কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১৩৭

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১৩৭

শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

ইন্দ্রপুরী রহস্য

 


(৩)

মর্জয়ন্ত

মন্থন করে আগুনকে আবার জাগিয়ে তোলার ঋকবেদীয় প্রকরণ মর্জয়ন্ত। শুভায়ুর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে আমরাও যেন সেই মন্থনকর্মের ঋত্বিক হয়ে উঠেছি। দুপুর হতেই কর্মস্থলে আশুদার ফোন। ইন্দ্রপুরী যেতে হবে। তখনই। তথাগত অধিকারী ব্যবস্থা করেছে। বিখ্যাত অভিনেতার আশপাশে সঞ্চরণশীল মানুষগুলোর সঙ্গে কথোপকথনের এই সুযোগ সহজে হাতছাড়া করা মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বিশেষত সেই মন্থনের মূল কাণ্ডারী যেখানে আশুদা স্বয়ং। ফলত বেরিয়ে পড়লাম কর্মস্থল থেকে। আজ আমাদের এই মন্থনে কোন অনির্বাপিত অগ্নি দপ করে জ্বলে উঠবে কে জানে!

যতোবার ইন্দ্রপুরী রেসিডেন্সীতে ঢুকি, ততোবার আলো আর অন্ধকার মেশানো এক আশ্চর্য আলোছায়া ঘিরে ধরে আমাকে। এই শহরে এক শ্রেণীর মানুষ আছে, যাদের মাথার উপর ন্যুনতম আশ্রয়টুকুও নেই। যাদের শিশুরা পথে পথে ধুলোমাখামাখি করে বেঁচে আছে। তবু তাদের মুখে দিনের শেষে একঝলক হাসি খুঁজলেই দেখতে পাওয়া যায়। আর আছে এইসব রেসিডেন্সির মানুষ। বড় বড় ম্যানসন, দামী গাড়ি। অথচ মনের ভিতর এক অপার শূন্যতাকে অতিক্রম করতে কিছুতেই পারছে না তারা। রেসিডেন্সি অদূরেই একটা দোতলা বাড়ি ভাঙছে বুলডোজার। ওখানেও নিশ্চিত একটা বড় অ্যাপার্টমেন্ট হবে। সকলেই তাদের নিজস্ব স্কোয়ারফিট বূঝে নিচ্ছে। সেই স্কোয়ারফিট চওড়া হতে হতে একসময় সেই বিশাল স্কোয়ারফিটে মানুষ আর নিজেকেই খুঁজে পারছে না! শুভায়ু দের ফ্ল্যাটের তলাতেই আর একটি ফ্ল্যাটে আপাতত থাকেন তার স্ত্রী নবনীতা ও সেই সুনন্দ ছেলেটি। তথাগত আশুদাকে বলে রেখেছিল। তাই মনে হল নবনীতা মনে মনে প্রস্তুত ছিলেন। এক পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব অপরূপ সুন্দরী নারী নবনীতা। এতোটাই তার রূপ, যে নজর ফেরানো যায় না। প্রথম দিন শুভায়ুর ঘরে যখন গিয়েছিলাম, তখন দু একটি ছবিতে তাকে এক ঝলক দেখেছিলাম। আজ এই ভয়াবহ শিহরণ জাগানো ঘটনা ঘটে যাবার পরেও তার এই উপস্থিতি যেন সেই ঝলকদর্শনকে মুগ্ধতার রেশ এনে দিল। নবনীতা আমাদের বসতে বললেন। ঘরটা শুভায়ুর ঘরের প্যাটার্নেই তৈরি। শুধু জানলা দরজাগুলো সামান্য এদিকওদিক। ঘরে সোফায় বসে রয়েছেন এক স্থুলকায় পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তি। সহজেই বোঝা যায়, ভদ্রলোক অবাঙালি। নবনীতার চোখে সামান্য স্তব্ধতা থাকলেও গভীর শোকাবহতা সেখানে খুঁজে পেলাম না। আমাদের বসতে বলে আলাপ করিয়ে দিলেন। "ইনি ব্রজলাল বাজোরিয়া। সোম প্রোডাকশন্সের মালিক। শুভায়ু শেষ যে ফিল্মটায় কাজ করছিল তা ওনাদের প্রোডাকশন হাউজেরই প্রজেক্ট ছিল।" আমরা প্রতিনমস্কার সেরে সোফায় বসে পড়লাম।

আশুদা প্রথম প্রশ্নটাই বাজোরিয়াকে করল। লক্ষ্য করলাম, বাজোরিয়া কিন্তু বাংলা কথাবার্তা বেশ স্বচ্ছন্দভাবেই বলতে পারেন। অবশ্য কেনই বা পারবেন না! এটা ওনার বিজনেস। যে বাংলা সিনেমাকে উনি  পণ্য করছেন, তার ভাষার প্রতি ন্যুনতম দখল না থাকলে তিনি সেই বাণিজ্য করবেন কী করে! আশুদা আর বাজোরিয়ার কথোপকথন চলতে থাকল।

-মিস্টার বাজোরিয়া। শুভায়ুর ভিতর সম্প্রতি কোনও পরিবর্তন দেখছিলেন সেটের ভিতর?

-হ্যাঁ। জরুর। খুব আলাগসা বিহেভ করছিল ইদানিং। ডায়লগ ভুলে যেত। এতো বছর ওর সঙ্গে কাজ করছি। ও ডায়ালগ ভুলত না কখনও! তাছাড়া আরো একটা বেপারও ছিল। আমি নোটিস করেছি ...

বলেই বাজোরিয়া থেমে গেল। আশুদা উৎসুক হয়ে বলল, "কী সেটা?"

বাজোরিয়া নবনীতাদেবীর দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল, "আজকাল, খুদকা নাম, আতা পাতা, সব ভুলভাল বলছিল। এ কথাটা কেউ জানে না। আপনারাও কারোকে বলবেন না। বললে আমার নুকসান হবে অনেক ...

-কেন?

-কারণ শুভায়ুবাবুকে কাস্ট করেছি আমি নিজের দায়িত্বে। ই কথাগুলো সবাই জেনে গেলে আমাকে সবাই দোষ দেবে।

-আপনি ওই অবস্থায় শুভায়ুকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতেন কী করে?

-করিনি তো। আই কল্ড অফ দ্য সেটস। বলেছিলাম একমাস বাদে আবার শ্যুটিং শুরু হবে।

-ঠিক কবে থেকে ওর ভিতর এই পরিবর্তনগুলো দেখলেন?

-বাঙ্গালোর গিয়েছিল ও। দো হপ্তা আগে। তারপর ফিরে এসেই। এই ধরেন। দিন দশেক।

আশুদা গম্ভীর হয়ে ভাবল কিছু। তারপর নবনীতাদেবীর দিকে ধেয়ে গেল তার প্রশ্নবাণ।

-আচ্ছা নবনীতাদেবী, শুভায়ুবাবু হঠাৎ ব্যাঙ্গালোর কেন গিয়েছিলেন? কোনও শ্যুটিং এর কাজে, না ব্যক্তিগত কোনও কারণে?

লক্ষ্য করলাম, নবনীতা একটু অস্থির হয়ে পড়ছেন। খানিক তাকালেন বাজোরিয়ার দিকে। তারপর বললেন,"না। শ্যুটিংএর কাছে নয়। ব্যাক্তিগত কাজেই।" আশুদা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে প্রশ্ন করল, "কী ধরনের ব্যক্তিগত একটু বলতে পারবেন? যদি খুব অসুবিধে না থাকে!" নবনীতা একটু অস্বস্থির ভিতরেই বললেন, "আসলে শুভায়ুর একটা অসুখ ছিল। ওর সারা শরীর মাঝৈমাঝে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেত। যখন এটা হতো, তখন আর কোনও কাজ করতে পারত না ও। সেই কারণেই মাঝেমাঝেই ওকে চিকিৎসার জন্য বাঙ্গালোর যেতে হতো।

-কোথায় যেতেন বাঙ্গালোরে? আই মিন কোন হাসপাতাল?

-আরতি ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স।

-ওখানকার ডাক্তারবাবুরা অসুখটার কোনও নাম বলেছিলেন? আপনার মনে আছে?

নবনীতা মাথা নেড়ে জানালেন, তাঁর মনে নেই। আশুদা বলল-

-আচ্ছা। বাজোরিয়া যেমন বললেন, ঠিক ফিরে আসার পরে পরেই কি ওই অস্বাভাবিকতা শুরু হয়ে গিয়েছিল শুভায়ুর আচরণে?

নবনীতা মাথা নেড়ে 'হ্যাঁ' জানালেন। আশুদা খানিকটা  স্তব্ধতা এনে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, "আচ্ছা নবনীতাদেবী, আপনি তো একসময় মডেলিং করতেন, এমন কি দু একটা ছোট সিনেমাতে অভিনয়ও করেছেন। ফিল্মের কেরিয়ারটা একেবারে ছেড়ে দিলেন কেন?

নবনীতা আবার বাজোরিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, "চেষ্টা করিনি এমন নয়। কিন্তু ছাড়তেই হল। শুভায়ুর পছন্দ ছিল না আমি ইণ্ডাস্ট্রিতে কাজ করি। ইদানিং আমার নানান বিষয়ে আমাকে সন্দেহ করত। এমনকি কখনও কখনও গায়ে হাতও তুলত...

-পুলিশকে জানাননি কেন?

-পারিনি।

নবনীতা দুই চোখ জলে ভরে আসে। সেই দৃশ্যে বাজোরিয়া তার দিকে টিশ্যু এগিয়ে দেয়। আশুদা এবার আবার বাজোরিয়াকে প্রশ্ন করে।

-আচ্ছা বাজোরিয়াজি, শুভায়ুবাবু আপনার ছবিতে যে চরিত্রটা করছিল, সেটা কি খুব চ্যালেঞ্জিং? মানে কাজের ধরনটা জটিল হওয়াতে তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে, এমন কি হতে পারে?

বাজোরিয়া চিন্তা করে বলল,"এমন তো হোবার কথা নয়। শুভায়ু পাকা অভিনেতা। এর থেকে অনেক কঠিন চরিত্রে ও অভিনয় করেছে এর আগে। আমার ফিল্মে ওই লিড ছিল। একজন পুলিশ অফিসারের রোল। একজন সাহসী নীতিপরায়ণ পুলিশ অফিসার। শুভায়ু বলত বারবার, এটা তার ড্রিমরোল...

-আচ্ছা টলিগঞ্জে স্টুডিওপাড়াতে আপনাদের ফিল্মের সেটটায় আমরা কি একবার যেতে পারি?

বাজোরিয়া একটু ভেবে বলল, "হোয়াই নট। আমি বলে রাখছি।" আশুদা ধন্যবাদ জানিয়ে বলল,"আচ্ছা, শুভায়ুর এই অসুখটার কথা আপনি জানতেন?" বাজোরিয়া ম্লান হেসে বলল, "জানতাম। কিন্তু লোকটাকে বাঁচাতে পারলাম না। সাচ আ ওয়েস্ট"।

আশুদা হেসে নবনীতাকে বলল, "একবার ওই ছেলেটিকে ডেকে দেবেন? যে এ বাড়িতে কেয়ারগিভারের কাজ করছিল।

-কে সুনন্দ? এখনই ডেকে দিচ্ছি...

নবনীতা ভিতরে চলে গেলেন সুনন্দকে ডাকতে।

বাজোরিয়া আমাদের দিকে তার 'সোম প্রোডাকশন্স'এর একটা কার্ড এগিয়ে দিলেন। কার্ডটা দেখামাত্র আশ্চর্যচকিত হলাম। কার্ডের এককোণে সেই চিহ্নটি আঁকা, যা শুভায়ুর দেহের ডান হাতে ট্যাটু হিসেবে পেয়েছিলাম! আশুদার দিকে একঝলক তাকিয়ে আমি জিজ্ঞেস করেই ফেললাম,"এটা কি?" বাজোরিয়া বেশ গরিমা নিয়েই বলল, "ওটা আমাদের প্রোডাকশন হাউজের লোগো। এটার কৃতিত্ব অবশ্য নবনীতা ম্যাডামজির। উনিই আমাদের এটা সাজেস্ট করেন। এর নাম উনালোম।" শুভায়ুর দেহের ট্যাটুটার কথা আমি বাজোরিয়ার সামনে তুললাম না আশুদার চোখের ইশারায়। বুঝলাম আশুদা কিছু একটা আন্দাজ করেছে নির্ঘাত।

ঘরেতে সুনন্দ প্রবেশ করতেই কিন্তু পরিবেশটা বেশ খানিকটা বদলে গেল। বেশ হৃষ্টপুষ্ট দোহারা চেহারা সুনন্দর। বয়স আঠারো উনিশ হবে। কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝেই কথা আটকে যাচ্ছে খেয়াল করলাম। তারই ভিতর জিভ দিয়ে 'ক্লিক ক্লিক' আওয়াজ করছে। সুনন্দর হাবেভাবে বোঝা গেল, শুভায়ুর মৃত্যুর থেকেও বেশি তাকে বিচলিত করেছে পুলিশের জেরা। মাঝেমাঝে নিজের অজান্তেই সে মাথা নাড়িয়ে উঠছে। আর কথা ফাঁকে ফাঁকে 'ক্লিক ক্লিক' আওয়াজ বের হয়ে আসছে। আমরা কথোপকথন শেষ করে ইন্দ্রপুরী থেকে বেরিয়ে এলাম। আশুদা গাড়িতে বসে বলল, "কী বুঝলি অর্ক?"

-সুনন্দ ছেলেটার বোধহয় ট্যুরেট সিন্ড্রোম আছে।

আশুদার মুখচোখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে আমাকে গর্বিত করে তুলল। "ব্রাভো অর্ক। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই সুনন্দ ছেলেটাকে তো খুব একটা পরিপক্ক কেয়ারগিভার মনে হল না। বয়স কতো হবে? মেরেকেটে বাইশ! এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এইরকম একটা ছেলেকে বাড়িতে রাখার কারণ কী? সহানুভূতি? সোশ্যাল ওয়ার্ক? না অন্যকিছু?"

-সুনন্দর মধ্যে একটা চাপারাগ আছে কিন্তু মনে হল...

-ঠিক বলেছিস অর্ক। এটা আমারও মনে হয়েছে। ও যেভাবে চেপে চেপে কথা বলছিল। বিশেষত শ্যুটিং আর শুভায়ুকে নিয়ে। হতে পারে ক্রমাগত পুলিশিজেরার ফল।

-কী মনে হল? নবনীতাদেবী সত্যি বলছে? বাজোরিয়া?

-সন্দেহের উর্ধ্বে আপাতত কেউই নয় অর্ক। বিশেষ করে কয়েকটা জিনিস যতক্ষণ না জানতে পারছি।

-যেমন?

-প্রথমত একবার সর্বানন্দকে ফোন করতে হবে। সর্বানন্দ এখন কোথায় আছে কে জানে। তবে বাঙ্গালোরে ওর জানাশোনা আছে। শুভায়ু বাঙ্গালোরে যে ক্লিনিকটায় যেত, সেখানে খোঁজ করে জানতে হবে, শুভায়ুর আসলে কী রোগ ছিল! মনে হচ্ছে এই তথ্যটা আমাদের এই সত্য ব্যবচ্ছেদে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

-আর উনালোম?

-হ্যাঁ। ওটাও আমাকে বেশ ভাবাচ্ছে। তোকে তাই সংকেত দিলাম। শুভায়ুর শরীরে ট্যাটুর কথা যে আমরা জানি এটা বাজোরিয়াকে জানানোর দরকার এখনই নেই। তবে এই দুটোর ভিতর কি আদৌ কোনও যোগ আছে? না নেহাতই কাকতালীয়!

-বাজোরিয়ার উনালোমে কিন্তু উপরের তিনটি বিন্দু নেই। শুভায়ুর উল্কিতে ওটা ছিল।

-আবার তোকে শাবাস বলতেই হচ্ছে। ঠিক বলেছিস। এটাও একটা সূত্র। একবার তথাগতকে বলে ফ্ল্যাটের সিঁড়ি আর করিডরের সিসিটিভি ফুটেজটা দেখতে হবে। একবার অলোকেশের সঙ্গেও কথা বলা দরকার। ওকে আসতে বলিস তো একবার।

-আপাতত আমরা কোথায় যাচ্ছি?

-টলিপাড়া...

গাড়ি নিয়ে চললাম টলিগঞ্জের স্টুডিওপাড়ার দিকে। বাজোরিয়ার কার্ডটা অনুসরণ করেই এগোচ্ছিলাম। স্টুডিওপাড়ায় পা দিলেই কেমন যেন মনের ভিতর একটা সমান্তরাল জগতের উপস্থিতি টের পাই আমি। এ যেন এক অবচেতনিক জগত। যা কিছু অবচেতনিক অবদমন, তা কল্পনার ডানায় ভর করে উড়ে বেড়াচ্ছে সেট থেকে সেটে। বেশিক্ষণ থাকলে কোনটা অভিনয়, কোনটা বাস্তব গুলিয়ে যায়। সেই কুসুমকুমারী দাসীর 'গান্ধারীর আবিদন'এর স্মৃতি মনের ভিতর উঁকি মেরে যায়। কতো প্রতিভা, স্বপ্ন, সুর, লয়, তাল, ঘুরপাক খেয়ে চলেছে এই কল্পজগতে। অবশেষে খুঁজে পেলাম 'সোম প্রোডাকশন হাউজ'এর অফিস। মাঝারি একটা গুমটি। গুমটির বাইরে শুভায়ু দের পোস্টার লাগানো। সিনেমার নাম 'আগুনপাখি'! শুভায়ু এক খাঁকি পুলিশ অফিসারের বেশে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে। ভাবতেই শিহরণ লাগে। এই মানুষটি আজ অতীত। অথচ তার এই মূর্ত পোস্টারটি কী জ্বলজ্যান্ত বাস্তব! বাজোরিয়া একটা নাম দিয়েছিল। আশীষ হালদার। আমরা সেই নামটার খোঁজ করছিলাম। পেয়েও গেলাম অবশেষে। সেটে শ্যুটিং চলছিল। কোনও ওয়েব সিরিজ। লাইট্সম্যান আশীষ আমাদের ইশারা করে শ্যুটিং শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে বলল। আমরা একপাশে দাঁড়িয়ে শ্যুটিং দেখতে লাগলাম। সভায় সোনার মুকুট পরে দেবতারা বসে আছেন। তাঁদের সামনে ছিন্ন বসনা বেহুলা মৃত লখিন্দরের শব সামনে সাজিয়ে নাচছে। পাগলিনীর মতো নাচছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল এই বেহুলা যেন কোনও পটচিত্র থেকে জীবন্ত হয়ে উঠে এসেছে! "বেহুলা বলে প্রাণনাথ করি নিবেদন। দেখিয়া আসিনু শশুর শাশুরির চরণ।। ক্ষণে ওঠে ক্ষণে বসে ক্ষণে গড়াগড়ি যায়। লখাই লখাই বলি মায় কান্দিয়া বেড়ায়।।"

শ্যুটিং শেষ হলে আশীষ হালদার অবশেষে হাত জোর করে ক্ষমা চেয়ে বলল, "আপনাদের বসিয়ে রাখলাম। সরি স্যার, উপায় ছিল না।আমি সামান্য কর্মচারী। বোঝেনই তো সব। চলুন অফিসে। ওখানে গিয়ে কথা বলি।"

অফিসে বাজোরিয়ার হাউজের সিনেমার পোস্টার সাঁটানো। তাদের বেশ কয়েকটিতে শুভায়ুর মুখ দেখতে পেলাম। একটিতে নবনীতাকেও খুঁজে পেলাম। আশুদা কথোপকথন শুরু করল।

-বলুন, কী জানতে চান।

-শুভায়ুবাবুকে আপনি কতোদিন চেনেন?

আশীষবাবু ষাটোর্ধ্ব হলেও মনে হল না তার স্মৃতি বিকল হয়ে গেছে। বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, "বছর পনেরো তো বটেই।"

-কেমন মানুষ ছিলেন শুভায়ু?

-ওই হিরোরা যেমন হয়। তবে অন্যদের থেকে 'আমাকে দেখো' ভাবটা একটু কম। আর খুব সন্দেহ করতেন ইদানিং!

-কাকে?

-আমাদেরকে। মনে করতেন আমরা সবাই শত্রু। ইদিনিং তো নাম বলতেও পারতেন না আমাদের। ডায়লগ বুঝতে পারতেন না। রেগে যেতেন ঘনঘন। আর আবোলতাবোল বলতেন। আমরা বলতাম, নেশা করে করে বাবুর মাথার তার কেটে গেছে...

-নেশা করতেন শুভায়ু?

-করতেন না আবার! তবে যে সে নেশা নয়।সাহেব গোছের কয়েকটা অ্যাংলো আসতো মাঝেমাঝে। লোকের নজর এড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে আসত। কীসব প্যাকেট দিয়ে যেত।

-কীসের নেশা! বাজোরিয়া জানতেন?

-বোধহয় জানতেন। চেপে যেতেন বোধহয়। সিনেমা ফ্লপ হলে তো সব ডুবল।

-পাউডার?

-সেরকমই কিছু! জিজ্ঞেস করলে একবার বলেছিলেন।

-কী বলেছিলেন শুভায়ু?

-ও নেশা সোমের নেশা। দেবতাদের পায়ের ধুলো!

-সোম মানে? সোম রস? মানে মদ্যপান?

-না না। মিথ্যে বলব না। স্যার মদ ছুঁতেন না।

-আর? অন্য কোনও দোষ ছিল স্যারের?

আশীষ এদিকওদিক তাকিয়ে বললেন,"একটা ব্যাপার আমরা আন্দাজ করতাম। শুভায়ুস্যারের সঙ্গে ম্যাডামের ইয়েটা ভালো ছিল না। মাঝেমাঝেই ফোনে ঝগড়া করতেন। বোধহয় ইগোর লড়াই। এ লাইনে এটা খুব হয়। আপনারা অমিতাভ জয়া ভাদুড়ির 'অভিমান' দেখেননি?

আশুদা আর আমার জন্য লাল চা এল। আশুদা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল,"তা তোমার স্যার রোজ নেশা করতেন?" আশীষবিবু ভেবে বললেন,"না। এখানে শুধু ডেলিভারি হতো। নেশাটা বোধহয় বাইরে কোথাও করতেন।"

-এই অস্বাভাবিক আচরণটা কবে থেকে দেখলেন?

-তা দিন দশ বারো! ওই বাঙ্গালোর থেকে আসবার পরেই কীই যে হল। নেশা করুন আর যাই করুন, স্যার ডায়ালগে একদম চোস্ত ছিলেন। কিন্তু ইদানিং সেটাও পারতেন না।

-স্যার কি মাঝেমাঝেই বাঙ্গালোর যেতেন?

-তা যেতেন বছরে দুবার। কীসের একটা চিকিৎসে করতে যেতেন। ওসব সেলিব্রিটিদের ব্যাপার! চল্লিশ বছর এখানে রয়েছি। আমাদের চিকিৎসা মানে এমআর বাঙ্গুর!

আমরা বেরিয়ে এলাম। যাবার আগে আশীষবাবুর ফোন নম্বরটা নিয়ে নেওয়া হল।আশুদাও নিজের ফোননম্বরটা দিয়ে দিল আশীষবাবুকে।"আর কিছু মনে পড়লে অবশ্যই জানাবেন" বলে আমরা স্টুডিওপাড়া থেকে বেরিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ থমকে গেলাম। পিছন থেকে কে যেন সুরেলা গলায় আমাদের ডাকছে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম সেটের বেহুলা রীতিমতো জ্বলজ্যান্ত বাস্তবজগতে পা রেখে আমাদের পিছু ডাকছে। আশুদার দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলল।

-এক্সকিউজ মি। আপনিই কি আশুদা?

আশুদা মৃদু হেসে 'হ্যাঁ' বলতেই মেয়েটি হেসে বলল,"আমি বিনতা। বিনতা ঘোষ।আর আপনি বুঝি অর্কপ্রভ?"

আমি মাথা নাড়লাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বিনতা এদিকওদিক তাকিয়ে বলল,"শুভায়ুদার মৃত্যুর তদন্ত আপনারা করছেন জেনে খুব নিশ্চিন্ত হলাম। আমি ঠিক জানি আপনারা অপরাধীকে খুঁজে বের করবেনই।

আশুদা ভ্রূকুঞ্চিত ভাবে বলল,"অপরাধী কেন? ঘটনাটা তো আত্মহত্যার!"

বিনতা নিচুস্বরে বলল,"আপনারা জানেন না। এখানে শুভায়ুদার অনেক শত্রু। এখানে বলা যাবে না সেসব কথা। এটা আমার নম্বর। কাল আমার ডে অফ। আপনারা সময় দিলে সামনাসামনি গিয়ে সব বলব। এখন আসি।" বলেই নিমেষের ভিতর অন্ধকারেই বেহুলার মতোই বিনতা অন্তর্হিত হল। আমি হতবাক হয়ে চেয়ে আছি দেখে আশুদা বলল,"চল এবার। অতো অবাক হবার কিছু নেই। সবে তো দিনের আলো ফুটছে। মন বলছে, এই মেয়েটিই আমাদের এই তদন্তের সেই ভোরের আলো! এখন চল।"

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন