কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১৩৭

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১৩৭

শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

ছেঁড়া শেকড়ের অন্তরাখ্যান

 


(৯)

সেই তুমি বিষাদের স্মৃতি নিয়ে সুখী, মানচিত্ররেখা…

ঘরে বিছানায় চোখ বুজে শুয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ। জ্বরে ভুগছিলেন বেশ ক-দিন। সাবু, বার্লি, সঙ্গে জ্বরের মিক্সচার খেতে হচ্ছিল। সবে পথ্য করেছেন। শীর্ণ চেহারা বড় দুর্বল দেখায়। ফাল্গুন শুরু, শীত গিয়ে গরম পড়ছে। দুপুরের দিকে পরপর ক-দিন নানা কাজে বেরোতে হয়েছিল। স্কুল তৈরির কাজ অগ্রসর হয়েছে। তাঁর নিজের এলাকা ছাড়িয়ে হেঁটে হেঁটে এদিক-সেদিক আরও গিয়েছেন। দিনের বেলা ছাড়া উপায় নেই। কাঁচা রাস্তা শুকনো এখন, বাতাস ধুলোয় ভরা। এখনও পর্যন্ত এসব অঞ্চলে ইলেকট্রিক লাইন আসেনি। চেষ্টা চলছে, কবে পাওয়া যাবে কেউ বলতে পারেনা। সন্ধের পরে ঘরে-ঘরে রেশনের হিসেবি কেরোসিনে ডিবরি আর হ্যারিকেনের মিটমিটে আলো। ডোবা, আগাছার ঝোপজঙ্গল, মশা, পোকামাকড়, এবড়ো-খেবড়ো কাঁচাপথ। তাই দিনে ছাড়া ঘোরাফেরার উপায় নেই। গাছপালা অনেক, হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হলে খানিক জিরিয়ে নেওয়া যায়। অবশ্য উৎসাহী মানুষ পেয়েছেন প্রায় প্রতি ঘরে। ফেলে-আসা দেশ, সংসার, ভিটের শোকে দগদগে মানুষ অন্য কার জমি দখল করে কোনওরকমে বেঁচে থাকা। অনেকের আত্মীয়-পরিজন পড়ে আছে ওদেশে, ভালো নেই তারাও। যারা অনেক আগে এপারে চলে এসেছে, ইতিমধ্যে এদেশের নানা প্রান্তে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে। এমন সব কথার সঙ্গে কথা জুড়ে সম্পর্ক জন্ম নেয়। ধীরেন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন কাকাবাবু, দাদাবাবু, জ্যাঠামণি। প্রাক্তন শিক্ষক বলে তাঁর কথা শোনে মন দিয়ে। পরিশ্রমে আর ক্লান্ত লাগে না, নতুন করে বেঁচে ওঠেন কাজ করতে করতে। মিটিং হয়, অনেকেই আসে শুনতে। কাজ করতে আগ্রহ দেখায়। অনেকের ঘরে ছোটো ছেলেমেয়ে। এই বনে-বাদাড়ে কাছাকাছি স্কুল কোথায়? যারা একটু বড়ো, তারা অনেকটা হেঁটে স্কুলে যায়। তিনি সুযোগ দিয়েছিলেন অমলাকে, নিরঞ্জনকে। আশা ছিল, অনেকদূর যাবে। সমস্ত ইচ্ছা পূরণ হয়না। স্বপ্ন ভর করে, স্কুলের সঙ্গে নতুন বসতিগুলোতে শিগগীরই ছেলেদের জন্য পরিচ্ছন্ন খেলার মাঠ, মেয়েদের জন্য সেলাইশিক্ষার, গান শেখার স্কুলের বন্দোবস্ত হবে। বাজারের দিকে জনাদুই খবর-কাগজ বিক্রিওয়ালা আসে। ভোরবেলা কাছাকাছি পুরনো নিরিবিলি সুভদ্র পাড়া, বড়ো রাস্তার অদূরে সুন্দর একতলা-দোতলা পাকা বাড়ি, হয়ত বা একটুকরো বাগান, গাছে-ছাওয়া চমৎকার পাকা রাস্তা আছে যেখানে, সেখানে কাগজ বিলি করতে যায়। আসা-যাওয়ার পথে একএকদিন ধীরেন্দ্রনাথ দেখতে পান। বেলা বাড়লে যে ক-খানা কাগজ পড়ে থাকে বাজারে নিয়ে বসে। বাজারের কোনও দোকানের সামনে বাঁশের ঠেকো-দেওয়া বসার ব্যবস্থা। একএক দিন তিনি বসেন, আগত মানুষদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। খবরের কাগজের পৃষ্ঠা ওলটান। মন অপ্রসন্ন হয়। অনবরত মাথায় গুজগুজ করে, উদ্বাস্তুদের নিয়ে চলতি সরকারের সমস্যার শেষ নেই। ক-বছর ধরে ওপার থেকে আসা ছিন্নমূল দরিদ্র মানুষকে কিছুটা জোর করেই আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে পাঠিয়েছে। সেখানে নাকি নতুন বসতি হবে, উপনিবেশ। একদিন শিবনাথ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল,

সে জাগা কেমন কাকাবাবু?”

বইতে পড়ছি আদিম অধিবাসীরা থাহে। তির-ধনুক দিয়া পশু মাইরা খায়। সাপখোপ, বইন্য জানোয়ার। সমুদ্রে কুমীর, কামট, হাংগর।

আমার চিনা এক ফেমিলি গেছে। আর আসতে পারব না?”

কেডায় জানে? স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগে কালাপানি কইত। বিপ্লবীগ ইংরাজ সরকার শাস্তি দিয়া হেই দ্যাশে দ্বীপান্তর করছে। ফাসি দিছে। যারা গেল হেরা কেমন আছে?”

আর খবর পাই নাই। সরকার আশা দিয়ে নিয়া গেছে – জমি দিবে, থাকার ঘর।

চুপ করে থাকেন ধীরেন্দ্রনাথ। এমন দুর্ভাগ্য যেন তাঁর পরিবারের কারও না হয়। মানুষ কি প্রাণহীন মাটি না বালি? এক জায়গা থেকে ঝোড়া করে তুলে অন্যত্র ফেলে দিলেই বসতি তৈরি হবে! শিবনাথ তাঁকে লক্ষ করে,

ভাইবেন না কাকাবাবু। আমাদের কাজ, লড়াই আমাদের লড়তে হইব।

ছেলেটিকে বেশ লাগে ধীরেন্দ্রনাথেরআশাবাদী, উদ্যমী, কর্মঠ। পিতৃহীন পরিবারে নিঃশব্দ লড়াই করে চলেছে এরা পাঁচজন। চার ভাই, বোন বাসন্তী। মাত্র ক-বছর তাঁরা পাশাপাশি, তাতেই আত্মীয়ের অধিক হয়ে উঠেছে। কতবার ভেবেছেন, এদের সঙ্গে সম্পর্ক করলে কেমন হত? অমলাও কাছে থাকত, রোজ দেখাশোনা। তাঁদের স্কুলে যোগ দিতে পারত। কিন্তু তারাসুন্দরীকে বলতে পারেন নি। তারাসুন্দরী রাজি হবেন না। এক জায়গায় পাশাপাশি ঘর, লোকে কী বলবে? তার ওপর অমলা সুন্দর, লেখাপড়া শিখেছে। একাধিক ভালো সম্বন্ধ আসছে। তারাসুন্দরী মুরারীর ছোটো ভাইয়ের সঙ্গেও অমলার সম্বন্ধ করতে চান না। বোনে-বোনে একই ঘর নাকি ভালো না। অমু নিজে কী চায়? অবশ্য তার মত নিয়ে কে মাথা ঘামায়? শেষ পর্যন্ত যা তাঁরা ভালো বুঝবেন তাই হবে। ধীরেন্দ্রনাথ শুয়ে শুয়ে ভাবেন, কেমন যেন মনে হয় দিন ফুরিয়ে এল। আর উঠে বসতে পারবেন না।

টুইটুই করে একটা পাখি ডাকছে অনেকক্ষণ ধরে। নানারকম পাখপাখালি, পোকামাকড়ের ডাক শোনা যায় দিনে-রাতে। ধীরেন্দ্রনাথের জন্য পেঁপে, থানকুনিপাতা দিয়ে জিরা ফোঁড়ন দিয়ে পাতলা জিয়ল মাছের ঝোল করে দিচ্ছেন তারাসুন্দরী। এক সময়ে লোক ডেকে ঢেঁরসের জঙ্গল পরিষ্কার করিয়ে চারা পুঁতেছিলেন। এখন ফনফনিয়ে বেড়ে উঠেছে। পেয়ারাগাছ, পেঁপেগাছ, একপাশে জায়গা করে পুঁই, পালং, নটেশাক। শিউলিগাছ ছিলই একটা, বিনবিনে শুঁয়োপোকা হয় তবু কাটান নি। চালগুঁড়ো আর ডালবাটায় ডুবিয়ে শিউলিপাতার বড়া খেতে চমৎকার। মুখের স্বাদ ফেরে। টালির চালে কচি লাউডগা, গোল লাউ, কখনও বা ঈষৎ কলসাকার – সোনারঙ রোদে চিকচিক চিকন গা। তারাসুন্দরীর হাতের বড়ি দিয়ে লাউঘন্ট অতি সুস্বাদু। আর লাউ-ছেঁচকি – খোসাটুকু ভাপিয়ে, সরষে, কাঁচালঙ্কা শিলে বেটে, তেলে নেড়ে গরম ভাতে মেখে খেলে অমৃতের স্বাদ হার মানে। নিয়ম করে গাছপালার যত্ন নেওয়া হয় না। অবহেলায় ঘুঁটেপোড়া ছাই বা ভাতের ফ্যান কি মাছধোয়া জল ঢেলে দেন গাছের গোড়াতে। জল দিতে হলে টিউবওয়েল পাম্প করে এনে দেয় অমলা কিম্বা নিরঞ্জন। মাটি খুঁড়ে দেয় খুরপি দিয়ে। অমলা ভালোবাসে গাছপালা, মাটি ঘাঁটতে। ইদানিং তাকে কাজ করাতে মায়া লাগে তারাসুন্দরীর। ছোটো মেয়ে, কোলপোঁছা আহ্লাদী ক-দিন পর শ্বশুরবাড়ি যাবে। ধীরেন্দ্রনাথের অসুখের জন্য অমলার মন ভালো নেই। বাসন্তী প্রায়ই দুপুরবেলা আসে তাকে সঙ্গে দিতে, গল্প করে বসে বসে। ক্লান্ত তারাসুন্দরী সংসারের কাজ সেরে ঘুমিয়ে পড়েন। বাসন্তী এঁদের শ্রদ্ধা করে, ভালোওবাসে।

দুপুরে খাওয়ার পর অমলা ঘরের দক্ষিণের দরজা খুলে ঘরের মেঝেতে বসে পা বাইরে রেখে গরম রোদ্দুর সেঁকে। গাছের গন্ধ আসে। একটু আগে সেলাই নিয়ে বসেছিল। আর ভালো লাগছে না। ছুঁচ, সুতোর লাছি, কাপড়ের টুকরো ছড়িয়ে আছে। গুজরাতি স্টিচ শেখা শুরু হয়েছে। এরপর কাচ বসাতে হবে। যদিও মাঝে মাঝে একঘেয়ে, তবু মন্দ লাগছে না। নিরন্তর গল্পের বইতে ডুবে-থাকার নেশাতে ভাগ বসিয়েছে সেলাই। সেলাই শিখতে যাওয়া আর টুকিটাকি আনতে দোকান যাওয়া ছাড়া তারাসুন্দরী আজকাল বাইরে বিশেষ বেরোতে দেন না। কোন গাছ থেকে কোকিল চীৎকার করছে। অমলা ঘাড় উঁচিয়ে এদিক-সেদিক দেখার চেষ্টা করল, দেখা গেল না। মনের মধ্যে কী এক সুর গুনগুনিয়ে উঠল। তার চুপিচুপি ইচ্ছে করে গান শিখতে। কলেজের এক সহপাঠিনী চমৎকার রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত। খুব ডাঁট ছিল, ‘দক্ষিণী বলে কোথায় যেন শেখে বলত। এখন আর ট্রামভাড়া দিয়ে গান শিখতে যাওয়া সম্ভব নয়। বাসন্তীর গলাতেও বেশ সুর আছে। ক-দিন ধরে আড়ে-প্রকারে সে অমলার বিয়ের কথা জানতে চাইছে।

তোর বিয়ের সম্মন্দ হচ্ছে, না রে?”

অমলার মুখ লাল হয়ে যায়। সে জবাব দেয়নি, তারাসুন্দরীর বারণ। ঘেঁষাঘেঁষি ঘর, বেড়ার দেওয়াল। একটু কান পাতলে পাশের ঘরের টুং-শব্দটাও শোনা যায়। বাসন্তী বলে,

তুই সুন্দরী, যে পাত্র তোরে দেখবে, সে-ই পছন্দ করবে।

এইসব কথা প্রায়ই শোনে সে। ভারী লজ্জা করে তার। একটু হেসে বলল,

সুন্দর না বান্দর! দ্যাখ না, মা সর্বক্ষণ কয় যে আসল কাজে মুষল নাই, সুন্দর ধুইয়া কি জল খাবে মানষে? আমি একটা অকম্মার ধাড়ি। তুমি ত কত কাজ পার।

কাজগুলা আগাইয়া আমার ঘাড়ে আইয়া পড়ছে, কী করি বল? আমারে কেডায় বিয়ে করব? বুড়িধাড়ি, কালো, মোটা, হাসি দিলে মাড়ি দেখায়

কোথায় কালো?”

বাসন্তী আপনমনে হাসে। অমলা সঙ্কুচিত হয়ে চুপ করে থাকে। বাসন্তী আর যা বলেছে সেটা শোনার পর থেকে মনের মধ্যে উচাটন। মা-কে বলতে পারেনি। ছোড়দিদি আসেনা অনেকদিন। চিঠিতে সমস্ত লেখা যায় না। অমলা মাথা নীচু করে কত কী ভাবে, আপনমনে মাটির ওপর আঙুল ঘষে। বাতাসে ছেঁড়া পালের মতো ফৎফৎ করে মন উড়তে থাকে। বাসন্তী চুপিচুপি বলেছে,

তুই আমাদের ঘরে আসবি? অজাত-কুজাত না, জানস ত আমরা ব্রাহ্মণ। আমাদের শিবু তোকে, মানে তার তোরে খুব ভালো লাগে। তুই বল। আমি তালে কাকাবাবু আর খুড়িমারে এসে অনুরোধ করব। আমার মায়ে ত থেকেও নাই।

আমি! কী বলব বাসন্দিদি?”

বলবি না ক্যান? ভিজা ন্যাকড়া হয়ে থাক তাইলে। এই জীবনটায় কত কিছু দেখলাম, সহ্য করলাম

কত ঘটনা জানিয়েছে বাসন্তী। পিঠোপিঠি দিদি হেমন্তী ছিল শান্ত নিরীহ। মেয়েটা বিয়ের কিছুদিন পর সেই যে বরের সঙ্গে চা-বাগানে গেল, আর দেখা হলনা। হেমন্তীর ছেলে হওয়ার খবর দিয়ে টেলিগ্রাম করেছিল সুখেন্দুবিকাশ। তখন গভীর দুঃসময়, দেশ কাটা পড়েছে। দলে-দলে মানুষ বাস্তু ফেলে রেখে এপারে চলে আসছে। তীব্র বিষাদে আক্রান্ত ভবতারণ – হেমন্তী-বাসন্তীর বাবা। মেজাজী প্রাণবন্ত মানুষটি কখনও পাথরের মূর্তি হয়ে বিছানায় পড়ে থাকেন, কখনও উদ্ভ্রান্তের মতো বেরিয়ে যান। সারাদিন টহল দিয়ে সন্ধেবেলা ধুলোয় ধূসর হয়ে ফেরেন। না ফিরলে ছেলেদের কেউ গিয়ে খুঁজে-পেতে ঘরে আনে। সে অঞ্চলে কত চেনা ঘরে পড়েছে তালা, রাত হলে শেয়ালের ডাক বেড়েছে। আকাশ থেকে কবেকার সেই পুরোনো চাঁদটাই রোজ মুখ দেখায় সারি সারি তালগাছ, সুপুরিগাছের ফাঁক দিয়ে। নিজের মুখ দেখে দিঘির জলে। ছোটো ভাইদুটি, বাসন্তী আর যোগমায়ার ভরসায় উন্মাদপ্রায় মানুষটিকে ফেলে রেখে কলকাতায় আসতে পারছিল না বিশ্বনাথ। তাই বলেছিল শম্ভুনাথকে,

তুই গিয়া একখান কামের বন্দোবস্ত দ্যাখ। থাকনের লাইগ্যা বাসাও ত লাগব। আমি তাগরে লইয়া পরে যামু, বাবারে বুঝাইয়া

দাদার কথায় শম্ভুনাথ সবার আগে কলকাতায় এল। তারপর অনভিজ্ঞ ছেলে অচেনা জনসমুদ্রে হারিয়ে গেল। প্রায় বছরখানেক খবর পাওয়া গেল না। যোগমায়ার দিন উদ্বেগে কাটে। বিশ্বনাথ ভেবে পেত না কোথায় চিঠি পাঠালে, টেলিগ্রাম করলে খবর আসবে। আত্মীয়রা যারা আগে থেকে আছে কলকাতায়, তাদের দু-তিনজনকে চিঠি দিল। জবাব এল না। এরই মধ্যে বাড়ি থেকে আধমাইল দূরের এক বড়ো পুকুর থেকে শেষ বিকেলে ভেসে উঠল ভবতারণের নগ্ন, শরীর। গলায় গামছার ফাঁস, মোটা পইতে বুকের ওপর লেপটানো। কোন ভোরে বেরিয়ে  আর বাড়ি ফিরলেন না। ভবতারণের মৃত্যুতে অন্তত একটা সংশয় থেকে মুক্ত হল পরিবার। তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যাওয়াতে আর বাধা রইল না। হেমন্তীকে বাবার মৃত্যুসংবাদ দিয়ে চিঠি দিয়েছিল বিশ্বনাথ, বাসন্তীও। আসতে পারেনি ওরা। দিদির মনের অবস্থা অনুমান করতে পেরেছিল বাসন্তী। করার কী-ই বা ছিল? সে তখন যোগমায়াকে সামলাতে ব্যস্ত।

দেশ ভাগাভাগি সম্পন্ন হলেও অশান্তির আগুন ধিকধিক। মাসকয়েক পরে আবার দাঙ্গা লাগল। চা-বাগান থেকে পালিয়ে আসা হল না। জামাইবাবুর বাড়ি থেকে পরে খবর এসেছিল। হেমন্তী ধর্ষিত হয়, সুখেন্দু বাঁচাতে চেষ্টা করেছিল। শিশুটি কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ জানে না। তিনটি তাজা, নির্দোষ প্রাণ অকারণে অবেলায় মুছে গেল জন্মের মতো। একটু একটু করে বলেছে বাসন্তী, শ্বাস টেনেছে বারবার। গলা ভেঙেছে, চোখ আগুন হয়েছে, আবার ভিজেছে।

আমার মা নরম-শরম। একের পর এক এইরম ঘটনা ঘটলে কাউর মাথা আর ঠিক থাকে?”

অমলার বড়দিদিকে আবছা মনে পড়ে। মনে পড়ে মেজদাদা মনোরঞ্জনের কথা। মন ভালো লাগে না বলে সে নীরব থাকে। বাসন্তী দু-একদিন বলে,

ভাইবা দেখিস অমু আমার প্রস্তাবটা

সে দোলাচলে পড়ে, মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। শিবনাথকে আসতে-যেতে দেখেছে ধীরেন্দ্রনাথের কাছে। মুখোমুখিও হয়েছে দু-চারবার। স্বাভাবিক সঙ্কোচে মাথা নামিয়ে সরে গেছে। সে বাসন্তীর মতো, তার দিদিদের মতো শক্ত নয়। মরে গেলেও মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারবে না। 

ফাল্গুনের শেষে অমলাকে দেখে গেল পাত্রপক্ষ – পাত্রের বাবা-মা, এক কাকা-কাকী। অমলাকে তাদের পছন্দ হয়েছে, কথাবার্তা প্রায় পাকা। দাবীদাওয়া নেই। ছেলের বাবা আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। আধঘোমটা-টানা, চোখা, গম্ভীর চেহারার ছেলের মা-কে দেখে অমলার কাজলমাখা চোখের পর্দায় ভয় ফুটেছিল। তাদের পাড়া আর ঘরদুয়ার দেখে ভাবী বেয়াইকে একটু হেসেই বলেছিলেন,

হুট্ বইল্যা মাইয়ারে লইয়া আইতে দিমু না। হেইডা মাথায় রাইখেন। আর মাইয়াও ত আমগ যুগের মতো কচি মাইয়া না, মা-মা কইরা কাইন্দা ভাসাইত না। কী কও অমলা?”

মোটামুটি জ্যৈষ্ঠমাসের প্রথম শুভদিন ধার্য হল। দু-টি মাসে অনেক কাজ সারতে হবে ধীরেন্দ্রনাথ আর তারাসুন্দরীকে। ধীরেন্দ্রনাথকে ততদিনে সম্পূর্ণ সেরে উঠতে হবে। অমলার মনের মধ্যেটায় তুমুল তোলপাড়। মাসদুই পর অচেনা এক পরিবারে চলে যেতে হবে বরাবরের মতো। মাঝে মাঝে আসবে অতিথি হয়ে যেমন ছোড়দিদি আসে। পরীক্ষা না দিয়ে বাবার অবাধ্যতা, কাজ না করে নভেলমুখে শুয়ে থাকা, মার মুখে মুখে চোপা, বাসন্দিদির সঙ্গে আড্ডা-গল্প – তার ছোটো জীবনটায় এসব আর থাকবে না। অমলা তক্তপোশে চিত হয়ে শুয়ে টালির চালের দিকে তাকায়, বেড়ার দেওয়াল দেখে। তার একঢাল কালো থাকথাক চুল মাটিতে লুটোপুটি খায়। অদ্ভুত শব্দে ডেকে চলা পাখির ডাক শুনতে শুনতে মনে হয়, তবে কি বাসন্দিদির কথায় রাজি হলে ভালো হত?

(ক্রমশঃ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন