কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১৩৭

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১৩৭

শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫

পি. শাশ্বতী

 

মহাভারতেই রাষ্ট্রতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের বীজ

 


মহাভারত মহাকালের দলিল। আজ একথা প্রামাণ্য সত্য যে সভ্যতার সকল রহস্য ও সমাধান প্রচ্ছন্ন আছে মহাভারতে। রাজনীতির বিষয় তো বটেই। সভ্যতার হাত ধরেই কূটনীতি, রাজনীতি ও রাষ্ট্র নীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে মানব সমাজে।

পুরাণের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায় " নাসাবৃষির্যস্য মতং ন ভিন্নম্"। অর্থাত "যাঁর মত ভিন্ন নয়, তিনি ঋষি হতে পারেন না। পুরাকালে ঋষিরাই বেদ আদিশাস্ত্র চর্চা করতেন। আর বর্তমান পাঠপদ্ধতি বলছে স্বকালের বোধ, বিচার, বিবেক, বুদ্ধিতে যে কোন গ্রন্থ উপলব্ধ হয় পাঠকের কাছে। কোন গ্রন্থের অর্থ লেখক বা লেখার ওপর নয়, পাঠকের বোধের ওপর নির্ভর করে। আর অনড়ও নয়। ভারত এক অতি প্রাচীন ও পবিত্র দেশ। যুগে যুগে ঋষি, বিদ্বান, গবেষকরা এই দেশকে গৌরবান্বিত করেছে, সমৃদ্ধ করেছে। তবে রাজতণ্ত্র, রাষ্ট্রতন্ত্র, প্রজাতণ্ত্র বুঝতে গেলে প্রথমে বুঝতে হবে দেশ, রাজ্য, রাষ্ট্র কী? দেশ কারা চালায়? তারা কি জনগণের অনুমতিতে চালায়, না নিজেদের ইচ্ছায়? আবার রাজ্য বোঝার আগে বুঝতে হবে নৈরাজ্য কী। রবীন্দ্রনাথের "আমরা সবাই রাজা" শব্দবন্ধ গানে সুন্দর হলেও বাস্তবে নয়। কারণ  সবাই রাজা হলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। রাজা যদি প্রজার সাথে এক সারিতে বসেন তবে সিদ্ধান্ত নেবার লোক থাকে না। সকলের মন রেখে চললে রাজকার্য চলে না। তখন নৈরাজ্য শুরু হয়। এই নৈরাজ্যের মহত্বকে যারা ভয় পায়, তারা বানায় জাতিসংঘ। যে স্বীকৃতি দেয় রাষ্ট্রকে। মূলে রাজ উপান্তেত্র। ত্র-এর ভিতরে 'ষ্ট্রণ'। ষ্ট্রণ অর্থ পরিগঠন। রাজ-এর যে পরিকাঠামো তার নাম রাষ্ট্র। রাষ্ট্রে রাজ্য যদি একটি নির্দিষ্ট আকার পায় তাহলে অন্যরাজ্য সে দখল করতে পারে না এবং নিজের আকারের নিরাপত্তা রক্ষিত হয়, কারণ জাতিসংঘ তাকে মান্যতা দেয়। রাজ্য সহজে প্রজা পায়, তাকে শাসন করে। নব্যরাজার বিরাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সবাই যখন তার নিকট নিজের স্বাধীনতার বন্দোবস্ত দেয়, তখন রাষ্ট্র মূর্তিমান হয়। রাষ্ট্রের ভেতর রাজার অদ্বিতীয় ও প্রশ্নাতীত বিরাজত্ব ত্বরিত বা রহন হয়, অর্থাত স্থিতিকাঠামো লাভ করে, তখনই রাজ্য রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তাই রাষ্ট্র হল নির্দিষ্ট মেয়াদে রাজার অদ্বিতীয় বিদ্যমান সংগঠন। তাই জনগণের রাষ্ট্র কথাটা সোনার পাথরবাটির মতোই ।

রাষ্ট্র শব্দের আরও অর্থ হল উপদ্রব, মকরাদি, দুর্ভিক্ষ। তবু রাজা, রাজ্য বা রাষ্ট্র প্রকৃতির মতোই প্রশ্নাতীত মনে হয়, এই অভ্যাস একটা মনোগত অসুখ। আত্মপ্রবঞ্চনা। কবি বলেছেন-- 'লাশকাটা ঘরে  ক্লান্তি নাই, তাই কেউ কেউ লাশকাটা ঘরে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকছে'।

এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য যে রাজনৈতিক আন্দোলন তার মূল কথা ছিল যে এই ব্যবস্থা মানবতাবিরোধী ত্রাস-এর ভিত্তি। একে ভাঙতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্র কোন বস্তু নয়। তাই এই ব্যবস্থা ভাঙব বললেই ভাঙা যায় না। তাই নৈরাজ্যবাদী চিন্তার বদলে গঠনমূলক চিন্তার প্রয়োজন। রাষ্ট্র ব্যক্তিমানুষ বা সমাজের বাইরে নয়। ব্যক্তি বা নাগরিকই রাষ্ট্র। নাগরিকের স্বভাব রাষ্ট্রের শাস্ত্র। জনতার আন্তঃসম্পর্ক রাষ্ট্রের ধরন নির্ধারণ করে। রাষ্ট্রকে বদলাতে হলে এই স্বভাব ও সম্পর্ক সমূলে বদলাতে হবে। এর সমাধান পাই আমাদের মহাকাব্য মহাভারতে। মহাভারত সম্পূর্ণ রূপে রাজতণ্ত্র, রাষ্ট্রতণ্ত্র, প্রজাতন্ত্রের পারস্প রিক সম্পর্ক ও তার ওপর কূটনীতির প্রভাব। পূর্বে আমাদের এই দেশ অবাধ ও স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতির মাধ্যমে হয়ে উঠেছিল এক স্বয়ম্ভূ প্রতিষ্ঠান। স্বপরিচালনা ও সহযোগিতা ছিল এর চালিকা শক্তি। যখন  মন্ত্র হবে, “আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে  আসে নাই কেহ ধরণী পরে, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে"। তখন একটি প্রকৃত শান্তিপূর্ণ গৌরবোজ্জ্বল দেশ পাওয়া সম্ভব। ভালবাসা হবে রাষ্ট্রের প্রধান স্তম্ভ। এর উন্নয়নকল্পে মানুষ অংশগ্রহণ করবে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে।

দেশব্যবস্থাপনার ঐতিহাসিক বিবর্তনের মধ্যে রূপান্তর সম্ভব। রাষ্ট্র থাকলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা থাকবে, রাজ্য থাকলে থাকবে নৈরাজ্য। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ঘটেছে কুরুক্ষেত্রে। কর্তৃত্বের লোভে আসে মতাদর্শের মোহ। মোহের বশে মুক্তচিন্তা বাধা হয়, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রতি অন্ধ আনুগত্যপ্রবণ নানা মহল এমনকি রাষ্ট্র নিজে। নিজের মতাদর্শকে অভ্রান্ত এবং অন্যকে আদর্শ বহির্ভূত মনে করে। ফলে মতাদর্শ বলপ্রয়োগের দ্বারা রূপান্তরিত হয় কর্তৃত্বতন্ত্রে। কোন মতাদর্শই ব্যক্তিকে স্বাধীনতা দিতে চায় না। স্বাধীনতার অর্থ জানে না। আবার আপামর মানুষ গুটিকয়েক লোকের সামনে এলেই নত হবে, তারজন্য থাকে বিস্তর প্রশিক্ষণ, আজন্ম- আমৃত্যু দীক্ষায়ণ। ফলে এসব সহজাত মনে হয়, সমষ্টিক অবচেতনে গেঁথে যায়। নির্দ্বিধায়  গুরুদক্ষিণা স্বরূপ একলব্যের দক্ষিণ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দান, নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও যুদ্ধের পূর্বে ব্রাহ্মণকে কর্ণের কবচ কুণ্ডল দান, এ সবেরই প্রতিফলন দেখা যায় মহাভারতের আঙিনায়।

আমাদের সকল যুক্তি, বিবেকবুদ্ধি, তথ্যভিত্তিক ধারণা, পরিবীক্ষণজাত বিবেচনা মুখস্থ মতাদর্শের সামনে একেবারেই বিকল হয়ে যায়। ভরা রাজসভায় দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা ঘোরতর অন্যায় জেনেও রাজশক্তির সম্মুখে নত মস্তক থাকা। যখনই এমন সম্ভাবনা হয় "সম্ভবামি যুগে যুগে" আমূল পরিবর্তন আনে।

সকল কিছুর সূচনা সেই হস্তিনাপুরেই হয়েছিল এবং তার পরিত্রাণ, সমাধানও উল্লিখিত আছে সেই পটভূমিতে। সেই তত্ত্বাবলী ধারণের গর্ব নিয়ে আজও অনিবার্য মহাভারত। কিন্তু যথার্থ অনুধাবনের অভাবে তা কার্যকরী হতে পারছে না। কোথাও পূজিত হচ্ছে ধর্মপুস্তক রূপে, কোথাও রূপকথা আর কোথাও মহাকাব্য আখ্যা দিয়ে এর ভিতরের শিল্পমূল্য অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছে। অর্থাত বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী, শ্রদ্ধাবান পণ্ডিত, ভক্ত, ভোগী সকলেই এই গ্রণ্থটিকে আজব মনে করে বিস্ময়ে অভিভূত হয়। ভক্তি বা ভয়ে এড়িয়ে যায়। এর দার্শনিক তত্ত্ব অনুধাবন, বিশ্লেষণে এগিয়ে আসেন না।

এই কাব্য সেই যুগের কথা বলে যে যুগের গর্ভে ইতিহাসের জন্ম। ব্যাসদেব এমনই একজন কবি যিনি সত্যের প্রতিফলন দেখতেন নিজ হৃদয় দর্পণে।বাস্তব বিবরণকে বেশি গ্রহণ করায় বেশিরভাগ পাঠকের হৃদয়- দর্পণ বিকল। আর দর্পণ বলেই এতে সকল ব্যক্তির ছবি নিখুঁত হলেও উল্টোভাবে প্রতিবিম্বিত হয়। মহাভারত কেবল ভরতবংশীয়দের কোন সাধারণ যুদ্ধের গল্প নয়। এ হল ভারতীয় সংস্কৃতি ও সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাস। নিজ নিজ কুরুক্ষেত্রের লড়াইয়ে যখন আমরা মুখ থুবড়ে পড়ি, যারা নিজেরা উঠে দাঁড়াতে পারি না তখন কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে দেওয়া শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ (গীতা) আমাদের পথ দেখায়।

মহাভারতের পাঠ সীমিত থাকে রাজার ন্যায়ের প্রশ্নে। তাই রাজার কর্তব্য ও রাজধর্মেই পাঠক আবর্তিত হয়।

"ন তেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ।

ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সর্বে বয়মতঃপরম।।"

বিশ্ব যাকে ইন্ডিয়া বলে সেই অখণ্ড ভারতবর্ষের নাম যে নরপতির নাম অনুসারে হয়েছে সেই মহান নৃপতি "ভরত"এর নাম থেকে এই দেশের নাম হয়েছে ভারত এবং ভারতের অবিচ্ছেদ্য কাব্যেরও নাম হয়েছে মহাভারত। প্রথম সার্বভৌম রাজা ভরত চক্রবর্তী ছিলেন ন্যায়ের প্রতীক।সততা, নিষ্ঠা ও কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে রাজধর্মকে এক অনন্য উচ্চতায় স্থাপন করেন।

রাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার গান্ধর্বপুত্র ভরত। শকুন্তলার গর্ভজাত পুত্রকে রাজা দুষ্মন্ত ভরত নাম দিলেন এবং  যুবরাজ রূপে অভিষিক্ত করলেন। চন্দ্রবংশীয় ক্ষত্রিয় রাজার পর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র ভরত। জৈন ও বিষ্ণুপুরাণ অনুসারে তিনি কিংবদন্তি। জৈনপুরাণে ভরত চক্রবর্তী নামে এক রাজার উল্লেখ পাওয়া যায় যিনি সারাবিশ্ব জয় করে সুমেরু বা মেরুপর্বতের ওপর ধ্বজা রোপণ করেন। পরে যুদ্ধে নরহত্যার জন্য বিতৃষ্ণ হয়ে নির্বাণ লাভের উদ্দেশ্যে অহিংস জৈনধর্ম গ্রহণ করেন। মহাকবি কালিদাস (খ্রি. পূ.প্রথম শতক/ খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতক) প্রণীত অভিজ্ঞানশকুন্তলম গ্রন্থে তাঁর বাল্যজীবন বর্ণিত আছে। এছাড়াও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১--১৯৫১)  রচিত শকুন্তলা গ্রন্থে তাঁর পরিচয় নিবদ্ধ আছে।

মহাভারত অনুসারে ভরত বিখ্যাত নৃপতি এবং অপরাজেয় শূরবীর। তাঁর রাজ্যের সীমা ছিল হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত। এইরকম মহাশূরবীর আরও থাকলেও প্রাগৈতিহাসিক কালের এই রাজা বর্তমানেও অবিস্মরণীয়। নিজের রাজদরবারের ভূমিতে প্রজাতন্ত্রের প্রথম বীজ তিনিই বপন করেন। জন্ম ও কর্মের সূক্ষ্ম ভেদরেখা টেনে তিনি বলেন জীবনের আসল পরিচয় 'জন্ম' নয়, 'কর্ম'। রাজসিংহাসন প্রত্যাশী নিজের নয় পুত্রের উদ্দেশ্যে তিনি একথা বলেন। রাজপুত্র হিসেবে এরা প্রত্যেকেই প্রথমে যুবরাজ ও পরে ভারতবর্ষের নৃপতি হবার স্বপ্নে বিভোর ছিল। 'পিতা' হয়েও 'রাজা ' ভরত তা হতে দেননি। যদিও পিতা হিসেবে সন্তানদের প্রতি মমতা ও কর্তব্যে তাঁর কোন ঘাটতি ছিল না। তবু রাজা হিসেবে তিনি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যুবরাজ অভিষেকের দিনে রাজসভায় দাঁড়িয়ে সভাসদ ও প্রজাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, "আমি কৃতজ্ঞতা জানাই এই দেশের প্রজাদের, যাঁরা তাঁদের আশীর্বাদ ও শুভকামনায় আমাকে এই সিংহাসনের যোগ্য ভেবেছেন। তাঁদের ভালোবাসার জোরে আমার সামান্য যোগ্যতা নিয়ে আমার সকল নিষ্ঠা মানবসেবায় নিয়োজিত করতে পেরেছি। আমি চক্রবর্তী মহারাজা ভরত আমার মহান প্রজাদের দেওয়া ব্রতকে অঙ্গীকার করে ঘোষণা করছি, কোন রাজাই তার দেশ ও জনগণের থেকে বড় হতে পারেননা।রাজা নিধিপতি নন, কেবল প্রতিনিধি।এই দেশ এবং দেশের আচার্য রা আমাকে শিখিয়েছেন একজন রাজার কেবল তিনটি কর্তব্য থাকা উচিত। জনগণকে সন্তানের মত লালন পালন করা, দেশের সীমানাকে যে কোন মূল্যে রক্ষা করা।

এমন একজন ব্যক্তিকে যুবরাজ নিযুক্ত করা যিনি রাজা হয়ে এই তিনটি দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবেন। পিতা হিসেবে আমি ব্যর্থ কারণ আমি রাজা হলেও আমার কোনও পুত্রের মধ্যে তেমন যোগ্যতার লক্ষণ আমি দেখছিনা। রাজা পিতা। প্রজারা তাঁর সন্তান। তাই ভরদ্বাজ ভূমন্যুকে নিজের সন্তান মনে করে আমি এই রাজ্যের যুবরাজ ঘোষণা করছি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য কাশীদাসী মহাভারতের আদিপর্বে 'পুরুবংশ কথনে' বলা হয়েছে 'ভরতের গুণকর্ম কহিতে বিস্তার / ভূমন্যু বলিয়া পুত্র হইল তাঁহার'। পাঞ্চাল পুরাণ অনুসারে তিনি একজন সাধারণ প্রজা। আবার জৈনপুরাণ অনুসারে , রাজা ভরত ঋষি ভরদ্বাজকে দত্তক নিয়েছিলেন। অজ্ঞাতকুলশীল এই সন্তানটিকে প্রথম মরুতেরা প্রতিপালন করেন। পরে মরুতসোম যজ্ঞ শেষে রাজা ভরতের কাছে দিয়ে যান। মরুতেরা শাস্ত্রশিক্ষা দেন আর ভরত শস্ত্রশিক্ষা। সে জন্য একই অঙ্গে তিনি ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়। এই ভরদ্বাজ যজ্ঞ করে ভরতকে একটি পুত্র  সন্তান দান করেন। ভরত তাঁর নাম রাখেন ভূমন্যু।

মহাভারতে ভরতের ভাষণটি দীর্ঘ (৩২টি শ্লোক)।বাচ্যার্থ ও ভাবার্থকে অক্ষুণ্ণ রেখে মূলকথাটি নেওয়া হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে মহাভারতের আখ্যান বিভিন্ন ভাবে বিবর্তিত হয়েছে। ফলে মূল মহাভারত কোনটি, নিশ্চিতরূপে তা নির্ণয় করা দুরূহ। পুণের 'ভাণ্ডারেকর প্রাচ্য গবেষণা সংস্থা' ১৯১৯ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত নিরলস কাজ করেছেন এই বিষয়ে। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া থেকে প্রাপ্ত মহাভারতের প্রায় সমস্ত পাণ্ডুলিপি (প্রায় ১০,০০০) বিচার করে এই সংস্থাটি, প্রামাণিক ৩৫,০০০শ্লোক সংবলিত মহাভারতের একটি সঠিক ও সমীক্ষণাত্মক সংস্করণ প্রকাশ করে। মহাভারত বলতে ১৮টি খণ্ডে বিন্যস্ত সেই পুস্তকটিকে আমরা বুঝি।

ভূমন্যুকে যুবরাজ ঘোষণার পর মাতা শকুন্তলা তাঁকে বলেন, 'সম্ভবত তুমিই এমন একমাত্র পিতা, সম্পর্কের বন্ধন ছিন্ন করে নিজের সন্তানের অধিকার যে অন্যকে দিয়েছে।' ভরত নীরব থাকেন কারণ তিনি জানেন শকুন্তলা শুধু একজন মা। মায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে এসকল তিনি বলেছেন। তাই স্নেহের মোহে তিনি এসকল বলেছেন। কিন্তু ভরত রাজা। রাজাকে ন্যায়নিষ্ঠ হতেই হয়। ভরতের এই জীবন বোধের উৎস  হল জীবন মন্থন করে পাওয়া প্রজ্ঞা আর রাজপুরুষের দায়। এই দায় থেকেই তিনি ভাবতে পেরেছিলেন যে রাজা পিতাই আর প্রজাও সন্তান। নিজের সন্তানের মোহ কাটাতে না পেরে অন্যের সন্তানদের জীবনকে অনিশ্চয়তার ভেতর ফেলার অধিকার রাজার নেই। এমন ন্যায় ভাবনা তাঁকে ভরতকুল ছাড়িয়ে সর্বজনের কাছে শ্রদ্ধেয় করে তুলেছিল। ভারতবর্ষের ভূমিতে প্রজাতন্ত্রের প্রথম যে বীজ তিনি বপন করেন, ভরত-উত্তর কয়েক প্রজন্মের সফল রাজকার্যের মাধ্যমে তা হয়ে উঠেছিল অবশ্য- অনুসরণীয়। মহাপরাক্রমশালী ভরত ছিলেন প্রশ্নাতীত কর্তৃত্বের অধিকারী। ফলে তাঁর স্বৈরাচারী হবার পথ প্রশস্ত ছিল। কিন্তু ন্যায়নিষ্ঠার চিরকালীন পথে তাঁর দিশারী ছিলেন কণ্ব। ভরতের হৃদয়ে তিনি কল্যাণ রাজ্যের বীজ বুনে দিয়েছিলেন। রাজার মার্গদর্শন করাতে তিনি বলেন,  'সকল সংকটে রাজার কেবল স্বীয় প্রজ্ঞা ও বিবেকপ্রসূত ন্যায়ধারণার প্রতি ভরসা রাখা উচিত। আত্মদর্শনের প্রতি অবিচলিত না থাকলে কোন ব্যক্তি ন্যায় করতে পারে না।স্থূল আবেগ ও চিন্তামুক্ত হলেই কেবল আস্থা পাওয়া যায় আর পাওয়া যায় দ্বিধাজড়িত সকল প্রশ্নের উত্তর'। রাজাভরত আজীবন এই  মহাঋষির বাণী শিরোধার্য করেছেন। ইতিহাসে তাঁর মত সার্থক নৃপতিদের সাদৃশ্য এই যে তাঁরা কেউই কখনোই পণ্ডিত ও ন্যায়বান আচার্যদের উপদেশ অগ্রাহ্য করেননি।

অবশ্য রাজপুত্রদের বাদ দিয়ে সাধারণ এক নাগরিককে যুবরাজ করায় অন্দরমহলে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া হয়। মহাভারত বলছে 'নাভ্যনন্দত তান রাজা নানুরূপা মমেত্যুতে', অযোগ্য রাজপুত্রদের ভরত সিংহাসনবঞ্চিত করেন, কিন্তু রানীদের তা সহ্য হয় না। রাগে, দুঃখে, অভিমানে। তিন রানি তাঁদের নয় পুত্রকেই মেরে ফেলেন,' ততস্তান মাতরঃ ক্রুদ্ধা পুত্রান নিন্যুর্যমক্ষয়ম।' অভিজ্ঞান শকুন্তলমের ভাষ্য অনুসারে ঋষি বিশ্বামিত্রের তপোভঙ্গের জন্য প্রেরিত মেনকা সফল হন তাঁকে কামে প্রলুব্ধ করতে। ফলতঃ একটি কন্যা সন্তান হয়।  তপোর্জিত ফল বিনষ্ট হওয়ায় বিশ্বামিত্র মেনকা ও তাঁর কন্যাকে পরিত্যাগ করলেন। মেনকাও শিশুকন্যা ছেড়ে দেবলোকে ফিরে যান। শকুনছায়াবৃত অবস্থায়  মহর্ষি কণ্ব তাকে উদ্ধার ও প্রতিপালন করেন। তাই নাম হয় শকুন্তলা এবং পরিচয় হয় মহর্ষি কণ্বের কন্যা।

মহর্ষি কণ্ব ভরতের দার্শনিক গুরু এবং মাতামহী। ত্রেতা যুগের প্রাচীন ঋষি তিনি।তাঁর দ্বারা ঋগ্বেদের কয়েকটি স্তব লিপিবদ্ধ হয়েছে। তাঁকে ঘোরের পুত্র এবং অঙ্গীরসদের একজন মনে করা হয়। ক্ষেত্র বিশেষে তিনি সপ্তর্ষির তালিকাতেও অন্তর্ভুক্ত হন।

কিন্তু রাজা শান্তনুর শাসনকালে এই ভরতবংশীয় আদর্শ প্রজাতন্ত্রের ধারণার মূলে ঘুণ ধরে। প্রজা পরিণত হয় দাসে। রাজা হয়ে ওঠেন একচ্ছত্র প্রভু। নিষ্প্রশ্নক কর্তৃত্ব, ভোগ-বিলাস চরিতার্থতা রাজার জীবনের পরিভাষায় পরিণত হয়।

প্রজাতন্ত্রের স্থান নেয় পরিবারতন্ত্র। বিদ্বানের মর্যাদা কমে। আচার্যরা রাজসভার অলঙ্কার-এ পরিণত হন। ফলে দেখা দেয় সমূলে বিনাশের সমূহ লক্ষণ। কুলের গর্ব আর বংশধারার গরিমা রাজপুরুষদের অপরিণামদর্শী করে তোলে। তখন কর্মের চেয়ে জন্ম পরিচয়ের মূল্য এত বেশী হয়ে ওঠে, যে কর্তৃত্বের একচ্ছত্র অহংকারে অজ্ঞানদর্শী প্রতিজ্ঞার জালে রাজপুরুষরা আটকা পড়তে থাকেন। রাজপরিবারের এই ত্রিবিধ ক্ষয় নিজ নিজ পথের পূর্ণপরিক্রমণ শেষে কুরুক্ষেত্রে গিয়ে মিলিত হয়। বিনাশের উপযুক্ত ভূমি প্রস্তুত হয়। সেই রণভূমির পরিণতি বড়ই বিয়োগান্ত এবং ভাবীকালের জন্য অবশ্য শিক্ষণীয়। তাই এই রণভূমি থেকে যেন এই দেশের লোকেরা শিক্ষা নিতে পারে, এই মহান দায়কে অঙ্গীকার করেই এগিয়ে চলে বিশ্বনন্দিত মহাকাব্য মহাভারত।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন