| সমকালীন ছোটগল্প |
মাথার ভেতরকার রামায়ণ
নদী পাহাড় ইত্যাদির মালিকানা নিয়ে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা বিখ্যাত কবিতা আছে। তা থাকতেই পারে। কবিদের ওরকম অস্তিত্বহীন অনেককিছুই থাকে, যা তাঁরা কবিতায় সাজিয়ে রাখেন। কাব্যপ্রেমীরা সেসব পড়ে শুধু শুধু মুগ্ধ হয়। তবে বিশ্বাস খুব একটা করে না। আমাদের কিন্তু করতে হয়েছিলো। কিছুদিন আগে বেড়াতে গেছিলাম শ্রীলঙ্কা। সেখানে সমুদ্র তীরের শহর ‘বেনটোটা’। অনলাইন এ্যাপ দেখে বেনটোটাতে আমরা যে হোটেল বুক করেছিলাম, তারা জানিয়েছিল, নানারকম সুবিধের সাথে সাথে তাদের একটুকরো প্রাইভেট সমুদ্র আছে। গিয়ে দেখলাম কথাটা ষোলোআনা সত্যি। হোটেলের সামনে কয়েক পা হাঁটলেই সমুদ্র। খানিকটা বালুকাবেলা। তার পরেই উত্তাল সমুদ্র। সেই সমুদ্রে বেড়া দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তীরে জাল টাঙ্গিয়ে সীমানা নির্ধারণ করা সম্ভব। সেটা করা আছে। যদিও সেই পল্কা জালের বেড়া হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে আসা যাওয়া করা সম্ভব। "Trespassing is prohibited" এরকম কোনো ঘোষণা নেই। তবে বালুতে গাঁথা একটা লাঠির মাথায় একটা লাল পতাকা সামুদ্রিক বাতাসে পতপত করে উড়ছে। এটা কি দখলিসত্ত্বের পতাকা? ভুল ভাঙ্গলো খোঁজ নিতেই। তা না। ওটা নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ঐ পতাকা দিয়ে হোটেলের বোর্ডারদের জানানো হয়েছে, এখানে সমুদ্র খুবই বিপজ্জনক। তাই জলে নামা বারণ। আরে এ তবে কিসের প্রাইভেট বিচ? এতো পাক্কা প্রতারণা! জালের বেড়া ঠেলে সরিয়ে অনায়াসে যাতায়াত করা যায়। অনেকেই সেটা করছে। যারা এভাবে বর্ডার ক্রস করছে তারা এ হোটেলের বোর্ডার নয়। লাল পতাকার ভয় দেখানোকে মান্য করে সমুদ্রের জলে কেউই নামছে না। হোটেল তো কবি নয় যে এটুকুতেই "আমাদের একখন্ড নিজস্ব সমুদ্র আছে" বলে বারফট্টাই করবে?
অবশ্যি মাঝে দেখলাম হোটেলের দুজন
স্টাফ ঐ সীমানাবদ্ধ বিচে ঝাড়ু দিচ্ছে। মানুষের নোংরামি যা সমুদ্রের ঢেউ তীরে এনে ফেলে
রেখে গেছে, তাদের ঝাড়ু দিয়ে ঝুড়িতে তুলছে। নেহাতই মামুলি প্রয়াস। এভাবে ঝাড়ু দিয়ে
কি দখলিসত্ব স্থাপন করা যায়? ঠকে গেলেও মানুষ হাসে। আমরাও এভাবে ঠকে গিয়ে খানিকটা
হাসলাম।
ওদের রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে ঠাট্টা
করেই জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের নিজস্ব সমুদ্রে কি মাছ আছে? তোমরা সে মাছ ধরে রেঁধে বেড়ে
গেস্টদের খেতে দাও স্বল্পমূল্যে? তারা হাসিমুখে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালো।
অর্থাৎ সে গুড়ে বালি। কিম্বা সে
মাছে বালি। যাইহোক মূল্য দিয়েই ভোজন হলো। গুরু ভোজনই হলো। স্বাদ ভিন্ন কিন্তু খেতে
মন্দ নয়। নারকেলের তেলে রান্না করা মাছ মাংসের মধ্যেও আরো বেশ খানিকটা করে নারকেল
দেওয়া। এ দেশে নাড়কেল প্রচুর। পথে আসতে আসতে একধরনের গোল্ডেন নারকেলের গাছ দেখেছি।
তাদের জল সবুজ নারকেলের থেকে অধিক মিষ্টি। মূল্যও।
এখানে ঘুড়ে বেড়ানোর জায়গা তেমন বিশেষ কিছু নেই। সামান্য বেড়িয়ে বিকেলে নিজস্ব বিচে একটু বসে এবং হোটেলের সুইমিং পুলে দাপাদাপি করে খিদে বাড়িয়ে রেস্টুরেন্টে গেলাম। এবং পেটপুরে খেলাম। রাতে হোটেলের বিছানায় শুয়ে ঘুম এলো বিনা সাধ্য সাধনায়। গুরু ভোজনের পার্শপ্রতিক্রিয়া।
পাতালে প্রবেশের পর সীতামাতার পরবর্তী হদিস আমার জানা নেই। পাতাল থেকে সরাসরি স্বর্গে যাওয়ার কোন শর্টকাট রাস্তা আছে কিনা, সে খবরও আমার জানা নেই। তবে একটা সম্ভাবনা, অপমানে, অভিমানে তিনি মাটির তলে তলে ব্যাক টু শ্রীলঙ্কাও হতে পারেন। রাবণের স্বর্ণলঙ্কা এড়িয়ে বেনটোটার প্রাইভেট বিচটি তাঁর লুকিয়ে থাকার জন্য মন্দ জায়গা নয়। বনবাসের চেয়ে মাচ বেটার বিচে বাস। এটা বাল্মীকিও মানবেন।
আমি রাতে যেন দেখতে পেলাম সমুদ্রের
ঢেউগুলো চমৎকার আলোকিত। আকাশে চাঁদ নেই। তাই সে আলো জোৎস্নার নয়। তবে কি ফসফরাসের?
যাদের মাথায় করে সমুদ্রের ঢেউ নাচে।
ঐ আলোতেই দেখলাম লাল পতাকার নিষেধাজ্ঞা
অমান্য করে কয়েকজন সমুদ্রের জলে নেমেছে। তাদের শরীরেও সেই আলো পড়েছে। এবং ঝকঝক করছে।
ওদের মধ্যে যাকে দেখতে রাণীর মতো। তবে তিনিই কি সীতামাতা? হতেই পারেন।
শ্রীরামচন্দ্র কি তাঁর পত্নীর খবর
রাখেন না? তিনি তো অন্তর্যামী এবং সর্বজ্ঞ। তাহলে এই ইম্পর্ট্যান্ট ইনফরমেশনটা মিস করে গেছেন কী করে?
অগত্যা ঠিক করলাম আমিই তাঁকে খবরটা
দেবো। অন্তর্যামীকে অন্তর দিয়ে ডাকা যায়। তাই ডাকতে থাকলাম। কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর
উনি সারা দিলেন।
- প্রভু।
- কী ব্যাপার। মাঝরাতে ডাকাডাকি
কেন?
- একটা খবর দেবার জন্য।
- কী খবর? কার খবর?
- আপনার স্ত্রী এবং আমাদের মাতা
সীতামাতার খবর।
- এ্যাঁ। তার আবার কী খবর?
- তিনি এখন শ্রীলঙ্কার বেনটোটায়
আছেন।
- কী বলছিস? এ মহিলা কি আমাকে শান্তিতে
থাকতে দেবে না!
- এখন আপনি কোথায় প্রভু?
- কেন অযোধ্যায়। আমার জন্য চমৎকার
থাকার জায়গা বানিয়ে দিয়েছে এরা। সেটাকে আরো চমৎকার বানানোর জন্য এখনো কাজ চলছে।
আরে দাঁড়া দাঁড়া। কী বললি তুই, সীতা বেনটোটায়? তাহলে এখানে আমাকে রেঁধে দিচ্ছে কে?
আমার খাবার তো অযোধ্যার সীতা-রসোই থেকেই আসছে!
- নিশ্চয় অন্য কেউ রেঁধে দিচ্ছে।
- এরা আমাকে ঢপ দিচ্ছে বলছিস?
- না না ওরকম কিছু বলার মতো ধক
নেই আমার। রাবণের দশটা ছিল। আমার তো একটাই।
- মাথার কথা বলছিস তো। হুঁ এখন
মাথার সংখ্যা চোখে দেখে বোঝার উপায় নেই। অনেকেরই অনেক মাথা। সে মাথায় টিকিও আছে।
সে টিকিও আবার বাঁধা আছে নানা অদৃশ্য জায়গায়। এটা সম্পূর্ণ ডিফারেন্ট যুগ। শুধু কলি
নয়, ঘোরকলি।
- তা তুই কি, কী দেখতে কী দেখছিস?
আসব টাসব সেবন করিসনি তো?
- না প্রভু। ইচ্ছে থাকলেও ও মুল্যবান
বস্তুর নাগাল পাওয়া মুস্কিল। বড্ডো দাম। আমাদের তো কারেন্সি এক্সচেঞ্জের পর ট্যাঁকের
জোর অত্যন্ত সাধারণ।
- হুঁ।
এরপর আর সারা নেই। প্রভু কি নিদ্রামগ্ন
হলেন? শুনেছি অযোধ্যা মন্দিরের এ সি এবং রুম হিটার দুয়ের ব্যবস্থাই আছে। যখন যেটা
প্রয়োজন হয়, সেটা চালু করে দেওয়া হয়। সুতরাং ঘুমিয়ে পড়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। ভগবানেরও ঘুম পায়। আমিও ঘুমোনোর চেষ্টা
করা শুরু করলাম। সাগর তীরে ভ্যাড়া নয় এখানে ভ্যাড়া নেই তাই ডলফিন গুনতে গুনতে একসময়
ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গলো গোলমাল
শুনে। গতরাতে কারা যেন দুঃসাহসিক কাজ করেছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সমুদ্রে নেমেছে।
তারা কারা সেটা জানা যায়নি। জানা গেলে তাদের হোটেল থেকে বহিষ্কার করা হবে। তুলে দেওয়া
হবে শ্রীলঙ্কান সাগর পুলিশের হাতে। হোটেল কর্তৃপক্ষ বলছে, ঐ ব্যাপারে কারো কাছে কিছু
ইনফরমেশন থাকলে যেন তাদের জানানো হয়। ভয়ের কিছু নেই। তারা ভরসা দিয়েছে, তাদের পরিচয়
গোপন রাখা হবে।
এটা শুনেও কিন্তু আমি সাহস করলাম
না। ঐ যে আমি দশানন নই আমার ঘাড়ে একটাই, সেটা আমি ভুলি কী করে!
বেনটোটা থেকে আজই আমাদের কলম্বো
ফেরা। সুতরাং আজ রাতে আমার অন্যত্র নিদ্রা। আশাকরি সেখানে তেমন তেমন কোনো কিছু ঘটবে
না। ভালো ঘুম হবে।
আমি শুধু রওনা দেবার আগে ওদের সৈকত
sweeperদের শুধালাম-
- Got something while
sweeping?
- what?
- any gems? মনিরত্ন?
তারা তো অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলো। ওরা সিংহলি ছাড়া অন্য ভাষা বোঝে না। তখন হোটেলের রিসেপশনিস্ট
মহিলা এগিয়ে এলেন।
- You want Gems? Srilankan
Gems are world famous. You will get some renouned Gems shops here on the road
side. You will get them even in Colmbo.
- Thanks.
এটুকু বলেই আমি গাড়িতে উঠে পড়লাম।
বুদ্ধদেবের দেশে রাম সীতার খোঁজ বেশি না করাই ভালো।
তবে তখনই আমার মনে পড়লো। আমাদের বিশ্বকবি তো আগেই বলেই গেছেন, আসল রামায়ণ পুস্তকে নয়, মস্তকে থাকে। তাই এটা আসলে আমার মাথার ভেতরকার রামায়ণ।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন