মাওরিদের মঞ্চে
“একদম চুপ, কোন শব্দ নয়, ওদের কাছে বিষাক্ত তীর আছে আর অন্ধকারেও ওদের নিশানা কিন্তু অব্যর্থ”।
জমাট অন্ধকারে, পাতার হালকা শিরশিরানির
ফাঁক দিয়ে ভেসে এল জলদগম্ভীর অশুভবার্তা। দমবন্ধ করা অন্ধকার আকাশছোঁয়া বুনো গাছগুলোকেও
যেন পিষে ফেলছে। পরিষ্কার ইংরেজীতে ঐ চাপা ব্যারিটোন চারদিকের থমথমে আবহাওয়াকে আরো বিভীষিকাময় করে
তুললো। বুকের ভেতর অস্থির আশঙ্ক, কাঁপুনি ক্রমশ
ঊর্ধমুখী, কারণটা ঐ অস্বাভাবিক সতর্কবাণী। পাঁজর ফেটে বেরিয়ে এই অনৈসর্গিক নিস্তব্ধতা
ছত্রখান করে দেবে না তো? কঠোর, নিষ্ঠুর হাতে মাওরিদের নিজেদের একান্ত গোপনীয়তা রক্ষা
করার অনেক ইতিহাস শুনেছি।
ডনিউজিল্যান্ডের রোটোরিয়ার “হেল গেট জিওথারমাল পার্কে” কাদা স্নান আর গন্ধকের গরমজলে আরাম করে, চিত্তবিনোদনের পর আমাদের সান্ধ্য কর্মসূচী ছিল “মাওরি সংস্কৃতি”। মাওরিদের সম্পর্কে গভীর ঔৎসুক্য আমার, ওদের জীবনযাত্রা, সামাজিক বিচিত্র কর্মকান্ড, আর ওদের সাংস্কৃতিক স্রোতধারা। তারই সন্ধানে আপাতত আমরা একটা গভীর জংগলের মধ্যে দিশাহারা অন্ধকারে, অনিশ্চয়তার আতঙ্কে এসে পড়েছি।
কুড়ি বাইশ ফুট নীচে রূপালী ফিতের
আলোআঁধারীর খরস্রোত বেয়ে সরু লম্বা কয়েকটা নৌকো কিছু মানুষ নিয়ে তীরবেগে এগিয়ে আসছে। একেবারে সামনে সটান দাঁড়িয়ে
একজন বলিষ্ঠ মানুষ, হাতে মশাল, সবার মুখেই
রংচঙে মুখোশ বা চড়া উল্কি। দেহে অদ্ভুত, ভয়ঙ্কর আঁকাঝোঁকা, মশালের এলোপাথাড়ি
আলোছায়ায় বিভীষিকাময়। তার ভেতর থেকেই এক অস্বাভাবিক হাড় হিম করা কোরাস বেরোচ্ছে
- হেঃ হো, হোঃ হো, তালে তালে। আমাদের থেকে ফুট দশেক আগে ওদের গতি কমে কমে স্থির হল
নৌকার সারি, সর্দার দুহাত তুলে দলের সবাইকে
সংযত হতে বললো বোধহয় - ওপরে, ডাইনে, বাঁয়ে তার সন্দিগ্ধ চোখের মনি যে পাক খাচ্ছে,
সেটা অন্ধকারেও পরিষ্কার। হাতের সব ধনুক আর বর্শার কেন্দ্রীভূত নিশানা সম্ভাব্য লুক্কায়িত অজানা অনুপ্রবেশকারীদের দিকে উদ্যত
হয়ে আছে। আমাদের রক্তচাপ আর ফুসফুসের সঙ্গত তুঙ্গ, সামান্য নড়াচড়ার সরসরানি আমাদের
মধ্যে কারুর জন্য অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুবাণশ। গাইডের একটু আগেকার ইঙ্গিত কেউই ভুলতে
পারছি না।
সাবধানে বড় করে নিঃশ্বাস নিতে
পারলাম ওরা চলে যাবার পরই, যখন সম্মিলিত কোরাস আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল গাছ গাছপালার
আড়ালে।
আমাদের গাইড এবার সাধারণ স্বরেই বলে উঠলো, “ধন্যবাদ ।আপনাদের অখন্ড নিরবতার জন্যই কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি, এখন আমরা নিরাপদ। এবারে আমরা যাব মাওরিদের জীবনযাত্রার মঞ্চে।”
গাছপালা ঘেরা একটা পরিষ্কার আঙিনায়
আমাদের দাঁড় করালো গাইড।
আমাদের একজন লীডার ঠিক করতে হবে,
যে আমাদের হয়ে সর্দারের সঙ্গে পারস্পরিক যোগাযোগ করবে। তাকে কোন কথা বলতে হবে না,
আমরা কেউ কারোর কথা বুঝি না। কেবল শারীরিক ভঙ্গিমায় বোঝাতে হবে আমরা ওদের বন্ধু, ওদের
সঙ্গে চেনাজানা করতেই এসেছি। তবে তার আগে, পৃথিবীর কোন অংশ থেকে কে কজন এসেছেন সেটা
জেনে নিই। আমেরিকা? জাপান? অষ্ট্রেলিয়া? জার্মানী? আরব-রাষ্ট্র…”। প্রশ্নের সঙ্গে
সঙ্গে উৎসাহী জনতার হাতগুলি আকাশপথে আন্দোলিত হচ্ছে।
“আচ্ছা আজ তাহলে আমেরিকাই সংখ্যাগরিষ্ঠ,
তাই”! পৃথিবীর আঙ্গিনায় জন্মভূমির অপমান অসহ্য , আমার ভারতবর্ষ কোথায়? হয়তো ভারতীয়রা
এদেশের সম্পর্কে কম কৌতূহলী, হয়তো সংখ্যায় কমই আসেন, তবু ৭.৫ শতাংশ, প্রায় তিনলাখ
ভারতীয় এখানকার জনসাধারণের সেবা করে যাচ্ছেন নিরলস। ভারত নিউজিল্যান্ডকে ক্রিকেট জগতে
কম চোবানী খাওয়ায়নি! আমার সেই মাতৃভূমি উপেক্ষিত?
দেড়মিনিটও লাগল না, রীতার হাত
ধরে ভীড় কাটিয়ে গাইডের মুখোমুখি - দুফুটের মধ্যে। জনতার দিকে ফিরে হাত উঁচু করে
বললাম, “উই টু আর ইন্ডিয়ান!” শেষ শব্দটির ওপর ইচ্ছাকৃত জোর। ঐ দেশে সারা বিশ্বের নাগরিকদের
মধ্যে দাঁড়িয়ে “ইন্ডিয়ান” শব্দটা বুক থেকে উথলে বের হয়ে এল এক স্বতস্ফূর্ত আবেগে।
মুহূর্তে অবর্ণনীয় আনন্দে দুচোখের বাষ্পে দৃষ্টি ঝাপসা। আবছা আচ্ছন্নতার ভেতর দিয়ে
দেখলাম পাঁচ সাতজন পর্যটক দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল আমাদের, চারদিকে অন্ধকার বনের ছায়াতে
তখন সমবেত করতালিতে হাজার পায়রার পাখা ঝাপটে উড়ে যাবার প্রতিধ্বনি। হৃদয় উপছে পড়ছে
গর্বে, তার ঝলকানিতে আমার চোখ মুখ সর্বাঙ্গ এখন আলোকিত। “ওয়েল কাম ইন্ডিয়া, ওয়লকাম”
- গাইডের গাঢ় করমর্দন, নাম জিজ্ঞেস করে, পিঠ চাপড়ে আমাকে ভীড়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে
এবার আমাদের নির্বাচিত লিডারকে নিয়ে পড়লেন।
-“সর্দার এসে ওদের রীতি অনুযায়ী
নানা অঙ্গভঙ্গি করে পরীক্ষা করবে আমাদের কোন খারাপ অভিসন্ধি আছে কি না! আমাদের সমাজে ঐ রকম অভিব্যক্তি হাস্যকর
মনে হতে পারে কিন্তু তুমি বা তোমরা, কেউ হাসবে না, ওটা ওদের পক্ষে অত্যন্ত অপমানকর।
জন, তুমি সোজা চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকবে। একবার সন্দেহের অবসান হলে ও তোমাকে ফুল-পাতা
দিয়ে অভ্যর্থানা করবে নানারকম দেহভঙ্গিমা করে - একদম অনড় থাকবে তুমি। তারপর, ও যা যা করবে তুমি ঠিক তা-ই
করবে। ততক্ষণে ওদের ছেলেমেয়েরা এসে হয়তো বর্শা বল্লম নিয়ে নাচ-গান শুরু করবে, তোমরা
দর্শকেরা, হাততালি দিয়ে সবসময়ে ওদের উৎসাহ দেবে। সেটাই ওরা আশা করবে। কিন্তু হাসাহাসি
নয়, কোনরকম তুচ্ছ তাচ্ছিল্য নয়। দর্শকরা পরস্পরের সঙ্গে কোন কথাও বোলো না প্লীজ্!
কোনমতেই ওদের কালচারকে ছোট করা যাবে না - খুব সাবধান! তিনবছর আগে এই নিয়ে একজনের প্রায়
প্রাণহানির জোগাড় হয়েছিল”।
ততক্ষণে আলো অন্ধকারে জেগে উঠেছে
একটা গাছেঘেরা গ্রাম। সামনেই একটা বাড়ী, সম্ভ্রান্ত কারোর - সর্দারেরও হতে পারে মনে
হল। মানুষজন নেই, কেমন একটা ছমছমে অপ্রাকৃতিক নীরবতা নামছে গাছের পাতা, শিরা, উপশিরা
বেয়ে। ড্রাম জাতীয় বাদ্যযন্ত্রের একটা ভীতিকর তাল বুকের গুরগুরানিটা বাড়িয়ে তুলছে।
হঠাৎ চড়া আলোকবৃত্তের মধ্যে রহস্যময় রংচঙে উল্কি ছাপানো বলিষ্ঠ, পেটানো চেহারার এক ব্যক্তির আবির্ভাব, সর্দারই হবে। হাতে বর্শা জাতীয় দন্ড - দামামার ভয়ানক তালের সঙ্গে সঙ্গে রাগান্বিত পদক্ষেপে সে ঘুরিয়ে যাচ্ছে, জনের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করেই। হঁশ হতেই সে উল্টোমুখে একলাফে এসে পড়ল জনের সামনে, আকস্মিকতায় অত শেখানোর পরও জনের ভারসাম্য হারিয়ে যৎ সামান্য অস্থিরতা আমার চোখ এড়ায়নি - আমাদের গাইড অলক্ষ্যে ইশারা করে ভরসা দিল ওকে। চলতে থাকলো সর্দারের অঙ্গভঙ্গি আর আস্ফালন - সত্যিই ভয় উদ্রেককারি। এর মধ্যেই সারি বেঁধে কিছু লড়াকু সশস্ত্র যুবক যুবতীর প্রবেশ, তীর ধনুক-ঢাল-বর্শা হাতে।
কেবল সর্দারের অনুমতির অপেক্ষা, মুহূর্তে ফালাফালা করে ফেলবে সন্দেহজনক আগন্তুককে। এর মধ্যেই হঠাৎ ঢাকের আওয়াজ থেমে গেল, সঙ্গে সঙ্গে সর্দারের উন্মত্ত ভঙ্গিমা স্তব্ধ। এখন সে সন্তর্পণে বকের অনুকরণে পায়ে পায়ে জনের দিকে একাগ্র দৃষ্টিতে এগোচ্ছে। চোখে অবিশ্বাস, তার সন্দিগ্ধ দৃষ্টি জনের চোখের মণিতে নিবদ্ধ। বর্শার উদ্যত ফলা জনের বুক বরাবর। ফুট তিনেকের মধ্যে মূর্তির মতো স্থির ঐ পাঁচফুট দশইঞ্চি কলেবর, মাঝে মাঝে মৃদু খোঁচায় মৃত্যুভয় অনিবার্য মনে হলেও গাইডের কথামত জন্ কিন্তু সোজা দাঁড়িয়ে। এ অবস্থায় দু:সহ ৩০-৩৫ সেকেন্ডের নিটোল স্তব্ধতা, সর্দার গভীর পর্যবেক্ষণে চোখে চোখ রেখে স্থির, কেবল যোদ্ধাদের অস্থির পায়ের অধৈর্য খসখসানি।
আমাদের রুদ্ধশ্বাস নীরব প্রার্থনা জন যেন ঘোর আতঙ্কে কোন অবাঞ্ছিত কাজ করে না বসে। ফুসফুসের সীমিত শক্তিতে কতক্ষণ আর দমকে শাসনে রাখা যায়!
হঠাৎই দেখলাম বর্শা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে, সর্দার যোদ্ধারা স্বাভাবিক তালে নড়াচড়া শুরু করল, সন্তর্পণে দু তিন-পা পেছিয়ে গেল আর কুটিরের পেছন থেকে দু চারজন সুসজ্জিতা যুবতী এসে পড়ল মঞ্চে। সর্দারের তীক্ষ্ণদৃষ্টি জনের সম্ভাব্য সঞ্চালনার ওপরেই। ওদের একজনের হাত থেকে কয়েকটা সবনপাতা নিয়ে সর্দার মাপা পদক্ষেপে উঠোনের মাঝখানে খুব আদরের সঙ্গে হাঁটু গেড়ে বসে মাটিতে নামিয়ে দিল।
একইভাবে পায়ে পায়ে পিছিয়ে গেল - চোখের প্রখর চাহনি তখনও জনের ওপর। গাইডের আঙ্গুলের খোঁচায় জনের ভীত হতভম্ব ভাবটা কেটে গেল, তার পরের ইশারাতে সে গাইডের সাথেই এক পা এক পা করে সেদিকে এগিয়ে গেল, একটু অনিশ্চিত বলেই মনে হচ্ছে তাকে। আবার কনুইয়ের গুঁতো - জন এবার হাঁটু গেড়ে পাতাগুলো তুলে বুকে নিয়ে আস্তে আস্তে পিছিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। সর্দার এখন বুক বাজাতে বাজাতে এক পা এক পা করে এগোচ্ছে, পেছোচ্ছে , আশপাশের অস্ত্রশস্ত্র একই তালে ঘুরে চলেছে, আর সেই গতিতে জনও গাইডের হাত ধরে পায়ে পায়ে ওর দিকে এগিয়ে চলেছে। পাতাগুলো যথাযথ সম্মানের সঙ্গে হাতবদল হল।
সর্বোচ্চ গ্রামে বেজে উঠলো নাকাড়া, সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছসিত যুবক যুবতীরা উদ্দাম নাচগান শুরু করে দিল।
সর্দার জড়িয়ে ধরলো জনকে, হস্তমর্দন করল গাইডের সঙ্গে আর আমাদের দিকে দুহাত নাড়িয়ে, মনে হল, অল ক্লিয়ারের সঙ্কেত দিল। অজস্র উল্কির ফাঁক দিয়ে ওর সরল হাসির ঝলক আমাদের কারোরই চোখ এড়াল না। নিশ্চিন্ত, আমরা বিপন্মুক্ত, অনেক আশা আর ঔৎসুক্য নিয়ে এতদূর আসাটা বিফলে যাবে না তাহলে! এরই ফাঁকে আবার এক বীর-পুরুষের পাণিপ্রার্থী সুন্দরীর সঙ্গে তাদের সম্প্রদায়ের গল্প কথা বিবরণের সূত্র ধরে তাদের আচার অনুষ্ঠানমত, সামাজিক বিয়ের দৃশ্যও দেখানো হল।
খাবার বিশাল হলটা আলোয় ঝলমলে। সর্দারের সঙ্গে এগোচ্ছি সবাই, মনের মধ্যে একটু আগের আপাত বিপজ্জনক পরিচিতি পর্বের রেশ। চোখে পড়ল মাটির নীচে এক বৃহৎকায় গর্তের মধ্যে একটি ভেড়া বা শূকরজাতীয় পশুর মাংস পোড়ানো সবে শেষ, চিড়বিড়ে আগুনের ফাঁক দিয়ে ধোঁয়ার নাচন।
দেখলাম, ঝলসানো দেহটিকে টেনে তোলার পরে নিখুঁত তৎপরতার সঙ্গে ওগুলো টুকরো করে সোজা খাবার টেবিলে সাজান হল। ঘরে ঢুকে এলাহি ব্যবস্থা দেখে হতবাক আমরা। সর্দারের হাতে মাইক্রোফোন, আমাদের সবাইকে আরও অবাক করে দিয়ে দৃপ্ত আমেরিকান উচ্চারণে স্বাগতম জানিয়েই আঙ্গুল তুলে দুই শ্বেতাঙ্গিনী তরুণীকে উদ্দেশ করে বলে উঠল, “তোমরা শো’য়ের সময় নিজেদের মধ্যে কথা বলে আর হাসাহাসি করে এ দেশের সংস্কৃতিকে অপমান করেছ, আর তুমি”, এবারের লক্ষ্য এক জাপাননন্দিনী - “অনবরত মোবাইল ঘেঁটে গেছ। এগুলো আমাদের দেশে চরম অভদ্রতা”। তারপরে বেশ কিছু ভর্ৎসনা, উপদেশ এবং ভবিষ্যতের জন্যে সাবধানবাণী পর্ব
ততক্ষণে চারপাশে হতবাক্ পর্যটকদের
ভীড় জমে গেছে। অবিশ্বাস্য লাগছে - যে মানুষদের ভাব ভঙ্গীতে, ইশারা ইঙ্গিতে, জঙ্গুলে
চলাফেরাতে এতক্ষণ আমরা বিপজ্জ্নক স্হানীয় অধিবাসী বলেই মনে করছিলাম (সত্যি সত্যিই
আদি-বসবাসকারী তারা, আলোকপ্রাপ্ত) তাদের অনেকেই যে পোষাক বদলে মেকআপ্ তুলে এতো সহজেই
শহুরে মানুষে রূপান্তরিত হতে পারে, কেউই ভাবতেই পারিনি আমরা। আন্তরিক অনুতাপ প্রকাশের
পরে সর্দারের কথামত বাকী উপস্থিত সব গ্রামবাসীদের কাছেও দুঃখ প্রকাশ করতে হল তাদের
তিনজনকে।
বড় বড় বাল্বের সম্মিলিত আলোর
তেজে তখন বিশাল খাবার ঘর অত্যুজ্জল। টেবিলের ওপর অতি আকর্ষণীয় রসাল, সুস্বাদু খাদ্যসম্ভার,
নিজের ইচ্ছামত যা ভাল লাগছে, দেখে বা অনুমানে, তা নিজেদেরই নিতে হবে - ঐ ‘বাফে’ আর
কী!
আর, সারা সময় ধরে গর্তের ভেতর যে ভেড়া বা শূকরটি সীমিত আঁচে অতি ধীরে ধীরে দগ্ধ হচ্ছিল, তার বিভাজিত অংশগুলি একটা বড় টেবিলে রাখা হলো, চারপাশে নানা আকৃতি, নানা মাপের বিভিন্ন আয়তনের ছুরি দেখা যাচ্ছে। এতবড় পিন্ড থেকে কী করে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী মাংস আয়ত্বে আনা যাবে সে ভাবনাটা সবারই চোখেমুখে প্রকট। কিন্তু সহজ সমাধান করে ফেলল ওরাই, এই সমস্যাটা হয়তো প্রতিবারেরই। দুজন, একটু আগেকার হিংস্র যোদ্ধা, শানানো ছুরির ফলা দিয়ে নিপুণ দক্ষতায় কয়েক মিনিটের মধ্যেই যথাযথ মাপে কেটে প্লেটে স্যালাডপাতা, স্ট্রবেরি, আঙ্গুর, আর্টিচোক ডিপ, চেডার চীজ্, পোড়ামুর্গীর টুকরো, রকমারি সব্জী আর দুচার রকম সস্ দিয়ে রসনা সিক্ত করার উপযোগী ডিশ তৈরী করে ফেললো। সর্দারের সহাস্য ইংগিত পাবার আগে পর্যন্ত আমরা কিন্তু অজান্তেও প্লেট তুলে নিয়ে মাওরি আতিথেয়তায় আবার নতুন করে ন্যূনতম আঁচড়ও লাগাতে সাহস করিনি। যদিও এখন আমরা জেনে গেছি সবটাই ছিল ওদের অভিনয়, শো ম্যানশীপ আর বিনোদন পর্যায়ের। তবু, যে দু-চারজন ছ’ফুটের কাছাকাছি শক্ত সমর্থ মানুষ হাতে দানবিক ছুরি নিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে টেবিলের ওপরে শব-ব্যবচ্ছেদ করছিল, তাদের চোখে মুখে কোনরকম কৌতুকের চিহ্ন ছিল না, তাই আমরা সত্যিই একটু ইতস্তত করছিলাম। তাদের মুখের ভীতিপ্রদ উল্কির নিদর্শন মনের ভেতরে তখনও দাপটে জ্বলছে যে!
খুবই ভয়ানক সুন্দর একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা কাটিয়ে ওদের যথাযোগ্য সম্মান, অভিনন্দন আর ধন্যবাদ জানিয়ে বাইরে খোলা আকাশের নীচে বেরিয়ে এলাম আমরা, যেখানে আমাদের দুধসাদা অতিকায় ভলভো লাক্সারী বাসটা অলৌকিক চাঁদের বিচ্ছুরিত মায়াবী দ্যূতি ছড়িয়ে আশপাশের আলোছায়ায় অশরীরি গাছপালাকে আরো রহস্যময় করে
মৃদুগতিতে রাস্তার পিচে হাল্কা আওয়াজ তুলে সুদূর অতীতের রঙ্গমঞ্চকে পেছনে ফেলে বর্তমান বাস্তবতার পথে এগিয়ে চলেছি এখন আমরা। কেন জানি না, বুকের ভেতরের কুঠুরীটা একাধারে খাঁ খাঁ শূন্য লাগছ, আবার অন্যদিকে টৈটম্বুর, পরিপূর্ণ। বাসটা বাঁদিকে হাল্কা মোড় নিতেই গভীর নীল আকাশের বুকে পূর্ণচাঁদের বিবর্ণ হারূপরেখা - মিলিয়ে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে ঐ প্রাচীন ইতিহাসের পাতায় আর, অকারণে আমার মনে হচ্ছে এই বিনোদনে অংশগ্রহণকারীদের কেউ কেউ কি হাজার বারোশো বছর আগেকার জীবনের পাতা থেকে উঠে মিনতি করে বলছিল, “বাঁচাও আমাদের ঐতিহ্য আর সমাজকে, তাচ্ছিল্য করে পেছনে ফেলে যেও না। আমরাও নিজেদের সংস্কৃতির আবেগ নিয়ে তোমাদের সবাইয়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে পৃথিবীর আঙ্গিনায় চলতে চাই।”
কেউ একজন? ভুল করেও?









0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন