| সমকালীন ছোটগল্প |
তামাশা
আয় বৃষ্টি ঝেঁপে
ধান
দেবো মেপে
ধানের
ভিতর পো ও ও কা
জামাই
বাবু বো ও ও কা
গলির শেষ বাড়ি থেকে কচি গলায় বৃষ্টিকে ডাকা হচ্ছে।
কিন্তু জামাইবাবুর তো ভুল হতেই পারে!
না।
আমার জামাইবাবু নেই।
মামার
বাড়ি ভারি মজা
কিলচড়
নাই।
না।
মামার বাড়িও আমার নেই!
ইন
ফ্যাক্ট, ঢাক
পেটানোর মতো, জামার বোতাম খুলে জানানোর
মতো কেউই নেই এই ভবঘুরের। ভুল হল
একটু। আছে একজন। বলি তাহলে! হাটের মধ্যে নয়। একান্তেই
বলি। আমার একজন ঈশ্বর আছেন। তিনি মাঝেমধ্যেই পথে নামেন। দেখা হয় তখন। আমি তো পথে পথেই। তাই তখন দেখা হবেই। আর আজকেও
তাই হ’ল।
-
প্রণাম। কেমন আছেন?
-ও! হ্যাঁ। নমস্কার। আপাতত তো
ভালোই।
-
আপাতত কেন! সব সময়ে নয়!
-
না:! সব দিন কি ভালো থাকা যায়! ওতে পেটের অসুবিধে হয়।
-অ্যাঃ! ওসব আপনারও হয়!
-হবে না? আপনাদের হলে আমারও হবে। আপনাদের জন্যেই তো আমি।
আপনারা আছেন বলেই তো আমি!
-ও! এতো সব তো জানতাম না। শুধু জানি, আপনি পথে রেখেছেন, তাই
তো আমি পথে।
-ভালো লাগছে না? অন্য কোথাও যাবেন?
-তা গেলে মন্দ হয় না। এখানে, শুধু এখানে কেন, স্টেশন বা
ফ্লাইওভারেও কেউই আর বিশেষ কিছু দেয় টেয় না। কিন্তু আপনার সঙ্গে যাওয়াটা কি ঠিক
হবে আমার! আমার তো জাতপাতের ঠিক নেই। এমনকি জন্মেরও।
-আরে না না। ওসব তো আপনাদের জায়গায় চলে। যাবেন কিনা, বলুন।
-বেশ। চলুন তা’হলে।
-কিন্তু এ কোথায় এনে ফেললেন, স্যার! এখানে তো কেবলই জল আর
জঙ্গল! এখানে কে আমাকে ভিক্ষে দেবে! কে দেবে দিনরাতের দুটো ডালরুটির পয়সা?
-এর নাম সোঁদরবন। ওই নদীটা দেখছেন। ওর নাম বিদ্যেধরী। জলে
কুমীর আছে, জঙ্গলে বাঘ। কিন্তু চিন্তা নেই। আমি তো আছি। এখন থেকে আপনি কিন্তু আর
অবিনাশ নন। আপনি আজ থেকে গণেশ। ঐ যে বাড়িটা দেখছেন, বেশ জমকালো, তাই না? এখন থেকে
আপনি ও বাড়ির কাজের লোক। আপনার ভাতরুটির ব্যবস্থা কিছুদিন ওখানেই হয়ে যাবে।
কথা শেষ হতে না হতেই অবিনাশ দেখলো, এক বড়ো বাড়ির অন্দরে অবিনাশ থুড়ি গণেশ। পাশে
ঈশ্বর।
একটু দূরে বয়ে যাচ্ছে, ওই যে উনি বললেন, বিদ্যেধরী। এ যেন আদ্যিকালের
জমিদার বাড়ি। প্রায় পরিত্যক্ত।
দেখা গেল, সে বাড়ির একটা ঘরে তুমুল আড্ডা। বোধহয় এই গল্পের লোকজন
সব।
রম্বাস আকৃতির ঘর। লাল মেঝে। তিনটে জানলা।
লম্বা। ভেনিসিয়ান পাল্লা। তৃতীয় জানলাটি দরজার বাঁ পাশে। একটা কব্জা খুলে গ্যাছে।
ঝুলে আছে হালকা চালে। অন্দরের দিকে তো, তাই অসুবিধে নেই। ঘরটি বেশ উঁচু
এবং বড়ো। মাঝামাঝি জায়গায় আট জন বসার মতো ডাইনিং টেবিল। মনে হচ্ছে বেশ দামী কোন
কাঠের। চেয়ারগুলিও
তাই। একটা বেশ প্রাচীন খানদানি ব্যাপার। গণেশের মজা-ই লাগছে। বোঝাই যাচ্ছে, প্রায়
ফাঁকাই পড়ে থাকে এই ঘর। লোক নিশ্চয়ই আছে, তাঁরাই পরিচ্ছন্ন রাখে। দেখে শুনে
মনে হচ্ছে, একশো ছুঁই ছুঁই পুরোনো বাড়ি। কতোই বা পরিস্কার রাখা যায়! অবিনাশ মানে
এখন গণেশ দেখলো, বাড়িতে ঘুণ ধরেছে। সময়ের। ইঁদুরে, টিকটিকিতে এখানে বড়োই সদ্ভাব।
ওদেরই তত্ত্বাবধানে থাকে বোধহয় বাড়িটা।
গণেশ ঈশ্বরের দিকে তাকালো।
-দেখতে থাকুন। ওদের কথামতো বাঁচুন কিছুদিন।
গণেশ দেখতে থাকে। ছ’জন ত্রিশোর্দ্ধ মানুষে ঘর মোটামুটি
ভর্তি। মধ্যবিত্ত চাকুরে সব বলেই মনে হচ্ছে। খাওয়াপরার অভাব নেই। বোধ হয়, পুজোর
ছুটিতে এরা সব এসেছে। বাড়ির চারপাশে অনেক গাছপালা্ ফাঁকা জমি ঝোপঝাড়। বেশ
ঠান্ডা। তবু জমে উঠেছে আড্ডা। কথাগুলো কখনো যেন অনুযোগ, কখনো শ্লেষ, কখনো বা মজার।
আড্ডায় কিন্তু সক্রিয় সবাক সকলেই। তো কথাটা হচ্ছিল নোবেল প্রাইজ
নিয়ে। এ বছর
কোন বিষয়ে কে পুরস্কার পেলেন, কেন
পেলেন, নোবেল কমিটির কৈফিয়ৎ ইত্যাদি নিয়ে বেশ জমে উঠেছে আড্ডা। সামনের চা বোধহয় ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। দেয়ালের রঙ তেমন
কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবু দেয়ালে রোদ। তবু হেমন্তের সকাল। উঠে আসছে নানান প্রশ্ন,
কৌতূহল, বিতর্ক।
আরও একটা সমস্যা নিয়ে এরা কথা বলছেন। আজকাল ইঁদুর আর
টিকটিকির বাড়াবাড়ি বা উৎপাত-ও বলা যেতে পারে, বেড়েছে খুব। এমনভাবে থাকে এরা, মানুষ
আর ইঁদুর টিকটিকিতে আলাদা করা যাচ্ছে না। এ নিয়ে চারপাশে খুব সংশয়, ভয়, ক্রোধ,
হতাশা। অগত্যা এদের সবার হাতে একটা করে আতসকাঁচ। সামান্য অন্য
কায়দার। আসল নকলে তফাৎ করা যায়। সামনে কিছু দেখলেই তার উপর এরা একবার সেটা ঘুরিয়ে
নেয়। নিশ্চিন্ত হয়।
আজকের আলোচনার সুতোটা অমরের হাতে। সে-ই সব যোগাড় করেছে। ছবি,
নোবেল কমিটির বক্তব্য, নানান দেশের উমেদারির ক্লিপিং, সম্ভাব্য প্রাপকদের কাজের
বিস্তৃতি ইত্যাদি। ইতিমধ্যে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্রের
অপব্যবহার, আগ্রাসন, বিশ্বায়ন, অস্ত্র ব্যাবসা, শান্তিচুক্তি ইত্যাদি নিয়েও তুফান
উঠেছে। এতোটাই যে, ছাদ থেকে মাঝামাঝি গোছের একটা চাঙর খসে পড়লো। তবু
কেউ তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। যেন স্বাভাবিক এই বাড়ির পক্ষে। বিনতা কেবল একটু সরে
বসেছিল আর ছাদের দিকে তাকিয়েছিল এক ঝলক। তা দেখে নীনা হেসে বলেছিল, লাভ নেই।
ওখানেও পড়তে পারে। বাকি সবাই হেসেছিল এবং ঢুকে পড়েছিল আবার প্রসঙ্গে। তিনু মানে
অতীন এক ভিসিয়াস সার্কেলের কথা বললো। পরমেশ দেশ, শান্তি আর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে
নানান ফেরেব্বাজির তামাশার কথা। তপেশ অমরকে বললো, নোবেল প্রাইজ পাওয়ার ব্যাপারটাও
কি তাই! উঁচু গলায় অমরের তীব্র প্রতিবাদ। পুরোনো দিনের মানুষ রাখাল দৌড়ে এলো।
-কিছু বলছিলেন, দাদা।
- তোমাকে নয়।
রমা উলকাঁটা টেবিলের উপরে রেখে হেসে উঠলো। কেন, কে জানে!
টেবিলে ছড়ানো আছে দু’ধরনের ছবি। এক পাশে প্রাপকদের, অন্য
পাশে নোবেলের জন্য তদ্বির পাওয়া কিছু মুখের ছবি। প্রতিটি সাদাকালো ছবিগুলোর উপর
ঘুরে যাচ্ছে টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়া সব ক’টা হাতের আতস কাঁচ। স্পষ্ট হয়ে
যাচ্ছে মানুষ আর মনুষ্যেতর জীব। ছ’জোড়া চোখে কখনো বিস্ময়, আনন্দ, কখনো বিদ্বেষ, ঘৃণা।
এমনও হতে পারে! সব মিলেমিশে একাকার। ভালোমন্দ শুয়ে আছে পাশাপাশি! এ-ও কি সম্ভব!
ছ’জন পরস্পরের চোখে চোখ রাখলো। থমথমে মুখ। চোখে ভয় বিস্ময় ঘৃণা দ্রুত যাতায়াত
করছে।
ইতিমধ্যে
একজনের হাতে উঠে এলো এক টুকরো মাফলার। রঙটা সাদাকালোই হবে। ছিন্নভিন্ন। টেবিলের উল্টো দিক থেকে
উঠে এলো গতদিনের নিউজ পেপার। এখানেও নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তি নিয়ে
তুমুল আলোচনা। ছবিসহ তিন কলম ছাড়িয়ে পরের পৃষ্ঠা পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিছু সাদাকালো ছবির
উপর সাদাসহ কালো বিষ্ঠা। ঘেন্নায় হাত থেকে ফেলে দেওয়া হ’ল কাগজটা। বোঝা যাচ্ছে,
টিকটিকির কম্ম। সুতরাং এসে পড়লো আবার ইঁদুর। এলো টিকটিকি। উঠে এলো
বিশেষ এক ধরনের
আঠার কথা। এবং
অবশ্যাম্ভাবী উত্তপ্ত অভিযোগ, অনুযোগ। কৈফিয়ৎ এলো, স্থানীয় বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না।
অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে মহিলা শ্রোতাদের। আলোচনাটা ক্রমে নোবেল থেকে ইঁদুর টিকটিকির
দিকে। কোনটা ভালো? আঠা, নাকি চিরাচরিত ফাঁদ! অনেকটা ইলেকট্রিক চেয়ার নাকি রশিতে
চল্লিশ মিনিট ঝুলিয়ে ফাঁসি- কোনটা বেশি মানবিক হতে পারে, তার মতো।
হঠাৎ একটা শোরগোল। ছ’জনেই চমকে নিজেদের মধ্যে চেঁচামেচি। দেয়ালের এক কোনে একটা
ইঁদুর আর এক টিকিটিকি। দুটোই বেশ বড়োসড়। গণেশ কিছু ত্রস্ত, দেয়ালের অন্য পাশে
দাঁড়ালো। মনে হচ্ছে, দুটোই প্রচুর নিষিদ্ধ প্রোটিন নিয়মিত পায়। একটা ছবি নিয়ে টাগ
অফ ওয়ার। চেয়ারগুলোর তীব্র চোখেও ধরা পড়লো না, ছবিটা কি কোনো প্রাপকের নাকি অন্য
কারো। প্রায় ছিন্নভিন্ন দশা। চেয়ারের
প্রত্যেকে হাতের আতস কাঁচ তুলে ধরলো। ও দুটো সত্যিই মনুষ্যেতর জীব। তবে অনেকটা অন্য রকম। আরও কোলাহল। হেমন্তের সকালে যেন আগুন লেগেছে। এতো সবের
মধ্যে একটা ইঁদুর লাফ দিয়ে টেবিলের উপরে উঠে প্রচুর তদ্বির পাওয়া ঢক্কানিনাদিত
হতাশ মুখের একটা সাদাকালো ছবি নিয়ে কুটিকুটি করে ধীরেসুস্থে নেমে গেল। টিনা আর্তনাদ
করে চেয়ার থেকে উল্টে অচেতন। আবার হইচই। এবার গণেশ এক জাগ জল নিয়ে এগিয়ে গেল।
ঈশ্বর মুচকি হাসলেন। অমর অবাক হয়ে গণেশের দিকে একবার তাকিয়ে টিনাকে নিয়ে আবার
ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
গণেশ থুড়ি অবিনাশ ঈশ্বরের দিকে তাকালো। ঈশ্বর হাত তুললেন। অবিনাশ দ্বিধায়। কিছুটা
হতাশ। তামাশাটা যেন ঠিক জমলো না। কিন্তু উনি কি ডাকছেন! তার ভাতরুটির ব্যাপারটা
আবার বোধহয় অনিশ্চিত হয়ে গেল! তবে কি হেমন্ত শেষ হয়ে গেল! মাঠ থেকে সব ধান উঠে
গেছে গোলায়?
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন