ওরছা, ওড়না আর এক রামকাহিনী
কেন আর বেতোয়ার আগলে রাখা জমির ভেতর মাহবা, ললিতপুর, ঝাঁসি, টিকমগড়, ছত্রপুর। বাঁহাতে বিদিশা, দাতিয়াকে ফেলে রেখে বেতোয়া চলে গেছে যমুনার কাছে। কেনের সাথে তার সেখানেই দেখা। নদীরা সই পাতায় না কি সময়বিশেষে সতীনের মতো শত্রু হয়ে ওঠে সে খবর নেওয়া হয়নি কখনও। উত্তরের সমতলে যমুনার বুকে ঝাঁপ দেওয়ার আগে পেঞ্চের গায়ে খানিক শ্যাওলা-সবুজ জঙ্গলছাপ ছেড়ে যায় কেন। মাঝের এই মস্ত এলাকাটা জুড়ে যে বুন্দেলখন্ড তার রাস্তায় রাস্তায় বেড়ে ওঠা গাঁ ঘর, জমিন আর ঘোমটার বউটি নিজেদের অজান্তেই হিন্দি সিনেমার চরিত্র হয়ে ওঠে, কখনও ফুলওয়া কখনো বা ঝুনঝুনুর গল্পে। অনেক আগেই পেছনে ফেলে এসেছি পুরনো গলি, ইতিহাসের স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ আর শহর গোয়ালিয়র। সি অফ করতে আসার কথা ছিল না কারও। তবুও বয়ে যাওয়া জানলার ওপারে দাঁড়িয়ে রইল নোংরা ঘিঞ্জি প্ল্যাটফর্ম, মানুষের জটলা আর ভাবলেশহীন মুখ যতক্ষণ না ট্রেন চলে গেল ওদের দৃষ্টি ছাড়িয়ে দূরে, আরও দূরে।
পশ্চিমবঙ্গের কোন এক অনামী গঞ্জের সন্ধ্যায় হলদেটে আলোয় বইয়ের পাতায় ফুটে ওঠা লক্ষ্মী বাইয়ের ছবি দেখে ইমপ্রেসড হওয়ার কারণ ছিল না কোথাও। ঘোড়ার পিঠে সাদামাটা চেহারার হাতে তরবারি সমেত রাণীর একমাত্র গুরুত্ব ছিল পরীক্ষার খাতায়। সিপাহী বিদ্রোহের সাথে রাণীর একটা সম্পর্ক ছিল, কিন্তু সেটা ঠিক কেমন, তাঁতিয়া টোপির টুপি এত ছোট কেন, সেসব উত্তর জানতে জানতে বয়স বেড়ে গেছে অনেক। ইতিহাসের সত্যসাধন স্যার অনেক সত্য গোপন রেখেই রিটায়ার করে গেছেন ততদিনে। বীরাঙ্গনা রাণী লক্ষ্মীবাই স্টেশনে পা দিতেই সেইসব পরীক্ষা আর কেটে নেওয়া নম্বরের স্মৃতিরা ফিরে এল। একে একে নয়, ভিড় করে, দলে দলে। কোন সৈন্যদল নয়, বরং স্টেশন চত্বর থেকে বাইরে বেরোতেই ঘিরে ফেলল অটো আর ট্যাক্সির ড্রাইভাররা।
ভেঙে পড়া বনেদিয়ানার গায়ে একটা ধুলোর গন্ধ থাকে, থাকে শ্যাওলার ছোপ, মেঝেতে অন্ধকারের দাগ। গোয়ালিয়র যদি পুরনো বনেদি বাড়ি হয় তবে ঝাঁসি শহর হল ফিটফাট সেনাকর্তা। ঝকঝকে, পরিচ্ছন্ন। শহর ছাড়িয়ে ফাঁকা মাঠ ছাড়িয়ে, শালের সোঁদা গন্ধ পেরিয়ে রাস্তা গেছে ওরছার দিকে। রাস্তার গায়ে গায়ে টিকমগড়ের মাইল ফলক। বেতোয়া নদীটি বসে আছে রোদ মেখে, দুহাতে কাঁচের চুড়ি। কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছে।
বৃষ্টি ফুরোলে কাজললতার মতো রং লেগে থাকে গাছে। সকালের রোদ নাছোড় হাতে সেইসব রং ধুয়ে হলুদে ফিরতে চায়। ঝাঁসি শহর ছাড়াতেই ঘরবাড়ি মিলিয়ে যায় দেখতে দেখতে। দুপাশের গাছপালা ঘন হয়ে আসে, জঙ্গল বলতে ইচ্ছে করে। বেশ খানিকটা দূরে দূরে দুয়েকটা পেল্লাই সাইজের হোটেলের মতো বাড়ি। সবকটা নামের সাথেই প্যালেস জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলো বিয়ে বাড়ির জন্য ভাড়া দেওয়া জন্যই মনে হয় বিশেষ করে তৈরি। বিয়ে বোধহয় এখানে একটা মস্ত ইনডাস্ট্রি। তবে সারা পৃথিবীতেই তো বিয়ে এক ইন্ডাস্ট্রি। শুধু একবার এক আদিবাসী বিয়েতে দেখেছি কনেটি গাছের ওপর চড়ে বসেছে আর নীচ থেকে হবু বর নেমে আসার জন্য কাকুতি মিনতি করে যাচ্ছে। মেয়েটি নিচে নামার দর বলেছে দুটো ছাগল, দশকেজি চাল, গন্ধতেল, তিনটে লতোন কাপড়। অনেক দরাদরি শেষে মেয়ে যখন গাছ থেকে মাটিতে নামল, লোকেদের সে কী উল্লাস! তারপর লাজুক লাজুক মুখে পটলচেরা চোখের মেয়ে আর কাজল-কালো ছেলে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে আলু, বেগুন, টমেটো, কুমড়ো দিয়ে গাঁথা মালা পরিয়ে দিতেই দ্রিমদ্রিম তালে শুরু হল নাচ। নেশার মতো ঝিম ধরানো নাচ। শালপাতার ঠোঙায় উজাড় করা মহুয়ার রস শরীর, গলা ভিজিয়ে নাচতে লাগল শিরায় শিরায় ।
শাল পিয়ালের দেশের মানুষ আমি, আমার চলার পথে মহামানবের মতো বাকল বিছিয়ে রাখে অর্জুন। বসন্তে আকাশ বাতাস তোলপাড় করা মহুয়ার বাস আমার পূর্বপুরুষের রক্তে। পলাশে, কৃষ্ণচূড়ায় ডাক দিয়ে যায় ঋতুরাজের দখিন হাওয়া। খর বৈশাখে আমূল শুদ্ধ হয়ে উঠি বারবার। ভেজা শালের জঙ্গল ছাপিয়ে উঠে আসা রোদের ফালা নিজেকে মার্জিত করে ফেলছে বারবার। যেন পথচলতি মেয়ের ঘাগরার কাঁচ ছুঁয়ে ফিনকি দিয়ে ফুটে উঠছে আলো। তীব্র, তীক্ষ্ণ। ওরছা দাঁড়িয়ে আছে নরম চিকন দেহাতি মেয়ের মতো, চেনা সোঁদা গন্ধে, রোদের ঝলকানিতে।
দেশ মানে মাটি, মাটি ঘিরে মানচিত্র। ডাইভারসিটির সমীকরণ থেকে সমীকরণে যেতে যেতে বদলে যায় দেশ শব্দের বিন্যাস আর ব্যাপ্তি। ডাইভারসিটি খুঁজতে তন্নতন্ন করে ফেলতে হয় খাবারের থালা, পোশাকের রকমসকম, রীতিনীতির ফের। অথচ হৃদয়ে উঁকি দিলেই নিটোল সমুদ্রের আভাস। সেখানে শুধু থৈথৈ জল। প্রেমে কিম্বা অপ্রেমে মানবজমিন জুড়ে জীবনের চাষ।
"গঙ্গেচ যমুনেচৈব গোদাবরী
সরস্বতী
নর্মদে সিন্ধু কাবেরী জলেস্মিন সন্নিধিং কুরু।"
এই সাতনদীর জল একঘাটে এনে ফেলার তলে তলে আর্যাবর্তের যে মানচিত্র এঁকে ফেলা হয়েছে সেই মানচিত্রের উত্তপূর্ব সীমানায় লক্ষ্মণের গণ্ডির মতো বয়ে চলা গঙ্গা নদীর ওপার থেকে আসা এই অনার্য পথিকের পা আর্যভূমিতে পড়ার অনেক আগেই সরকারি ভাবে মুছে ফেলা হয়েছে দেশকালের সীমা। এর বহু আগেই ডিডি ন্যাশনাল ছড়িয়ে দিয়েছে সেই গান 'মিলে সুর মেরা তুমহারা তো সুর বনে হামারা...' আর 'বুলন্দ ভারত কি বুলন্দ তসবিরের' অ্যাড জিঙ্গল স্বপ্ন ছড়িয়ে গেছে হামারা বাজাজ স্কুটারের চাকায় চাকায়, দেশের কোণায় কোণায়।
একটা সাবঅল্টার্ন বিকেলের ধূলোমুঠি রোদ বৃষ্টিধোয়া পায়ে চলে গেছে অন্ধকারের দিকে। দেশ নামের ফিকশন থমকে আছে ধনধান্য পুষ্পে ভরা মাঠের ওপারে।
হোটেলের পিছনে ছোট যে নালাটা বয়ে গেছে বেতোয়ার টানে সেটা এখন জল থৈথৈ। সকালের সেই লাজবন্তি মেয়ে যার ঘাঘরায় ঠিকরে পড়া আলো শালের পাতায় ছায়া ভাঙছিল , "কোথায় পাবো তারে " খুঁজতে খুঁজতে রাস্তা থেমেছিল কেল্লার গায়ে। নিরীহ কেল্লাটা একনজরে যতই ছাপোষা মনে হোক না কেন, পুরনো ঝারোখা খিলানে লুটোপুটি খাচ্ছে লাজবন্তির ঘাঘরা ছাপানো মেহেন্দি রঙ। সুবাহ কি নানহা মুন্না উগতা সুরজ দেখতে দেখতে হাটটাগাট্টা জোয়ান হল অথচ দেশ গাঁয়ে তার খবর গেলনা এমন কী হয়? বাদল মহলের মাথায় রোদের সভাসদরা বসলো আংরাখা মেলে। ওপারের চতুর্ভুজ মন্দির হাঁ করে চেয়ে থাকল বেতোয়ার আয়নায় নিজেকে দেখবে বলে। অথচ দেহাতি বেতোয়ার দিকে নওজোয়ান সূরজের নজর পড়তেই মেয়ে গুটিয়ে নিল তার বিখরে হুয়ে আঁচল, তিরছি নজর। শ্যাওলা জড়িয়ে মুখ লুকিয়ে থাকল বর্ষার অপেক্ষায়।
দুপুরের ঠা ঠা রোদে জলের খোঁজে থেমেছি যে দোকানের সামনে তার গায়ে মস্ত পাকুড় গাছের ছায়া। সে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সন্দেহ ছিল, কিন্তু ফ্রিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা চিল্ড জল গালে ঠেকিয়ে গলা দিয়ে নামতে নামতে নিজেকেই নিজে আওড়ে নিই ডু নট জাজ দ্য বুক....
পাকুড় গাছটার তলায় উঁচু মাচার ওপর রাখা গোটা পাঁচেক মাটির হাঁড়ি, এরা বলে মটকি। দুটোর গায়ে লাল শালু জড়ানো। বছর পঁচিশের মা তার বছর আটকের মেয়েকে সেই হাঁড়ি থেকে জল নিয়ে খাওয়াচ্ছে। কচু-চুষি'র মাঠ পেরিয়ে, শিরোমণি ঠাকুরের পৈতেগাছা উড়তে উড়তে এতদূরের পাকুড়তলায় এসে পড়ল না কি সেই মেয়েটি যে একবুক তেষ্টা নিয়ে চলে গেছিল তারই ছায়া পাকুড়ের তলা বিছিয়ে আঁজলা ভরে জল তুলে দিচ্ছে এমন নিতান্ত দুপুরে, সেকথা বোঝার আগেই গাড়ি গড়িয়ে গেছে হুশ করে। ওরছার সাথে দেখা হলো কই?
ভরা দুপুরে হোটেলের ঘর থেকে বেতোয়ার নালাটার দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার কথা মনে আসেনা। আকাশের মেঘ দর্শনে শ্রীমতির কৃষ্ণ দরশন হয় অথচ এ পোড়া মানব শরীর মেঘটুকুও দেখতে পায়না। বাঁশি, নূপুর কিছুই তো চাইনি প্রভু, শুধু মেঘ হয়ে এসো......নালার ওপারে শাল পলাশের বন, তারও ওপারে ফসলের ক্ষেত। ধূ ধূ, রুখা।
কৃষ্ণের সাথে রামের তাত্ত্বিক অমিল এতটাই যে রাম যেমন কৃষ্ণভূমির ধারে কাছে ঘেঁষেন না তেমনই অভিমানে কৃষ্ণও মথুরার বাউন্ডারি পেরিয়ে সোজা পশ্চিমে হাঁটা দেন। যেই রাম সেই কৃষ্ণ জপতে জপতে রাম আর কৃষ্ণের দেখা হয় শেষমেষ সেই পতিতপাবণী গঙ্গার ঘাটে, বাংলার ফিউশন-ভূমিতে। তার আগে অব্দি ম্যাপের উত্তর মাথায় রাজা রাম আর গোষ্ঠিপতি কৃষ্ণর স্ট্যাটাস মেলেনা কিছুতেই। কৃষ্ণকে দূত কিম্বা সারথি খাড়া করা গেলেও মহাকাব্য থেকে দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের পাতা পর্যন্ত রামের আগেপিছে অনুজ লক্ষণ, অনুগৃহীত সুগ্রীব কিম্বা বিভীষণ হাত জোড় করে, হাঁটু মুড়ে বসেই জীবন কাটিয়ে ফেলছে। অথচ কৃষ্ণ যেন বাঁশি ছেড়ে অসি হাতে নন্দগোয়ালা'র পাড়া থেকে বের হতে পারছেননা কিছুতেই। অভিজাত রামের পাড়ায় কৃষ্ণ না এলেও বৃষ্টি এল। বৃষ্টিতে ভিজল ওরছার বন, পাকুড় গাছের ছায়া। জাহাঙ্গীর মহলের জাফরি ছুঁয়ে চতুর্ভুজ মন্দিরের মাথায় গড়িয়ে বৃষ্টি গিয়ে নামলো সেইখানে যেখানে রাজা হয়ে বসে আছেন রাম, প্রহরে প্রহরে গান স্যালুট দেবে বলে রাইফেল উঁচিয়ে আছে সরকারি পুলিশ। রামরাজার দরবার জুড়ে বৃষ্টি এল।
টিকমগড়ের দলটা এসেছিল বিয়ে বাড়ির বাজা নিয়ে। রোদ মাথায় করে, পাগড়ি আর পাল্লুতে মাথা বাঁচিয়ে আরেক দল গান গাইছে বসে। দলে দলে বরকনে গাঁটছড়া বেঁধে সুখী জীবন আর শুখা রোটির আশির্বাদ নিচ্ছে, ফিরে যাচ্ছে। প্রজাবৎসল রামের দরবারে আমজনতার লাইন। ভক্তি আর শক্তির পাঞ্চে সেইসব জনতা সামলাচ্ছে পুলিশ। রামের সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে জানলে আগাম ভেট আনাই নিয়ম, কিন্তু আনা আর হল কই? ভিড় বাঁচিয়ে গানের দলটাতে কনসেনট্রেট করতেই একজন হাত নেড়ে ডাকলো। কাছে যেতেই সরে গিয়ে বসে যাওয়ার খানিক জায়গা দিতেই হাতের তালে তালে বেজে উঠল গান। সুরে বেসুরে আমিও গেয়ে ফেললাম পায়ো জি ম্যায়নে রাম রতন ধন পায়ো...
উঁহু তাই বলে পাওয়া অত সহজ নয়। রাম কেন, কোন রতনই কোলের কাছে, বুকের ভেতর পাওয়া যে সহজ নয় সেকথা জানে মানুষ, তা সে নীলা হোক কিম্বা কড়ি, রাম হোক বা রামানুজ। তবুও গল্পরা বাড়ে ডালপালায়। রাণীমা ফেরেন রামকে কোলে নিয়ে, সঙ্গে শর্ত। যেখানে প্রথম রাখবে বাপু সেখানেই আমার ঠাঁই। আর তারপর অনাদি অনন্ত সময় ধরে আমিই হব সেদেশের রাজা। বলো রাজি?
রাজী না হয়ে রাণীর উপায় কী? অযোধ্যা ফেলে রাণী চললেন ওরছার পথে, ওদিকে কলায় কলায় বাড়তে লাগলো চতুর্ভুজ মন্দির। রাম আসছেন রাজা হয়ে, মন্দির রেডি, পুরোহিতও। অথচ যেই না ক্লান্ত রাণী তার রান্নাঘরের কোণে নামালেন রামের মূর্তি অমনি রাম জেদ ধরলেন এইখানেই আমাকে থাকতে দাও গো মেয়ে, শর্ত আমার ভুলে গেছ বুঝি?
শর্ত ভোলেনি কেউই, খেলাপও করেনি কোন পক্ষই। আকাশছোঁয়া মন্দির পড়ে রইল একপাশে, ধূপ দীপ নৈবেদ্য ফেলে রাম বসলেন হেঁসেলের পাশটিতে। তরকারির গন্ধ, ডালের ফোড়ন কিম্বা ভুজিয়ার গন্ধে চনমন করে উঠল তাঁর মন। ক্রমশঃ মানবতর থেকে মানবতম হয়ে উঠেন ঈশ্বর। এ গল্পের সত্যি বা মিথ্যা যাচাই করিনি গো মহামহিম। শুধু লোকবিশ্বাসে ঈশ্বরের এই যে ক্রমাগত মানবতর, সাধারণতর হয়ে ঘরের ছেলেটি হয়ে ওঠার ঝোঁক এইটিই ভারতীয় ভক্তিবাদের আসল সুর। ক্ষ্যাপা এই পরশপাথর খুঁজে বেড়ায় আজীবন আর উচ্চাকাঙ্ক্ষী খুঁজে পাথরের ছিদ্র। তারই তলে তলে বাড়ে ধর্মের দলাদলি, রাজনীতির এপার ওপার।
মানবত্ব ব্যাপারটাই বাড়াবাড়ি রকমের ভার্সেটাইল। স্নেহ, প্রেম, দয়া,ত্যাগে যতখানি মানুষ হয়ে ওঠা যায় ততটাই রাগ, হিংসা, কিম্বা প্রতিহিংসায়। রোমান্টিসিজমের মতো সূক্ষ্ম ব্যাপারস্যাপার মনে হয় এই দুই সত্ত্বার মিশেলেই কোন একদিন জন্ম নিয়েছিল খোলা আকাশের নিচে কিম্বা গুহার অন্ধকারে। সেইসব রোম্যানটিক গতিবিধি যত না হৃদয়ে ছাপ ফেলেছে তার চেয়ে ঢের বেশি ফেলেছে শিল্পীর তুলি কিম্বা ছেনিতে। মোনালিসার সাথে তাজমহলের জোর টক্কর হতেই পারে, জিতবে কিন্তু রোমান্টিসিজম।
এই যে এমন খর দুপুরের পর ভরা শ্রাবণের জলে ভেসে যাচ্ছে বেতোয়ার নালা, টিকমগড়ের দিকে গড়িয়ে যাওয়া রাস্তাটার দুপাশে গাঢ় সবুজ হয়ে উঠেছে শালের মাথা এসবের ফাঁকেই মারাত্মক রোম্যান্টিক হয়ে উঠেছে জাফরান রঙের বিকেল।
হোটেলের পেল্লাই গেট ঠেলে বেরোনোর জায়গা করে দিতে দিতে দারোয়ান জিজ্ঞেস করেছিল গাড়ি লাগবে কিনা। মধ্যবিত্ত পকেট প্যালেসমার্কা হোটেলের রেস্তোরাঁয় ষাট টাকায় একবোতল জল কিনতে কিনতে তখন অম্লশূলে ভোগা বাঙালির মতো জেরবার। বহু শতক আগেই কলহন জানতেন জিলজিলে রোগা, কালো, বেঁটে বাঙালির পেট আর পকেট দুইই অম্বলশূলে জীর্ণ। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী অবধি সে খবর পৌঁছে গেছে হাওয়ায়। কিন্তু সেকথা দারোয়ানকে বলা চলেনা। বললেই সে এমন চোখে তাকাবে যেমনটা প্যাস্ট্রির দোকানে লেড়ো বিস্কুটের খরিদ্দারের দিকে তাকায় মালিক।
ঝাঁসি থেকে আসা গাড়ি দুপুর অব্দি থেকে চলে গেছে, যদিও গাড়িদের দুনিয়ায় অলবিদা বলে কিছু হয় না। ট্রাকের পেছনে হামেশাই লেখা থাকে ফির মিলেঙ্গে। যেসব ছোটগাড়ির পেছনে বান্টি আউর বাবলি লেখা থাকে নিশ্চিত জানি সেইসব গাড়ীদের সাথে দেখা হয়ে যাবে প্রত্যেক মোড়ে মোড়ে। দারোয়ানকে বলি বৃষ্টি পড়েছে, যাই একটু হেঁটে দেখে আসি । কম কথার মানুষ দারোয়ান স্যালুট ঠুকে রাস্তা ছেড়ে দেয়, মনে মনে বোধহয় বলে "এ বাঙ্গালী পাবলিক ভারী কঞ্জুস আছে "।
ঝরঝর জল তখনও ওপারের ক্ষেত থেকে কলকলিয়ে ছুটে যাচ্ছে বেতোয়ার নালায়। পায়ের পাতা ডুবতে না চাইলেও ডুবোচ্ছে ইচ্ছেমতো। দুয়েকটা ফড়িং পিড়িং পিড়িং উড়ে বেড়াচ্ছে নাকের ডগায়। এইসময় ঘাসের মাথায় খুঁজলেই লাল টুকটুকে ভেলভেট পোকাদের সাথে দেখা হয়ে যাবে ঠিক। কাঁচা রাস্তাটার মাথায় দাঁড়ানো টোটো থেকে রাজ বাব্বরি কায়দায় যে মুখটা বের হয়ে এল তারই পেছনের সিটে বসা স্বপ্নও কি রাণী শর্মিলী স্মাইলে তাকাল আমার দিকে।
সাম্য, শিক্ষা, সভ্যতা এইসব শব্দগুলো যতটা কেতাবে থাকে তার সিকিভাগও যদি রিয়েল লাইফে ইমপ্লিমেন্ট করা যায় তবে পৃথিবীর নাম হত ওয়ান্ডারল্যান্ড। পুরো টোটো দখল করে বসে আছে শর্মিলা ঠাকুর। সিনথেটিকের শাড়ির আঁচল কোমরে প্যাঁচিয়ে। শাড়ীটা শেষ কবে ধোয়া হয়েছে গেস করা মুস্কিল, কাঁচাপাকা মাথাভর্তি চুল তার ছোট্ট কপাল ঘিরে। চোখের তলায় বয়সের চেয়ে কিছু বেশি ভাঁজ। কুড়োনো শিশি বোতল, পালস্টিকের ভাঙ্গা হাতল কিম্বা বাটি সমেত বাঁধা বস্তাটা সিটের নিচে পা রাখার জায়গায়। চটিজোড়া বাধ্য হয়েই সিটের ওপর খোলা।
এ টোটোয় হম নেহি জায়েঙ্গে। তুমি যাও বাপু। ...এতক্ষণে তির্ছি টোপির নিচে রাজ বব্বরের মুখটা ভালো করে দেখা গেল। বছর ষোলো'র মুখে গোঁফের রেখা এখনো স্পষ্ট নয়। চোখদুটো একটু নিস্তেজ। জীবনটা ঠিক মুভি স্টাইলে চলছেনা তার সে তো হাসিতেই খানিক মালুম।
চলিয়ে না। ইসকো উতর দেতে হ্যায়। তুম উতর যাও.....
ক্রাইসিস নয়, এর নাম ক্রিটিক্যাল মোমেন্ট। ঠিক এই মুহূর্তে স্কুলের বইয়ে পড়া যাবতীয় ভালো ভালো জ্ঞান, ন্যায় অন্যায়, অধিকার, বিনয় ইত্যাদির সাথে ঠেকে শেখা, অভিজ্ঞতা, এমনকি গান্ধীজিকে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেওয়ার গল্পটা অব্দি এসে চোখ রাঙিয়ে গেল।
দ্বিধা তবু আটকে থাকে পায়ের পাতায়।
এ্যায়সে কিউ করতে হো? চলো না! আও বৈঠো। বলতে বলতে বস্তাটা তুলে ফেলে টোটোটার ছাদে, চটিজোড়া সিট থেকে তুলে কোলে তুলে নিতে নিতে এক সাইডে সরে বসে। এতেও রাজি না হলেও চলত, কিন্তু ওই যে অ্যাইসে কিউ... বলতে বলতে যে হাসিটা হেসেছিল তেমনটা শর্মিলা ঠাকুরও পারবেনা। কী কনফিডেন্ট, এলিগ্যান্ট অথচ নরম আলোর মতো হাসি! এত্ত সুন্দর কাউকে শেষ কবে দেখেছি? ব্যক্তিত্বহীন আমার অত সাধ্য কই যে ওই হাসিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই। এ যেন সেই পাতাকুড়োনি দুয়োরাণী। রাজ্য নেই, রাণীত্ব নেই তবু কী ভীষণ রাজকীয়!
বেতোয়ার পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্মৃতিসৌধ আর পাতাকুড়নির গল্পটা মিলেমিশে যায় বেলাশেষের আলোয়। মেঘভাঙা শেষ বিকেল নেমেছে সৌধের মাথায়, চামচিকিদের ঘরের ভেতর ঢুকে পড়া চোরাগোপ্তা আলোয় গুটিয়ে আসছে দিনের সাম্রাজ্য। রামরাজার রাজত্বে রাত নামার আগে ব্যাগের ভেতর কেউ কুড়িয়ে রাখছে টুকরোটাকরা আলো প্রদীপের শিখায় রাখবে বলে ।
এএসআইয়ের বোর্ডগুলো থেকে লেখা মুছে গেছে । পড়ে বোঝা মুস্কিল কোন সৌধ কার। সে একরকম ভালই। এই টুকরো আকাশ, চিলতে আলো, টুকরো টুকরো সবুজ আর একবুক বেতোয়ার গভীরে শুয়ে থাক মানুষের স্মৃতি যারা কেউ রাজা ছিল, কেউ বা রাণী, কেউ বা নিছকই রাজ অনুচর।
নিরীশ্বরবাদী স্যাংখ্যদর্শন কোন কেমিস্ট্রিতে ঈশ্বরবাদী হিন্দুর কাছে মান্যগণ্য হয়ে উঠল সে এক মস্ত ঘোরালো ব্যাপার। মহাভারতের শান্তি পর্বে বলা আছে সাংখ্যদর্শনের চেয়ে বড় বিদ্যা আর নেই। আবার মহাভারতের কৃষ্ণই জোরে জোরে অর্জুনকে বলছেন কর্মণ্যেবাদি করস্তু মা ফলেষু কদাচন। সাংখ্যবাদী কপিলমুনি বলছেন এই সৃষ্টির চেতনরূপ পুরুষ বিকারহীন , কর্মহীন । প্রকৃতিই সমস্ত ক্রিয়া ও গুণের আধার । আর পুরুষ ও প্রকৃতির পারফেক্ট ব্যালেন্সে তৈরি হয় বিশ্বচরাচর। সেই জায়গাটাতেই কৃষ্ণ বলছেন কর্ম করো (প্রকৃতির ধর্ম )কিন্তু বিকারহীন (পুরুষের ধর্ম) হয়ে। সোজা কথায় প্রকৃতি আর পুরুষের ইকুইলিব্রিয়ামে পৌঁছনোতেই মানুষের পারফেকশনের রাস্তা খুঁজেছেন।
অথচ হিস্টোরিক্যালি মানুষ নিজেই নিজেকে কন্ট্রাডিক্ট করতে করতে মানুষেই ঈশ্বর খুঁজেছে বারবার। কবীর থেকে লালন হয়ে দুদ্দু শেখ , আউলচাঁদ, বলাহাড়ি কিম্বা রামধনীরা খুঁজে বেড়ায় সহজমানুষ। মানুষ ভজনার রাস্তাতেই মুক্তি খোঁজে। রামসীতা কিম্বা রাধাকৃষ্ণে পুরুষ আর প্রকৃতিত্ব চাপিয়ে দিয়ে নিরাকারকে আকারে ধরার চেষ্টায় ঘোরে ভক্তমানুষ।আর দেখতে দেখতে ভক্তির গান , বিশ্বাসের গান লোকজীবনের গান হয়ে ওঠে।
জাফরানরঙা আলোয় বেতোয়ার তীর ভেসে যাচ্ছে গানে। পাকুড় গাছের নীচে বসা দুই সাধু হারমনিয়াম আর পাখোয়াজে রামগানের সুর ছড়িয়ে দিচ্ছে ঘাটের সিঁড়িতে। স্থির স্থবির সৌধের ছায়া পড়েছে জলে। জাফরান রঙ সিঁদুররঙ, ম্যাজেন্টা হতে হতে নীল হয়ে ঢলে পড়ছে সন্ধ্যার দিকে।
সুন্দরের টোটো ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে হোটেলের রাস্তায়। সুন্দর মিশ্রা, বয়স সতেরো। স্কুলছুট, টোটো চালায়। যাওয়ার সময় যে নামিয়ে দিচ্ছিল ওই গার্বেজ-কুড়োনি দুয়োরানীকে, বড় ভাড়া বেহাত হওয়ার ভয়ে। আমার মেয়ের থেকে বয়সে অনেকটা ছোট সুন্দর থতমত খেয়েছিল আইসক্রিমটা হাতে পেয়ে, নিতে চায়নি। একটু অবাক চোখে তাকিয়ে চালাতে শুরু করেছিল, বলছিল পরে খাবে। কিন্তু আইসক্রিম তো ততক্ষণ অপেক্ষা করে আইস ফর্ম বজায় রাখবে এমন গ্যারান্টি কোম্পানি দেয়নি। ওকে বলেছিলাম খেয়ে নিয়ে তারপর চালাতে। ঠিক তখনই জানা গেল বিকেলের ওই শর্মিলা ঠাকুর আর সুন্দর একে অন্যকে হাসিতে টেক্কা দিতে পারে।
সবুজ বন, ভেজা রাস্তা আর সুন্দরের
বকবক শুনতে শুনতে পৌঁছে গেছি একসময়।
–স্কুল ছেড়ে দিলি কেন রে?
–নাইন মে দো দো বার ফেল হো গিয়া ।
–কোন সাব্জেক্টে ফেল করেছিলি?
–হিস্ট্রি , ইংলিশ আউর সায়েন্স।
– একটা টিউশন নিতিস না হয়?
–পয়সা নেহি থা। ঘর মে তিন ছোটা
ছোটা ভাইবহেন ভি হ্যায়।
– পাপা হ্যায় না?
–হ্যায়।
–ক্যায়া করতে হ্যায় বো?
–দারু পিতা হ্যায়।
সুন্দরের গলা গিয়ে থামে সেইখান যেখানে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সন্ধ্যালগ্নে রথের ওপর বসা যুধিষ্ঠির আকুল দ্রোণাচার্যের দিকে চেয়ে উচ্চারণ করছেন "অশ্বত্থামা হত, ইতি গজ...", মাথা ঝুঁকে পড়েছে বুকের ওপর। চোখের দিকে তাকাতে ভয় হয়।
সুন্দরকে জিজ্ঞেস করিনা কত নেবে। কিছু টাকা দিই।
খুশি তো? পিচিক করে আবার সেই হাসিটা হাসে সুন্দর, ঠিক যেমনটা হেসেছিল তার শর্মিলা ঠাকুর। "ফির আনা..." বলতে বলতে অন্ধকার রাস্তায় মিলিয়ে যায় সুন্দর। সন্ধ্যা নামে গাঢ় হয়ে – রামরাজা সরকারের মন্দিরে সালামির তোপ পড়ে গুম গুম গুম...

0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন