সত্য-মিথ ও রহস্যে-ভরা ঝাড়খণ্ডের স্থাননাম
![]() |
| রাঁচির দশম জলপ্রপাত |
ডাঙা-ডহর-টাঁইড়-টিকরের দেশ ঝাড়খণ্ড।
ঝোপ-ঝাড়-বুদা-পাহাড়ের দেশ ঝাড়খণ্ড। নালা-গাঢ়া-দরহ-ডভায় ভরা ঝাড়খণ্ড। গড়া-বাইদ-বহালে
ভরা ঝাড়খণ্ডের মাটি। অজস্র ফুল আর অসংখ্য বৃক্ষের নামানুসারে ঝাড়খণ্ডের বহু গ্রামের
নামকরণ। অনেক মিথ ও রহস্যে ভরা আছে ঝাড়খণ্ডের স্থাননাম। বলা চলে, সুজলা সুফলা শষ্য
শ্যামলা প্রান্তর এখানে এসে যেন মন্থর গতিতে থেমে গেছে। শুরু হয়েছে ডুংরি-পাহাড় ঘেরা
এক তরঙ্গ ভঙ্গিমা সীমানা। বহু কল্প-গল্প নিয়ে গড়ে উঠেছে এক একটি জনবসতি।
ঝাড়খণ্ডের স্থাননামে এক সত্য ও
কল্পনা যেন মিলে মিশে এক হয়ে গেছে। কঠোর ও বাস্তব সত্যকে সবসময় ধরে রাখা যায় না। মিথ
কল্পনা আর বাস্তব সত্য মিশে না গেলে জীবনের রহস্য অপূর্ণ থেকে যায়।
আমরা ঝাড়খণ্ডের কিছু স্থাননামের
উল্লেখ করে রহস্যের রসাস্বাদন করতে পারি।
রাজরাপ্পা বা রাজরাপা
হাজারীবাগ থেকে প্রায় চল্লিশ কি.মি দূরে এটি এক শক্তিপীঠ। দেবী ছিন্নমস্তার মন্দির। দুটি নদীর সঙ্গমস্থলে এই মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা। অনেকে বলেন, স্থানটির আসল নাম 'রাজরাপা'-যার অর্থ উপরের দিকে গড়িয়ে পড়ে। এটি এক ব্যতিক্রমী চিত্র। কারণ সব কিছু উপর থেকে গড়িয়ে নিচের দিকে যায়। এখানে দামোদর নদীর উপর এসে পড়েছে ভৈরবী নদীর জল - নরনারীর মিলনের বিপরীত নদ-নদীর সঙ্গমস্থলে তাই গড়ে উঠেছে এই শক্তিপীঠ - ছিন্নমস্তা মন্দির।
কয়েক দশক আগেও স্থানটি নির্জন পাহাড়ের
গভীর জঙ্গলে অবস্থিত ছিল। যদিও আজ পর্যটকদের আগমনে ও আক্রমণে স্থানটি জনবহুল ও আর পাঁচটি
পর্যটন ক্ষেত্রের মতই হয়ে উঠছে।
মহুলিয়া
ঘাটশিলার পশ্চিমাংশে মহুলিয়া (বর্তমানে গালুডি নামে সর্বাধিক পরিচিত) স্থাননাম। শোনা যায় ধলভূমরাজ তাঁর ইষ্টদেবী রঙ্কিণীকে সুদূর পশ্চিমের ধারানগর থেকে ঘাটশিলায় নিয়ে আসছিলেন। রাজার সঙ্গে দেবী রঙ্কিণীর শর্ত ছিল যে ঘাটশিলা রাজবাড়ি পৌঁছাবার পূর্বে পথমধ্যে রাজা পিছনে ফিরে তাকাবেন না। কিন্তু ঘাটশিলা পৌছাবার পূর্বেই দেবীর কোন শব্দ না পেয়ে রাজা পিছনে ফিরে তাকান ও প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করেন। দেবী রঙ্কিণী রাজাকে আদেশ দিলেন যে এখানেই যেন তাঁর মন্দির তৈরি করা হয় এবং দেবী এখানেই থাকবেন। ধলভূমের কবির বর্ণনায়-
“দেবী বলে নরপতি স্মর পূর্বকথা।
আর না যাইব আমি রহিলাম হেথা।
মন্দির বানায়ে মোর দাও ত্বরা করি।
দাসদাসী দেহ আর ব্রাহ্মণ পূজারী।
মোহুল বৃক্ষের তলে বিশ্রাম আমার।
মোহুলিয়া নামে গ্রাম হইবে প্রচার।
আজি হৈতে মোরনাম হইল রঙ্কিণী। যাও
রাজা তবে তুমি এবে রাজধানী।
এত শুনি নরপতি করিয়া প্রণাম। পহরেক
মধ্যে আইল ঘাটশিলা গ্রাম।
মন্দির করিয়া দিল মোহুল্যা গ্রামেতে।
রঙ্কিণী স্থাপন কৈলা সেই মন্দিরেতে”।
আজও মহুলিয়া রঙ্কিণী মন্দিরটি বহু ভক্ত সমাগমে ঊজ্জ্বল হয়ে আছে। ধলভূমরাজের ইষ্টদেবী এই রঙ্কিণী। মন্দিরকে ঘিরে বহু লোককথা প্রচলিত। একদা এই মন্দিরে নাকি নরবলি দেওয়া হত, এমন জনশ্রুতি শোনা যায়। রঙ্কিণী দেবীর মন্দিরটি আজও জাতীয় সড়কের গাঁ ঘেঁষে অবস্থান করছে।
শ্যামসুন্দরপুর
![]() |
| শ্যামসুন্দরপুরের রাধাকৃষ্ণ মন্দির |
“সাতুটি বলিয়া গ্রাম দিলা সেই রাজা।
বহুরূপে বসাইলা তথা জন প্রজা।
নাম দিল তার শ্রীশ্যামসুন্দরপুর।
বহু সাধুসেবা যাত্রা হইলা প্রচুর”
শ্যামানন্দ প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটির
অস্তিত্ব আজও বর্তমান। শ্যামাসুন্দরপুর সুবর্ণরেখা নদীকূলে এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এখানে
আজও দোলপূর্ণিমায় বিশাল মহোৎসব আয়োজিত হয়। এখানে অনুষ্ঠিত যে মোচ্ছব হয় তার প্রথম শুভারম্ভ
নাকি স্বয়ং শ্যামনন্দ করেছিলেন –
“মহোৎসব করিব শ্যামসুন্দরপুরে। ফাল্গুনেতে মহোৎসব করিল প্রকাশ।
মহা আনন্দিত হৈল শ্যামসুন্দরপুরে। শত মুখে সে সুখ কে কহিতে পারে।
নরসিংগড়
![]() |
| নরসিংহগড় |
ঘাটশীলা রাজধানী ত্যজিয়া নৃপতি। তিনক্রোশ পূর্বদিকে করিলেন স্থিতি
নরসিংহগড় নামে গড় হৈল প্রকাশ। দশভুজা
রূপে দেবী কৈলা তথা বাস”।
নরসিংহগড়ের অদূরে সেদিন এক রেলস্টেশন
তৈরি হল এবং ধলভূমরাজের গড়ের অদূরে বলেই স্টেশনটির নামকরণ হল ‘ধলভূমগড়’। এই ধলভূমগড়কে
কেন্দ্র করেই বিখ্যাত বাংলা চলচিত্র নির্মাণ করেছেন সত্যজিৎ রায় - ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’
(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
অম্বিকানগর (আমাইনগর)
![]() |
জাতীয় সড়কের ধারে পুতড়ু-খাড়িয়া
কলোনীর পাশে নবকুঞ্জের নির্মাণ শ্রীচৈতন্যের স্মৃতিকে যেন ধরে রেখেছে। বর্তমানে জাতীয়
সড়কের নাম ‘চৈতন্যপথ’ হওয়া উচিৎ বলে একটা দাবীও উঠেছে।
চাইবাসা বা চাঁইবাসা
![]() |
| চাইবাসার রোরো নদী |
সাঁওতালি লোককাহিনি অনুসারে অতি প্রাচীনকালে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা বিভিন্ন গড় বা দুর্গে বাস করতেন। এই স্থানগুলি হল - চাইগাড়, চাম্পাগাড়, বাদোলীগাড়, কয়রাগাড়, খাইরীগাড় (বিশ্বনাথ মুর্ম্মু: 'সাঁওতালী শব্দাবলী ও ভাষাশিক্ষা) প্রভৃতি। এই চাইগাড় থেকে চাইবাসা স্থাননামের উৎপত্তি। একটি ঝাড়খণ্ডী বাংলা ভাষার লোকপ্রবাদে চাইবাসার উল্লেখ পাওয়া যায়, ‘চাঁই, চিংড়ি ফুকুবাসা, তবে জানবি চাঁইবাসা’।
স্বাধীনোত্তরকালে মানভূমের বঙ্গভূক্তির
আন্দোলন শেষ হল মানভুমের বুক চিরে তাকে দ্বিখণ্ডিত করার পর - পুরুলিয়া বাংলার আওতায়
আর অবশিষ্ট অঞ্চলটি বিহারে অধীনে। দ্বিখণ্ডিত মানভূমের বুকে সেদিন লোককবির গানে সাধারণ
মানুষের চাপা ক্ষোভ যেন প্রকাশ পেয়েছে - ‘হায় ভালবাসা, আমার চল্যে গেল চাঁইবাসা।
হাজারীবাগ
![]() |
| হাজারীবাগের আমবাগান |
শোনা গেছে এখানে হাজারটি আমের গাছ ছিল, তাই স্থাননাম হাজারীবাগ। একদল বলেন, 'হাজারী' নামের এক বিশেষ ধরনের আমের প্রজাতির গাছ ছিল, বলেই এর নাম হাজারীবাগ। কেউ আবার বলেন ‘হাজারা’ বাবুর আমবাগানের জন্যই এর নাম হাজারীবাগ। যদিও বর্তমানে হাজারীবাগ একটি জেলা শহর। মিথ আর সত্য যাই হোক না কেন, হাজারীবাগ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যটি অবশ্যই উল্লেখযোগ্য --
“প্রশস্ত প্রান্তরের মধ্যে হাজারিবাগ
শহরটি অতি পরিষ্কার দেখা যাইতেছে। শাহরিক ভাব বড়ো নাই। গলিখুঁজি, আবর্জনা, নর্দমা, ঘেষাঁঘোঁসি, গোলমাল,
গাড়িঘোড়া, ধুলোকাদা, মাছিমশা এ সক্কলের প্রাদুর্ভাব বড়ো নাই; মাঠ পাহাড় গাছপালার মধ্যে
শহরটি তক্তক্ করিতেছে”।
ঘাটশিলা
![]() |
মধ্যযুগের ‘রসিকামঙ্গলে’ ঘাটশিলার নামোল্লেখ আছে এবং সেখানেও পঞ্চপাণ্ডবের ঊল্লেখ আছে—
ঘন্টশিলা বলিয়া মহাপুণ্যস্থান। সুবর্ণরেখার কূলে অতি দিব্যস্থান।
অতি ঘোরতর কুঞ্জ বিচিত্র নির্মাণ। পূর্বে পাণ্ডবাদি তথা করিলা বিশ্রাম
হেন মহাপুণ্যস্থান আছয়ে প্রমাণ। হেনকালে পাণ্ডবাদি ছিল যেই স্থানে
সেইস্থানে রসিককেন্দ্র করিলা গমনে। অতি
মনোহর স্থান দেখিতে সুন্দর।
গহন কানন নদী জল পরিমল।
এই ঘাটশিলাতেই রসিক মুরারিকে দীক্ষা দিয়েছিলেন পরম বৈষ্ণবাচার্য শ্যামানন্দ। এই রসিক মুরারি দীক্ষা নিয়ে হলেন রসিকানন্দ। তাছাড়া ধলভূম রাজ্য কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হল, ধলভূমের রাজধানী কীভাবে ঘাটশিলা হল - এসব কথা ধলভূমের কবির লেখনিতে ব্যক্ত হয়েছে—
জগন্নাথ দর্শন করিয়া মহামতি। ধলভূমে
আসিয়া হইলা নরপতি।
লুপ্ত হৈল সিংহপদ জগদ্দেউ নাম।
রাজধানী করিলেন ঘাটশিলা গ্রাম।।
ঘাটশিলাস্থিত দেবী রঙ্কিণীর উল্লেখ প্রতিবেশী রাজ্যের কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে”-
‘রঙ্কিণি বন্দিব যাঁর ঘাটশিলা পুরী’
নবজাত শিশুর নামকরণ যেমন অন্যেরা
করে থাকেন, তেমনি কোন স্থাননামও অন্যদের দেওয়া। প্রাকৃতিক পরিবেশ, গাছগাছালি, ব্যক্তির
প্রভাব সব নির্ভর করে স্থাননামের উপর। ভাব, ভাবনা, গল্প-কল্প সব মিলিয়ে অবশেষে স্থাননামটি
সুপরিচিত হয়। স্থাননাম দীর্ঘদিনের বাসস্থানের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বললেও বোধহয়
অতুক্তি হয় না।









0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন