কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১৩৭

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১৩৭

শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫

সাইদুর রহমান

 

সমকালীন ছোটগল্প


সেলফি

বছর দেড়েক হল প্রিয়া নিউ দিল্লীর এই নতুন অ্যাপার্টমেন্টে উঠেছে। ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট। কিন্তু স্টাইলিশ। সাদা অফ হোয়াইট দেয়ালের প্রতিটি কোণের উপরে প্যাস্টেল সেড, পূবদিকের দেয়ালে থ্রি-ডি ওয়াল পেপার। কোণাকুণি দুখানা ঘর। একখানা শোবার, আরেকখানা রিডিংরুম। রিডিংরুমেও সুন্দর কারুকার্য। একদিকের দেয়াল ভিনিসিয়ান প্লাস্টার করা। ওয়াল হ্যাংগিংয়ে ফ্রেমে বাঁধানো রাতপরীদের স্বপ্নরঙীন ক্যানভাস আর কিছু পেন্টিং দেয়াল জুড়ে একটা ক্লাসিক লুক এনে দিয়েছে। দেয়ালের এক কোণে একটা বড় আয়না। আয়নার পাশে একটি ছোট্ট বুনোগাছ। প্রিয়া সারাদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের কন্টেণ্ট তৈরি করত। আর মাঝে মাঝে এসে আয়নার পাশে বসে সেলফি নিত। তারপর সেই সেলফিকে ফিল্টার করে ইনস্টাগ্রামে দিত। তারপর গোটা ইনস্টাগ্রাম জুড়ে বয়ে যেত লাইক আর কমেন্টস-এর বন্যা।

প্রিয়ার বয়স এখন চব্বিশ। ডিজিটাল কন্টেন্ট নির্মাতা। অনলাইন বন্ধুদের জন্য নিয়মিত সে ব্লগ, ভিডিও, ছবি, গ্রাফিক্স ও পডকাষ্ট তৈরি করে। তবে সে ইনস্টাগ্রামে বেশি সময় ধরে থাকে। ইন্সটাগ্রামে তার একটি সুন্দর প্রোফাইল তৈরি করা আছে। ইনস্টাগ্রামের প্রোফাইল পিকটাও খুব সুন্দর। একটি পাহাড়ী লেকের ধারে দাঁড়িয়ে। চোখে-মুখে মনোমুগ্ধকর নিখুঁত হাসি লেগে আছে। ব্লগ আর গ্রাফিক্সগুলো ফেসবুক, হোয়াইটস্য্যাপ শেয়ার করে। আর ভিডিও ছবি, পডকাস্ট শেয়ার করে বেশি ইনস্টাগ্রামে।

প্রোফাইলের লুকে প্রিয়াকে খুব আত্মবিশ্বাসী আর অবিশ্বাস্য সুন্দরী মনে হত। তার অনুসারীরা তার আত্মবিশ্বাস, তার ফ্যাশনসেন্স এবং তার ফিল্টারবিহীন সকালের ভিডিওগুলির জন্য অপেক্ষা করত, তাকে ভালোবাসত। যদিও তার কোনোটিই ফিল্টারবিহীন ছিল না। তার ইনস্টাগ্রাম এতই সাজানো যে বাস্তবের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। সে পাহাড়ের ধারে হেসে দাঁড়িয়ে আছে, লেকের পাড়ে চুল উড়িয়ে দিয়েছে - সব নিখুঁত, সব নির্মল।

শুধু ছবিগুলো তোলা হত তার ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। হাজারবার চেষ্টা করে। হাজারভাবে ফিল্টার দিয়ে। হাজার শব্দের ক্যাপশন তৈরি করে।

সবাই জানে প্রিয়ার অত্যন্ত সুখী জীবন। কিন্তু ভেতরে সে একা। একটা অদ্ভুত যন্ত্রণা তাকে প্রতিদিন পোড়ায়। সে যত বেশি সেলফি নেয়, তত বেশি মনে হয় -  নিজেকে সে হারাচ্ছে।

প্রিয়ার রিডিংরুমের ভেনিসিয়ান প্লাস্টারে মোড়ানো ধূসর-রূপালি দেয়ালের পাশে একটি বড় আয়না আছে। আয়নার পাশে ছোট একটা বুনোগাছ। গাছটার পাতাগুলো অদ্ভুতভাবে সবুজ। প্রিয়ার মনে হয় – এটা যেন একমাত্র জীবন্তবন্ধু। প্রিয়া সন্ধ্যায় এসে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। মোবাইলের ক্যামেরা অন করে।

তারপর - ক্লিক। ক্লিক। ক্লিক।

মুহূর্তে হাসি জমে যায় তার মুখে। চোখে কৃত্রিম উজ্জ্বলতা। ঠোঁটের কোণে সাজানো আনন্দ। তারপর ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামে আপলোড হতে থাকে ছবি। মুহূর্তে বয়ে যায় লাইক আর কমেন্টের বন্যা। প্রিয়া লাইকের বন্যায় ভাসতে ভাসতে ঘুমিয়ে পড়ে।

একদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলল। ফিল্টার করতে গিয়ে মনে হল ছবিতে অন্য কিছু বলছে। ছবি তার নিজের, কিন্তু চোখের দৃষ্টি, ঠোঁটের বাঁক, গালের টোল - সব যেন অদ্ভুতভাবে আলাদা। আর অস্বাভাবিকভাবে জীবন্ত। ছবিতে সে বেশি হাসছে, বেশি উজ্জ্বল, যেন তার ভেতরের ছায়া নেই। যেন এক অন্য ‘প্রিয়া’। প্রিয়া কিছুক্ষণ স্থির হয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকল।

তার মনে হলো - এই মেয়েটা আমি নই। আয়নার ছবিতে সে ক্লান্ত, শূন্য। কিন্তু ছবিতে মেয়েটা দীপ্ত, আলো ছড়ানো। এটা কি ফিল্টারের খেলা? না কি অন্য কিছু? নাকি মোবাইলে নতুন কোনো সফটওয়্যার আপলোড হয়েছে!

প্রিয়ার হঠাৎ মনে হলো - আয়নার ওপাশে কেউ আছে। সে আয়নার দিকে বার বার তাকাল। কিছু বুঝতে পারলনা।

দিন কয়েক পর আরও একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আবার প্রিয়ার ইনস্টাগ্রামে একদিন নোটিফিকেশন এলো - তার ছবি দিয়ে কেউ ফেক অ্যাকাউন্ট খুলেছে। প্রোফাইল পিকে তার সেই রহস্যময় সুন্দর সেলফি। ওই ছবিটাই যা দেখে প্রিয়া নিজেকেই চিনতে পারেনি। অ্যাকাউন্টের বায়ো - “Becoming the real me!” ছবিগুলো সব প্রিয়ার পুরনো ছবির চেয়েও নিখুঁত, আরও বেশি ঝকঝকে, আরও বেশি ফিল্টার করা। প্রিয়ার মনে হল কোনওদিন সে এমন ছবি আপলোড করেনি।

ছবির ক্যাপশনগুলোও অদ্ভুত – ‘আজ আমি ভেতরের অন্ধকারকে অস্বীকার করলাম।’ ‘আমি এখন সম্পূর্ণ।’ ‘আমি সেই প্রিয়া, যে প্রিয়া হতে চেয়েছিল।’

এগুলো পড়তে পড়তে তার গা শিউরে উঠল। কে এই ছবি পোস্ট করছে? কার কাছ থেকে পেল এই অদ্ভুত ছবি!

হঠাৎ তার মনে হলো - এগুলো এমন সেই ছবি সে যা হতে চেয়েছিল, কিন্তু কখনও হতে পারেনি। সেই মেয়েটা - ঐ ছবির প্রিয়া - কেউ তাকে নিজের করে ব্যবহার করছে। যেন তার চেয়ে সুন্দর, শক্তিশালী এক সংস্করণ ইন্টারনেটে ভেসে বেড়াচ্ছে।

আর সে? সে দাঁড়িয়ে আছে তারই ছায়ার পাশে।

প্রিয়া অবাক হয়ে দেখল - সেই ফেক প্রোফাইলের ফলোয়ার বাড়ছে। লাইক-কমেন্টসের বন্যা বইছে। মানুষ সেই প্রিয়াকে ভালোবাসছে - যাকে বাস্তবে কেউ কখনও দেখেনি।

একরাতে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে বসে প্রিয়ার হঠাৎ খুব কাঁদতে ইচ্ছে করল। সে বুঝতে পারছিল, মানুষ আসলে তাকে ভালোবাসছে না। ভালোবাসছে তার তৈরি করা এক নিখুঁত প্রতিরূপকে। তার হাসি মেকি।

তার ছবি সাজানো। তার ভেতরে সবসময় একটা ভয় - কেউ যদি তার সত্যিকারের মুখটা দেখে?

‘আমি কি সত্যিই আছি?’ প্রিয়া নিজেকে প্রশ্ন করল।

ঠিক এই মুহূর্তেই রিডিংরুমের আয়নাটা ধীরে ধীরে কাঁপতে শুরু করল। জানালা বন্ধ, কিন্তু একটা হাওয়ার ঢেউ উঠে এল ঘর জুড়ে। প্রিয়া ভাবল – এটা সে ভুল দেখছে।

কিন্তু না। এরপরেই দেখল আয়নাটা যেন ভিতর থেকে আলো ছড়াচ্ছে। আর তাতে একটি মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সে তার তার নিজের মুখ। স্থিরভাবে সেই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল প্রিয়া। মুখটা স্পষ্ট, অকৃত্রিম। সেলফিতে যে মুখটা দেখে সে মুখটা নিখুঁত, ঝকঝকে, উজ্জ্বল, তাকে সে চিনতে পারে না। প্রিয়া দেখল আয়নার ভিতর থেকে গভীর, তীক্ষ্ণ, নির্মম দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে সেই মুখ।

প্রিয়া ভয়ে পেছনে সরে গেল। সাথে সাথে আয়নার ভিতরকার ‘প্রিয়া’ ঠোঁট নড়াল, “তুমি কে?”

প্রিয়ার শরীর হঠাৎ যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বুকের ভেতর বয়ে গেল হিমশীতল হাওয়া। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে প্রিয়া বলল, “আমি? তুমি কে? কে তুমি!”
আয়নার মেয়েটি মৃদু হাসল। একটা নিখুঁত, অকৃত্রিম হাসি। বলল, “আমি!” তারপর মুচকি হাসল। আবার বলল, “আমি আসলে সেই তুমি - যাকে তুমি সবার সামনে দেখাতে চাও। আমি তোমার সেলফির ভিতরকার সেই তুমি।”

সহসা প্রিয়া যেন নিঃশ্বাস হারিয়ে ফেলল। তার সামনে কে দাঁড়িয়ে।

আয়নার মেয়েটি আবার বলল, “তুমি নিজেকে লুকাও। আমি নিজেকে দেখাই। তুমি ক্লান্ত। আমি নিখুঁত। তুমি ভেতরে ফাঁকা। আমি পরিপূর্ণ।”

“তুমি আমার ছবি নিয়ে নতুন অ্যাকাউন্ট বানিয়েছ?” প্রিয়া দাঁত চেপে কঠিনভাবে বলল।

আয়নার মুখ আবার হেসে উঠল। বলল, “না। তুমি তো আমার ছবি তুলেছ সবসময়। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ। এখন আমিই তোমাকে মুছে দিচ্ছি।”

আর এই সময় খুব জোরে একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল। কেঁপে কেঁপে নড়ে উঠল আয়নাটা। ভেঙে গেল না। কিন্তু তাতে আয়নামুখটি আরও বড় হয়ে উঠল। তার দৃষ্টি আরও গভীর, তীক্ষ্ণ। বলল, “তুমি নিজেকে ভুলে গেছ, প্রিয়া। তুমি নিজের সাথে কোনওদিন সেলফি করোনি। সবসময় করেছ লোকদের জন্য, লাইকের জন্য। এখন তোমাকে নিজের সেলফিতে ফিরিয়ে নিতে এলাম।”

প্রিয়া কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। তার চোখ যেন ঝাপসা হয়ে গেছে। মনের ভেতরে অদ্ভুত ভয়। বুকের ভেতর সহসা যন্ত্রণা।

এই সময় হঠাৎ আয়নার আলো নিভে গেল। চারদিক অন্ধকার। অন্ধকারের ভেতর একটি কণ্ঠ - একদম নরম, কিন্তু তীক্ষ্ণ, “কতদিন হলো তুমি নিজের সাথে কথা বলেনি, প্রিয়া?”

সহসা প্রিয়ার মনের মধ্যে নিঃশব্দে কান্না উঠে এল। তার ইচ্ছে হল জোরে জোরে সে কাঁদে। কিন্ত শব্দ বেরোল না।

আয়নার মুখ আবার বলতে শুরু করল, “কতদিন হলো তুমি কারও হাতে হাত রাখনি? কারও সামনে নিজের দুর্বলতা স্বীকার করোনি? তোমার সব হাসি তো ফিল্টারে তৈরি - কেউ কি তোমার সত্যিকারের কান্না দেখেছে?”

এবার ভেঙে পড়ল প্রিয়া। চোখের জল বেঁধে রাখতে পারল না। দুই গালের উপর দিয়ে জল নীরবে গড়িয়ে পড়তে শুরু করল।

ফিসফিস করে সে বলল, “আমি একা। ভীষণ একা।”
অন্ধকারে আয়নার মুখ উষ্ণ কণ্ঠ বলল, “হ্যাঁ। আর সেই একাকীত্বই আমাকে তৈরি করেছে। তুমি নিজেকে যত ফাঁকি দাও - আমি তত শক্তিশালী হই।”

একটু পরে ধীরে ধীরে আলো ফিরে এলো। দেখা গেল আয়নার ভিতরকার মেয়েটা আর তত ঝকঝকে নেই। ক্লান্ত মনে হচ্ছে তাকে। সেলফির সৌন্দর্য ফুরিয়ে আসছিল। ধীরে ধীরে ফিল্টারের আলো কমে গিয়েছিল।

হঠাৎ আয়নার ভিতরকার প্রিয়া হাত বাড়াল আয়নার কাচের ভেতর থেকে। কাচ ভেদ করে বেরিয়ে এলো হাত। ভয়ে পেয়ে প্রিয়া আরও পিছিয়ে গেল।

আয়নার প্রিয়া বলল, “চলো। চলো আমার ভেতরে। যেখানে তুমি সত্যি করে হাসতে পারবে। যেখানে লাইক নেই, ফিল্টার নেই, শুধু তুমি আছ।”

পিছোতে পিছোতে থামল প্রিয়া। তারপর সামনের দিকে এগিয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে সেও হাত বাড়াল। তারপর তার হাত জোরে চেপে ধরল সে।

হঠাৎ আয়নাটা কেঁপে উঠল। এক ঝলক আলো বেরিয়ে এল আয়না থেকে।

তারপর সব শান্ত। যখন আলো ফিরল, দেখা গেল - আয়নার সামনে কেউ নেই।

টেবিলের ওপর প্রিয়ার ফোনটা রাখা। ফোনের স্ক্রিনে ইনস্টাগ্রাম খোলা। সেই ফেক অ্যাকাউন্ট RealPriyaLive একটা নতুন ছবি পোস্ট করেছে। ছবিতে একটি মেয়ে, হাসছে না, পোজ দিচ্ছে না, ক্যামেরার দিকে তাকিয়েও নেই। সে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে খুব নরম, শান্ত, একদম ফিল্টারহীন আলোয়।

ছবির ক্যাপশন - “Finally, a real selfie. No filters. No lies. Just me.”


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন