সমকালীন ছোটগল্প |
পরালালনীল
কয়দিন আগের একটা কথা মনে পড়লে এখনো হাসি পায়। লোকটা দেশের
প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু বলে নিজের পরিচয় দেয়। অসীম ক্ষমতাধর বলে
পরিচিত সে। বনানীতে আমার বাসার ড্রইংরুমে এসে বসে। জিজ্ঞাসা করি, কোন মেয়েকে তার লাগবে; পুরনোদের মধ্যে কেউ, নাকি নতুন মেয়েদের দেখাব।
জবাব দেয়,
“না
আপনার সাথে গল্প করব।”
আমি বলি,
“শুধু
তা কেন, বসেন, গল্প করেন, তারপর চমৎকার অল্পবয়সী কোনো মেয়েকে দেই। দুর্দান্ত কিছু
মেয়ে এসেছে।”
মুচকি হাসে। “অনেকের কাছে তোমার গল্প শুনেছি। প্রায় সবাই
বলেছে তুমি নিজেও খুবই আকর্ষণীয়। ইউ উইল গেট ইনাফ পেমেন্ট, লট মোর দ্যান ইউ’ড এক্সপেক্ট।”
তাকে আমি বোঝাতে চেষ্টা করি, “দ্যাখেন, এই জায়গাটা এখন
আমিই চালাই, কিন্তু নিজে আর
পয়সার জন্য শুই না।”
“তুমি জানো, আমি না চাইলে বাংলাদেশের কোথাও তুমি এই
ব্যবসা চালাতে পারবা না?”
আমি নীরবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। শান্তভাবে তাকে বলি, “আপনি যত ধনী বা ক্ষমতাধর মানুষই হোন না কেন, আমি পয়সার জন্য শুই না আর কারো সাথে।”
লোকটা বিড়ালের মতো থাবা গুটিয়ে খানিকক্ষণ নীরব থাকে, যেন এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়বে। ঘরের চারপাশে চোখ
ঘুরিয়ে জানালার পর্দা, পর্দা ছুঁয়ে আসা
শেষ বিকালের রোদের ফালি, টেলিভিশন, রিমোট কণ্ট্রোল, পেইণ্টিং
দ্যাখে। তারপর উঠে গিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। আমি বলি, “কোনো লাভ নাই, আমাকে জোর করে রেপ করলে আমি প্রেস কনফারেন্স করব, তখন আপনার পলিটিক্যাল পার্টি আপনাকে উদ্ধার
করবে না। আপনি জানেন আমি প্রস্টিটিউট,
লাজশরমের
বালাই আমার নাই।”
আমার মুখের দিকে লোকটা তাকিয়ে থাকে। তারপর প্যান্ট খুলে তার
সুবিশাল পুরুষাঙ্গ তুলে ধরে বলে,
“বাপের
জন্মে দেখছ এরকম? জীবনে তো কম
মানুষের সাথে শোও নাই। এমন জিনিস দেখছ আর?”
মনে মনে বলি,
দাঁড়াও, তোমার ফুটানি ছুটাই। তার সামনে থেকে সরে
গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে বলি, “এই মুহূর্তে
এখান থেকে চলে যান, নাইলে ড্রাইভার, দারোয়ান ডাকব।” সে ঠিকমতো প্যান্ট টান দিয়ে
পরে হিস্হিস্ করতে করতে বেরিয়ে যায়। বলে যায়,
“খানকি, তোমার দৌড় কতখানি আমি দেইখা নিব।”
সে বেরিয়ে গেলে আমার বেডরুমে ঢুকে একটা বালিশ আর ওয়ারড্রোব
থেকে একটা চাদর বের করে এনে ছাদে চলে যাই। আকাশ ভর্তি তারা দেখি। নারকেল পাতা
র্সর্স করে কাঁপছে। টবের হাস্নাহেনা ফুলের গন্ধ পুরো ছাদের বাতাসকে আচ্ছন্ন করে
রেখেছে।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আমার বন্ধু (ইশতিয়াক) হাসানকে ফোন করি। সব খুলে বলে
জিজ্ঞাসা করি আরিফ নামে প্রাইম মিনিস্টারের ছেলের কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে কিনা।
হাসান জানায়, সে চামচা জাতীয়
কেউ, অত ঘনিষ্ঠ বন্ধু না।
তেমন কাছের কেউ হলে সে জানত। “তবে আমাদের অফিসে এসে প্রাইম মিনিস্টারের ছেলের
বন্ধু পরিচয় দিয়ে ক্ষমতা দেখায়। বিভিন্ন অফিসারের পোস্টিং করায়, বহু সিনিয়র অফিসার, এমনকি টপ লেভেল-এর অফিসাররাও তাকে তেল মারে।
তোমার ওরিড হওয়ার কিছু নাই। তোমার কানেকশন অনেক স্ট্রং তা সে হয়তো জানে।”
তার ভাবনা অচিরেই মাথা থেকে অপসৃত হয়ে যায়। আজকে সন্ধ্যায়
কবিতা লিখব ভাবছিলাম, এখন আর মুড নাই।
বিকালে একটা কবিতা খানিকটা লিখেছি:
সন্ধ্যা অপেক্ষায় থাকে আমার জন্য
আমিও তার
বারান্দায় দেখি সোনালি পড়ন্ত সূর্য
দিগন্তের কাছাকাছি
ঝিলিমিলি রোদে ঝলসে দেয় নদী
নদীর বুকে একটুখানি আকাশ
নক্ষত্রময় রাতের স্নিগ্ধ আলো-অন্ধকার, হাস্নাহেনার গন্ধ, মৃদু বাতাসের আদরের ছোঁয়া আমাকে সজীব করে
তোলে। কখন ঘুমিয়ে পড়ি টের পাই না।
পারতপক্ষে শহরে বের হই না আমি। রাস্তার জ্যাম, এত মানুষজন, হৈচৈ, দমবন্ধ লাগে।
রাজন, ফাহিম, হাসান কয়জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে। মাঝে মাঝে
ওদের কারো সাথে রেস্টোরান্টে খেতে যাই। আরেকজন সচিব বন্ধু আছে হাসনাত আলী মাহমুদ, তিনি আমার এখানে পঁচিশ বছর বয়সী পিয়া নামের
একটা মেয়ের সঙ্গ পছন্দ করেন। যাবার সময় আমার সাথে কিছুসময় আড্ডা মেরে যান। একদিন
সোফায় পাশে বসে কথা বলতে বলতে আমার গাল টিপে দিয়েছিলেন।
তিনি চেষ্টা করেন ফ্লার্ট করতে।
“কত যে আভায়
ঝিকমিক করে নক্ষত্রের মতো তোমার দু’চোখ।”
আমি হাসি। জানালার পর্দা টেনে দিতে উঠে যাই। ফিরে এসে অন্য
সোফায় বসি। সচিব সাহেব বলেন, “তোমার সাথে গল্প
করাও ইন্টারেস্টিং, এই রকম একটা
প্রফেশনে এত সফিস্টিকেশন, এত পড়াশোনাজানা
কেউ!”
সন্ধ্যার দিকে রাজন ফোন করে, “কেমন আছো,
বেবি? চলো,
ঢাকার
বাইরে যাই, বৃহস্পতিবার
হাফ-অফিস করে তোমার বাসায় চলে আসব। তারপর গাজীপুরে তোমার বাগানবাড়িতে চলে যাব। তবে
রাত এগারোটার মধ্যে আমার ঢাকায় ফিরতে হবে। বউ ইদানীং কড়াকড়ি আইনের মধ্যে রাখছে।”
রাজনের সাথে পরিচয় হয় পাঁচ বছর আগে। তখন বনানীর এক বাসায়, উচ্চবিত্ত এলাকার আর-দশজন সাধারণ বারবনিতারই
একজন ছিলাম। ঐ সময়টায় ভীষণ প্রেমে ডুবে ছিলাম শিহাবের। প্রথম যেদিন রাজনের সাথে
পরিচয়, সে একসময় বলে, “তোমাকে প্রথম দেখার সময়েই মুগ্ধতা তৈরি
হইছিল আমার, যতক্ষণ আমার
পাশে ছিলা, মনে হইছিল
একবিন্দু মনোযোগ তোমার নাই আমার প্রতি। তোমার চোখের দিকে তাকালেই মনে হয় তুমি অন্য
কোনো গভীর ভাবনায় ডুইবা আছো।”
আমি ভয়ে-ভয়ে সদ্যঃপরিচিত লোকটার দিকে তাকাই। বলি, “আসলে আমার শরীরটা ভালো নাই। তাছাড়া এখানকার
ম্যানেজার দুপুরে ঝগড়া করছে আমার সাথে,
এজন্যও
মন খারাপ।” তারপর বলি, “আমি আপনার সাথে
কোঅপারেটিভ ছিলাম না ম্যাডামকে জানায়েন না,
প্লিজ।”
বলতে-বলতে কেঁদে ফেলি। যদি আমার সম্পর্কে এই গেস্ট হাউসের ম্যানেজারকে বলে দেয়, আমাকে হয়তো বের করে দেবে এখান থেকে। নারায়ণগঞ্জে
বা অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। আমার একমাত্র মেয়েকে দার্জিলিং-এ একটা কনভেন্ট স্কুলে
পড়াই। তখনও বাড়িগাড়ির মালিক হই নাই। মেয়ের
খরচ কে জোগাবে? রাজনকে খুলে বলতে পারি না যে একজনকে পাগলের মতো ভালোবাসি। আমার মন
প্রাণ যকৃৎ হৃৎপিণ্ড - সব তারই জন্য। রাজন আমার কপালে, দু’চোখে চুমু খেয়ে বলে, “আমি তোমার কাছে আবার আসব। তুমি অনেক
মিষ্টি।” সেই থেকে রাজনের সাথে বন্ধুত্ব,
তারপর
থেকে আমার যে-কোনো বিপদে, অস্থিরতায় সে
আমার পাশে ছিল।
আমার এখানকার মেয়েগুলো প্রায় সবাই দেখতে-শুনতে খুব ভালো।
এরা সবাই তাদের পেশাকে ভালবাসে। নিজেদের স্বাধীন মনে করে। সকালবেলায় ঘুমায়। দুপুরে
পেডিকিওর, ম্যানিকিওর, বিউটি পারলার, বা ঘরদোর গোছাতে ব্যস্ত থাকে। কেউ ইংরেজি শেখে। পুলিশ, আমলা,
রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী,
বিত্তশালী
বহু নামি-দামি লোকজন আসে ওদের কাছে। প্রায় সবসময়ই তারা নিজেদেরকে ফুলদানির ফুলের
মতো সাজিয়ে রাখে। অবসরে সিনেমা দ্যাখে বা ঘরদোর, ফুলের টবের যত্ন নেয়। অনেকেই মাসে-মাসে ঢাকায় বা গ্রামে বাবা-মাকে টাকা
পাঠায়।
রাতে ঘুমানোর আগে যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে-পড়া
আমার একমাত্র মেয়ে লিরাকে ফোন করি। ফোনে মেয়েটা বাচ্চার মতো সারাদিনের সব ফিরিস্তি
দেয়। শৈশবে-কৈশোরে তাকে বুঝতে দেই নাই আমার পেশা কী।
রাতে প্রায় একঘন্টা হাল্কা মিউজিক ছেড়ে ৩৭ ডিগ্রি গরমে জলে
বাথটাবে গোসল করি। গোসল-শেষে এত সজীব লাগে মনে হয় ভেসে বেড়াব এখন। ‘মন মোর মেঘের
সঙ্গী...’ গাইতে-গাইতে বিছানা চাদর বালিশ নিয়ে ছাদে চলে যাই। আকাশে হালকা মেঘ
চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছে, চাঁদের চারপাশে
মেঘের বিমূর্ত পেইন্টিং। মাঝেমাঝেই আমার মনে হয়, আমার মতো সুখী মানুষ পৃথিবীতে খুব বেশি নাই। একটা ছোট্ট
ঘাসফুলের সৌন্দর্যও প্রাণ ভরে পান করি আমি।
রাস্তার ট্রাফিক,
শপিং
মল, এয়ারপোর্ট রোডের
দু’পাশের সবুজ গাছ, রংবেরং-এর ফুল, গাড়ির সঙ্গীতে ঢাকা ছেড়ে গাজীপুরে পৌছাই। পুরো পথ আমার থেকে খানিক
দূরত্ব বজায় রেখে রাজন অভিনিবেশে গান শুনছিল অথবা হয়তো কিছু ভাবছিল। গাড়িতে
ড্রাইভারের সামনে সে সবসময় আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখে।
এক বয়স্য বন্ধু জাফরানের কাছ থেকে গাজীপুরের এই বাগানবাড়িটা
পেয়েছি। প্রথম সাক্ষাতে সত্তর বছর বয়সী জাফরান আমার পাশে এসে বসে। সৌহার্দ্য
বিনিময়ের পর প্রায় আর কোনো কথাই হয় না দু’জনের মধ্যে। তার গম্ভীর মুখশ্রীর সামনে
নিজে থেকে কোনো কথা বলতেও সংকোচ হয় আমার। কিছুক্ষণ নীরবে ড্রিংক করে আমার কাছ থেকে
বিদায় নিয়ে চলে গেল সে। বলল আরেকদিন আসবে। তার পোশাক, জুতা সবকিছু থেকে অভিজাত্য ঠিকরে পড়ত। মুখে সবসময় এক
বিষণ্ণ গাম্ভীর্য ঝুলে
থাকত তার। আমার কাছে দাবিও ছিল খুবই সামান্য। আমাকে অনুরোধ করত নগ্ন শুয়ে থাকতে।
সবসময় যে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত,
তাও
না। বিছানায় আমাকে নগ্ন রেখে পাশে সোফায় বসে মদ খেত। মদ খেতে খেতে নিজস্ব কোনো
ভাবনায় ডুবে যেত সত্তরোর্ধ্ব মানুষটা। অনেকসময়ই টেবিল-ল্যাম্পের মৃদু আলোতে, সঙ্গীতের মূর্ছনায় লোকটাকে পাশে বসিয়ে রেখেই
ঘুমিয়ে পড়তাম। ভোররাতে নিজেকে আবিষ্কার করতাম তার বুকে আলিঙ্গনাবদ্ধ। আমাকে জাপটে
সজোরে বুকে চেপে ধরা আর মাঝে মাঝে মাথায়,
মুখে, শরীরে চুমু খাওয়া ছাড়া অন্য কোনো যৌন আচরণ
সে করত না। কখনও এত জোরে চেপে ধরত যে মনে হত হাড়গোড় চুরমার হয়ে যাচ্ছে।
স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কখনও কখনও চেষ্টা করতাম তার ভিতরের
পুরুষকে জাগিয়ে তুলতে, কোনো লাভ হত না।
তার সন্তানেরা বিদেশে থাকে। স্ত্রী মারা গেছে প্রায় বিশ বছর। তার শক্ত সজোর
আলিঙ্গনে টের পেতাম সব নিঃসঙ্গতা সে পুষিয়ে নিতে চায় আমাকে সর্বশক্তি দিয়ে বুকে
চেপে ধরে। যে গেস্ট হাউসে থাকতাম তার ম্যানেজার লাবণী ম্যাডামের অনুমতি নিয়ে আমাকে
সে নিয়ে যায় গাজীপুরে তার বাগানবাড়িতে।
বন, দিঘি, বাগান,
ধানখেত, মাঠ - সুবিশাল এলাকা জুড়ে রাজপ্রাসাদের মতো
তার বাগানবাড়ি। উঠানের পাশে পাতাবাহার গাছ দিয়ে ঘেরা দারুণ দৃষ্টিনন্দন এক ফুলের
বাগান। পৃথিবীর সব সৌন্দর্য যেন সেখানে স্থির হয়ে আছে। জাফরান বলে, “চলো,
বাড়ির
ভিতরে চলো, তারপর পুরো বাড়ি
ঘুরে দ্যাখো।” বাড়ির ভিতরটা অভিজাত। হাত মুখ ধুয়ে শাড়ি বদলে সালোয়ার কামিজ পরে আমি
বেড়াতে বের হই। জাফরান পইপই করে বলে দিলেও,
বাড়ির
কেয়ারটেকার রহমতকে সাথে নেই না। একাই বেরিয়ে যাই। দু’পাশে শালবন, তার মাঝে সরু একটা হাঁটাপথ, বনের উপরে মেঘযুক্ত একচিলতে নীলাকাশ। মার্চ
মাসের বিকেলে হালকা বাতাসে শালগাছ ছাড়াও নানা লতা আর হাজারো বুনোগাছ মাথা নেড়ে
আনুগত্য জানাচ্ছে। একটা ছোটঝোপ আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা আছে মাকড়শার জালে। গলা ছেড়ে
রবীন্দ্রসঙ্গীত গাই, ‘এই উদাসী হাওয়ার
পথে পথে মুকুলগুলি ঝরে..।’ মাটিতে মরা গাছের গুঁড়িতে সবুজ মখমলের মতো শৈবাল তার
সাম্রাজ্য বিস্তার করছে। ঝিরিঝিরি হাওয়া,
পাখির
সঙ্গীতে অতীত, ভবিষ্যৎ, অর্জন,
বিসর্জন
সবকিছু বিস্মৃত হয়ে যাই। এই অরণ্য,
পাখির
গান- যেন এই সবকিছুরই অংশ আমি। মেয়ে ছোট থাকতে যখন ওর কাছে যেতাম দার্জিলিং, তখনও মা-মেয়ে ঘন কুয়াশার মতো মেঘরাজ্যে
হারিয়ে যেতাম। আমি আর লিরা প্রজাপতির মতো পাহাড়ে জঙ্গলে সারাদিন দাবড়ে বেড়াতাম।
ঘন অরণ্যের ভিতর এই একচিলতে পথে শুকনো পাতা মাড়িয়ে কিছুদূর
এগিয়ে গেলে একটা ছোট খোলা মাঠ, তাতে উঁচু ঘাস, পাশেই বড় একটা দিঘি। চারপাশের মানুষের সাড়া
পাওয়া যায় না, শুধুই বাতাসের
গোঙানি। মাটি-কামড়ে-থাকা কিছু লতানো গাছে ছোট-ছোট হলুদফুল ফুটে আছে। হাওয়া তার নরম
আদর বুলিয়ে খেলছে আমার চুলে, চোখের পাতায়, গালে,
ওড়নায়।
চারিদিকে পাতার মর্মর, পাখির
কিচিরমিচির, কাকের
কাঁপা-কাঁপা ডাক। প্রকৃতির এই সুরেলা সমাবেশে আমি মাতাল হয়ে যাই। বাগানবাড়ির মালিক, আমার বন্ধু জাফরানের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে
ওঠে।
একটা মাছরাঙা দিঘির জলের উপর দিয়ে উড়ে চলে গেল বনের দিকে।
মাঠের মাঝে সরু হাঁটাপথ পার হয়ে দিঘির শান-বাঁধানো ঘাটে নামি। বেশকতক সিঁড়ি নেমে
গেছে জলে। বাচ্চাদের মতো লাফিয়ে-লাফিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামি। হাঁটুঅব্দি দুই পা জলে
ডুবিয়ে বসে থাকি। একটা আমগাছ তার শরীরের বেশির ভাগই পুকুরের পানিতে ঝুঁকিয়ে
দাঁড়িয়ে আছে। পুকুরের ওপাশে ঘন বন তার অতল রহস্যের ভান্ডার নিয়ে স্থির। বরফের চাঁইয়ের
মতো সাদা মেঘ পুকুরের জলে প্রতিফলিত হয়ে বাতাসে-ওঠা ছোট-ছোট ঢেউয়ে ভেঙে-ভেঙে
যাচ্ছে। আমার পায়ের কাছে ডোবানো সিঁড়িতে ছোট-ছোট মাছের ঝাঁক। পাশে নানান জলজ
উদ্ভিদের ফাঁকে ফাঁকে বড় কিছু মাছ কানকো নেড়ে নেচে যাচ্ছে। জল-ডোবা দু’পায়ে জলের
নীচে সিঁড়িতে তাল দিয়ে গান গাই,
‘মোর
বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি।’ মাছগুলো আমার পায়ের কাছ থেকে সরে সরে যায়।
সন্ধ্যা নেমে এলে ফিরে আসি। খুব ধীরে আঁধার নামবার সময়ের
প্রতিটা পরিবর্তন, প্রতিটা পল
উপভোগ করি আমার সংবেদনে। ঘরে ফেরার পর আমার বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস দেখে জাফরান হাসে।
ঘরের সব আলো নিভিয়ে, মোমবাতির আলোয়
রাতের খাবার খেতে খেতে ছোট শিশুর মতো আবদার করি, “আরো কিছুদিন এখানে থাকব।” রাতে জাফরান যেমন সজোরে জড়িয়ে ধরে
আমাকে ঘুমায়, আমিও
আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে আঁকড়ে থাকি ঘুমিয়ে নেতিয়ে না-পড়া পর্যন্ত। সেবার টানা তিনদিন ঐ
বাগানবাড়িতে থাকি। বনে আর দিঘির পাড়েই কাটে দিনের বেশিরভাগ।
সন্ধ্যার পর থেকে চারপাশে ঝিঁঝিঁপোকার শব্দে, মোমবাতি বা টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় আমরা দু’জন
গান শুনি। রাতে ছাদে চলে যাই, হয়তো
রবীন্দ্রসঙ্গীত গাই, সে নীরবে শোনে।
তাকে মাঝেমধ্যে অন্য গ্রহের কোনো মানুষ মনে হত। মনে হত দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময়
নিয়ে আমার কান্ডকারখানা উপভোগ করছে সে। যদিও টাকার জন্য করতাম, তারপরও শুরুর দিকে জাফরানের সামনে নগ্ন হতে গ্লানি বোধ হত।
মনে হত পয়সার জন্য এত বৃদ্ধ এক লোকের সাথে শুচ্ছি। তাছাড়া বয়সের কারণে তার মুখ
থেকে গন্ধও বের হত। অথচ জাফরানই আমার জীবনটা বদলে দিল। শুরুর দিকে তার বাগানবাড়ির
চাবিটা সে আমাকে দিয়ে দেয়। পরে বারিধারায় একটা অ্যাপার্টমেন্ট। এবং তার সহায়তায়ই
একজন সাধারণ বারবনিতা থেকে একজন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে পারি। যেহেতু দালাল, কাস্টমার, পুলিশ, প্রশাসন, রাজনীতিবিদ, সবারই সাথে কানেকশন তৈরি হয়ে গেছিল, ব্যবসাটা বুঝে উঠতে আমার সময় লাগে নাই। আমার
ব্যবসা বেশ্যাদের নিয়ে হলেও, নিজে আর পয়সার
জন্য শুই না। গত চারবছর আগে জাফরানকে তার সন্তানেরা আমেরিকা নিয়ে যায়। ওখানে তার
মেরুদন্ডের নার্ভের অপারেশন হয়। বহুদিন ব্যথায় ভুগছিল। অপারেশনের পর নাকি সে
প্যারালাইজড হয়ে যায়। গত বছর মারা গেছে আমেরিকাতেই।
কেউ-কেউ আমার প্রেমে পড়ে নানারকম অদ্ভুত কান্ড করত। একবার
এক ব্যবসায়ী আমার প্রেমে পড়ে। সে কী অনুনয়,
আমি
যেন তাকে বিয়ে করি; তার সবকিছু সে
আমাকে দিয়ে দিবে। সুপুরুষ, শিক্ষিত, সফল ব্যবসায়ী লোকটা ছেলেমানুষের মতো আচরণ
করে; আমার দু’হাত ধরে করুণ
চোখে আমার মুখে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘ সময় পার করে দেয়। কী আকুতি তার দু’চোখে! আমাকে
বোঝায়, তাকে বিয়ে করলে
সম্মানজনক একটা জীবন হবে আমার। মনে মনে হাসি,
নিজের
স্বাধীনতা ছেড়ে সম্মানজনক জীবনের প্রয়োজন আমার নাই। অন্ততঃ আমার।
আমি আমার স্বাধীনতা ছাড়তে রাজি হই নাই। শেষের দিকে এমনকি
দেখাও দিতাম না তাকে। একদিন আমাকে ফোন করে সে কী কান্না- “তোকে আমার সন্তানের মতো
ভালবাসি, আর তুই একবারের জন্য
আমার ফিলিংসটা বুঝলি না!” তার সাথে যদিও শীতল আর কঠোর ব্যবহার করি, কিন্তু মনে মনে ভয় পাই আত্মহত্যাটত্যা করে
বসে কিনা। আমার এক বেশ্যা বান্ধবী রীতার সাথে প্রণয় ছিল পুলিশের একজন দারোগার। তার
প্রেমিকা তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করলে লোকটা একসময় আত্মহত্যা করে। ঐ ঘটনাটা আমাদের
ম্যানেজার-সহ এখানকার সবগুলো মেয়েকে বিষণ্ণ করে দিয়েছিল। মারা যাওয়ার আগের রাতে সে রীতার সাথে দেখা করতে তার রুমের সামনে ছুটে
গিয়েছিল। রীতা তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়। আমাদের ম্যানেজার ডেইজি ম্যাডামও রীতাকে অনুরোধ করে
লোকটার সাথে দেখা করতে, তা না হলে
অন্ততঃ কথা বলতে। সে তাও বলে নাই। সেই রাতেই লোকটা নিজের মাথায় গুলি করে।
বছর চারেক আগে আমি শিহাবের প্রেমে পড়ি। অল্পসময়ের মধ্যেই
আপাদমস্তক ডুবে যাই। একদিন সে বলে,
“তোমার
কথা বলার ভঙ্গি, ভ্রু-কোঁচকানো, চাউনি,
চুলের
স্টাইল, হাঁটার ভঙ্গি, সবকিছু মিলিয়ে তুমি এক সম্রাজ্ঞী। অন্ততঃ
একটা রাজপ্রাসাদ তোমার থাকা দরকার। তুমি সেখানে বাগান চাইলে বাগান করে দিতে হবে।
চুল আঁচড়াতে চাইলে চুল আঁচড়ে দিতে হবে। তোমার ঘরে ঢোকার আগে, তোমাকে ছোঁবার আগে, মাথা নুইয়ে বাও করতে হবে, মহারানি।” আমি বলি, “তুমি আমার কানে এত মধু ঢেলে দাও!” সে বলে, “মধু আবার কড়ায়-গন্ডায় ফেরত নিব তোমার
প্রতিটি ইঞ্চি থেকে।”
সে ছিল রাজনীতিবিদ,
সরকারি
দলের এমপি। বুদ্ধিমান, সহজ আর
বন্ধুবৎসল। শিহাবের সাথে সাথে সম্পর্কের আনন্দটা এই ছিল যে সে আমাকে তার সমান
উচ্চতায় তুলেই সম্পর্ক রেখেছে। প্রথম থেকেই তাকে ভালো লাগে আমার। শিশুর মতো তার
হাসি দেখে ভাবতাম একজন রাজনীতিকের হাসি এত অনাবিল হয় কেমন করে! ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা, কৌতুকপ্রিয়তা,
আমার
সমস্ত দিয়ে চেষ্টা করেছি তাকে টানতে। সেও তার চরম ব্যস্ততার মধ্যেও দিন-রাত যখনই
অবসর পায় ফোন করে বা চমৎকার এসএমএস পাঠায়...
Your hair, my favorite touch
Your eyes my favorite sight
Your cheeks my favorite color
Your ears, my favorite whisper
Your lips, my favorite kiss
Your voice, my favorite symphony
Your smile, my favorite aim
Your presence, my favorite hope
Your touch my hottest feeling
একবার সে আমেরিকা যায় কনফারেন্স যোগ দিতে, তার আগেরদিন দুপুরবেলাটা আমার সাথে কাটিয়ে যায়। আমেরিকাতে তাকে এসএমএস পাঠাই, ÒI still smell you in my room.Ó সে জবাব দেয়, ÒI am never too far.Ó সেবার প্রায় পনেরো দিন সে আমেরিকাতে থাকে। আবার মেসেজ আসে, ÒI don’t know why I am so lonley, especially at dawn. I miss so much being at your place, watching you sleep. Oh, how I wish I could wake up beside you every morning of my life! Ó আমি লিখি, ÒMy life, my destiny, is in your hand. You can do with me whatever you will. I will never let you down.Ó
মাঝে মাঝে এমন হত যে মিটিং থাকলে বা নিজের নির্বাচনী এলাকায়
গেলে হয়তো সে ফোন ধরত না। আর এদিকে আমি সারাদিন ফোন করেই যেতাম । রাত ১২টার পরে
হয়তো পেতাম তাকে, আর তখন তটভূমিতে
আছড়ে-পড়া সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের মতো কান্নায় আমার গলা জড়িয়ে যেত- “আর কিছুক্ষণ
তুমি কথা না বললে আমি আত্মহত্যা করতাম!” কান্না থামার পর আবার শিশুর মতো আহ্লাদ
করতাম, ভুলে যেতাম আমার ৪৫
চলছে। বা হয়তো তুমুল চেঁচামেচি বাঁধাতাম,
“তোমার
ব্যস্ততা বোঝার দরকার আমার নাই। লাঞ্চ টাইমে বা অন্য কোনো সময় কি একটু ফাঁক বের
করে ফোন করতে পারতা না?” বলেই হয়তো ফোন
কেটে দিতাম। আবার তিন/চার মিনিটের মাথায় ফোন করে ফোঁপাতাম- “তোমার সাথে ঝগড়া করে
তো দুই মিনিটও থাকতে পারি না।”
নিজেরই বিস্ময় লাগত আমার মতো শত-পোড়-খাওয়া মাঝবয়সি এক
প্রফেশনাল হোর কেমন বাচ্চাদের মতো করছি!
কিছুকালের মধ্যেই তার সাথে আমার এক অদ্ভুত টেলিপ্যাথিক
যোগাযোগ শুরু হয়। রান্না করতে করতে হঠাৎ হয়তো মনে হচ্ছে কোনো টিভি চ্যানেলে তাকে
দেখা যাচ্ছে। টিভি অন করে দেখি ঠিকই টক শো দেখাচ্ছে, অথচ এর খবর আমাকে কেউ দেয়নি। আবার কোনোদিন সারাদিন হয়তো ফোন
করে নাই। রাত ১১টার দিকে মনে হয়েছে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ফোন করবে। ঠিক তার
দশ-পনেরো মিনিটের মাথায়ই তার ফোন। একবার ভারতীয় এক সংগীত শিল্পীর অনুষ্ঠান দেখতে
গেছি জাদুঘর মিলায়তনে আমার বাসার সব মেয়েরা-সহ। ওখানে পৌঁছেই মনে হয়েছে সে আছে।
অনুষ্ঠান-শেষে দেখি সে বেরিয়ে যাচ্ছে সাথে আরও দু’তিনজন লোকসহ। আমাকে দেখে
সঙ্গীদের কাছ থেকে একটু দূরে সরে এসে বলে,
“তুমি
এইখানে!” আমি বলি, “আমার
টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা তৈরি হইছে, আজকে এখানে আসার
পর থেকে আমার মন বলতেছিল তুমি এখানেই আছো,
অথচ
গতকালই বলছিলা আজকে সারাদিন ব্যস্ত থাকবা।”
“পাগলদের
টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা থাকে,” হেসে জবাব দেয়।
“লোকজন অপেক্ষা করতেছে আমার জন্য,
পরে
কথা বলব।”
আরেকদিন ঈদ-এর কয়েকদিন আগে গুলশান আড়ং-এ যাই। ওখানেও ঢোকার
পর থেকেই আমার মন বলছিল সে আছে এখানেই ভিড়ের মাঝে। পাঞ্জাবি সেকশনের দিকে যেতে
দেখি, এক ভদ্রমহিলা তাকে
পাঞ্জাবি দেখাচ্ছে। আমি তার কাছে যেতেই চোখের ইশারায় বোঝায় পাশে তার স্ত্রী।
আমার সাথে যা একেবারেই যায় না সে কথাটা তাকে বলি একদিন।
যদিও আমি আমার ব্যবসায় পরাপুরি সেটেলড। তারপরও বলি, “শোনো, তুমি যেভাবে চাও
আমি তেমনই হব। তুমি যদি চাও এই বিজনেস ছেড়ে দিব। স্কুলে মাস্টারি করব। আর বাসাভাড়া
যা আসে তাতেই চলে যাবে। লিরাকে বলব সপ্তায় ২/৩ দিন অড জব যেন করে। তা নাহলে আমার
বাগানবাড়িটা বিক্রি করে দিব। একসময় তো অনেক গরিবের মেয়ে ছিলাম। নতুন পরিস্থিতিতে
অ্যাডজাস্ট করতে আমার সমস্যা হবে না।”
সে বলে, “তুমি এই ব্যবসা
করো জেনেই তো প্রেমে পড়ছি। তোমার সাথে মিশে দেখছি এমন আর হয় না। আমার জন্য এমন
কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ো না যার জন্য দু’দিন পর অনুতাপ করবা। তোমার প্রফেশনের প্রতি
কোনো অশ্রদ্ধা নাই আমার। আমরা পলিটিশিয়ানরা তো কত অন্যায় করি, মানুষের সাথে কত প্রতারণা করি। তুমি যা-ই হও
না কেন, সবসময়ই আমার মহারানি।”
একদিন তার বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলি, “শোনো,
কোনো-না-কোনোসময়
তো তুমি বোরও ফিল করতে পারো, তখন কি আমাকে
ছেড়ে চলে যাবে?”
“যে আমাকে ফেলে
দেয় না তার সাথে আমি থাকি। সারাজীবনই থাকি। তাছাড়া তোমার ব্যক্তিত্বের এবং শরীরের
আকর্ষণ দু’টোই আমার তীব্র। আমি এই পাগল মেয়েটাকে হারাতে চাই না, কখনও না। তবে তোমার যদি বোরিং লাগে তবু
আমারে ধরে থাইকো। আমারই থাইকো। তোমার গলা শুকনা লাগতেছে কেন?”
“সকালে
কাঁদছিলাম। প্রেমে পড়লে মনে হয় মানুষের মাঝে মাঝে কান্না পায়।”
“লিপি, আমারও কান্না পায়। এই যে রাজনীতি করি, বক্তৃতা দেই। মাঝে মাঝেই মনে হয় অন্যের জীবন
যাপন করতেছি। ভন্ডামি করতেছি।”
আমার টেলিপ্যাথি,
কার্যকারণ
সব ব্যর্থ করে দিয়ে শিহাব হঠাৎ একদিন আমার সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। আমি ফোন
করলে রিসিভ করে না। কোনো অচেনা নাম্বার থেকে ফোন করলেও আমার কন্ঠস্বর শুনলেই লাইন
কেটে দেয়।
প্রেমে ডুবে ছিলাম আমরা, আমার সাথে যোগাযোগহীনতার তিনদিন আগেও আমার জন্য একটা হীরার
নাকফুল নিয়ে এসেছিল। নিজেই পরিয়ে দিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, “মৃত্যুর পর আমার নাক থেকে লোকজন এটা খুলে
নেবে। মৃত্যুর আগে কখনোই না।” আমার ঘোষণায় সে হেসেছিল। আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে
দেওয়ার পর, টিভিতে টক-শোতে, সংসদে,
আগের
মতোই তাকে উজ্জ্বল দেখি। তখনও আমার নাকে তার দেওয়া নাকফুল, নাকের চারপাশ পুঁজে, ব্যথায়, ফুলে ঢোল,
মগজময়
চার বছরের প্রেমের স্মৃতির বুদবুদ। সেইসময় জীবনের সবচেয়ে বড় পাগলামিটা করলাম, প্রেস কনফারেন্স করলাম। সাংবাদিকদের জানালাম
পতিতাবৃত্তি আমার পেশা। বিভিন্ন সময়ে মোবাইল ফোনে আমার তোলা তার ছবি দেখালাম; জানালাম চার বছর গভীর প্রেমের সম্পর্ক থাকার
পর কীভাবে আমাকে সে ছুঁড়ে ফেলে দিল। কথা বলতে বলতে সাংবাদিকদের সামনে কেঁদে ফেলি
আমি। ফলাও করে সব পত্রিকায়, প্রাইভেট টিভি
চ্যানেলে ছাপা হয় এ-খবর।
তারপর কয়েকজন সাংবাদিক আমার পিছে ঘোরে, আমার প্রণয়-কাহিনী নিয়ে স্টোরি করবে। তাদের
কাউকে-কাউকে টাকা দিয়ে নিবৃত্ত করি। এর পরও কয়েকটা পত্রিকা আমাকে কভার স্টোরি করে।
আরও কিছু ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা আর পুলিসকে জড়িয়ে নানা গল্প বানায়, যাদের অনেকেরই সাথে আমার এমনকি পরিচয়ও হয়নি
কোনোদিন। শিহাবকে বাদ দিয়ে আমিই হয়ে দাঁড়াই পত্রিকাগুলোর ফোকাস। এরপর পুলিস আর
গোয়েন্দারাও আমার খোঁজখবর শুরু করে। আমার মেয়েগুলিকে, বা নানা কানেকশনকে ব্যবহার করে তাদেরও
আস্তে-আস্তে থামাই আমি।
সেই সংকটে আমার বন্ধু রাজন এসে পাশে দাঁড়ায়। শিহাবের সাথে
আমার সম্পর্কের আগে থেকেই রাজন আমার বন্ধু ছিল। শিহাবের সাথে প্রণয়কালে রাজনের
সাথে যা গল্প করতাম তার বেশিরভাগই শিহাবকে নিয়ে। বছরখানেক আগে লন্ডন থেকে মেয়ে ফোন
করে সে কী কান্না! তার সার্বিয়ান প্রেমিক তাকে ছেড়ে চলে গেছে। রাজনকে দায়িত্ব দেই
লিরাকে বোঝাতে। একটা বাচ্চাকে বোঝ মানানোর মতো রাজন বহুসময় ধরে লিরাকে বোঝায়। পরে
লেবানিজ এক ছেলের সাথে প্রেম হলে লিরা সামলে ওঠে।
শিহাবের সাথে যখন সম্পর্ক ছিল, পারতপক্ষে তখন সে ছাড়া অন্য কারো শয্যাসঙ্গী
হইনি আমি। রাজনকে যে কত উচ্ছ্বাস দেখিয়েছি। শিহাব চলে গেলে রাজন ছাড়াও ফাহিম, ইশতিয়াক-সহ আরও কিছূু নতুন বন্ধু হয়।
রাজন-সহ গাজীপুরে আমার বাড়িতে যখন পৌঁছাই, তখনই আমার মেয়ে ফোন করে। রাজন পাশে আছে শুনে
লিরা তার সাথে কথা বলে। লিরার সাথে কথা বলার সময় তার মুখ একজন বাবার মতোই উদ্ভাসিত
হয়ে ওঠে। আমার আরেক বন্ধু মুহিবের এসএমএস যখন আসে, রাজনের পাশে আমি শুয়ে। ÒI’m not in London, I’m away on a seminar, I’ll write you a
mail tomorrow afternoon when I’m back.Ó
বাথরুমে যাওয়ার জন্য রাজন উঠে যায়।
রাত ৯টার দিকে রাজন চলে যায়। তারপর ছাদে যাই বালিশ, চাদর আর মাদুর নিয়ে। এক-আকাশ ঝিকিমিকি তারার
নিচে ছাদের ওপর ঝুঁকে-পড়া একটা গাছে অগণিত জোনাকি জ্বলছে আর নিভছে। চারপাশে টানা
ঝিঁঝিঁপোকার শব্দ, আর জোনাক-জ্বলা
অপার্থিব সৌন্দর্যের মুখোমুখি হয়ে ভাবি,
যে-আমি
প্রকৃতির বিন্দুবিন্দু রসও শুষে নিতে জানি,
তার
কেন কখনোই কান্নাকাটি করতে হবে? ছাদে গান গাই:
Close your eyes and I’ll be on my way.
One more time let me kiss you.
Now the time comes to leave you
Every song I sing, I sing for you
When I come back I’ll bring your wedding
ring
So kiss me and smile for me
Hold me like you never let me go.
I’m leaving on a jet plane
Don’t know when I’ll be back again.
Oh babe, I had to go.
পাশে বন থেকে খ্যাঁকশেয়ালের ডাকাডাকিতে অন্ধকার গাঢ় হয়। আকাশে মেঘ জমেছে, ছোপ-ছোপ মেঘ এসে তারাগুলোকে ঢেকে ফ্যালে। মাদুর আর বালিশ নিয়ে ঘরে ফিরে যাই। কবিতা লিখতে বসি, পুরনো ডায়েরি বের করি, কিছু টুকরো-টুকরো কবিতা আছে। সেগুলোর ওপর কাজ করতে হবে। শিহাবের সাথে যখন প্রেম, সেসময় থেকেই কবিতা লিখি-
সাদা বিড়াল
হুল্লা শুনে
এগিয়ে যেতে দেখি
একদল সাদা বিড়াল আকাশে
উড়ে যাচ্ছে,
তার
পিছে উড়ে যাচ্ছে
একটা রাজনৈতিক মিছিল,
ঘর্মাক্ত
সমবেত বিড়ালেরা কাঁদছে
আকাশে প্রবল ধারাপাত
স্মৃতি
নিয়ে যাচ্ছে স্মৃতি ভাটির টানে, মেঘনা ব্রিজের
ওপর দিয়ে বিন্দুর মতো,
খোসার
মতো দুলে
যাত্রীবাহী নৌকা,
স্মৃতি
এক অবিরাম ঘূর্ণাবর্ত
পাক খেয়ে টলে
ঝিকিমিকি সূর্য-প্রহরায়
জমাটবদ্ধ হুইসেলের স্মৃতি নিয়ে
নদীতীরে জেলেবঊ কাপড় শুকায়
ঘুমাতে ঘুমাতে যায় ভাটির টানে
নদী ট্রেন আর সে
যদি আরেকবার শুধু ছুঁতো আমায়
পরদিন বেলা করে ঘুম থেকে উঠি। মুখ ধুয়ে আয়নায় তাকিয়ে দেখি আমার নাকফুলের চারপাশ লাল হয়ে আছে। ফুলে উঠেছে। প্রায় বছরখানেক আগে শিহাব নাকফুলটা পরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু আজও মাঝেমাঝেই নাকের চারপাশটা ফুলে ওঠে। পুঁজরক্ত বের হয়। ব্যথায় টনটনায়। ইনফেকশন থাকে কয়দিন। ডাক্তার অবস্থা দেখে বলেছিল নাকফুলটা খুলে ফেলতে। আমি রাজি হইনি। সুঁচ-রাজকুমারের মতো লাগে নিজেকে মাঝে মাঝে। শিহাবকে আবার গালি দেই, প্রতারক, আই হেইট ইউ!
ঘর থেকে বেরিয়ে বনে ঢুকি। সামনেই ছোট একটা গর্তে কালো পানি
জমে আছে। সরু হাঁটাপথ পার হলেই ঘন ঘাসে-ভরা খোলা মাঠ। বনে ঢোকার পরই বিষণ্ণতা উবে
যায়। দিঘির ঘাটে গাছের ছায়ায় বসি। ভরদুপুরে একদল মশা আমার মাথার ওপর টানা গান গেয়ে যাচ্ছে।
মরা পাতার পচা মিষ্টি গন্ধ আসছে। কনিয়াক আর হাভানা চুরুটের জন্য হাহাকার লাগে।
দিঘির জল, বন, দিঘির পাশে একটু খোলা প্রান্তর, আমাকে আমার প্রিয়তমের মতো জড়িয়ে ধরে রাখে।
এমন করে, যেন কোনোদিন ছেড়ে যাবে
না। নানা জাতের পাখির কাকলি। এই অশান্ত সঙ্গীত নিজের খেয়ালে বেজে যাচ্ছে। একটা সময়
ছিল যখন কোনো অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মুখোমুখি হলে আমার মেয়ের জন্য প্রার্থনা
করতাম। আর করতাম শিহাবের জন্য, যেন সে মন্ত্রী
হয়। যেন তার মাথা সবসময় উঁচু থাকে। প্রায় প্রতিটি নিঃশ্বাসে প্রার্থনা করতাম তার
জন্য।
সাত-আট মাস আগে মুহিব নামে আরেকজনের সাথে সম্পর্ক হয়েছিল, শিহাবকে হারানোর ক্ষত তখনও দগদগে। আমার কাছে
নিয়মিত আসত। কখনও আমার রূপের বা গুণের একবিন্দু প্রশাংসা করে নাই। মুহূর্তের জন্যও
বলে নাই সে আমাকে পছন্দ করে বা ভালবাসে। অথচ যখন আমাকে স্পর্শ করত, তা করত পরম যত্নে আর মমতায়। এত আলতো, এমন সংবেদনশীলতায়, যেন ক্রিস্টালের তৈরি পুতুল স্পর্শ করছে। স্ত্রীর
সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে। একমাত্র মেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পড়ে। একদিন ফোন করে জানাল তার
ট্রান্সফার হয়েছে লন্ডনে। দু’দিন পরই চলে যাচ্ছে। এর আগেও সাত-আট বছর লন্ডনে চাকরি
করেছে। লন্ডন থেকে
প্রায় প্রতিদিন সে ইমেল বা এসএমএস পাঠায়:
‘I hope you are fine.
I am OK, but still a bit “lazy” and not focused.’
‘I
am sitting in my office and looking out at RAIN, RAIN and even more rain.’
‘I
look forward to the weekend. I have no big plans for it, maybe some night
clubs.’
‘It
has been a long period since I did any physical training, but now I am back on
track and I am motivated. I am actually going to the gym after I send you this
mail. Later this afternoon I am invited by my neighbours for dinner. He is a
Norweigian, married to a British lady. The are very nice and have helped me a
lot since I came to London for the first time.’
‘Last
evening , I went to a night club. I even danced, which I seldom do.’
‘I
have registered in a course: “how to make South Italian food”. This course is
held close to where I live. I am a bit curious. I am sure I will pick up some
new practical knowledge.
‘The
Italian food evening class yesterday was excellent. Good atmosphere, a lot of
useful advice. We were only 9 participants there. I will have to practice some
of the dishes, perhaps Saturday or Sunday, when I’ll have a bit of time.’
‘Today
I am working on a lecture I am going to give next week. I bought 2 more paintings (as well as 4
black-and-white photos) on Sunday. I just walked
by an art gallery and decided to go inside for a look.’
‘My
daughter mailed me yesterday, she
is in doubt whether she should take a break in her studies (for 6 months–
backpacking in New Zealand or Aus) or continue with her studies. She asked for my
opinion.’
‘Last
evening I was a bit depressed and decided to go out just to see people. I went
to a bar downtown, but it was no fun at all. I had one glass of wine & went
home.’
‘I
got hold of my daughter, and she was in a good mood, looking forward to see her
tomorrow in Sydney. She has an exam on Monday.’
‘I
will be in Thailand on the 21st, next Friday. I
will return to London 14 December. ’
‘Best
regards from Thailand. Presently, I am in Ao
Nang. Tomorrow I have a ferry ticket to Phi Phi. I will stay there till Friday. Then I will take the ferry to Phuket and spend
one night there. Saturday afternnoon I will fly back to Bangkok and then it is
a flight to London late in the evening. ’
‘I am fine, I was stuck in Bangkok for a few extra days, due to
the demonstrations. I had a ticket for Krabi, flying south 26th, but I have
postponed it till 4th December. Presently, I am on an island, Koh Chang, close to the Cambodian border. I took a bus for 5 hours, plus a
ferry. I am staying at a nice resort. I rented a bungalow down at the sea. This
morning I was awake because of the sound from the waves. Today, I went to a very nice
fishermen village, the place was just lovely.’
রাতে ঘুমানোর আগে আইপড, চাদর, বালিস-সহ ছাদে চলে যাই। জোছনায় রুপালি আলোয় ছাদ, উঠান, অরণ্য, সমস্ত চরাচর কাঁপছে, এক স্নিগ্ধ রুপালি পর্দা দুলছে পৃথিবীময়। আইপড নিয়ে এলেও গান শুনি না, ঝিঁঝিঁপোকার সঙ্গীত এবং বাতাসের মর্মর মধুরতর মনে হয়। আকাশভরা নক্ষত্র, জোছনা, রাতের নিজস্ব যত শব্দ আর হালকা কুয়াশার নিচে শিশুর মতো ঘুমাই। ভোররাতের দিকে স্বপ্নে দেখি বৃষ্টিতে ভিজছে আমার মেয়ে লিরা, নগ্ন শরীর, চুল, মাথা বেয়ে টুপ টুপ পানি পড়ছে। একটা দিঘির কিনারে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। তার চারপাশে প্রায় কোমর সমান উঁচু লম্বা-লম্বা ঘাস। পাশে অস্বাভাবিক লম্বা একজন সাদা-চামড়ার লোক দাঁড়িয়ে।
ভোর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি আকাশে চাঁদটাকে গোল ঘষা কাঁচের
মতো দেখাচ্ছে। ঘন কুয়াশা মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে আছে। বাইরে ঘুমিয়ে ঠান্ডা লেগে
গেছে আমার। ঘরে ফিরে যাই। ঘরে ঢুকেই মেয়েকে ফোন করে বলি, “তোমাকে নিয়া দুঃস্বপ্ন দেখলাম। কেমন আছো? দেখলাম বৃষ্টিতে ভিজতেছ আর কানতেছ।
সাদা-চামড়ার একজন তোমাকে আমার কাছে আসতে দিতেছে না।”
ফোনের ওপাশে মেয়ে জবাব দেয়, “মজার স্বপ্ন দেখছ,
আম্মু।
লম্বা ড্যানিশ একটা ছেলের সাথে প্রেম হইছে রিসেন্টলি। খুবই কিউট দেখতে। তোমারে ছবি
পাঠাইয়া দিব। আর বাংলাদেশ নিয়া তার আগ্রহও অনেক। লেবানিজ যে-বয়ফ্রেন্ডটা ছিল সে
অনেক বাজে ছিল বলে ছেড়ে দিছি।”
তারপর আরও কিছুক্ষণ আমার গেস্ট হাউসের সব মেয়েদের খোঁজখবর
সে নেয়। দেশে এলে গেস্ট হাউসের সব ‘খালা’দের জন্য গিফট নিয়ে আসে। মেয়েরাও সবাই তার
জন্য নানা পদের রান্না করে, জামাকাপড় কিনে
দিয়ে, তার দেশে থাকার প্রতিটা
মুহূর্ত উৎসবমুখর করে রাখে। লিরা যখন ছোট ছিল, চেষ্টা করতাম আমার পেশা তার কাছে লুকিয়ে রাখতে। তাকে বলতাম, অনেক ছোটবেলাতে তার বাবা মারা গেছে। ক্লাস
এইটে উঠে বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে সে,
তখন
সত্যের মুখোমুখি করি তাকে। আমার ধারণা ছিল মুষড়ে পড়বে। তাকে বুঝিয়ে বলি, “আমার বাস্তবতায় এছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল
না।” তারপর বলি, “দ্যাখ, আমি আপাদমস্তক স্বাধীন একজন মানুষ। এটা কি
কম পাওয়া?” অনেকক্ষণ চুপ
থেকে বলে, “আম্মু, তুমি যাই হও, তুমি পৃথিবীর সেরা আম্মু। হোয়াটএভার ইউ আর, আই রেসপেক্ট ইউ নান দ্য লেস।”
লিরার সাথে কথা বলে,
রুমে
আলো বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়ি। সকাল ছটায় ঘুম আসে। দুপুরে ঘুম ভাঙলে ঢাকায় আমার
বাসায় ফোন করে বলি ড্রাইভার পাঠিয়ে দিতে। গাজীপুরের এই বাড়ির কেয়ারটেকার রহমতকে
সাথে নিয়ে নেই। তাকে ডাক্তার দেখাতে হবে। বেশ কিছুদিন তার খাওয়াদাওয়ায় অরুচি এবং
জ্বর-জ্বর যাচ্ছে। জাফরানের কাছ থেকে গাজীপুরের বাগানবাড়ির সাথে তার কেয়ারটেকার
রহমতকেও পাই। তখন থেকেই আমি এবং রহমত দু’জনই দু’জনের প্রতি প্রয়োজনের অতিরিক্ত
স্নেহশীল। রহমতের সন্তানদের পড়ালেখা,
সংসার, সবকিছুরই খরচ এখানকার আয় দিয়ে চালায়। তাকে
বলি স্ত্রী-সন্তানের সাথে এখন বাড়িতে থাকতে পারে। সে ওখানে থাকলেও তার বাড়িতে
প্রতি মাসে টাকা পাঠিয়ে দেব। বা তার বউকেও এ-বাড়িতে এনে রাখতে পারে। সে রাজি হয় না।
বলে, “এই বাড়ি ছাইড়া অন্য
কোনোহানে আমার ভালো লাগে না, এই জঙ্গল, বাগান ছাইড়া কোথাও গেলে দুই দিনে আর নিশ্বাস
বন্ধ হইয়া যায়। এইখানেই আমি মরতে চাই।” মাঝে মাঝে তার স্ত্রী-সন্তানেরা ঐ বাড়িতে
গিয়ে কিছুদিন তার সাথে কাটায়। তারা এলেও,
দু’চারদিনের
মধ্যে তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
ঢাকায় ফিরে রাজনকে ফোন করলেই বলে, “কালকে সন্ধ্যায় আমি আসতেছি, সন্ধ্যাটা ফ্রি রাইখো।” সেদিন সন্ধ্যায়
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইশতিয়াক হাসান বলে, “সুইটহার্ট,
তোমার
লেজের নাগাল পাওয়া যায় না। ঢাকায় তো থাকোই না। আজকে সন্ধ্যায় গুলশান ক্লাবে আসো।” আমি
বলি, “গাজীপুর থেকে ফিরলাম
বিকালে, খুবই টায়ার্ড। দুয়েকদিন
পর তুমি সময় করে বাসায় এসো, শায়লার
কাছে খোঁজখবর নিয়ে।” আমার এই গেস্ট
হাউসটা দেখাশোনা করে আমার বহুদিনের পুরানো বান্ধবী শায়লা। কাস্টমার ম্যানেজ করা, মেয়েদের দেখাশোনা করা, ট্রেনিং, হিসাবপত্র,
পুলিশ
প্রশাসন, কানেকশন, সব সামলায় নিপুণভাবে।
সন্ধ্যার পর টিভি অন করে দেখি শিহাবকে দেখাচ্ছে টক-শোতে।
আক্ষেপ হয়, কেন তাকে নিয়ে
প্রেস-কনফারেন্স করলাম। নিজেকেই সস্তা করলাম সারাদেশের মানুষের কাছে। তার তো কোনো
ক্ষতি হয় নাই। পরদিন সকালে দেখি নাকফুলের
চারপাশটা ফুলে লাল হয়ে আছে। ব্যথায় টনটন করছে। অয়েন্টমেন্ট দিতে গিয়ে নাকফুলে একটু
চাপ লাগতেই হীরার নাকফুলের নীচ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকে। ব্যথায় সারাদিন কাতরাই।
মনে পড়ে ডাক্তার বলেছিল নাকফুলটা খুলে ফেলেন,
সব
ঠিক হয়ে যাবে। আমি জানি এই নাকফুল খুলব না আমি। সন্ধ্যায় রাজন এসে আমাকে দেখে
চিৎকার করে ওঠে, “তোমার নাক তো
ফুলছেই, চোখের নীচ, গাল সব ফুলে গেছে, ডাক্তারের কাছে চলো।”
আমি বলি,
“ডাক্তারের
কাছে যাওয়া লাগবে না।” ওকে জিজ্ঞাসা করি,
“তুমি
তো একজন পুরুষ মানুষ, তুমি বলো তো
শিহাব কেন আর যোগাযোগ রাখল না। কেন ছেড়ে গেলে আমাকে। আমার একটু মন খারাপ দেখলেও
ছোট বাচ্চার মতো আদর করছে আমাকে। প্রতিদিন বহুবার ফোনে কথা বলছে। হঠাৎ কেন যোগাযোগ
বন্ধ করে দিল! লজ্জার মাথা খেয়ে কতবার ফোন করলাম, একবারও ধরল না আর।”
রাজন বলে,
“প্লিজ
ঐ লোকের কথা থামাও। নাকফুলটা ছুঁড়ে ফ্যালো,
নাইলে
মারা যাবা। নাকটা ইনফেকশন হয়ে তোমার চেহারা ভয়ংকর দেখাইতেছে।” অনেকটা সময় নীরবে
তার বুকে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকি। রাত সাড়ে দশটায় সে উঠে চলে গেলে দরজা বন্ধ করে দেই।
বিছানায় নিশ্চল শুয়ে থাকি। তারপর চিৎকার করে কাঁদি। শেষে ঘুমের অষুধ খেয়ে ঘুমাই।
সকালের দিকে স্বপ্নে দেখি শিহাবের সাথে গল্প করছি, আহ্লাদে গলে যাচ্ছি। ঘুম ভেঙে যায় নাকের ব্যথায়। নাকফুলের
চারপাশে টিশুপেপার চেপে ধরি। স্বপ্নে তাকে এত জীবন্ত, এত সত্য মনে হয়েছে যেন তার শরীরের গন্ধ আমার
গায়ে লেগে আছে। আয়নায় দেখি নাকের চারপাশে রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে আছে। বামপাশের
চোখ ফুলে বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। মনে মনে বলি,
শিহাব, কুত্তার বাচ্চা, আই হেইট ইউ।
সকাল নয়টার দিকে শিহাবকে মোবাইলে ফোন করি। বেশ কিছুক্ষণ রিং
বাজার পর সে ফোনটা ধরে। দুইবার হ্যালো
বলি। সে আমার গলা শুনে লাইন কেটে দেয়। আবার ফোন করি। রিসিভ করে না। এই অপমান আমার
নিয়তি। তা না হলে এত বন্ধু-আপনজন থাকার পরও তাকে কেন ফোন দেই? ঘর অন্ধকার করে বিছানায় শুয়ে থাকি কিছুক্ষণ।
তারপর একটা কাগজে লিখি, “লিরা, মাফ করে দিস মা’কে।” তারপর ম্যাচ জ্বেলে দেই
আমার নাইট গাউনে। আমার দু’পা জুড়ে দাউ দাউ আগুন উপরে উঠছে। তীব্র ব্যথায় আর আগুনের
উন্মত্ত শিখা দেখে মনে হয় মারা যাচ্ছি এখন। যন্ত্রণা অসহ্য হয়ে ওঠে। রুমের দরজা
খুলে করিডোর ধরে ছুটে রান্নাঘরে যাই। কাজের মেয়ে রাহেলা প্রথম দেখে আমাকে। তার
বিলাপ আর চিৎকারে বাড়ির সবাই জড়ো হয়। কেউ একজন পানি ঢালে আমার গায়ে। তারপর সম্ভবত
বেহুশ হয়ে যাই।
ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে আমার চারপাশে শায়লা, রাজন,
রহমত, লায়লি সবাই। স্যালাইন দেওয়া। ডাক্তার
ড্রেসিং করছে। ডাক্তার আস্বস্ত করে,
“ঠিক
হয়ে যাবে, ইনশাল্লাহ।” রাজন কানের
কাছে এসে বলে, “কেন এমন করলা, সোনা?”
শায়লা
বলছে, “আল্লাহ বাঁচাইছে, চুলে আগুনটা লাগে নাই। চুলে পৌঁছাইয়া গেলে
তোমারে কেউ বাঁচাইতে পারত না।”
একদিন পর-পর ড্রেসিং করে। অ্যানেসথিসিয়া দেয়। ঘুমের উপর
ভাসতে-ভাসতে অনেকগুলি বর্গাকার, সাদা-সাদা ঘর
পার হই। একটা সাদা-এপ্রন নার্সকে দেখা যায়। তাকে প্রাণপণ বলতে চাই, আমাকে একটা টেলিফোন দাও, শিহাবকে শুধু বলব আমি মারা যাচ্ছি।
রাজন আমাকে ব্যাংককে পাঠানোর আয়োজন করে। লিরা ফোনে কাঁদে, “তুমি তো আমার আম্মু, তুমিই বাবা। কেন একবারও আমার কথা ভাবো নাই?”
লিরা শায়লাকে বলেছে,
যতদ্রুতসম্ভব
যেন ব্যাংকক নিয়ে যায় আমাকে। পরের ফ্লাইটে সে ব্যাংকক যাবে। শায়লা যাচ্ছে আমার
সাথে। রাজন ঢাকা এয়ারপোর্টে বিদায় দেয়। লোকজনের সামনেই আমার মাথায়, কপালে চুমু খায়। স্টেচারে যখন আমাকে নিয়ে
যাচ্ছে তার মুঠোবন্দি আমার হাতটা ছেড়ে দেয় সে। ওর দু’গাল বেয়ে পানি গড়াচ্ছে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন