বর্ণমালার সাতকাহন
(পর্ব ৩১)
হেমন্তের দিনেরা
থানা থেকে এলাম। মফস্বলের ছিমছাম ছোট্ট থানা। এত শান্ত পরিবেশ, মনে হয় পৃথিবীতে গুণ্ডা বদমাইশ বলে কিছু নেই। পুলিশ ও চোর দুজনেই দেখলাম বেশ শান্ত নিরীহ টাইপ। আমি কেন থানায়? খুন ধর্ষণ ডাকাতি ছাড়াও থানা যেতে হয় কখনও কখনও। সেরকম একটি কারণ। আমার পাশে আরেক নিপাট ভদ্রলোক। সমবয়স। তিনিও লিখছেন। আমিও। দরখাস্ত। আমি হারিয়ে ফেলেছি ব্যাঙ্কের খাতা মানে পাশবই, আর তাঁর ব্যাঙ্ক থেকে হঠাত হারিয়ে গেছে পঁচিশহাজার। ব্যাপক ভুঁড়ি কুঁতকুঁতে চোখ মরচে পরা বন্দুকটা নিয়ে হাম্টি ডাম্পটি একটা টুলে বসে অলস দৃষ্টিতে আমাদের দেখছে। একটি ছোটোখাটো ফুটফুটে চোর। একই রকম একটি পুলিশ দেখলাম হেসে হেসে কীসব গল্প করছে দুজনে। চোর, কারণ একটা গরুর দড়ি ভীষণ সংকুচিত হয়ে ছেলেটির হাতে পরানো। বড়বাবু এসে পৌঁছননি। আমরা দুজন দরখাস্ত লিখে জেরক্স করে গল্প-টল্প করতে লাগলাম। এভাবে কত মানুষ সল্প সময়ে আত্মীয় হয়ে ওঠে! জেরক্সের দোকানের পাশে মাটির জিনিস। লাল মাটির প্রদীপ ছোটো বড়ো, ঘর সাজানোর, টুনি আলোর প্যাকেট, চাল ডাল শ্যাম্পুর পাউচ। চট করে বলা মুস্কিল কিসের দোকান। উল্টো দিকের দোকান ফুলে ফুলে ভরা। প্লাস্টিকের। গলি থেকে বেরোলে রাজপথ।দু জন চা খাই। থানায় ফিরে কাজ শেষ হলো তারপর
যে যার পথে চলে গেলাম। থানার সামনে
একটা বিরাট গাছ, ছোটো ছোটো সাদাফুল, চলে আসার সময় গায়ে পড়ল তার হলুদ পাতা।
সতুদার দোকান এখন বাজারে উঠে গেছে আজ আবিষ্কার করলাম। সতুদা খুব বুড়ো হয়ে গেছে। সাদা খোঁচা দাড়ি গালময় দাঁত পড়ে গেছে। বাকিটা একই আছে। হাসল।
"তুমি এখানে দোকান দিয়েছ
এখন?"_আমি সামনের মাটিতে বসা চেনা মাসির থেকে চোদ্দশাক কিনি। দূরবীন দিয়ে দেখি
ছোট্ট একটা মাঠ। একধারে সার করে ঘর। সবে পাকা হচ্ছে। আমরা যাই গান শিখতে। পাড়ার বালিকারা।
উল্টোদিকে একটা টিউকল, এখানে টিউকলই বলে সবাই। পাশে টালির ঘর। সতুদার বোন দাঁত উঁচু।
রং কালো ।আরতিদি আমাদের সঙ্গেই গান শেখে। দুটো ঘর। একটিতে সতুদার বাবা জানলার ধারে
শুয়ে থাকেন। শুয়েই। কখনও হাঁটতে দেখিনি। মনে প্রশ্ন জাগেনি, কেন! যেন ওটাই স্বাভাবিক।
আমরা গান শিখে সবাই ঘিরে বসি খাটে। মাঠ পেরিয়ে রোদ। আমরাও চলে আসি। সতুদার বাবা আবার
বলেন গল্পটা। মাঝরাতে একদল ডাকাত এসেছিল। এমন এক হেমন্তের রাত। বন্দুক আর দা নিয়ে।
সতুদার বাবাকে গুলি করে। পায়ে। কপালে না লেগে একটা হাতে। যা ছিল সব লুটপাট করে নিয়ে
যায়। গুলিবিদ্ধ সতুদার বাবার লড়াইয়ের গল্প শুনি। রোজ প্রায় একই সে রাতের গল্প।
সতুদার মা উনুনে আঁচ দেয়। খুব ধোঁয়া। আমরা মুড়ি খাই। এই পুরো জমিটা সতুদার বাবা ট্রাস্টিকে
দিয়েছেন ইস্কুল করার জন্য। সেই স্কুল আজ সরকারি। উচ্চমাধ্যমিক। কত নাম। গেটে সতুদার
বাবার ছবি। ট্রাস্ট থেকে টালির বাড়িটি পাকা করে দেয় পরে। এখন বিরাট মাঠ বাঁধানো।
ওখানে কালীপুজো হয়। স্কুলে মিড-ডে মিল। বিজয়া সম্মিলনীর খাওয়া দাওয়া।
মইদুল এসেছে ফিরে দেখি। প্রতিবার আসে। টুনি দিয়ে আমাদের বারান্দা সাজিয়ে দেবে। রাতে বাজি ফাটানো হবে। রং মশাল, চরকি, তুবড়ি। হেমন্ত এলে আজকাল তেমন শিশির পড়ে না।
(ক্রমশ)

0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন