কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১৩৭

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১৩৭

শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫

প্রণব চক্রবর্তী

 

সমকালীন ছোটগল্প


গল্পের মতো গল্প

"সব গল্পগুলোই কি গল্পের মত হবে! হওয়াটা কি আদৌ উচিৎ! হলে কি আর কেউ গল্প লিখবে! গল্প তো তখন বোতাম লিখবে, গল্প লিখবে কৃত্রিম বুদ্ধিবোঝাই যন্ত্রখুড়ো। তুমি বসে পান চিবোতে চিবোতে, নাতিপুতির কাছে ছেলেভুলোনো সান্ধ্য-বকবকে, পানের পিক ফেলে বলবে 'একদিন আম্মু লিখিচি, লিকে লিকে কত যে ছাপাকাগজ ভরিয়ে দিতুম তোরা সেসব বুঝবি নে' ইত্যাদি।" তো মৃত্যু পথযাত্রী অ-বিখ্যাত এক গল্পকার এমন এক আত্মবিকীরণ ধরাধামে প্রকাশ করেই প্রায় লাফালাফি কোরে সাধের ধরাধাম থেকে নিষ্কৃত হলেন। সে এক রহস্যময় মধ্যরাত। পাশে বসা দেখাশোনার এক প্রায়-ঘুমন্ত মহিলা সহযোগী এবং সুযোগ্য এক প্রতিবেশী-- যিনি পাড়ার দুর্গাপূজোয় প্রতিবার বেশি চাঁদা দিয়ে নিজের একটি গল্প সুভেনিরে ছাপানোর প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করে নেন। এবং ছাপা হওয়ার পর প্রতিবারই দেখা যায়, মানে খুবই তুচ্ছসংখ্যক পাঠকের মধ্যে কেউ হঠাৎ আবিষ্কার করে বসেন, গল্পটি এই সদ্য প্রয়াত অ-বিখ্যাত গল্পলিখিয়ের পুরোনো কোনো পত্রিকায় ছাপা কোনো গল্পের প্রায় ৮০-৯০ শতাংশ। তবে এই চাঁদাপ্রদান বাবুর প্রধান কৃতিত্ব কোন গল্পেরই শিরোনাম পুরোনো মুদ্রিত গল্পটির মত নয় এবং লেখকের নামটাও পুরোনো গল্পটির সঙ্গে মেলে না। প্রসঙ্গটি এখানেই চাপা পড়ে যায় কারণ সুভেনির বা পূজো কমিটিকে সে কথা বললে তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া আসে, "আপনার যা মনে হচ্ছে আপনার মধ্যেই রাখুন, আর যেন কেউ না জানে। কারণ, উনি আমাদের প্রচুর চাঁদা দেন, ওনার টাকাটা কিন্তু আমরা মিস করতে চাই না। ব্যাস। কথাটা মনে রাখবেন। তা নইলে ওনার চাঁদাটা কিন্তু আপনার ঘাড়ে এসে পড়বে, কেউই কিন্তু আপনাকে উদ্ধার করতে পারবে না।" সুতরাং মিলমিলান্তি আবিষ্কারে ঢ্যাঁড়া। 

তো এমন একজন সজ্জন প্রতিবেশী, যিনি সুভেনিরের লেখক বা অন্যের লেখা নাম বদলে ছেপে লেখকের সম্মান উপভোগ করেন, তিনি সযত্নে সেই অ-বিখ্যাত গল্পবাবুর শেষমুহূর্তের উচ্চারিত কথাগুলো মোবাইলে রেকর্ড করে নিয়েছিলেন। যার সুবাদে পরের দিনের স্থানীয় সংবাদপত্রে তার ছবিও বেরিয়েছিলো নিজের নাম সহ। আর আমরা সংবাদপত্র থেকেই জেনেছিলাম মৃত্যুপথযাত্রী শক্তিমান সেই অ-বিখ্যাত গল্পলিখিয়ের গদ্যসাহিত্যের গল্প-আঙ্গিকটি নিয়ে জীবনের শেষ উপলব্ধি। তবে জনান্তিকে বলে রাখা দরকার, ওনার মোবাইল রেকর্ডটি ফরোয়ার্ড কোরে নিজেদের মোবাইলে নিয়ে পত্রিকা সংস্থার সম্পাদকেরা সেটির অনুলিখন করে ছেপেছিলেন। বাধ্যত গল্প লেখা বিষয়ে একজন ব্যতিক্রমি লেখকের শেষ উচ্চারিত প্রায় প্রতিটি শব্দকেই আমরা লেখকের নিজস্ব সাক্ষর হিসেবেই গ্রহণ করেছি। চুরিপাঠ ভেবে প্রতারিত হতে হয়নি।

যাইহোক, শক্তিমান লেখকের সেই উচ্চারিত বাক্যগুলোকে বারবার পড়েছি, এখনও পড়ি। আর গল্প নামক কিছু লিখবার কথা ভাবলেই সামনে এসে আয়নার মত দাঁড়িয়ে পড়ে-- "সব গল্পগুলোকেই কি গল্পের মতো হতে হবে"!... না বা হ্যাঁ, এককথায় এর উত্তর দেয়া যাবে না। একটা গোটা সন্ধ্যা প্রদক্ষিণার সঙ্গে বসে চুমুটুমু, আদর চাদর খচাখচি কোরে হঠাৎই বিষয়টা পেড়ে ফেললাম। বাংলাভাষায় কলেজে পড়ানো দিদিমণি, কথাটা শুনেই যেন নতুন কিছু পেলো গবেষণা উপযোগী-- এমনই আগ্রহে নিজস্ব মেধা ও শিক্ষার উনুনে যেন গাজরের হালুয়া বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আর এর ফাঁকেই সন্ধ্যে গ্যালোপ করতে করতে রাত সাড়ে এগারোটায়। হঠাৎ হুঁশ ঘড়িতে ফিরতেই, লাফিয়ে উঠে বললো, ট্যাক্সী ডাকো। বাড়ী যদিও সে গেলো, কিন্তু ঘন্টাখানেক পর থেকেই মোবাইলে বিস্তর ফুলঝুরির মত শব্দবাজী। আসলে অগ্রজ ওই গুণী লেখকের সংক্ষিপ্ত উচ্চারণের প্রথম অংশটির অভিনবত্বেই আটকে গেছে প্রদক্ষিণা। বাক্যাংশটির মধ্যে 'গল্প' শব্দটির দুবার ব্যবহারকে একাডেমিক যুক্তি, উপমা ও অভিব্যক্তির তাৎপর্যকে বিশ্লেষায়িত করতেই তার যে এত ছটফট, সেটা বুঝতে পারলেও আমার কাছে বাক্যটি এক সহজ ও সরল আত্মসমীক্ষা বলেই মনে হয়েছে। এখানে গল্পের চিরাচরিত আঙ্গিকের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে বলেই আমার মনে হয়েছে। যা আমি মানতেও পারি, না-মানতেও পারি। অবশেষে বিদায়ী চুমুটুমু বিলিয়ে নিদ্রাযাপন।

নিদ্রা কি এত সস্তা যে যাপন করব বললেই হামলে পড়বে! তার ওপর কানমাথায় কটকট করছে দিদিমণির নানারকম স্বরসৌকর্ষ। কখনও নাভীর যেন তলদেশ থেকে উঠে আসা গভীর শব্দ অক্ষরের অহৈতুকী যুক্তিহীন এলোমেলো আলোড়ন, কখনও যেন কণ্ঠের স্বরভঙ্গের সাথে এক বিপন্ন গলন যা শীৎকার বলেই পরিচিত সমাজ-প্রেক্ষিতে। কিন্তু বিষয় হিসেবে মধ্যফাঁকে ধরে রাখা আছে এক গৌণ ভাবনা যা জুগিয়ে দিয়েছি আমি মানে সেই গল্প বিষয়ক ইত্যাদি। কোথায় ঘুম, ঘুম তো চটকে দিয়েছে রাত দুটো পর্যন্ত ফোন আওয়াজ। আচ্ছা, রাত হয়েছে বলে অত ছটফট করে তোর চলে যাওয়ার কি দরকার ছিলো? চাদর তো চটকেছেই, শুধু পোষাক ভেসে যেত হাওয়ায়, কি ক্ষতি হতো? আর এই প্রশ্নটা থেকেই তৈরি হতে পারে মধ্যবিত্ত পরিবারের চরিত্রদের নিয়ে আরেক গল্প। হিন্টস-- বিপরীত লিঙ্গ দুই মানুষ-মানুষীর সম্পর্ক সাড়ে আট বছরের, দুজনাই যৌনকাতর, ক্ষুধায় ছটফটে দুই বাঘ-ভালুক, বিবাহ বাঁধনে সেঁটে যাবার জন্য প্রয়োজনীয় দুটি একটি মোক্ষম শর্ত মেটাতে পারছে না, তাই চুমুতেই চকাস। নাভীর নীচে ঢ্যাঁড়া। মূল্যবোধের প্যানপেনে ধানাইপানাই শুনে, 'যা পাবি চালিয়ে দে প্যালা' ব্যাটাছেলেটির সাম্প্রতিক মোক্ষপ্রাপ্তি। অন্যপক্ষ যেদিন বেশি গরম হয়, সারারাত ফোন নিয়ে চ্যাটাতে পারলেই অর্গ্যাজমে মুক্তি পেতে পারে বোঝা যায়, কিন্তু সে সুযোগ দিতে ব্যাটাছেলেটি আর রাজি নয়। বরং ঘুমে সে বেশি আসক্ত। ব্যাস।

যেহেতু ব্যতিক্রমী গল্পকারের মৃত্যুকালীন গল্পবিষয়ক উপলব্ধি নিয়ে এ লেখা শুরু হয়েছিলো, তাঁকে বা তাঁর উপলব্ধিকে সম্মান জানাতেই আপাতত গল্পের মত গল্প এখন লিখছি না। হিন্টসটুকু চেটে দিয়ে প্রয়াত গল্পলেখকের সজ্জন চাঁদাপ্রদানকারী প্রতিবেশীর মতো কেউ গল্পের মতো একটা গল্প লিখে বাজারী কাগজে বেচে কিছু টাকা পয়সা পেলে, জানাতে হবে না। বাই। 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন