ঘরওয়ালি-র নাসির… ফিরে
দেখা_
প্রতি,
হে দর্শক... ওই দেখুন, একুশ শতকের নামী সিনেমার
অভিনেতার পোস্টার। হ্যাঁ, আরও দেখতে, জানতে,
বুঝতে থিয়েটার দেখতে হবে। আমি একজন দর্শক। যে নাটক সিনেমা দেখতে
ভালবাসি। এই ভালবাসার কারণ ছিল একটা। বিশেষ করে দেখতে পাওয়া। আমার সেই অবুঝ বেলায়
কতগুলো আলো চোখের সামনে নেচে বেড়াত। কখনও প্রজাপতি রঙের। কখনও হলদে রঙ মেখে যায়
গায়ে পায়ে। সব মিলিয়ে দারুণ ব্যাপার! কখনও হাততালি দিচ্ছে। আমিও দিয়েছি তাল
মিলিয়ে। সেসব অন্ধকার ঘরের মধ্যে চোখের সামনে কিছু মানুষের ঘোরাঘুরি। মা বলতেন,
অভিনয় করছেন। নাটক। না না থিয়েটার! থিয়েটার দেখতে যাব, যাচ্ছি, গেছি... একটা থিয়েটারের কথা লিখি।
নাসিরউদ্দিন শাহ-র অভিনয়। একক ভূমিকা, কথক ও অভিনেতা। সে
দারুণ। নাম বলতে পারবেন কেউ?
নাটকের নাম মনে নেই। নাটকের আর যে বা যাঁরা কুশীলব, তাঁদেরও মনে নেই। শুধু মনে রয়েছে... নাসিরউদ্দিন শাহ-এর একক অভিনয়। হ্যাঁ,
আরেকটু পরেই শুরু হবে। মানে হয়েছিল সেদিন। দিন, তারিখ মনে নেই। মনে পড়ে সন্ধ্যা। অডিটোরিয়াম, এন এস
ডি-র। আর ব্যক্তিগত স্মৃতি।
এই ‘আলো দেখা’—এই নেশাই আমাকে বড় হয়ে শহর থেকে শহরে টেনেছে।
সিনেমা পর্দা আমার কাছে জানলা—দূরের পৃথিবী দেখা যায়। কিন্তু থিয়েটার? থিয়েটার ছিল দরজা, যেখানে আমি ঢুকে পড়ি, আবার বেরও হয়ে যাই। এই যাওয়া-আসার তীব্রতা, মানুষের মুখ, আলো-ছায়ার শব্দহীন সংলাপই আমাকে একদিন পৌঁছে দেয় দিল্লির এন এস ডি-তে। 'সেখানে ছিলাম আমি...’ আলো-নেশাগ্রস্ত এক মানুষ। যে কিনা থিয়েটারের অন্ধকারে
শ্বাস
নিতে শেখার চেষ্টা করছে। এবারে
ফ্ল্যাশব্যাক... স্মৃতিময় স্তর, খুব সম্ভবত নাট্যকার কৃষ্ণা চন্দর-এর গল্প
অবলম্বনে তৈরি ‘ইস্মত আপ কে নাম’ সিরিজের অংশ… ‘ঘরওয়ালি’? যদি তাইই হয়… “ঘরওয়ালি (Gharwali)”
- কাহিনি, চরিত্র, আবহ, অভিনয়ের ধরন।
লেখক: ইসমত চুঘতাই। নাট্যরূপদান ও
অভিনয়: নাসিরউদ্দিন শাহ। আপন স্মৃতির সঙ্গে সবচেয়ে মিল থাকা
অংশ।
কুর্তা-পাজামা। একক ন্যারেশন। ঘুরে দাঁড়ানো, কুর্তার ঝুল ঘুরে ‘ঘাঘরা-ভাব’ তৈরি
হওয়া। আলো একটু কমে–বাড়ে। মঞ্চে খুব কম
প্রপ। উর্দু–হিন্দির মিশ্র গদ্যরীতি।
এবার,
আমার দেখা সেই রাত।
মঞ্চে তিনি এলেন - নাসিরউদ্দিন শাহ। ছোট ঝুলের সিল্কের কুর্তা, নরম আলোয় রঙ বদলায়—কখনও ধূসর, কখনও নীলচে, কখনও যেন সোনালি ধুলো লেগে আছে।এমন সাধারণ পোশাকও কেমন রাজকীয় হয়ে ওঠে তাঁর গায়ে - এটাই তাঁর বিশেষত্ব। আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল, আর এক মুহূর্তে তৈরি হল এক নতুন পৃথিবী। না কোনও বড় সেট, না প্রপ - শুধু তাঁর কণ্ঠ, শরীর, আর শ্বাসের ভেতরে জন্ম নিল মির্জা। মির্জা…।
গল্প সামাজিক। আরে, গল্প তো সামাজিকই
হবে। নইলে চরিত্ররা আসে কোত্থেকে!
গল্প — একজন বয়স্ক পুরুষ মির্জা , তার
নিঃসঙ্গতা, সরলতা, আর তার জীবনে আচমকা
ঢুকে পড়া চঞ্চল, স্বাধীনচেতা যুবতী লাজো। কেন্দ্রীয় চরিত্র
মির্জা - একজন মধ্যবয়স্ক একা থাকেন। তার ঘর, রান্না, পরিষ্কার সবকিছু বিশৃঙ্খল। একদিন তার জীবনে আসে লাজো - এক চঞ্চলা, কম বয়সি মেয়ে। সে কাজ করতে আসে মির্জার বাড়িতে।
লাজো দিনে দিনে বুঝে যায়। এ বাড়ির মালিক বোকাসোকা।
সহজ। একলা। তাকে দিয়ে
অনেক কিছু করিয়ে নেওয়া যায়। লাজো ধীরে ধীরে মীরাজাকে মেপে
ফেলে। সে ঘর পরিষ্কার করে, রান্না করে।
বুড়োর সামনে লাজুকতার অভিনয় করে। আবার কখনও
খুব স্পষ্টভাবে তাকে উত্তেজিত করে। একটা দৃশ্য আছে যেখানে
নাসিরউদ্দিন শাহ কুর্তা ঘুরিয়ে, কোমর নেড়ে লাজোর অভিব্যক্তি
দেখান — এটাই হয়ত স্মৃতির ‘ঘাগরা-ভাব নাচ’।
মির্জা লাজোর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। সে লাজোর ওপর কোনওই নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না, উল্টো লাজো তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। লাজো চাইলেই ঘর
থেকে বেরোয়, আবার আসে। অন্য পুরুষদের
সঙ্গে কথা বলে, মির্জাকে ঈর্ষা করায়।
লাজো মির্জাকে শারীরিকভাবে প্ররোচিত করে।
এটা খুব সূক্ষ্মভাবে দেখানো হয় - নাসিরউদ্দিন শাহ কেবল দেহভঙ্গি ও
কণ্ঠের ওঠানামায় এটা করেন। হাস্যরস, দেহভঙ্গি, চোখ ঘোরানো - সব মিলিয়ে।
কিন্তু মঞ্চে যা দেখলাম, তা গল্পের পুনর্কথন
নয়, বরং দু’জন মানুষের নিঃশব্দ টানাপোড়েন, ক্ষমতার লড়াই,
আকর্ষণ, দখল, আবার ছেড়ে
দেওয়া - সবই ফুটে উঠছিল একমাত্র একজন মানুষের শরীরে।
সবচেয়ে বিস্ময়কর মুহূর্ত - যখন নাসির লাজোকে ফুটিয়ে তুলতে কোমর
দোলালেন,
কুর্তার ঝুল হাওয়ায় হালকা ঘুরে উঠল। এক সেকেন্ডের জন্য মনে হয়েছিল,
যেন সত্যিই এক মেয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে।
কোনও বাড়াবাড়ি নয়, না কার্টুন - শুধু দেহভঙ্গির নিখুঁত স্বরূপান্তর। মির্জার হাসি কিঞ্চিৎ বোকা, নিঃসঙ্গতার গন্ধ মিশে আছে। লাজোর চোখ—তির্যক, চঞ্চল, প্রায় জ্বালাময়ী। “আরেহ জনাব…” এই উর্দু উচ্চারণে এক অদ্ভুত দুষ্টুমি।
সব বদল হচ্ছিল চোখের, কণ্ঠের, ভঙ্গির সামান্যতম নড়াচড়ায়। নাটকের চূড়ান্ত শক্তি এখানেই - এক শরীরের মধ্যে দুই জীবনের ওঠানামা। এক মুহূর্তে বৃদ্ধ, পরের মুহূর্তে নবযুবতী। এটাই থিয়েটার, এটাই জাদু।
শেষ দৃশ্যে লাজো ফিরে আসে - আর মির্জার মুখে ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত শান্তির হাসি। নাসিরের শরীরে অভিনয় তখনও সত্যিকারের সুখের প্রতিমা সাজে। হ্যাঁ, মঞ্চের বাঁ-দিকে নাট্য ঘটনার শেষ ধাপ। আলো? রঙ মনে নেই। তবে, হলুদ আর নীল মনে হচ্ছে এই দৃশ্যে মিলবে-মেলাবে। তাই… মধুরও সমাপন।
নাটক শেষ হওয়ার পরও সেই মির্জা আমার সঙ্গে চলল অডিটোরিয়ামের সিঁড়ি বেয়ে। তারপর? তারও পরে পোশাক পাল্টে তিনি এলেন নৈশভোজ আসরে। যেন তিনি আর পাঁচজনের মতো একজন। একজনই বটে! তিনি একজন অভিনেতা। অফ হোয়াইট শার্ট আর ধূসর ট্রাউজার। কেশ বিন্যাস সাদা, মেকআপ ছাড়াই। চশমা। অনেক গুণী মানুষ। হাসছেন, কথা কইছেন... তিনিও। আমার ঝাঁপি থেকে এই স্মৃতি লাফিয়ে তুলল স্বপ্ন থেকে। আর তাই লেখা গেল, এবারের ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি।
ও হ্যাঁ, স্মৃতির ছবির নেগেটিভ পজেটিভ হল
লেখায়। আর ছবি, ওয়েব মাধ্যম থেকে নেওয়ার ঋণ।
__ইতি
একুশ শতকের এক ফ্ল্যাশব্যাক স্বত্বাধিকারী


0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন