কবিতার কালিমাটি ১৪১ |
বিষ্ণুধাম
হেমন্তের পড়ন্ত
বিকেলে,
ঘড়িতে বাজে সাড়ে
চারটে।
কাল কালীপুজো।
কুমোরটুলির
স্যাঁতলা গলি,
সোঁদা মাটি আর
কাঁচা রঙ,
ঝাঁঝলা গন্ধ নাকে
লাগছে।
মাধবীলতা হাঁটছে
ভিড় বাঁচিয়ে,
যুবকের পাশে পাশে।
চোখেমুখে চিন্তার
ছাপ,
কাল পুজো বাড়িতে,
তবু আজ এসেছে,
যুবকের কাছে, দেখা করতে।
অনিশ্চিত ভবিষ্যত,
বিয়ের দোরগোড়া থেকে
ফিরে গেছে এ
সম্পর্ক।
থমকে তার পরিণতি।
লুকিয়ে দেখা যুবকের
সাথে,
বাড়ির ছোটমেয়ে,
বংশের একমাত্র
প্রদীপ,
পুজোর আগে মিথ্যে
বলে আসা,
খচখচ করছিল মনটা।
ঠাকুর নিয়ে যাওয়ার
পালা,
শোরগোলের মাঝেই
ঘুমোচ্ছে ক্লান্ত
শিল্পী,
শিবের বুকে মাথা
রেখে,
আধা রঙ করা।
নর্দমা লাগোয়া
রাস্তায়
মাটির লেপন হাতে
মেখেই
বিড়িতে টান দিচ্ছে
বুড়ো দাদু।
মাধবীলতা থমকায়
কলপাড়ে,
একটা আধ পাগল ছেলে,
দেখছে হেমন্তের
কুমোরটুলি,
আধপোড়া বিড়ি
দাঁতে চেপে।
নোংরা আধোয়া জামা,
উশকো-খুশকো চুল,
লোকে তাকে চেনে
পাগল বলেই।
ওর সঙ্গে প্রায়
সমবয়সি একটি মেয়ে।
গায়ে কাপড়ের
অস্তিত্বটা বড় বিকট,
ছেঁড়া কাপড়ের
পোঁটলা গলায় ঝোলানো,
পরনে লজ্জা
নিবারণের বিন্দুটুকু নেই।
ছেলেটার একটা হাত,
জাপটে ধরে আছে
মেয়েটি।
লালা পড়ছে মুখ
থেকে, অনবরত।
ছেলেটির অন্য হাতে
একটা আঁকার খাতা আর
ভাঙা পেন্সিল।
ও পাড়ার লোকেরা
অভ্যস্ত,
ওদের এভাবেই দেখতে।
কখনও রাস্তায় পড়ে
থাকে,
এঁটো পাত কুড়িয়ে
চাটে,
কখনও নিজেদের মনেই
বিড়বিড় করে।
থাকে রেললাইনের
কাছেই একটা বস্তিতে।
রাতে বসে থাকে,
সামনের কাশীমিত্র
শ্মশানের ঘাটে।
ওদের বাস
কুকুর-বেড়ালের সঙ্গে,
আঁচড়া-আঁচড়ি
করেই।
৫নং কুমোরটুলি
স্ট্রিট।
কবিরাজ বিজয়রত্ন
সেনের বাড়ি,
রোয়াকটায় বসে
ওরা।
উল্টোদিকে
বিষ্ণুধাম,
পুরনো তিনতলা বাড়ি,
হলদে, রঙচটা।
পলেস্তরা খসা থাম,
খাঁজে খাঁজে গোঁজা
টুথপেস্টের টিউব,
বাইরের দেয়ালে
ঝুলছে,
ঠাকুরদেবতার ছবি।
ছেলেটিকে নজর করে,
পিছু নেয় মাধবী।
ছেলেটি আঁকার
খাতাটা খোলে,
ভাঙা পেন্সিল দিয়ে
ছবি আঁকে।
বিষ্ণুধামের সামনে
বেঞ্চিতে বসে এক প্রৌঢ়।
আদুড় গা, শ্যামলা চকচকে,
গলায় একটা লাল কার,
তাতে তিনটে
রুদ্রাক্ষ,
ডান হাতে তাবিজ।
নাপিত দাড়ি কেটে
দিচ্ছে,
নুরুন দিয়ে।
পাশের সিঁড়িতে বসে
দেখছেন,
আর একজন প্রৌঢ়।
ছবিটা এঁকে ছেলেটা
বসে।
সামনে দিয়ে একজন
হেঁটে যায়।
চটিপরা পায়ের ফাঁক
দিয়ে
ছেলেটি দেখে
বেঞ্চিতে বসা লোকটাকে।
মাধবী একভাবে
তাকিয়ে সেদিকে,
পথ চলতি লোকেরা বলে,
“ছেলেটা প্রায় আসে
এখানে,
মেয়েটাকে সঙ্গে
নিয়ে।
বসে ছবি আঁকে,
শুধু এই বাড়িটার।
তারপর তাকায়,
তিনতলার চিলেকোঠার
দিকে,
উঠে চলে যায়।”
মাধবী জানতে পারে,
বিয়ে করে ছেলেটি
পাগলি মেয়েটাকে, ভালোবেসে।
বিষ্ণুধামের এক
উত্তরাধিকারি,
ঠাঁই হয় বাড়ির
বাইরে।
পৈতৃক ভিটে,
মায়ার বড় ভার।
রয়ে যায় কাছের
বস্তিতে।
চাকরি জোটেনি, তা ভুল,
চাকরির চেষ্টাটুকুও
করেনি,
প্রাকৃতিক জীবনের
যাপনে।
ওরা ভীষণ আদিম।
এ গলির মায়া বড়
অদ্ভুত।
ছেলেটি চেষ্টা
করেছিল,
মেয়েটাকে সুস্থ
জীবন দিতে,
শহরের বুকে ভদ্র
পাড়ায়।
মেয়েটি নিখোঁজ হত
বারবার,
পাওয়া যেত কুমোরটুলির
অলিতে গলিতে।
জানতে পারে পরে, সবটাই।
ছেলেটি তাই আর ভুল
করেনি।
ছোট্ট শ্বাস ফেলে
মাধবী,
ছেলেটি জানে,
সোনাগাছি আর
কুমোরটুলির দু’টো গলি,
মিশেছে একটাই বড়
রাস্তায়।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন