কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৫

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

বর্ণমালার সাতকাহন

 


পর্ব ১৯  

অনিশ্চিত পর্ব

কুটকুটে রোদ্দুরে এক রাউন্ড পাক মেরে এলাম বাজার থেকে। আশ্বিন মাসের বেলা। এই পাড়া, এই ওভারব্রীজের ওপর দিয়ে ঝমঝম করে চলে যাওয়া আসা ট্রেন, কয়লাপট্টি, কামারপাড়া সব এক নেই। যেখানে টিলার মাথায় ট্রেন যাবার রেলপথ নিচে ফিতের মতো রাস্তার ওপারে আরেক পাহাড়__কয়লার পাহাড়, মানুষের চেয়ে বিরাট বিরাট দাঁড়িপাল্লা ছিল... সেসব নেই।

এখানেই আমি বেড়ে উঠেছি। সেসব পুকুর আর গাছে টিঁয়ার ঝাঁক, আর নেই। প্রাকৃতিক ভারসাম্য, উষ্ণায়ন প্রভৃতি তত্বকথা-ফথা কেউ মানে না ভাই। তাই আমাদের গাঁ এখন শহর। এখানে অনেক বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ি আর দোকান, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা বাসিন্দারা মানে গত ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে যারা ছিল বা আছে তারা পাল্টায়নি। পনের বছর পর আমার নিজের এই পাড়ায় ফিরে এসে দেখলাম আমার শৈশবের বন্ধুরা ছেলে থেকে লোক হয়ে গেছে, কাকুদের মাথায় সাদা চুল সামান্য অথবা টাক, মুখে ভাঁজ, কাকিমাদের চলতে কষ্ট বাতের ব্যথা। কিন্তু আমরা কেউ পাল্টাইনি। তাই কিছুদিনের মধ্যেই আবার বন্ধুদের সঙ্গে পুনর্মিলন হলো।

এখনও তাই বাজার যাওয়া মানে এক পশলা আড্ডা। আমরা এখনও পাতি পাবলিক। আড্ডা দিই পকেটে মোবাইল রেখে চা দোকানের বেঞ্চিতে, পানের দোকানের সামনে অথবা লম্বা সিঁড়িটায় যেখানে বিভিন্ন সময়ের স্লটে পরপর আড্ডা বসে সিনিয়র জুনিয়র ও আমাদের মতো মধ্য গগনদের।

সংক্ষিপ্ত আড্ডার পর পা বাড়াতেই দেখলাম অল্প বয়সী মেয়েটি মুদিখানা থেকে জিনিস কিনে এই অপরিসীম সাধারণ রাস্তার মাঝে সেল্ফি তাক করছে, একটি বাইক সজোরে ব্রেক কষে থতমত তার পেছনে রিকশা এবং একটি গাড়ি এবং আরো একটি বাইক। এসব থেকে মন উড়ে গেল অন্য দিকে। আসলে আমরা বন্ধুরা বেশ ঘেঁটে গেছি। বলা বাহুল্য ছেলেবেলার এই বন্ধুবৃত্তে কেউ  ইঞ্জিনিয়ার কেউ বাবার ব্যবসা, কেউ টুকটাক অথবা কিছুই করে না জাস্ট ভ্যারেন্ডা ভাজে, ছেলে কিম্বা মেয়ে, সেখানে স্টেটাস একটাই_বন্ধু। ফারাক  পড়েনি কখনও, কিন্তু পড়েনি যে ঠিক তা নাহলেও বন্ধুত্বের বাতাসে উড়ে গেছে সেসব।

কিন্তু সুরঞ্জন, ডাক নাম যার তোতন, সে বিট্রে করেছে। আমাদের ধোঁকা দিয়েছে। রিসেন্টলি আরকি, সেজন্য আমরা ... আমাদের মধ্যে ওই একমাত্র বোহেমিয়ান টাইপ। তেমন কোনও চাকরি করত না বাঁধাধরা। করত না মানে পায়নি। তাতে অসুবিধা ছিল না এই এত বয়স অবধি। দুই দাদা মাথার ওপর আর বাবার বাড়িতে থাকা। ডাল ভাত জুটেই যেত।

কখনও মন্দারমণিতে হোটেল ম্যানেজার, কখনও ফিজিও থেরাপির কাজ, কখনও ইন্সুরেন্স এজেন্ট কিম্বা মাঝে মাঝে কাঠ বেকার তোতোনকে আমরা খুব খ্যাপাতাম। আসলে আপাতত একমাত্র তোতন আমাদের মধ্যে কনফার্মড ব্যাচেলর ছিল।

আমার এই গ্রাম কাম মফস্বলে প্রত্যাবর্তনের পরে একমাত্র তোতোনের মধ্যেই দেখেছিলাম দৃষ্টিতে অদ্ভুত একটা স্নেহের ভাব। যেমন গত সপ্তাহেই পানের দোকানের সামনে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট, খুব খানিক আড্ডার পর মাথায় হাত রেখে হেসে চলে গেল যেন কত বড় দাদাটা। আগে খেয়াল করিনি কিন্তু এই সব এখন মনে পড়ছে। আগে খেয়াল করিনি। গত তিনদিন। কারণ গত তিনদিন আগে ভাই সন্ধ্যায় ফোন করেছিল। দিদির সঙ্গে আড্ডা দেবার মতো ভাই-বোনের সেদিন গেছে। কিন্তু ভাই সেদিন ফোন করল। আর বলল, কিন্তু আমি ভাবলাম ভুল যদিও, বললে তোদের বন্ধু তোতন সুইসাইড করেছে। সেই থেকে ভেবে যাচ্ছি আমরা এমন কী কারণ যা আমরা জানলাম না। ক্রমে আমরা-টা প্রধান হয়ে উঠেছে মরণটা ছাপিয়ে। আমাদের ভীষণ ইগো হার্ট হয়েছে। আমরা শোকের চেয়ে ক্রুদ্ধ। একটা সিগারেট হাফ শেয়ার করে যারা খায় যদিও পুরনো অভ্যাসে, আজও খায়, তারা। বাবলু ড্রাঙ্ক হয়ে গিয়ে একটাই কথা বিড়বিড় করছে, অমিত, প্রভাত আমরা একটাই কথা ভাবছি। একবার, একবার বলতে পারলি না কী সমস্যা। জাস্ট একবার। মরতিস কিন্তু বলতে ক্ষতি ছিল না। তোতন সুইসাইড করল কেন?

এই বিস্ময় একদিন একদিন করে পুরনো হবার পথে এক রাতে বাবলু ফের বলল-

--"কেন মরল তোতন?"

বাবলু ইঞ্জিনিয়ার। ছোটো থেকে ভালো ছেলের তকমা, হাসির পাত্র ছিল যতক্ষণ না ইঞ্জিনিয়ারিং

হোস্টেলে গিয়ে জীবন জানল। ওর বাবা বাংলার মাস্টারমশাই ছিলেন আমাদের। বাবলু চাকরি ছেড়ে ফিরে  এসেছে পাড়ায়। স্যর মারা যাবার পরে কাকিমা একদম শয্যাগত। মানসিকভাবে পঙ্গু। বাবলু ড্রাঙ্ক। রাস্তা শুনশান যার যার ফেরার পথ ধরতে চৌমাথায়। এমন সময় বাবলু আবার বলল কথাটা-

--"পাঁচদিন আগে ফোন করেছিল তোতন"। 

__"কিছু বলেছিল?" চারজন সমস্বরে বলে উঠল।

--“হুম, তখন তো আমি জয়পুর কাজে গেছিলাম”।

অমিত বলল ,"কী বলল?"

সকলের পা থেমে আছে। বাবলু সবার মুখের দিকে তাকাল। ধীরে ধীরে মাথা নিচু করল-

--"বলছিল একটু টাকা জি পে করে দিবি, খুব বিপদ!"

মুখটা কালচে লাগছে বাবলুর। অন্ধকার।

--“কত?” 

--“একহাজার”।

--“তোর কাছে আগে চেয়েছিল?”

অমিত জিজ্ঞেস করল-

--“না, সেদিন প্রথম”।

--“দিলি?” প্রভাত চেয়ে আছে।

--"না, বললাম কলকাতা ফিরে তারপর দিচ্ছি”। বাবলু একবার সবার মুখের দিকে তাকাল। তারপর মাথা নিচু করে অস্ফুটে বলল-

--"আমি বুঝতে পারিনি রে। ভুল…"

--“কী বুঝতে পারিসনি, যে লাখখানেক মাইনে পাস তবু বন্ধুকে জি পে করতে হাত উঠল না, কোনটা বুঝতে পারিসনি?”

না। আমরা জিজ্ঞেস করিনি বাবলুকে। আমরা আর কেউ কথা বলিনি। তারপর থেকে আমরা আর আড্ডা দিইনি।

চা দোকানের বেঞ্চি ফাঁকা থাকে। আমাদের আস্থা টলে গেছে। পরস্পরের প্রতি কিম্বা নিজের প্রতি... কিম্বা ভালোবাসার প্রতি।

(ক্রমশ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন