নাম বলতে পারবেন?

-না স্যার।

আশুদা এইবার তাঁর পকেট থেকে আমাদের কিনে আনা 'অস্মিতা'র একটা স্ট্রিপ বের করল।   আশুদা পকেটে নিয়ে ঘুরছে জানতাম না। রফিক পাতাটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে মনোযোগ দিয়ে দেখে বলল, "হ্যাঁ স্যার। মনে তো হচ্ছে এটাই। আপনিও কি ওই অ্যাপ থেকে..."

-না। আমরা কিনেছি এটা। বেশ। আপনি এখন আসতে পারেন।

তথাগতকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে আশুদা বলল, "অয়নকে কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের জন্য ওষুধটা পাঠাব বলে পকেটে নিয়েছিলাম। কিন্তু এভাবে মোক্ষম সময়ে 'ডেজাভু' হয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি।" আমি খানিক মজার সুরে বললাম, "কী ভাবছ? ওই অ্যাপে একবার ঢুকে দেখবে নাকি?" আশুদা চটুল হেসে বলল, "অ্যাপে তো ঢুকতেই হবে। তবে আমি নই। তুই ঢুকবি। তাও নিজের নামে নয়। বেনামে।" আমি আকাশ থেকে পড়লাম। সে কী করে সম্ভব? আমার মোবাইল নম্বর তো কলেজের সাইট খুললেই পাওয়া যাবে। আশুদা নিরুদ্বেগ হয়েই বলল-

--ওটা কোনও সমস্যাই নয়। প্রথমত অ্যাপের কেউ তোকে ক্রসচেক করে ঢুকবে বলে মনে হয় না। তবু নিরাপদ থাকতে আর কাজ চালাতে আমরা সাময়িক একটা সিম নেব। হয়ে গেল।

অগত্যা আশুদার কথা অনুযায়ী গড়িয়াহাটের একটা মোবাইল দোকান থেকে সিম কেনা হল। মোবাইলে পুরে অ্যাপ ডাউনলোড করে নিজস্ব প্রোফাইল করে ফেললাম। প্রোফাইলে আমার নাম হল, 'দময়ন্ত সান্যাল'। নামটা আশুদার মস্তিষ্কপ্রসূত। বলল-

-সারা পৃথিবীকে ঘুমের বিষয়, ঘুমচক্রের বিষয়, ঘুমস্বাস্থ্য বিষয়ে পণ্ডিত করে তুললেন যিনি, তিনি নিদ্রাবিজ্ঞানের জনক আমেরিকান গবেষক উইলিয়াম চার্লস ডেমেন্ট। তোর নামে না-হয় একটু তার ছোঁয়াও রেখে দিলাম। দময়ন্ত সান্যাল হয়ে অ্যাপে ঢুকে প্রথমেই নিজের নাম ঠিকানা সব জানাতে হল। ঠিকানা দিলাম কলেজের পাশের জেরক্স দোকানটার। ওই দোকানের মালিক, তপোজ্যোতিবাবু আমাকে চেনেন। ওনাকে বলে রাখব কোনও প্যাকেট এলে আমাকে হস্তগত করতে। এই বুদ্ধিও আশুদারই দেওয়া। নিজের নিদ্রাহীনতার সমস্যা জানাতে অ্যাপে প্রথমে কয়েকটি ভিডিও আর জনসচেতনতামূলক লেখাজোকা ভেসে এল। আমি মোবাইল আশুদাকে দিয়ে গাড়ি চালাতে লাগলাম। আড়চোখে দেখলাম, আশুদা সারাটা রাস্তা মোবাইলে খুটখুট করছে।

আশুদাকে কলেজ গেটে নামিয়ে আমি ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়লাম। আশুদার কীসব কাজ আছে বলল। গাড়ি থেকে নামবার সময় আশুদা বলল, "যারা অ্যাপটা করেছে তারা খুব সেয়ানা। খেলিয়ে খেলিয়ে মাছ তুলবে!"

-কীরকম?

-ব্যাপারটা এইরকম যে মিস্টার দময়ন্ত সান্যাল তার ঘুম না হওয়ার কথা জানিয়েছে। এই সমস্যার জন্য সে তার চাকরিতে অমনোযোগী হয়ে পড়ছে। কিন্তু 'নিদ্রা' তাকে প্রথমেই কোনও ওষুধ দিচ্ছে না। তাকে বোঝাচ্ছে কী কী করলে ঘুম স্বাস্থ্যকর হয়। দারুণ ইন্টারেস্টিং।

-তাহলে?

-তাহলে আর কী? অপেক্ষা করো। শব ব্যবচ্ছেদ করার সময় প্রথম আঁচড়েই কি আর সত্যিটা বের হয়? আমার বিশ্বাস দুদিন বাদে আবার সাইটে হিট করলে প্রথম ধাপ পেরিয়ে যাব।

কলেজের পর অত্রিদের বাড়ি যেতে হবে। আশুদা কী ভাবছে কে জানে! সেসব কয়েক ঘন্টার জন্য কলেজের কাজের চাপে ঢাকা পড়ে গেল। কিন্তু সন্ধ্যা হতেই আশুদার ফোন। "কোথায় আছিস? সোজা চালতাবাগান চলে আয়।" কথা মতো চালতাবাগানে অত্রির বাড়ির দিকে ছুটে চললাম। অত্রি আজ আসেনি কলেজে। ছুটি নিয়েছে। অত্রিদের বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে আরও একবার চোখে পড়ে গেল ডাক্তার মুরারী পালচৌধুরীর নামটা। আশুদার কথা অনুসারে সোজা উঠে গেলাম দোতলায়। আশপাশে কোথাও আশুদাকে বা কারোকে দেখলাম না। সিঁড়ি থেকেই ধুনোর গন্ধ পেলাম নাকে। তারপর দোতলায় গিয়ে বিস্ময়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

বসবার ঘরের মাঝখানের বেদিতে একটা সড়ার উপর ধুনো ধূপ রাখা। সেই কুণ্ডর পা শেই দাঁড়িয়ে রয়েছে দুটি কাপড় পরা পুতুল। দুটিকেই আমি দেখেছি। একটা মনসুর গাজীর রেশমি। অন্যটা যে পুতুলটা মনসুর সুচন্দ্রাকে আগের দিন উপহার দিয়েছিল। কুণ্ডের এক পাশে আসনের উপর আচ্ছন্ন হয়ে বসে আছে সুচন্দ্রা। অন্যদিকে কালো পাগড়ি জোব্বা পরে মনসুর গাজী কীসব মন্ত্র পড়ছে দুলে দুলে। ধোঁয়ার কুণ্ডলী যেন চেতন আর অবচেতনের ভিতর একটা বিকল্প স্তর তৈরি করছে। সেই আধো আবছায়া স্তরের ভিতর ঘরের মধ্যে উপস্থিত দুটি মানুষকেও ঠিক বাস্তবোচিত মনে হচ্ছে না যেন। তারাও যেন কোন সূক্ষ্ণ আত্মিক রূপরেখায় তৈরি শিল্পীর তুলির টানে সৃষ্ট পটচিত্র। আমি ঘরে ঢুকতে যেতেই লক্ষ্য করলাম আমার বিপরীত দিকের কালো পর্দাটা নড়ে উঠছে। তার আড়ালে আশুদাকে দেখতে পেলাম একঝলক। ঠোঁটের উপর আঙুল রেখে আমাকে ইশারা করে বলল শব্দ না করতে। আমিও তাই দরজার বাইরেই থেমে গেলাম। এরপর যা ঘটল, তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না এতোটুকু। ঘরের আরেক প্রান্তের দরজা থেকে হঠাৎ একটা খুটখাট আওয়াজ ভেসে উঠল। কেউ যেন আসছে। সেদিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। নিলয়দার কাছ থেকে নেওয়া রত্তিমিত্তির মুখোশটা পরে একটা মূর্তি ঘরের ভিতর মনসুর গাজীর পিছন থেকে ঢুকে আসছে ক্রমশ। তার দুটো হাত আগ্রাসী। যেন কিছু একটা খাবলে উপড়ে ফেলবে এখনই! তার আসার শব্দ শোনামাত্র সুচন্দ্রার চোখ খুলে গেল। সে এবার কাঁপতে কাঁপতে জায়গায় আসনের ওপর বসেই গোঁ গোঁ করে ঘুরতে শুরু করল। ধীরে ধীরে তার ডান হাতের তর্জনী উঠে এল সেই রহস্যময় মানুষটার দিকে। গোঙানির স্বরে সুচন্দ্রা হিসহিসিয়ে বলে উঠল, "তুই। তুই। আবার তুই!" পরক্ষণেই তার সেই হিসহিস শব্দ বদলে গেল কান্নায়। হাউহাউ করে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগল, "আমার মাকে ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও তোমরা।" তার সামান্য পরেই সুচন্দ্রা জ্ঞান হারালো। দেখলাম আসনের উপর তার সংজ্ঞাহীন শরীর মৃগীরোগীর মতোই কাঁপছে। তার ঠোঁটের কোণা দিয়ে গাঁজলা বের হচ্ছে। পর্দার আড়াল থেকে আশুদা বেরিয়ে এল ক্ষীপ্র গতিতে। অন্ধকারে বুঝতে পারিনি যে আশুদা তৈরিই ছিল। তার হাতে ওষুধ ভরা সিরিঞ্জ। সুচন্দ্রার ধমনীতে সেই ওষুধ ধীরে ধীরে দেওয়া মাত্র তার সেই থরথরানি থেমে গেল। রত্তিমিত্তির মুখোশ খুলে  অত্রি উদ্বিগ্ন চোখে সুচন্দ্রার মাথার কাছে এসে বসেছে। মনসুর ধুনিতে জল ঢেলে আলো জ্বেলে দিয়েছে ততক্ষণে। আশুদা অত্রিকে বলল, "এবার ওকে ভিতর ঘরে শুইয়ে দাও। ও এখন কিছুক্ষণ ঘুমোক। তারপর ঠিক হয়ে যাবে। একটা কথা বলো তো অত্রি।" অত্রি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে আশুদা বলল, "সুচন্দ্রার মাথার একটা ছবি করা প্রয়োজন। ওর এই অসুখটার চিকিৎসার প্রয়োজন। মোটামুটি একটা সন্দেহ করছি আমি। কিন্তু নিশ্চিত হতে পারব এম আর আই দেখেই। কাল একবার ওকে 'সোলেস হাসপাতাল'এ নিয়ে যেও তো। আমি সব বলে রাখব। ওখানকার স্নায়ুরোগ বিভাগে ডাক্তার নিখিলেশ সরকারকে আমি চিনি। আমার তিন চার বছরের সিনিয়র। নিখিলেশদা সব ব্যবস্থা করে দেবে।"

অত্রি সুচন্দ্রাকে ঘরে শুইয়ে এসে বলল, "নিখিলেশ জ্যেঠুকে আমিও চিনি। বাবার বন্ধু ছিল। ছোটবেলায় দেখেছি দু একবার।"

-বাহ। তাহলে ভালোই তো হল। করে নিও ছবিটা। এ অসুখ শাখামুটীর মতো। ফেলে রাখতে নেই। ফেলে রাখলেই ছোবল দেবে। মনসুর। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তুমি এবার রেশমিকে নিয়ে ফিরে যাও। তবে ওদের প্রয়োজন হলে চলে এসো।

-জরুর আসব।

অত্রিদের বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে গাড়িতে বসে আশুদাকে বললাম, "এইসব তোমার পরিকল্পনা। তাই তো?" আশুদা হেসে বলল, "তুই আমাকে কলেজে নামিয়ে দিলি। আমি চলে গেলাম সেখান থেকে মনসুরের ডেরায়। বুঝিয়ে বললাম কি কি করতে হবে। তারপর ঘরে গিয়ে মুখোশটা নিয়ে এলাম। অত্রিকেও বলে রেখেছিলাম। আসলে একটা ট্রিগার না হলে জটটা খুলছিল না কিছুতেই।

-কোন জট?

-শকুন্তলাদেবীর দ্বিতীয় ধর্ষক আর রত্তিমিত্তির জট।

-কী বুঝলে?

-এটাই বুঝলাম যে অভিনন্দন ছাড়াও তার দ্বিতীয় ধর্ষক যেই হোক, সেই ঘটনার দিন সে মুখোশ পরেছিল।

-রত্তিমিত্তির মুখোশ।

-তার মানে ছোট্ট সুচন্দ্রার সামনে সে তার পরিচয় প্রকাশ করতে চায়নি।

-ঠিক তাই।

-কিন্তু কে সে?

-আরেকটু ধৈর্য অর্ক। সব জানতে পারবি। আপাতত আমি যে রোগটা সুচন্দ্রার ভিতর দানা বেঁধে আছে বলে অনুমান করছি, সেটা সঠিক কিনা জানা দরকার।

গাড়ি দক্ষিণ কলকাতার অলিগলিপথ ধরেছে। হঠাৎ মনে পড়ল-

--আচ্ছা আশুদা, মনসুর একটা অ্যালবামের কথা বলছিল। সেটা একবার আমাদের দেখতে দিল না তো!

আশুদার চোখে ঝিলিক খেলে গেল।" সাবাশ অর্ক। তুই এবার শাণিত সত্যব্যবচ্ছেদকারী তৈরি হচ্ছিস। মনসুর অ্যালবামটা আমাকে দিয়েছে। এখনও খুলে দেখা হয়নি আমার। চল ঘরে গিয়ে কফি খেতে খেতে দুজনে মিলে দেখব।"

আশুদার প্রশংসায় গদগদ হয়ে আমি গাড়ি নিমেষে পার্ক করে ফেললাম।  

(ক্রমশ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন