| রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায় |
আয়না
জানলায় আলতো টোকা পড়ল। তারপর চাপা গলার ডাক শোনা গেল – “শৈবালদা...বউদি...”
শৈবাল ও
কল্যাণীর ঘুম ভেঙে গেলেও প্রথমেই সাড়া দিল না। আবার – “শৈবালদা...”
কল্যাণী সাড়া
দিল – “কে?”
একটা ফিসফিসে
কন্ঠ্য শোনা গেল, “বউদি, সপু। দুদিন পেটে কিছু পড়েনি”।
শৈবাল বলল, “সামনের দিকে আয়”।
“জানলা দিয়েই দাও না দাদা”
এ অভিজ্ঞতা
নতুন নয়। আগেও বহুবার সপু এভাবেই এসেছে...মাঝরাতে। শৈবাল কল্যাণীর ঘুম ভাঙিয়ে নিয়ে
গেছে যা পেয়েছে।
বউদি একটু জল
খাওয়াবে?
কল্যাণী
বললেন, “ভেতরে এসো। লাইট জ্বালছি না”
সেদিন
শৈবালদের অফিসে খাওয়াদাওয়া হয়েছিল ব’লে রাতে ও আর খায়নি। সেই খাবারটাই কল্যাণী
সপুকে বসিয়ে খাওয়ালো। ওর তৃপ্তিতেই বোঝা যাচ্ছিল শেষ কবে ভাত খেয়েছে ওর মনে নেই।
শৈবাল
জিজ্ঞাসা করল, “সিগারেট?”
“ছেড়ে দিয়েছি। স্মেল থেকে ট্রেসড হয়ে যাওয়ার চান্স থেকে যায়।
“সপু
হাসল। সেই নির্ভেজাল হাসিটা! কল্যাণী একটা কাপড়ের ঝোলায় বিস্কুট, মুড়ি আরো কীসব
ভরে দিয়েছে।
“সাবধানে থাকিস”।
চলে যাওয়ার
আগে সপু আরেকবার চারপাশটা সন্তর্পণে দেখে নিল। তারপর করমচা গাছের ঝোপটার ওদিকে
অন্ধকারেই ঝাঁপ দিল। কয়েকটা চামচিকে উড়ে গেল।
বেশ কিছুক্ষণ
পর একটা বোমা ফাটল কাছেই কোথাও। কল্যাণী চমকে উঠল। শৈবালের কপালেও চিন্তার ভাঁজ।
“নিরঞ্জন ভুল করেছে”।
“না, কোন ভুল হয়নি”।
“কী বলছিস, বাচ্চু?”
“আঃ!” সপু ও বাচ্চুর তর্ককে থামিয়ে বলে উঠলেন মিহিরদা। “আমাদের সবাইকে এটা মাথায়
রাখতেই হবে, পারফেকশন একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট কনসেপ্ট। ভুল হতেই পারে, তাকে রেকটিফাই
করার সৎ চেষ্টা থেকে দূরে সরে গেলে কিন্তু আমরা টার্গেট থেকে ডেভিয়েট করে যাব”।
“মিহিরদা...”
সপুকে চুপ
করিয়ে মিহিরদা বলে চললেন, “গোবিন্দকে মারাটা প্রিপ্ল্যানড ছিল না। কি করে থাকবে?
গোবিন্দ এতদিন ছিল আমাদের ওয়ান অফ দ্য মোস্ট রিলায়েবলস। কিন্তু সেদিন ও নিরঞ্জনকে
মিথ্যে বলেছিল। জেলেপাড়ার দিকে যাবে ব’লে নিরঞ্জনের থেকে আলাদা হয়ে ও সোজা
প্রশান্ত বৈরাগীর বাড়ি গিয়ে ঢোকে। নিরঞ্জন সন্দেহই করেনি। কীভাবে করবে? আগেরদিনও
তো বুবাই আর তপনকে ক্লিয়ার করতে একসাথেই গেছে দুজনে। গোবিন্দ কিছুদিন ধরেই সাসপেক্টেড ছিল। আমার কাছে ইনফর্মেশন
আসছিল। কিন্তু কোন সলিড ক্লু পা্ছিলাম না, কাজকর্মও ঠিকঠাকই করছিল। কিন্তু সেদিন
যখন জানতে পারলাম যে আগের দিন প্রশান্তর ছেলেদের সাথে অ্যাকশনের পরদিন ওর বাড়িতেই
গেছে, বিষয়টা ক্লিয়ার হয়ে গেল। নিরঞ্জন তপনকে সাবাড় করলেও বুবাই কীভাবে পালিয়ে
যেতে পারল, বুঝতে বাকী রইল না। বড়সড় সাবোটাজ করার আগে ইমিডিয়েট ওকে সরিয়ে দেওয়ার
দায়িত্ত্ব দিলাম নিরঞ্জনকেই। আর প্রশান্তর বাড়ি থেকে বেরিয়ে ও কোথায় যাচ্ছিল
জানিস?” মিহিরদা এতখানি বলার পর সরাসরি সপুকেই জিজ্ঞাসাটা ছুঁড়ে দিলেন।
সপু মাথা নেড়ে
‘না’ জানাতেই বাচ্চু বলল, “শৈবালদার বাড়ি!” মিহিরদা বাচ্চুকে সমর্থনের ভঙ্গী করলেন।
সপু মাথা নীচু করে নিল। ওর কাঁধের কাপড়ের ঝোলাটায় বিস্কুটের প্যাকেটটা এখনো রয়েছে।
মিহিরদা আবার শুরু করলেন, “আমরা আত্মীয় পরিজন ছেড়ে, কেরিয়ার জলাঞ্জলি দিয়ে, লাইফ রিস্ক নিয়ে এই অনিশ্চিতকে বেছে নিয়েছি। কেন? কারণ আমরা একটা সোনালী ভোর আনবই। আর সে কাজে যে বা যারা বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তাদের সরিয়ে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করব না। এটাই পার্টির স্ট্যান্ড। আমাদের ছেলেরাও হাজারে হাজারে প্রাণ দিচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তবু তারা শহীদের মৃত্যুবরণ করতে কেউ পিছিয়ে আসছে না। এভাবেই আমাদের ইডিওলজি এগিয়ে চলেছে ভিকট্রি স্ট্যান্ডের দিকে। করাপটেড সিস্টেমের ভেতরে যে বদরক্ত, পুঁজ ইত্যাদি জমে আছে, এসব পরিষ্কার করে না যেতে পারলে আগামী প্রজন্মের কাছে কি কৈফিয়ত দেব আমরা? আমাদের জন্য নয়, মানুষের জন্য এই আত্মাহুতি দিতে আমাদের তো বিচলিত হওয়া সাজে না। তাই নিজেদের মধ্যে মতানৈক্য থাকলে চলবে না। তীব্রতম কষ্টও আমরা সহ্য করে নেব কিন্তু দ্বিচারিতা নয়, অন্যায় নয়, ভণিতা নয়। আ শিয়ার প্যাশন!”
মিহিরদার
বক্তব্য সম্মোহিত করে আজও। এর টানেই তো একদিন সব ছেড়েছুড়ে...
সপু বাচ্চুর
কাঁধে হাতটা রাখল ক্লান্তিতে, ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গীতে। বাচ্চু জড়িয়ে ধরল ওকে। সপুর
একটা হিসেব মিলছে না কিছুতেই।
“কতদিন পর!” মিলি বলল। এই ছোট্ট দুটো শব্দেই গভীর বিষাদের প্রলেপ।
বাচ্চু চুপ করে আছে। থেকে থেকেই এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সবকিছু অবিশ্বাসের দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখার ছাপ ওর শরীরী ভাষায় স্পষ্ট।
“এর আগেও বহুবার বলেছি, শ্যামকে ভরসা কোরো না। প্রশান্ত বৈরাগীর বাড়িতেও ওর যাতায়াত আছে। আমাদের কাছে ওর কোন বিশ্বাসযোগ্যতা নেই”।
“বাঃ! একই এলাকার লোক, যাবেনা কেন?”
“কী বলতে এসেছো, তাড়াতাড়ি বল!” বাচ্চু বলল।
“দেশ উদ্ধারে ব্যস্ত, আর ওদিকে নিজের বাবা যে মরণাপন্ন,
খেয়াল আছে?” মিলি ঝাঁঝিয়ে উঠল।
বাচ্চু কিছুটা
গুটিয়ে গেল। “কি হয়েছে বাবার? শরীর খারাপ? তুমি একটু দেখো”।
“আমি আর কদিন দেখব? সামনেই আমার বিয়ে। তোমার তো আর সময় বা ইচ্ছে কোনটাই হল না”।
“মিলি!” বাচ্চু এভাবে ডাকলে মিলির সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে। হুবহু আগের মত। অনুভূতির ভেতরের দিকে শিকড়ের মাটি কি আলগা হয়ে যায়নি তাহলে? মিলির কোন কথা আসছিল না। মনে পড়ছে, আগেও দীর্ঘ সময় ওরা নিখাদ নৈঃশব্দের খেয়ায় পাড়ি দিয়েছে মাইল-কে-মাইল। কী যে হয়ে গেল তারপর...
“বাবার কি সিরিয়াস কিছু?” বাচ্চু আকুল হয়ে জানতে চাইছে।
“কেন সিরিয়াস না হলে বুঝি তোমাদের টাচ করে না?” মিলির ঝাঁঝ অব্যহত।
“আঃ, বলই না”। বাচ্চু অধৈর্য।
“তেমন কিছু নয়। মা নেই। একমাত্র ছেলে তুমি। তোমার জন্য
মানুষটার মন কাঁদবে না? শরীর খারাপ না হলেও এটা কি কিছুই নয়?” মিলি কাতর গলায় বলল।
“এসব কবে থামবে? আবার কবে আগের মত...” মিলি শেষ করতে
পারল না। কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হয়ে বলল, “এই তো সরকারদের বাড়ির দীপু, রামকৃষ্ণ স্কুলে তোমার একই
ব্যাচ, তোমার থেকে পেছনেই থাকত সবসময় দেখেছি। গত সপ্তাহে ভিয়েনা চলে গেল। কই, তোমাদের এই
আদর্শের ভীমরুল তো ওকে কামড়ায়নি?”
মন খারাপের
মধ্যেও বাচ্চুর হাসি পেয়ে গেল। “যদি ফিরে আসি তোমার কাছেই তো ফিরব, মিলি। আর কোথায় যাব বল?
আর কে থাকবে আমার? তোমার চুল পেকে যাবে, চামড়া কুঁচকে যাবে, থুত্থুড়ে হয়ে যাবে
তুমি, তবুও আমার জন্য ঠায় অপেক্ষা করে থাকবে। একদিন ভোরবেলা কী মাঝরাতে একটা গাড়ি
এসে লজঝড়ে আমাকে পাড়ার মোড়ে রাস্তার ওপর
ফেলে দিয়ে যাবে, সবাইকে অবাক করে তুমি এসে সেই একদলা শরীরটা কুড়িয়ে নিয়ে যাবে।
যাবে না?”
মিলি হু হু
করে কেঁদে ফেলল। “জানি না!” ও বাচ্চুকে জড়িয়ে ধরল। বাচ্চুর নাকে এল সেই আশ্চর্য সুগন্ধটা। যার নাম নেই,
যা কদাচিৎ মেলে, তবুও তা একটুও বদলায়নি, ঠিক আগের মত...এই উপলব্ধির সাম্রাজ্যে ও
একাকী সম্রাট! মিলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বাচ্চু বলে, “অনেক দেরী হয়ে গেল। বাড়িতে
চিন্তা করবে। আজ এসো”। ও বলতে পারে না, “এই কান্নার হীরেকুঁচিগুলো সবই জমানো রয়েছে, মিলি। একদিন
দেখাবো তোমায়”।
বাচ্চু আর
মিলি পাশাপাশি হাঁটছিল চুপচাপ। মিলির হাঁটার ভঙ্গীতেই প্রকাশ পাচ্ছে, এই সামান্য
প্রাপ্তিই ভরিয়ে তুলেছে ওকে। বাদামতলার কাছে এসে ও বাচ্চুকে বলল, “তোমাকে আর আসতে হবে না।
আমি একাই চলে যেতে পারব”।
বাচ্চুও বুঝতে
পারছিল আর এগোনো ঠিক হবে না, কিন্তু মিলিকে বলতে ওর আটকাচ্ছিল।
বাচ্চু
দাঁড়িয়ে পড়ল। মিলি হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল।
ফিরতে ফিরতে
বাচ্চুর মনে হল, শ্যাম জানে সবকিছু। সুতরাং প্রশান্ত বৈরাগীর কাছেও ও আজ এক্সপোজড।
বাচ্চু রাস্তা বদলে ফেলল। রেললাইন টপকে কাজিপাড়ার ভেতর দিয়ে গিয়ে সানির ডাঙায় গিয়ে
উঠবে ঠিক করল। কোমরে হাত ছুঁইয়ে দেখে নিল একবার। হাঁটার ধরনটাও পাল্টে ফেলল। এতটা
দেরী না করলেই হত।
“জানতাম তুই আজ এদিক দিয়েই আসবি”। প্রশান্ত বৈরাগীর খাস চেলা বুবাই, সাগরেদ পল্টনকে নিয়ে কাজিপাড়ায় ঢোকার মুখেই দাঁড়িয়ে।
বাচ্চু দাঁড়িয়ে পড়েছে। কোমরে হাত দিতেই বুবাই বলে উঠল, “উঁহুহু! পল্টনের দিকে দ্যাখ্। ওর কিন্তু মিস হয় না”।
“ভুল করছিস বুবাই”।
“ভুল করতেই তো আজ এলাম”। চোখের নিমেষে পল্টনের রিভলবার থেকে ছিটকে আসা ঘাতক বুলেটটা থেকে অলৌকিক ক্ষমতায় বেঁচে গেল বাচ্চু। পড়ে যেতে যেতেও কোমর থেকে রিভলবার বের করে সোজা বুবাইকে মিস করল না বাচ্চু। গুরুর হাল দেখে পল্টন সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ সময়ে যে হতচকিত হয়ে গেল, তার মধ্যেই ওর মৃত্যু পরোয়ানা লেখা বুলেটটাও ছিটকে বেরোল। বাচ্চু একটুখানি চুপ করে দাঁড়িয়ে আবার রেললাইন পেরিয়ে এপাশে চলে এল। আজ আর ঘুরে যাওয়ার দরকার নেই। এখন শ্যামকে প্রয়োজন।
বিন্তি পিসির বাড়িতে যখন ও লুকিয়ে ঢুকে পড়ল তখন সন্ধ্যের অন্ধকার অনেকটাই ঘন হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতির কারণে লোকজন এখন বাড়ির বাইরের দিকের আলোগুলোও প্রয়োজন না হলে জ্বালায় না সন্ধের পর। রাস্তার লাইটগুলোও যেন শুধুই নিয়মরক্ষার জন্য।
“কে ওখানে?”
তুলসী মঞ্চের
পেছন থেকে বেরিয়ে এসে সামনে এসে দাঁড়ালো বাচ্চু।
“তুই! এখানে?”
“শ্যাম কোথায় গো পিসি?”
“কেন রে?”
“দরকার আছে”।
পিসি ওপরের
দিকে দেখিয়ে বলল, “আজ সন্ধ্যেবেলাতেই চলে এসেছে”।
বাচ্চু ওপরে
উঠে গেল।
বাচ্চুকে দেখে
শ্যাম যা বোঝার বুঝে গেল। একটা বুলেট শ্যামের বুকে রেখে বাচ্চু যখন বেরিয়ে যাচ্ছে
পিসি ঠাকুর শয়ন দিচ্ছে।
“কিছু করার ছিল না গো, পিসি”। বাচ্চু মনে মনে বলল।
“পিসিই তো ছড়াবে”।
“আমিও তো সেটাই চাই”। সপু অবাক হয়ে চেয়ে রইল বাচ্চুর কথা
শুনে।
“বুঝলি না তো?” বাচ্চুর জিজ্ঞাসায় সপু দুদিকে মাথা নাড়ল।
“সেদিন মিলি আসার খবরটা শ্যামই দিয়েছিল। আজ বুবাই, পল্টনের
ওখানে উপস্থিত থাকার কারণটা পরিষ্কার। এখন মিলির রিপার্কেশনটা খুব জরুরী। মিলি কি
না জেনেই...সেটাই বুঝতে চাইছি”।
“যদি জেনেই...?” সপুর অর্দ্ধেক জিজ্ঞাসায় বাচ্চু চমকে উঠল। এরপর বাচ্চু হাঁটতে শুরু করল একাই। সপু বুঝতে পারল, এই মুহূর্তে ওকে অ্যাকোম্পানী না করলেও চলবে।
মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাচে সবচেয়ে নিঁখুত ড্রইং করতে পারত ও-ই। পড়াশোনাটা ওর প্যাশন ছিল। স্যারেরা সবাই ওকে ভালোবাসতেন। একদিন হেড ডিপ প্রফেসর লাহিড়ী ডেকে বলেছিলেন, “জীবনে কি সত্যিই কিছু করতে চাস?” ও বুঝতে পারে না স্যার কেন একথা বলছেন। উনি এরপর ওকে অবাক করে দিয়ে বলেন, “তাহলে ঋজুর সঙ্গটা ছাড়্। পড়াশোনাটা শেষ করে পালা এদেশ থেকে। তোদের মত ছেলেদের জন্য দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ওয়েটিং। ফিল ইট”।
ওর ভালোলাগেনি। ঋজুর মত ব্রাইট ছেলে, যাকে গোটা কলেজে সবাই একডাকে চেনে, যার মেধা প্রশ্নাতীতভাবে সকলের কাছে বিস্ময়ের, যার বন্ধুতার আশায় প্রত্যেকে উন্মুখ, সে নিজে এসে ওর দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে...স্যার যে কী বলছেন! ঋজুর ওপর স্যার কি কোন কারণে বিরক্ত!
অনেকদূর থেকে
আছড়ে এসে পড়া ঢেউয়ের ধাক্কায় বালিয়াড়িতে ফেনায় ভাঙছে স্মৃতির টুকরোরা।
“আজ সন্ধ্যেয় ফাঁকা?”
“সেরকম কিছু জরুরী কাজ নেই”।
“চ, এক জায়গায় নিয়ে যাব তোকে”।
“কোথায়?”
“গিয়েই দেখবি”। ঋজু স্মিতহেসে বলে।
সেই প্রথম মিহিরদাকে দেখেছিল বাচ্চু। আর প্রথমদিনেই কেমন একটা ঘোর লেগে গিয়েছিল। ফিরে আসার সময় ঋজু জিজ্ঞাসা করেছিল, “কেমন লাগল মিহিরদাকে?”
“অসাধারণ!”
“আর বাকীদের?”
“ভালোই তো!”
“এরা প্রায় সবাই ব্রিলিয়ান্ট। কিন্তু থোড়-বড়ি-খাড়ার বাইরে
ওরা অন্যকিছু ভাবতে চেয়েছে”।
“মানে?”
“দ্যাখ বাচ্চু, আমরা দিন বদলের স্বপ্ন দেখি। যে অবস্থায় বেঁচে রয়েছি এর চেয়ে ভালো কোন অপশন নেই, এমনটা ভেবে নিলে যে স্ট্যাগন্যান্ট স্টেট অফ মাইন্ডে চলে যাওয়া, তার থেকে বেরোতে হবে, বুঝলি। পিরিয়ডিক টেবিলকেও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল মেধা। অথচ দুটোই কিন্তু পড়তে হয়েছে। কেন বল তো?” বাচ্চুর উত্তরের প্রত্যাশা না করেই ও বলে চলল, “কারণ ভুলের ভিতের ওপরই তৈরী হয়েছিল নতুনের ইমারত, তার সম্যক উপলব্ধি থেকে যাতে বিচ্যূত না হই আমরা। এটা খুব জরুরী, বুঝলি? সময়ের সাথে অভিযোজিত হওয়াই তত্ত্বের নিয়তি, না হলে ইউনিভার্সালিটি বজায় থাকবে কীভাবে, তাই না? এসব শুধু নিজে বুঝলেই চলবে না। সবাইকে একসাথে নিয়ে অনুভবের সেই উদযাপনে সামিল হওয়াই আমাদের লক্ষ্য। আর লক্ষ্য পূরণের রাস্তা যে সবসময় ফুল বেছানো হবে, তা তো নয়। তাই লড়াই, এমনকি বেপরোয়া সশস্ত্র সংগ্রামও...”। ঋজু হঠাৎ থেমে গেল। বাচ্চু যেন অবশ...হাঁ করে তাকিয়ে ছিল, তারই বয়সী একটা ছেলের চিন্তাভাবনার কি অবিশ্বাস্য গভীরতা!
বাসে উঠতে যাবে, এমনসময় ঋজু ছোট্ট একটা বই ঢুকিয়ে দিল ব্যাগে। “পারলে আজ রাতেই পড়ে ফেলিস। কাল জানাস কেমন লাগল”।
বইটা পড়ে সে রাতে ঘুম আসছিল না কিছুতেই। অর্থহীন লেগেছিল সবকিছু, এতদিনকার প্রথাগত ধারণা যেন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে চেয়েছিল। ওর চেতনায় এক আনকোরা নতুন বোধের উন্মেষ ঘটেছিল। চেনা নদীতীর থেকে ও যখন ক্রমশঃ দূরে চলে যাচ্ছে, সে সময় ডুবে যাওয়া সূর্যের রঙে লাল হয়ে উঠছিল নদীর জল, আশ্চর্যভাবে মিলির মুখটা মনে পড়েছিল। ও বুঝতে পারছিল ভেতরে ভেতরে এক দুর্নিবার দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে...কীসের? ও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। এরপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে...
“তোকে একটা দায়িত্ত্ব দেব”। সপু জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে মিহিরদা বললেন – “শৈবাল সেন!”
সপু যেন এক সাঙ্ঘাতিক
ঝাঁকুনি খেল। এতগুলো কাজ করে ফেলার পর অনুভূতি অবশ হয়ে আসে, এটাই থিওরি। সপু বুঝতে পারল, থিওরি ছাড়িয়েও কোন একটা কার্ণিশ
আছে, যেখানে জন্মানো অশ্বত্থ চারাটাও বৃক্ষের স্বপ্ন নিয়েই জন্মায়।
“হেজিটেটেড?” মিহিরদার প্রশ্নে মাথা নাড়িয়ে ও বোঝাতে চায়, “বিন্দুমাত্রও না”।
“কোনভাবেই টার্গেট মিস হতে দেওয়া চলবে না। পার্টির হাই
কমান্ডের অর্ডার। কাজটা তোকেই করতে হবে সপু। কিছু বলবি?”
“কোন দায়িত্ত্ব পেলে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা দলবিরুদ্ধ, জানি
মিহিরদা। কিন্তু কেন যেন এক্ষেত্রে কারণ জানার ইচ্ছেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।”
“তুই কি সামহাউ আপসেট?”
“নাঃ...স্ট্রাগল হ্যাজ নো স্পেস ফর সেন্টিমেন্ট – আপনিই তো বলেন। তবু মনে পড়ে যাচ্ছে, দিনের পর দিন যখন আমাদের খাওয়া জোটেনি, শৈবালদার বাড়ি থেকেই মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে...”
“ওর অপরাধের তালিকা দীর্ঘ। গত সপ্তাহে ব্যারাকপুরে আমাদের সাতজনকে একসাথে মেরে ফেলা হয়েছে, এটা ওরই মাস্টারপ্ল্যান। বাগনানের ঘাঁটি উড়িয়ে দেওয়াতেও ওর যোগসাজস ছিল। এখন ওর সাথে প্রশান্ত বৈরাগীর যোগাযোগটাও স্পষ্ট, গোবিন্দই বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। গোবিন্দকে প্রশান্ত বৈরাগীর কাছে পাঠিয়েছিল শৈবাল সেনই। পুলিশ ডিপার্টমেন্টে থাকার সুবাদে ওর যে উইংসগুলো অপারেট করার সুবিধে রয়েছে, সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে ও এখানে এক সাঙ্ঘাতিক অ্যাকশন চালাতে চলেছে কয়েকদিনের মধ্যেই, খবর আছে। আর ওর টীমকে ব্যাক-আপ দেবে প্রশান্ত বৈরাগীর ছেলেরা। লোকাল পুলিশকে এই লুপে রাখাই হচ্ছে না, যাতে আমরা অ্যালার্ট না হয়ে যেতে পারি। এই ডেঞ্জারাস এলিমেন্টকে ইমিডিয়েট না সরালে এই রিজিয়ন থেকে আমাদের এক্সটিংক্ট হয়ে যাওয়া আর মাত্র কয়েকদিন।”
বাদল বলে উঠল,
“মিহিরদা
আমি দায়িত্ত্বটা পেতে পারি?”
“আঃ!” মিহিরদা স্পষ্টতই বিরক্ত।
সপু বাদলের
দিকে তাকালো আগুনে দৃষ্টিতে...বাচ্চু সঙ্গে সঙ্গে সপুকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।
মিহিরদার সঙ্গে বাচ্চুর কি চোখে চোখে কোন কথা হল!
“শোন্ আমিও থাকব তোর সাথে। ডাকবি তুই। বাকীটা আমি করব।” বাচ্চু কনভিন্স করতে
চাইছে ওকে।
সপু কোন কথাই
বলছে না।
“আজই। ফেলে রাখা যাবে না। শুনলি তো...”
“আচ্ছা বাচ্চু, হাইকমান্ড জানে আমরা কীভাবে বেঁচে আছি? বা মিলির প্রতিও তোর অবিশ্বাস এসে গেছে? সত্যি কথা বলতো, আমাদের যা বোঝানো হয়েছিল, তার থেকে কি আমাদের একটুও সরে আসতে হয়নি? কাল আমাকে সাফ করার দায়িত্ত্ব দিতে পারে তোকে বা আমাকে দিল তোকে শেষ করার। কেন ডেডিকেটেড সৈনিকরা গ্র্যাজুয়ালি বিট্রে করার দিকে ঝুঁকছে, কেন আদর্শ থেকে ডেভিয়েশন হচ্ছে - এ নিয়ে কোন সেল্ফ-অ্যানালিসিস হচ্ছে কি?”
“সপু, এখন কি এসব নিয়ে কথা তোলার সময়?”
“তুই বুঝতে পারছিস না বাচ্চু এভাবে বিতর্ক চেপে রাখতে রাখতেই আমরা মূল লক্ষ্য থেকে সরে আসছি। বালুরঘাটের যে চালের আড়তদারকে আমরা মেরেছিলাম, মনে আছে তোর? লোকটার বিপুল বিত্ত ছাড়া আর কি কোন অপরাধ ছিল? ও প্রতিবছর কত গরীব মেয়ের বিয়েতে অর্থসাহায্য করত, কত নিঃসহায় মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করত, হাইকমান্ড জানে? পলিসি এবং এর রূপায়ণের মধ্যে যে সোসাল গ্যাপ, এ নিয়ে গ্রাউন্ড লেভেল ওয়ার্কারদের কথা পার্টিকে শুনতে হবেনা?”
“সপু, তুই ডিসটার্বড।”
“কারণ আমি তোকে বোঝাতে পারছি না, শৈবালদা আমাদের শত্রু পুলিশের লোক হলেও বউদি আমাকে মাঝরাতে যখন বসিয়ে ভাত খাওয়ায়, আমার মায়ের কথা মনে পড়ে। ওদের ছোট্ট বাচ্চাটাকে নিয়ে বউদি অথৈ জলে পড়বে...আর আমি ওদের জন্য কিছুই করতে পারব না, এ আমার সত্যিই ভালোলাগছে না রে। বারবার মনে হচ্ছে অন্যের চোখের জলে কিছু অর্জন করা যায় না। আমরাও আলটিমেটলি ফেলিওর হব। দেখে নিস।”
“সপু, কনট্রোল ইয়োরসেলফ।”
“আমাদের আদর্শ কি আমরা কাউকে আদৌ বোঝাতে পেরেছি? না হলে আমাদের শত্রু বাড়ছে কেন? প্রশান্ত বৈরাগীর মত অ্যান্টিসোশালকে আমাদের এগেন্স্টে কাজে লাগাচ্ছে সরকার। পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসিতে আমাদের ভূমিকা কী হবে, মানুষ বুঝতেই পারছে না। শুধু হুলিগানিজমটাই ফোকাসড হচ্ছে। এভাবে কতদিন রেজিস্ট করতে পারব আমরা? কতদিন? বন্দুকের নল শেষ কথা বলে না। দল কিন্তু ভাঙছে ভেতরে ভেতরে। আই স্মেল ইট। ডোন্ট ইয়্যু?”
“স্যরি সপু। বাচ্চু রিভলবারটা কখন যে ওর দিকে তাক করে ফেলেছে, সপু খেয়ালই করেনি।”
সপুর ঠোঁটে এক করুণ হাসি। জানতাম এমনটাই হবে। কিন্তু...চোখের পলকে সপু ওর রিভলবার বের করে মুহূর্তেরও কম সময়ে সরাসরি বাচ্চুর খুলি লক্ষ্য করে চালিয়ে দিল। এতটাই অপ্রত্যাশিত সে আক্রমণ যে বাচ্চু কিছু বুঝে ওঠার আগেই উল্টে পড়ে গেল মাটিতে। রিভলবারটা ছিটকে পড়ল ওর হাত থেকে।
“দিনের শেষে আমিই যে তোর চেয়ে বেটার শুটার, এটা তোর কাছে প্রমাণ করার ছিল না রে...অথচ আজ আমরা এখানে এসে দাঁড়ালাম। তোকে বলা কথাগুলোও রয়ে গেল আমার কাছেই...মিলি, পারলে ক্ষমা করিস!”
জানলায় আলতো টোকা পড়ল। তারপর চাপা গলার ডাক শোনা গেল – “শৈবালদা...”
কল্যাণী সাড়া
দিয়ে উঠল – “কে?”
“বউদি, সপু।
কিছু আছে?”
শৈবাল বলল, “আজ
তেমন কিছুই নেই রে।”
সপু চুপ করে
আছে। মিহিরদাই কি তাহলে ঠিক!
“একটু মুড়িও
হবে না?”
“আচ্ছা সামনের
দিকে আয়।”
শৈবাল পড়ে
গেল। প্যাকেট ফেটে মুড়িগুলো ছড়িয়ে পড়েছে। গুলিটা ঠিক দু ভ্রূর মাঝখান দিয়ে ঢুকেছে।
সপু দৌঁড়তে শুরু করল...কল্যাণীর বুকফাটা কান্না পিছু ধাওয়া করেছিল অনেকক্ষণ।
“কিরে এত
রাতে?”
“কাজটা করে
এলাম মিহিরদা।”
“ওয়েল ডান মাই
বয়। আমি জানতাম ইয়্যু ওনট্ ফেল।”
“আরো একটা কাজ
বাকী আছে।”
“কী রে?”
রিভলবারটা বের
করে সোজা মিহিরদাকে লক্ষ্য করে চালিয়ে দিল সপু।
সপু আবার
দৌঁড়তে শুরু করল...
“ডক্টর সুপ্রতীক ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে কথা বলতে পারি?”
“বলছি।”
“স্যার,
‘দৃষ্টিকোণ’ পত্রিকা থেকে বলছি। আপনার একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই।”
“দৃষ্টিকোণ! কী বিষয়ে সাক্ষাৎকার?”
“স্যার, একটা বিশেষ সময়কে আপনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। আপনার জীবনে সেই সময়ের ছাপ এখনো কীভাবে রয়ে গেছে...এইসব আর কী!”
“ইন্টারেস্টিং। নেক্স্ট বুধবার আমার সাদার্ন অ্যাভেনিউ-এর চেম্বারে আসুন। শার্প তিনটে। আধঘন্টা সময় দিতে পারি।”
“থ্যাঙ্কিউ
স্যার।”
“স্যার, যে আদর্শ নিয়ে শুরু হয়েছিল, পালিয়ে যাওয়ার সময়েও কি একই আদর্শ ছিল?”
“মাইন্ড ইয়োর
ল্যাঙ্গোয়েজ, ‘পালিয়ে যাওয়া’ মানে? কী বলছেন?”
“স্যরি স্যার,
এমনটাই তো প্রচলিত।”
“ভুল। মিথ্যে।”
“স্যরি স্যার। এত এক্সাইটেড হবেন না
প্লীজ।”
“বলুন।”
“শৈবাল সেনের মার্ডারটা কি আপনার কাছে জাস্টিফায়েড ছিল?”
“এসব কথার উত্তর আমি দেব না।” আপনি আসতে পারেন। এই বলে ডক্টর ভট্টাচার্য উঠে দাঁড়ানোর ভঙ্গী করতেই সাংবাদিক ছেলেটি বলে উঠল, “বসুন চুপ করে!” তার কন্ঠ্যস্বরের হুকুমের ভঙ্গী না মেনে কিছু করার থাকল না ডক্টর ভট্টাচার্যর।
“আপনি কি জানেন যে শৈবাল সেনের মিসেস কল্যাণী সেনকে মিহির দত্তগুপ্ত প্রত্যাশা করতেন। কল্যাণী এসব জানতেনও না। গোবিন্দর অপরাধ হল, ও এটা যেভাবেই হোক জেনে ফেলেছিল। আর তাই নিরঞ্জনকে দিয়ে ওকে শেষ করাতে হয়েছিল। না হলে ইমেজে কালি লেগে যায় যদি! সেই অপূর্ণ প্রত্যাশা থেকেই শৈবাল সেনকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত। এই আক্রোশ মহান নেতা এমন কায়দায় মেটালেন যাতে সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না। শৈবাল কল্যাণী আপনাকে ছোটভাইয়ের মত ভালোবাসতেন, একথা আপনি জানতেনও। আপনার ভেতরেও প্রবল এক হেজিটেশন তৈরী হয়েছিল, সেসময় বাচ্চু আপনাকে শান্ত করতেই রিভলবার তাক করেছিল। ও যদি মারতেই চাইত, এত সহজে কি আর ওকে...”
“কে আপনি!”
“বলব। বলতেই তো এসেছি।”
“শৈবাল সেনও বুঝতেই পারেননি মাঝরাতে এসে খাবার নিয়ে যাওয়া
আদর্শবাদী ভাই তাকেই...মিনিমাম গেস করতে পারলে, সব সময় সার্ভিস রিভলবার সঙ্গে রাখা
লোকটাকেও কি আর এত সহজে...”
“প্লীজ স্টপ!” ডক্টর সুপ্রতীক ভট্টাচার্য্যের আচমকা চীৎকারে বেয়ারা বাইরে
থেকে দরজায় নক্ করল। আগন্তুক দরজা খুলে গম্ভীরভাবে তাকে জিজ্ঞাসা করল, “কী চাই?”
“স্যার ঠিক আছেন তো?”
“ফাইন। ডোন্ট ডিসটার্ব এগেন।”
ডক্টর সুপ্রতীক ভট্টাচার্য্য ভেঙেচুরে যাচ্ছেন ভেতরে ভেতরে।
“পাকা সোনায় কিন্তু গয়না হয় না, ডক্টর ভট্টাচার্য্য। সেজন্যই খাদ মেশাতে হয়। এখন আপনি যদি ভাবেন, নিখাদ গয়না তৈরী করবেন, তাহলে আপনার গোয়ার্তুমিটা বিশুদ্ধ হলেও গয়নাটা কিন্তু ঠুনকোই হবে, তাই না? ওয়ান ফাইন মর্নিং একজন বা একদল লোকের হঠাৎ মনে হল, একটা অ্যান্টিথিসিস প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। সমাজকে সাফ করতে হবে। এজন্য রেভোলিউশন জরুরী। আর্মড রেভোলিউশন। অনেককে মগজ ধোলাই করা হল। তারা আটপৌরে আবর্ত থেকে বেরিয়ে এসে অস্ত্র তুলে নিল হাতে। এর আগে কোনদিন তারা একটা ব্লেড চালায়নি পর্যন্ত! পড়াশোনার বাইরের জগতটাকে দামালপনায় উপভোগ করেনি। তারা ওপরতলার নির্দেশে নির্বিচারে শ্রেণীশত্রু নিধন করতে শুরু করল। সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর আগাছাগুলো পরিষ্কার করার এই কর্মসূচীতে তারা যে কত শত অন্যায় মৃত্যু ঘটিয়েছে, কত পরিবারকে ডুবিয়ে দিয়েছে, কত শিশুর চোখের জল বইয়ে দিয়েছে, এ হিসেব কি আছে তাদের কাছে? নিশ্চিতভাবেই নেই। রাজনৈতিক ক্ষমতার লোভে নয়, সমাজ বদলের স্বার্থে তারা নিজেরাও বিস্তর কষ্ট ভোগ করল...”
আগন্তুক একটু থেমে মুখে এক বিদ্রূপের হাসি মাখিয়ে আবার শুরু করল, “তারপর মেডিক্যালের মেধাবী স্টুডেন্ট স্থিত বৈরাগ্যের টানে সব ছেড়েছুড়ে ধানবাদ পালিয়ে গেল, এদিক সেদিক ঘুরে বহুদিন পর সুযোগ বুঝে সুরম্য চেম্বার সাজিয়ে বসল দক্ষিণ কলকাতার পশ এলাকায়। ততদিনে রাজনৈতিক ভারসাম্যের প্রভূত পালাবদল ঘটে গেছে। এ সমাজ আদৌ তাদের আকাঙ্ক্ষার মাপে গড়ে ওঠেনি। পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে ভুলেই গেল সবাই। কিন্তু তাঁর হাতে লেগে থাকা বিশ্বাসঘাতের রক্ত কি সে মুছে ফেলতে পারল? যখন এসে তাঁর উপলব্ধি হল, এসব কিছু হয়ত বেসলেস ছিল, ততদিনে চুরমার হয়ে গেছে অনেক কিছুই, ভাসিয়ে নেওয়ার জন্য নদীটার হাঁ-এর মুখে আর একটুকরো জমিও নেই। এই ব্যার্থতার দায় বয়ে নিয়ে চলার মত তাঁর সমসাময়িক প্রায় কেউই এই মুহূর্তে আর নেই...কখনো কি সে আত্মজিজ্ঞাসার সম্মুখীন হয় না যে, এই বেঁচে থাকাই তাঁর কাম্য ছিল কিনা!”
ডক্টর সুপ্রতীক ভট্টাচার্য্য দুহাতে মুখ ঢেকে মাথাটা দুদিকে ঝাঁকাচ্ছেন জোরে জোরে। তাঁর মনে হচ্ছে সামনে যেন একটা আয়না ধরা হয়েছে, একের পর এক ফুটে উঠছে প্রতিবিম্ব...মিলিয়ে যাচ্ছে...আবারও ফুটে উঠছে...একসময় আর কোন প্রতিবিম্ব নেই...তিনি মরীয়া হয়ে প্রত্যাশা করছেন আরো অনেক প্রতিবিম্বের মিছিল...আসলে তিনি উপলব্ধি করতে চাইছেন ফিনিক্স কীভাবে জেগে ওঠে। ছাইয়ের ভেতর থেকে জেগে ওঠার সময় তার গায়ে কি প্রাচীন চিহ্নগুলো লেগে থাকে, এটা বুঝে নেওয়া আজ যেন বড় জরুরী।
“আপনার জন্য একটা জিনিস এনেছি ডক্টর ভট্টাচার্য্য। দেখুন তো এটা চিনতে পারেন কিনা?”
এতদিন পরেও বাচ্চুর রিভলবারটা চিনতে সপুর এতটুকু অসুবিধে হল না। টেবিল থেকে তুলে নিয়ে ও পরম আদরে হাত বোলাচ্ছিল রিভলবারটার গায়ে, আর সামনে বসে থাকা আগন্তুককে উপেক্ষা করেই নিজের মনে মনে বিড়বিড় করছিল, “শুধু কি ভুলই করেছিলাম? শুধু মরে যেতে পারিনি বলেই আমার কনট্রিবিউশন আজ প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত?”
আগন্তুক উঠে পড়ল চেয়ার ছেড়ে।
সপু তাকালো তার দিকে...সে দৃষ্টিতে কোন জিজ্ঞাসা নেই। সব দ্বন্দ্বের অবসানের পর, সব দ্বিধা মুছে গেলে যেভাবে আলোর অবগাহনে পূর্ণ হয়ে ওঠা...তেমনই এক আত্মস্থতায় নিমজ্জিত হয়ে তার দুচোখে যেন দীর্ঘ উড়ানের আগে ডানা মুড়ে এসে বসা পাখিটার ছায়া...সর্বং পরবশং দুঃখং সর্বমাত্মবশং সুখম্...অন্যের নিয়ন্ত্রণাধীন সবই দুঃখের ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধীন সবই নিরন্তর সুখের উৎস!
আগন্তুক চেম্বারের দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার আগে জানতে চাইল, “মিলিকে মনে আছে আপনার?” তার বলতে ইচ্ছে হল না যে তার মায়ের নাম মিলি।
ডক্টর সুপ্রতীক ভট্টাচার্য্য যেন এ আবহ ছেড়ে হারিয়ে গেছেন বহু দূরে কোথাও...অতীতের কোন নক্ষত্রহীন নিকষ অন্ধকারে নিরুদ্দেশের অভিমুখে ধাবিত প্রাণের উদ্ভবের চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট নেই...অথচ অবধারিতের মত সেই অপাবৃত আঁচেই এক ব্যাখ্যারহিত উন্মোচনের দূরাগত ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে ওঠে...সেখান থেকে চাইলেও ফিরে আসা যায় না...
আগন্তুক চেম্বারের বাইরে এসে দাঁড়ালো। ভেতরে গর্জে উঠল বাচ্চুর রিভলবারটা।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন