কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১৩৭

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১৩৭

শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ১৩৭ / ত্রয়োদশ বর্ষ : দশম সংখ্যা 

 


রবীন্দ্রোত্তর যুগে বাংলা কথাসাহিত্যে যে অসংখ্য কথাসাহিত্যিক বাংলা ছোটগল্প ও উপন্যাসকে নিরন্তর সমৃদ্ধ করেছেন, তাঁদের মধ্যে যে চারজনের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয়, তাঁদের নাম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সতীনাথ ভাদুড়ী। এর ঠিক পরেই উল্লেখ করতে হয় সমরেশ বসুর নাম। বস্তুত, জীবনে প্রথম উপন্যাস রচনা করে যিনি বাংলা কথাসাহিত্যের শীর্ষগৌরব লাভ করেছিলেন, তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, উপন্যাসের নাম ‘পথের পাঁচালী’। জীবনে তিনি আরও অনেক উপন্যাস এবং ছোটগল্প রচনা করেছেন, প্রতিটি রচনাই অসাধারণ, তবে সাহিত্যের বিচারে স্বীকার করতেই হয় যে, ‘পথের পাঁচালী’র পাশাপাশি তাঁর আরও এক অনন্য সৃষ্টি ‘আরণ্যক’ উপন্যাস।

বিভূতিভূষণের সাহিত্যরচনার স্মৃতি স্মরণ করলে উল্লেখ করা প্রয়োজন, তাঁর প্রথম উপন্যাস লিখিত হয়েছিল আজ থেকে ঠিক একশ বছর আগে, বিগত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে, ১৯২৫ সালে। অর্থাৎ ‘পথের পাঁচালী’ লেখার শতবর্ষ পূর্ণ হলো এবছর ২০২৫ সালে। তবে রচনার সঙ্গে সঙ্গে তা প্রকাশিত হয়নি। বরং প্রকাশিত হয়েছিল তিনবছর পরে ১৯২৮ সালে সাহিত্যিক ও সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় প্রতিমাসে ধারাবাহিকভাবে। একই সময়কালে ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় প্রতিমাসে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসও। ১৯২৮ – ১৯২৯ সালে ‘পথের পাঁচালী’ প্রকাশিত হওয়া শেষ হলে উপন্যাসটি বই রূপে প্রকাশ করার জন্য আগ্রহী হন সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস। এবং তাঁরই উদ্যোগে ‘রঞ্জন প্রকাশনালয়’ থেকে ১৯২৯ সালে ‘পথের পাঁচালী গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রসঙ্গত আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিভূতিভূষণ ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস রচনার পর তার সিক্যুয়াল রচনা করেছিলেন ১৯৩৩ সালে, ‘অপরাজিত’ শিরোনামে।

আমরা সবাই জানি যে, সাহিত্যিক বিভূতিভূষণের যেমন সাহিত্যযাত্রা শুরু হয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসকে অবলম্বন করে, অনুরূপে বিশ্ববন্দিত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রযাত্রা শুরু হয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রকে অবলম্বন করে। অর্থাৎ দুই অনন্য সাহিত্যিক-শিল্পীর উত্থানের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একটি উপন্যাস, ‘পথের পাঁচালী, যে উপন্যাসের এবছর শতবর্ষ পূর্ণ হলো। বস্তুত, সত্যজিৎ রায় বিভূতিভূষণের দুটি উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ ও ‘অপরাজিত’কে অবলম্বন করে তিনটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন, ১৯৫৫ সালে ‘পথের পাঁচালী’, ১৯৫৬ সালে ‘অপরাজিত’ এবং ১৯৫৯ সালে ‘অপুর সংসার’। শুধুমাত্র বাংলা চলচ্চিত্রের বিশ্বেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের বিশ্বেও তা অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্ম রূপে স্বীকৃতি লাভ করেছে।  

‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের পক্ষ থেকে সবাইকে জানাই শুভেচ্ছা শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা।

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

 

কথনবিশ্ব 


পি. শাশ্বতী

 

মহাভারতেই রাষ্ট্রতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের বীজ

 


মহাভারত মহাকালের দলিল। আজ একথা প্রামাণ্য সত্য যে সভ্যতার সকল রহস্য ও সমাধান প্রচ্ছন্ন আছে মহাভারতে। রাজনীতির বিষয় তো বটেই। সভ্যতার হাত ধরেই কূটনীতি, রাজনীতি ও রাষ্ট্র নীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে মানব সমাজে।

পুরাণের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায় " নাসাবৃষির্যস্য মতং ন ভিন্নম্"। অর্থাত "যাঁর মত ভিন্ন নয়, তিনি ঋষি হতে পারেন না। পুরাকালে ঋষিরাই বেদ আদিশাস্ত্র চর্চা করতেন। আর বর্তমান পাঠপদ্ধতি বলছে স্বকালের বোধ, বিচার, বিবেক, বুদ্ধিতে যে কোন গ্রন্থ উপলব্ধ হয় পাঠকের কাছে। কোন গ্রন্থের অর্থ লেখক বা লেখার ওপর নয়, পাঠকের বোধের ওপর নির্ভর করে। আর অনড়ও নয়। ভারত এক অতি প্রাচীন ও পবিত্র দেশ। যুগে যুগে ঋষি, বিদ্বান, গবেষকরা এই দেশকে গৌরবান্বিত করেছে, সমৃদ্ধ করেছে। তবে রাজতণ্ত্র, রাষ্ট্রতন্ত্র, প্রজাতণ্ত্র বুঝতে গেলে প্রথমে বুঝতে হবে দেশ, রাজ্য, রাষ্ট্র কী? দেশ কারা চালায়? তারা কি জনগণের অনুমতিতে চালায়, না নিজেদের ইচ্ছায়? আবার রাজ্য বোঝার আগে বুঝতে হবে নৈরাজ্য কী। রবীন্দ্রনাথের "আমরা সবাই রাজা" শব্দবন্ধ গানে সুন্দর হলেও বাস্তবে নয়। কারণ  সবাই রাজা হলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। রাজা যদি প্রজার সাথে এক সারিতে বসেন তবে সিদ্ধান্ত নেবার লোক থাকে না। সকলের মন রেখে চললে রাজকার্য চলে না। তখন নৈরাজ্য শুরু হয়। এই নৈরাজ্যের মহত্বকে যারা ভয় পায়, তারা বানায় জাতিসংঘ। যে স্বীকৃতি দেয় রাষ্ট্রকে। মূলে রাজ উপান্তেত্র। ত্র-এর ভিতরে 'ষ্ট্রণ'। ষ্ট্রণ অর্থ পরিগঠন। রাজ-এর যে পরিকাঠামো তার নাম রাষ্ট্র। রাষ্ট্রে রাজ্য যদি একটি নির্দিষ্ট আকার পায় তাহলে অন্যরাজ্য সে দখল করতে পারে না এবং নিজের আকারের নিরাপত্তা রক্ষিত হয়, কারণ জাতিসংঘ তাকে মান্যতা দেয়। রাজ্য সহজে প্রজা পায়, তাকে শাসন করে। নব্যরাজার বিরাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সবাই যখন তার নিকট নিজের স্বাধীনতার বন্দোবস্ত দেয়, তখন রাষ্ট্র মূর্তিমান হয়। রাষ্ট্রের ভেতর রাজার অদ্বিতীয় ও প্রশ্নাতীত বিরাজত্ব ত্বরিত বা রহন হয়, অর্থাত স্থিতিকাঠামো লাভ করে, তখনই রাজ্য রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তাই রাষ্ট্র হল নির্দিষ্ট মেয়াদে রাজার অদ্বিতীয় বিদ্যমান সংগঠন। তাই জনগণের রাষ্ট্র কথাটা সোনার পাথরবাটির মতোই ।

রাষ্ট্র শব্দের আরও অর্থ হল উপদ্রব, মকরাদি, দুর্ভিক্ষ। তবু রাজা, রাজ্য বা রাষ্ট্র প্রকৃতির মতোই প্রশ্নাতীত মনে হয়, এই অভ্যাস একটা মনোগত অসুখ। আত্মপ্রবঞ্চনা। কবি বলেছেন-- 'লাশকাটা ঘরে  ক্লান্তি নাই, তাই কেউ কেউ লাশকাটা ঘরে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকছে'।

এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য যে রাজনৈতিক আন্দোলন তার মূল কথা ছিল যে এই ব্যবস্থা মানবতাবিরোধী ত্রাস-এর ভিত্তি। একে ভাঙতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্র কোন বস্তু নয়। তাই এই ব্যবস্থা ভাঙব বললেই ভাঙা যায় না। তাই নৈরাজ্যবাদী চিন্তার বদলে গঠনমূলক চিন্তার প্রয়োজন। রাষ্ট্র ব্যক্তিমানুষ বা সমাজের বাইরে নয়। ব্যক্তি বা নাগরিকই রাষ্ট্র। নাগরিকের স্বভাব রাষ্ট্রের শাস্ত্র। জনতার আন্তঃসম্পর্ক রাষ্ট্রের ধরন নির্ধারণ করে। রাষ্ট্রকে বদলাতে হলে এই স্বভাব ও সম্পর্ক সমূলে বদলাতে হবে। এর সমাধান পাই আমাদের মহাকাব্য মহাভারতে। মহাভারত সম্পূর্ণ রূপে রাজতণ্ত্র, রাষ্ট্রতণ্ত্র, প্রজাতন্ত্রের পারস্প রিক সম্পর্ক ও তার ওপর কূটনীতির প্রভাব। পূর্বে আমাদের এই দেশ অবাধ ও স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতির মাধ্যমে হয়ে উঠেছিল এক স্বয়ম্ভূ প্রতিষ্ঠান। স্বপরিচালনা ও সহযোগিতা ছিল এর চালিকা শক্তি। যখন  মন্ত্র হবে, “আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে  আসে নাই কেহ ধরণী পরে, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে"। তখন একটি প্রকৃত শান্তিপূর্ণ গৌরবোজ্জ্বল দেশ পাওয়া সম্ভব। ভালবাসা হবে রাষ্ট্রের প্রধান স্তম্ভ। এর উন্নয়নকল্পে মানুষ অংশগ্রহণ করবে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে।

দেশব্যবস্থাপনার ঐতিহাসিক বিবর্তনের মধ্যে রূপান্তর সম্ভব। রাষ্ট্র থাকলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা থাকবে, রাজ্য থাকলে থাকবে নৈরাজ্য। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ঘটেছে কুরুক্ষেত্রে। কর্তৃত্বের লোভে আসে মতাদর্শের মোহ। মোহের বশে মুক্তচিন্তা বাধা হয়, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রতি অন্ধ আনুগত্যপ্রবণ নানা মহল এমনকি রাষ্ট্র নিজে। নিজের মতাদর্শকে অভ্রান্ত এবং অন্যকে আদর্শ বহির্ভূত মনে করে। ফলে মতাদর্শ বলপ্রয়োগের দ্বারা রূপান্তরিত হয় কর্তৃত্বতন্ত্রে। কোন মতাদর্শই ব্যক্তিকে স্বাধীনতা দিতে চায় না। স্বাধীনতার অর্থ জানে না। আবার আপামর মানুষ গুটিকয়েক লোকের সামনে এলেই নত হবে, তারজন্য থাকে বিস্তর প্রশিক্ষণ, আজন্ম- আমৃত্যু দীক্ষায়ণ। ফলে এসব সহজাত মনে হয়, সমষ্টিক অবচেতনে গেঁথে যায়। নির্দ্বিধায়  গুরুদক্ষিণা স্বরূপ একলব্যের দক্ষিণ বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দান, নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও যুদ্ধের পূর্বে ব্রাহ্মণকে কর্ণের কবচ কুণ্ডল দান, এ সবেরই প্রতিফলন দেখা যায় মহাভারতের আঙিনায়।

আমাদের সকল যুক্তি, বিবেকবুদ্ধি, তথ্যভিত্তিক ধারণা, পরিবীক্ষণজাত বিবেচনা মুখস্থ মতাদর্শের সামনে একেবারেই বিকল হয়ে যায়। ভরা রাজসভায় দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা ঘোরতর অন্যায় জেনেও রাজশক্তির সম্মুখে নত মস্তক থাকা। যখনই এমন সম্ভাবনা হয় "সম্ভবামি যুগে যুগে" আমূল পরিবর্তন আনে।

সকল কিছুর সূচনা সেই হস্তিনাপুরেই হয়েছিল এবং তার পরিত্রাণ, সমাধানও উল্লিখিত আছে সেই পটভূমিতে। সেই তত্ত্বাবলী ধারণের গর্ব নিয়ে আজও অনিবার্য মহাভারত। কিন্তু যথার্থ অনুধাবনের অভাবে তা কার্যকরী হতে পারছে না। কোথাও পূজিত হচ্ছে ধর্মপুস্তক রূপে, কোথাও রূপকথা আর কোথাও মহাকাব্য আখ্যা দিয়ে এর ভিতরের শিল্পমূল্য অন্বেষণ করে বেড়াচ্ছে। অর্থাত বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী, শ্রদ্ধাবান পণ্ডিত, ভক্ত, ভোগী সকলেই এই গ্রণ্থটিকে আজব মনে করে বিস্ময়ে অভিভূত হয়। ভক্তি বা ভয়ে এড়িয়ে যায়। এর দার্শনিক তত্ত্ব অনুধাবন, বিশ্লেষণে এগিয়ে আসেন না।

এই কাব্য সেই যুগের কথা বলে যে যুগের গর্ভে ইতিহাসের জন্ম। ব্যাসদেব এমনই একজন কবি যিনি সত্যের প্রতিফলন দেখতেন নিজ হৃদয় দর্পণে।বাস্তব বিবরণকে বেশি গ্রহণ করায় বেশিরভাগ পাঠকের হৃদয়- দর্পণ বিকল। আর দর্পণ বলেই এতে সকল ব্যক্তির ছবি নিখুঁত হলেও উল্টোভাবে প্রতিবিম্বিত হয়। মহাভারত কেবল ভরতবংশীয়দের কোন সাধারণ যুদ্ধের গল্প নয়। এ হল ভারতীয় সংস্কৃতি ও সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাস। নিজ নিজ কুরুক্ষেত্রের লড়াইয়ে যখন আমরা মুখ থুবড়ে পড়ি, যারা নিজেরা উঠে দাঁড়াতে পারি না তখন কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে দেওয়া শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ (গীতা) আমাদের পথ দেখায়।

মহাভারতের পাঠ সীমিত থাকে রাজার ন্যায়ের প্রশ্নে। তাই রাজার কর্তব্য ও রাজধর্মেই পাঠক আবর্তিত হয়।

"ন তেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ।

ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সর্বে বয়মতঃপরম।।"

বিশ্ব যাকে ইন্ডিয়া বলে সেই অখণ্ড ভারতবর্ষের নাম যে নরপতির নাম অনুসারে হয়েছে সেই মহান নৃপতি "ভরত"এর নাম থেকে এই দেশের নাম হয়েছে ভারত এবং ভারতের অবিচ্ছেদ্য কাব্যেরও নাম হয়েছে মহাভারত। প্রথম সার্বভৌম রাজা ভরত চক্রবর্তী ছিলেন ন্যায়ের প্রতীক।সততা, নিষ্ঠা ও কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে রাজধর্মকে এক অনন্য উচ্চতায় স্থাপন করেন।

রাজা দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার গান্ধর্বপুত্র ভরত। শকুন্তলার গর্ভজাত পুত্রকে রাজা দুষ্মন্ত ভরত নাম দিলেন এবং  যুবরাজ রূপে অভিষিক্ত করলেন। চন্দ্রবংশীয় ক্ষত্রিয় রাজার পর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র ভরত। জৈন ও বিষ্ণুপুরাণ অনুসারে তিনি কিংবদন্তি। জৈনপুরাণে ভরত চক্রবর্তী নামে এক রাজার উল্লেখ পাওয়া যায় যিনি সারাবিশ্ব জয় করে সুমেরু বা মেরুপর্বতের ওপর ধ্বজা রোপণ করেন। পরে যুদ্ধে নরহত্যার জন্য বিতৃষ্ণ হয়ে নির্বাণ লাভের উদ্দেশ্যে অহিংস জৈনধর্ম গ্রহণ করেন। মহাকবি কালিদাস (খ্রি. পূ.প্রথম শতক/ খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতক) প্রণীত অভিজ্ঞানশকুন্তলম গ্রন্থে তাঁর বাল্যজীবন বর্ণিত আছে। এছাড়াও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১--১৯৫১)  রচিত শকুন্তলা গ্রন্থে তাঁর পরিচয় নিবদ্ধ আছে।

মহাভারত অনুসারে ভরত বিখ্যাত নৃপতি এবং অপরাজেয় শূরবীর। তাঁর রাজ্যের সীমা ছিল হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত। এইরকম মহাশূরবীর আরও থাকলেও প্রাগৈতিহাসিক কালের এই রাজা বর্তমানেও অবিস্মরণীয়। নিজের রাজদরবারের ভূমিতে প্রজাতন্ত্রের প্রথম বীজ তিনিই বপন করেন। জন্ম ও কর্মের সূক্ষ্ম ভেদরেখা টেনে তিনি বলেন জীবনের আসল পরিচয় 'জন্ম' নয়, 'কর্ম'। রাজসিংহাসন প্রত্যাশী নিজের নয় পুত্রের উদ্দেশ্যে তিনি একথা বলেন। রাজপুত্র হিসেবে এরা প্রত্যেকেই প্রথমে যুবরাজ ও পরে ভারতবর্ষের নৃপতি হবার স্বপ্নে বিভোর ছিল। 'পিতা' হয়েও 'রাজা ' ভরত তা হতে দেননি। যদিও পিতা হিসেবে সন্তানদের প্রতি মমতা ও কর্তব্যে তাঁর কোন ঘাটতি ছিল না। তবু রাজা হিসেবে তিনি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যুবরাজ অভিষেকের দিনে রাজসভায় দাঁড়িয়ে সভাসদ ও প্রজাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, "আমি কৃতজ্ঞতা জানাই এই দেশের প্রজাদের, যাঁরা তাঁদের আশীর্বাদ ও শুভকামনায় আমাকে এই সিংহাসনের যোগ্য ভেবেছেন। তাঁদের ভালোবাসার জোরে আমার সামান্য যোগ্যতা নিয়ে আমার সকল নিষ্ঠা মানবসেবায় নিয়োজিত করতে পেরেছি। আমি চক্রবর্তী মহারাজা ভরত আমার মহান প্রজাদের দেওয়া ব্রতকে অঙ্গীকার করে ঘোষণা করছি, কোন রাজাই তার দেশ ও জনগণের থেকে বড় হতে পারেননা।রাজা নিধিপতি নন, কেবল প্রতিনিধি।এই দেশ এবং দেশের আচার্য রা আমাকে শিখিয়েছেন একজন রাজার কেবল তিনটি কর্তব্য থাকা উচিত। জনগণকে সন্তানের মত লালন পালন করা, দেশের সীমানাকে যে কোন মূল্যে রক্ষা করা।

এমন একজন ব্যক্তিকে যুবরাজ নিযুক্ত করা যিনি রাজা হয়ে এই তিনটি দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবেন। পিতা হিসেবে আমি ব্যর্থ কারণ আমি রাজা হলেও আমার কোনও পুত্রের মধ্যে তেমন যোগ্যতার লক্ষণ আমি দেখছিনা। রাজা পিতা। প্রজারা তাঁর সন্তান। তাই ভরদ্বাজ ভূমন্যুকে নিজের সন্তান মনে করে আমি এই রাজ্যের যুবরাজ ঘোষণা করছি।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য কাশীদাসী মহাভারতের আদিপর্বে 'পুরুবংশ কথনে' বলা হয়েছে 'ভরতের গুণকর্ম কহিতে বিস্তার / ভূমন্যু বলিয়া পুত্র হইল তাঁহার'। পাঞ্চাল পুরাণ অনুসারে তিনি একজন সাধারণ প্রজা। আবার জৈনপুরাণ অনুসারে , রাজা ভরত ঋষি ভরদ্বাজকে দত্তক নিয়েছিলেন। অজ্ঞাতকুলশীল এই সন্তানটিকে প্রথম মরুতেরা প্রতিপালন করেন। পরে মরুতসোম যজ্ঞ শেষে রাজা ভরতের কাছে দিয়ে যান। মরুতেরা শাস্ত্রশিক্ষা দেন আর ভরত শস্ত্রশিক্ষা। সে জন্য একই অঙ্গে তিনি ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়। এই ভরদ্বাজ যজ্ঞ করে ভরতকে একটি পুত্র  সন্তান দান করেন। ভরত তাঁর নাম রাখেন ভূমন্যু।

মহাভারতে ভরতের ভাষণটি দীর্ঘ (৩২টি শ্লোক)।বাচ্যার্থ ও ভাবার্থকে অক্ষুণ্ণ রেখে মূলকথাটি নেওয়া হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে মহাভারতের আখ্যান বিভিন্ন ভাবে বিবর্তিত হয়েছে। ফলে মূল মহাভারত কোনটি, নিশ্চিতরূপে তা নির্ণয় করা দুরূহ। পুণের 'ভাণ্ডারেকর প্রাচ্য গবেষণা সংস্থা' ১৯১৯ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত নিরলস কাজ করেছেন এই বিষয়ে। সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া থেকে প্রাপ্ত মহাভারতের প্রায় সমস্ত পাণ্ডুলিপি (প্রায় ১০,০০০) বিচার করে এই সংস্থাটি, প্রামাণিক ৩৫,০০০শ্লোক সংবলিত মহাভারতের একটি সঠিক ও সমীক্ষণাত্মক সংস্করণ প্রকাশ করে। মহাভারত বলতে ১৮টি খণ্ডে বিন্যস্ত সেই পুস্তকটিকে আমরা বুঝি।

ভূমন্যুকে যুবরাজ ঘোষণার পর মাতা শকুন্তলা তাঁকে বলেন, 'সম্ভবত তুমিই এমন একমাত্র পিতা, সম্পর্কের বন্ধন ছিন্ন করে নিজের সন্তানের অধিকার যে অন্যকে দিয়েছে।' ভরত নীরব থাকেন কারণ তিনি জানেন শকুন্তলা শুধু একজন মা। মায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে এসকল তিনি বলেছেন। তাই স্নেহের মোহে তিনি এসকল বলেছেন। কিন্তু ভরত রাজা। রাজাকে ন্যায়নিষ্ঠ হতেই হয়। ভরতের এই জীবন বোধের উৎস  হল জীবন মন্থন করে পাওয়া প্রজ্ঞা আর রাজপুরুষের দায়। এই দায় থেকেই তিনি ভাবতে পেরেছিলেন যে রাজা পিতাই আর প্রজাও সন্তান। নিজের সন্তানের মোহ কাটাতে না পেরে অন্যের সন্তানদের জীবনকে অনিশ্চয়তার ভেতর ফেলার অধিকার রাজার নেই। এমন ন্যায় ভাবনা তাঁকে ভরতকুল ছাড়িয়ে সর্বজনের কাছে শ্রদ্ধেয় করে তুলেছিল। ভারতবর্ষের ভূমিতে প্রজাতন্ত্রের প্রথম যে বীজ তিনি বপন করেন, ভরত-উত্তর কয়েক প্রজন্মের সফল রাজকার্যের মাধ্যমে তা হয়ে উঠেছিল অবশ্য- অনুসরণীয়। মহাপরাক্রমশালী ভরত ছিলেন প্রশ্নাতীত কর্তৃত্বের অধিকারী। ফলে তাঁর স্বৈরাচারী হবার পথ প্রশস্ত ছিল। কিন্তু ন্যায়নিষ্ঠার চিরকালীন পথে তাঁর দিশারী ছিলেন কণ্ব। ভরতের হৃদয়ে তিনি কল্যাণ রাজ্যের বীজ বুনে দিয়েছিলেন। রাজার মার্গদর্শন করাতে তিনি বলেন,  'সকল সংকটে রাজার কেবল স্বীয় প্রজ্ঞা ও বিবেকপ্রসূত ন্যায়ধারণার প্রতি ভরসা রাখা উচিত। আত্মদর্শনের প্রতি অবিচলিত না থাকলে কোন ব্যক্তি ন্যায় করতে পারে না।স্থূল আবেগ ও চিন্তামুক্ত হলেই কেবল আস্থা পাওয়া যায় আর পাওয়া যায় দ্বিধাজড়িত সকল প্রশ্নের উত্তর'। রাজাভরত আজীবন এই  মহাঋষির বাণী শিরোধার্য করেছেন। ইতিহাসে তাঁর মত সার্থক নৃপতিদের সাদৃশ্য এই যে তাঁরা কেউই কখনোই পণ্ডিত ও ন্যায়বান আচার্যদের উপদেশ অগ্রাহ্য করেননি।

অবশ্য রাজপুত্রদের বাদ দিয়ে সাধারণ এক নাগরিককে যুবরাজ করায় অন্দরমহলে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া হয়। মহাভারত বলছে 'নাভ্যনন্দত তান রাজা নানুরূপা মমেত্যুতে', অযোগ্য রাজপুত্রদের ভরত সিংহাসনবঞ্চিত করেন, কিন্তু রানীদের তা সহ্য হয় না। রাগে, দুঃখে, অভিমানে। তিন রানি তাঁদের নয় পুত্রকেই মেরে ফেলেন,' ততস্তান মাতরঃ ক্রুদ্ধা পুত্রান নিন্যুর্যমক্ষয়ম।' অভিজ্ঞান শকুন্তলমের ভাষ্য অনুসারে ঋষি বিশ্বামিত্রের তপোভঙ্গের জন্য প্রেরিত মেনকা সফল হন তাঁকে কামে প্রলুব্ধ করতে। ফলতঃ একটি কন্যা সন্তান হয়।  তপোর্জিত ফল বিনষ্ট হওয়ায় বিশ্বামিত্র মেনকা ও তাঁর কন্যাকে পরিত্যাগ করলেন। মেনকাও শিশুকন্যা ছেড়ে দেবলোকে ফিরে যান। শকুনছায়াবৃত অবস্থায়  মহর্ষি কণ্ব তাকে উদ্ধার ও প্রতিপালন করেন। তাই নাম হয় শকুন্তলা এবং পরিচয় হয় মহর্ষি কণ্বের কন্যা।

মহর্ষি কণ্ব ভরতের দার্শনিক গুরু এবং মাতামহী। ত্রেতা যুগের প্রাচীন ঋষি তিনি।তাঁর দ্বারা ঋগ্বেদের কয়েকটি স্তব লিপিবদ্ধ হয়েছে। তাঁকে ঘোরের পুত্র এবং অঙ্গীরসদের একজন মনে করা হয়। ক্ষেত্র বিশেষে তিনি সপ্তর্ষির তালিকাতেও অন্তর্ভুক্ত হন।

কিন্তু রাজা শান্তনুর শাসনকালে এই ভরতবংশীয় আদর্শ প্রজাতন্ত্রের ধারণার মূলে ঘুণ ধরে। প্রজা পরিণত হয় দাসে। রাজা হয়ে ওঠেন একচ্ছত্র প্রভু। নিষ্প্রশ্নক কর্তৃত্ব, ভোগ-বিলাস চরিতার্থতা রাজার জীবনের পরিভাষায় পরিণত হয়।

প্রজাতন্ত্রের স্থান নেয় পরিবারতন্ত্র। বিদ্বানের মর্যাদা কমে। আচার্যরা রাজসভার অলঙ্কার-এ পরিণত হন। ফলে দেখা দেয় সমূলে বিনাশের সমূহ লক্ষণ। কুলের গর্ব আর বংশধারার গরিমা রাজপুরুষদের অপরিণামদর্শী করে তোলে। তখন কর্মের চেয়ে জন্ম পরিচয়ের মূল্য এত বেশী হয়ে ওঠে, যে কর্তৃত্বের একচ্ছত্র অহংকারে অজ্ঞানদর্শী প্রতিজ্ঞার জালে রাজপুরুষরা আটকা পড়তে থাকেন। রাজপরিবারের এই ত্রিবিধ ক্ষয় নিজ নিজ পথের পূর্ণপরিক্রমণ শেষে কুরুক্ষেত্রে গিয়ে মিলিত হয়। বিনাশের উপযুক্ত ভূমি প্রস্তুত হয়। সেই রণভূমির পরিণতি বড়ই বিয়োগান্ত এবং ভাবীকালের জন্য অবশ্য শিক্ষণীয়। তাই এই রণভূমি থেকে যেন এই দেশের লোকেরা শিক্ষা নিতে পারে, এই মহান দায়কে অঙ্গীকার করেই এগিয়ে চলে বিশ্বনন্দিত মহাকাব্য মহাভারত।


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায় হিন্দী ছবি: (১৩শ পর্ব) অতি-প্রাকৃত বিষয় নিয়ে ছবি

 

১১শ পর্বের ও মাই গড ২-তে অতি-প্রাকৃত ব্যাপার ছিল। মহাদেবের প্রতিভূরূপে হরিদ্বারে ভক্তের সংকটমোচনে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাঁর এক অনুচর, শিবগণ। এই পর্বে সরাসরি ভৌতিক বিষয় নিয়ে ছবির কথা থাকবে।

২০২২ সালের ভেড়িয়া (নেকড়ে)

 


পাশ্চাত্যের werewolf-কে এনে ফেলেছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অরুণাচল প্রদেশে। মুনাফাবাজ এবং প্রকৃতিকে ধ্বংস করে তথাকথিত ‘উন্নয়নে’র প্রবক্তা ববনজিৎ বাগ্গার (সৌরভ শুক্লা) হুকুমে পাকা রাস্তা তৈরির ঠিকেদার ভাস্কর (বরুণ ধাওয়ান) আর তার জ্ঞাতিভাই জনার্দন (অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়) অরুণাচলের জিরোতে উপস্থিত হয় জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে রাস্তা করার প্রস্তাব নিয়ে। স্থানীয় বয়ঃজ্যেষ্ঠরা এর তীব্র প্রতিরোধ করলে ভাস্কর তরুণ প্রজন্মের সমর্থন আদায় করে, জঙ্গলের জায়গায় নেটফ্লিক্স, শপিং মল আর আকাশের তারার পরিবর্তে স্টারবাকস-এর লোভ দেখিয়ে। স্থানীয় জোমিন (পালিন কাবাক) ভাস্করের পক্ষে হলেও, আপাত-বহিরাগত কিন্তু পরিবেশ-সচেতন পাণ্ডা (দীপক দোবরিয়াল) ভাস্কর-জনার্দনকে সাবধান করে এই বলে যে অরণ্যে আছে ‘বিষাণু’। যে অরণ্যধ্বংসের প্রয়াস করবে, বিষাণুর দংশনে সে পরিণত হবে ‘যাপুম’ বা মানুষ-নেকড়েয়। সেদিনই রাতে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যাবার সময় ঘটে দুর্ঘটনা আর ভাস্করের নিতম্বে কামড় বসায় এক নেকড়ে। আহত ভাস্করকে জোমিন নিয়ে যায় স্থানীয় পশু-চিকিৎসালয়ে (নেকড়ে আক্রমণের কথা জানাজানি হলে রাস্তা-প্রকল্প আটকে যাবে) যেখানে অনিকা-নাম্নী পশুদের ডাক্তার (কৃতি সানন) ভাস্করের ক্ষতস্থানে ইনজেকশন দেয়। পরদিন অপ্রত্যাশিতভাবে ভাস্কর সেরে ওঠে, তার ক্ষত হয় অদৃশ্য। কিন্তু সে এও বোধ করে যে তার শ্রবণশক্তি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, আর ঘ্রাণশক্তিও; শুধু মৃত পশুর গন্ধ তার কাছে লাগছে ফুলের সুবাসের মতো!

এরপর প্রকাশ পাজা (দোসাম বেয়ং), যার ওপর ভাস্কর দায়িত্ব দিয়েছিল স্থানীয়দের জমি বেচার দলিলে টিপসই সংগ্রহ করতে, রাতে নেকড়ে-দ্বারা আক্রান্ত হয়। পরদিন জোমিন আর জনার্দনের সামনে ভাস্কর করে রক্ত-বমি। তার অজান্তে তার বিষ্ঠা সংগ্রহ করে উক্ত দুজন (স্ক্যাটোলজিকাল কমেডির এক দমফাটা দৃশ্য), আর তা পরীক্ষা করলে পাওয়া যায় মানুষের দেহাংশ, নখ ইত্যাদি। বিষাণু তার কাজ শুরু করে দিয়েছে!

এরপর আমরা ভাস্করের পূর্ণিমা রাতে মানুষ থেকে নেকড়ে রূপান্তরিত হওয়া চাক্ষুষ করব।

স্থানীয় ওঝা (মদাং পাই) পাণ্ডে-মারফৎ ভাস্কর-জনার্দন-জোমিনকে জানায় যে ভাস্কর তখনই শাপমুক্ত হবে যখন নিজের নিতম্বে সে দ্বিতীয়বার যে নেকড়ে তাকে আক্রমণ করেছিল তার কামড় দ্বিতীয়বার খাবে। সেই নিরাময় হবার মুহূর্তে, যে নেকড়ে ভাস্করকে কামড়েছিল তার ওপর গুলিবর্ষণ করে আসাম থেকে প্রশাসন-কর্তৃক আনয়ন করা শিকারীর দল। আহত নেকড়ের পিছু নিয়ে ভাস্কর আবিষ্কার করে যে সেটিও মানুষ-নেকড়েঃ গত একশো বছর ধরে সে অরণ্যের রক্ষা করে আসছে। তার মনুষ্যরূপঃ অনিকা!

এরপর নেকড়েরূপী অনিকা পুলিশের হাতে বন্দী হলে ভাস্কর নেকড়েরূপ ধারণ করে তাকে মুক্ত করে, কিন্তু পালিয়ে যাবার পর নেকড়ে-ভাস্করের সামনেই আহত নেকড়ে-অনিকা পাহাড় থেকে খাদে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে।

অনুতপ্ত ভাস্কর এবার সিদ্ধান্ত নেয় যে রাস্তা হবে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নয়, জঙ্গলের সীমানা বরাবর, যাতে অরণ্যবিনাশ না হয়। খবরে এও জানা যায় যে ববনজিৎ বাগ্গা এক রহস্যময় বন্য পশুর উদরস্থ হয়েছেন!

ছবি শেষ হয় জনার্দন ভাস্করকে ঘরে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখে তাকে কাঁচা মাংস খাওয়াবার দৃশ্য দিয়ে।

ছবিতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, অরণ্যবিনাশ রোধ ছাড়াও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষেরা বাকি দেশে যেভাবে ব্যঙ্গবিদ্রূপ এবং জাতিগত স্টিরিওটাইপিং-এর সম্মুখীন হন (তাঁদের চীনে মনে করা, ধরে নেওয়া তাঁরা সবাই কুং ফু জানেন), এবং তার সঙ্গে যে কোন অন্য ধরণের মানুষ, যেমন আপাত-বোকা জনার্দন, যেভাবে আক্রান্ত হয়, তার অত্যন্ত সংবেদনশীল সমালোচনা রাখা হয়েছে।

সবদিক দিয়ে অত্যন্ত উপভোগ্য ‘কমেডি-হরর’।

ভুল ভুলাইয়াঁ - ৩ (২০২৪)

 


১৮২৪ সাল। বঙ্গভূমির রাজ্য রক্তঘাট। গভীর রাতে নৃত্যরতা এক অবগুণ্ঠিতা নারীমূর্তি। হঠাৎ সেখানে সদলবলে আবির্ভাব রাজার। ক্রুদ্ধভাবে তিনি চপেটাঘাত করলেন ঐ নারীকে। তারপর তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে জীবন্ত দাহ করা হলো। এরপর রাজার শয়নগৃহে অতর্কিতে দেখা দিল এক প্রেতাত্মা। তার হাতে বধ হলেন রাজা, তাঁর গৃহ গ্রাস করল আগুন – ঠিক যেমনভাবে তা গ্রাস করেছিল নর্তকীকে।

বর্তমান কাল। কলকাতায় ভূত তাড়াবার নাম করে ব্যবসা করে রুহান (কার্তিক আরিয়ান) নামে এক যুবক। এই ভণ্ড ওঝাকে কাজে লাগায় রক্তঘাট রাজপরিবারের মামা (রাজেশ শর্মা) ও তাঁর ভাগ্নী মীরা (তৃপ্তি ডিমরি) । রক্তঘাট রাজপ্রাসাদ থেকে রুহানকে দিয়ে রাজকন্যা মঞ্জুলিকার ভূতকে তাড়াবার ভান করে ঐ পরিবার প্রাসাদটি চড়া দামে বিক্রী করবে। বিক্রীর দামের ভাগ রুহান পাবে।

মঞ্জুলিকা ছিল রাজবংশের জ্যেষ্ঠা সন্তান। কিন্তু পরে দেবেন্দ্রনাথ নামে পুত্র জন্মাতে রাজা পুত্রকেই নিজের উত্তরাধিকারী করেন। অসূয়াতাড়িত মঞ্জুলিকা ভাইকে হত্যা করলে রাজা নাকি নিজের মেয়েকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার নিদান দেন। মঞ্জুলিকার প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রেতাত্মা রাজার প্রাণ নিলে, রাজপুরোহিত তাকে একটি কক্ষে বন্দী করে কক্ষের দরজায় মন্ত্রপূত তালা লাগিয়ে দেন। চেহারায় রুহান দেবেন্দ্রনাথের মতো, অতএব তাকে দেবেন্দ্রনাথের পুনর্জন্ম নেওয়া সত্তা বলে প্রচার করা হয়।

ইতিমধ্যে রুহান আরেকটি রুদ্ধ কক্ষের সন্ধান পায়, এবং নিজে ভণ্ড ওঝা হওয়ার সুবাদে ভূতে অবিশ্বাসী বলে সেই দরজা খুলে ফেলে, এবং প্রাসাদে আরেক প্রেতাত্মার আবির্ভাব ঘটায়।

বর্তমান রাজপুরোহিত জানান যে রাজার এক নয়, দুই কন্যা ছিলঃ অঞ্জুলিকা ও মঞ্জুলিকা। দুজনেরই সিংহাসনের ওপর লোভ ছিল!

মীরা প্রাসাদের সংস্কারের জন্য একটি সংস্থা থেকে কাউকে পাঠাতে বললে এসে উপস্থিত হয় ‘মল্লিকা’-নাম্নী (বিদ্যা বালন) একজন। যেসব দর্শকেরা প্রথম ভুল ভুলাইয়াঁ দেখেছেন, তাঁরা তৎক্ষণাৎ সন্দেহ করবেন যে মল্লিকা আসলে মঞ্জুলিকা (প্রথম ছবিতে মজুলিকার আত্মা বিদ্যা বালন অভিনীত চরিত্রের ওপরেই ভর করেছিল) । আবার প্রাসাদের ক্রেতারূপে আগত হন মন্দিরা (মাধুরী দীক্ষিত) নামধারিনী এক ‘রাণী’! দর্শক অনুমান করবেন যে মন্দিরা আসলে দ্বিতীয় কন্যা অঞ্জুলিকার অতিপ্রাকৃত সত্তা।

নানান বিচিত্র ও চমকপ্রদ ঘটনাসমূহের পর শীর্ষবিন্দুতে দেখা দেয় দেবেন্দ্রনাথের প্রেতাত্মা। সেইই ছিল দ্বিতীয় কক্ষে আবদ্ধ ভূত! অতীতে তার দুই ঈর্ষাকাতর দিদি একদিন ভাইকে দেখে মেয়েদের মতো গয়না আর পোশাক পরতে। দেবেন্দ্র তাদের বলে যে সে আসলে এক রূপান্তরকামী নারী! সেইই রাতে প্রাসাদে নেচে বেড়ায়। তার রাজত্বের কোন লোভ নেই, সে শুধু নিজের মতো করে বাঁচতে চায়। আর সে তার দুই দিদির কাছ থেকে পূর্ণ সহমর্মিতার প্রত্যাশী – তারা যে মেয়ে! আর কে তাকে তাদের চেয়ে ভালো বুঝবে?

দুই ক্ষমতালোভী দিদি এবার সহানুভূতির ভান করে। অঞ্জুলিকা গান ধরে – প্রথম ভুল ভুলাইয়াঁ থেকে আহরিত ‘আমি যে তোমার’ – যার তালে তালে নাচ ধরে দেবেন্দ্র, আর মঞ্জুলিকা বীরদর্পে রাজাকে গিয়ে বলে, “যে পুরুষ সন্তানের জন্য আমাদের রাজত্ব থেকে বঞ্চিত করেছো, এসে দেখে যাও সে কেমন পুরুষ!”

অতএব, ছবির শুরুতে আমরা নৃত্যরত দেখেছি দেবেন্দ্রকে। রাজা তাকেই জীবন্ত দগ্ধে মারার নিদান দিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রের রূপান্তরকামিতা সর্বসমক্ষে রাষ্ট্র করার অপরাধে দুই বোনের জোটে নির্বাসনের শাস্তি।তবে প্রজাদের জানানো হয় যে রাজত্বের লোভে দেবেন্দ্রকে হত্যা করেছে মঞ্জুলিকা। আর রাজাকে হত্যা করে পুরোহিতদের দ্বারা দ্বিতীয় কক্ষে অবরুদ্ধ হয় মঞ্জুলিকা নয়, দেবেন্দ্র। তারই আত্মাকে রুহান মুক্ত করেছে। অতীতের রাজপুরোহিত আরেকটি কক্ষের দরজায় মিথ্যা মন্ত্রপূত তালা লাগিয়ে সেখানে মঞ্জুলিকার ভূত আবদ্ধ আছে এমন গল্প ফাঁদেন যাতে দেবেন্দ্রের আত্মার ঘরের দিকে কেউ নজর না দেয়।

দেবেন্দ্র চায় পুরো পরিবারের বিনাশ। কিন্তু দুই অনুতপ্ত দিদি নিজেদের সহমর্মিতার অভাব স্বীকার করে ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চাওয়াতে দেবেন্দ্র হিংসার পথ ত্যাগ করে মোক্ষলাভ করে।

লক্ষ্যণীয়, ছবিটির শেষাংশে কিভাবে একাধিক গতানুগতিক চিন্তাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানো হয়েছে। রাজা পুত্রলাভ করা মাত্র পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতায় কন্যাদের সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করেন। নিরপরাধ ভাইয়ের প্রতি দুই নারীবাদী ভগ্নী চরম বিদ্বেষ পোষণ করে, এই কথা জানার পরেও যে সেই ভাই রাজত্ব চায় না। তারা তাদের ‘ট্রান্সফোবিক’ বাবার হাতে ভাইয়ের মৃত্যু সুনিশ্চিত করে। নারীবাদীদের রূপান্তর-বিদ্বেষ সর্বজনবিদিত। ভাগ্যের পরিহাস এখানেই যে তাদের অভিষ্ট সিদ্ধ হলেও, তাদের ভাই রূপান্তরকামী, এই কথা জাহির করার অপরাধে তাদেরও জোটে নির্বাসনের শাস্তি। রক্তঘাট হয়ে পড়ে শাসকহীন!

আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যে ‘প্রিভিলেজ’ বা বিশেষাধিকার নিয়ে নারীবাদীরা সরব, এই ছবিতে দেখা গেল যে, রূপান্তরকামী হওয়ার ‘অপরাধে’, সবচেয়ে বিশেষাধিকার-বঞ্চিত কিন্তু কোন জন্মগত নারী নয়, একজন যে জন্মগত হিসেবে পুরুষ কিন্তু নিজের শরীরে নিজেই বন্দী এক নারী।

রাজপুরোহিতের কথায়, বংশ অভিশাপমুক্ত হলো পুনর্জন্মের মাধ্যমেই, তবে সে দেবেন্দ্রের রুহান হওয়া দিয়ে নয়, প্রথমত মঞ্জুলিকা মল্লিকারূপে আর অঞ্জুলিকা মন্দিরারূপে পুনর্জন্ম নেওয়াতে; দ্বিতীয়ত, দেবেন্দ্রের আত্মা মল্লিকা আর মন্দিরা, দুজনকেই, নিজেদের ‘মঞ্জুলিকা’ বলে জাহির করানোর ফলে। চরম পরিণতি এলো প্রতিহিংসার মাধ্যমে নয়, ব্যতিক্রমী এক মানুষ, যে জীবিতাবস্থায় ছিল নিজের শরীরে বন্দী আর মৃতাবস্থায় এক মন্ত্রপূত কক্ষে আবদ্ধ, তাকে সহানুভূতির সঙ্গে বোঝার মাধ্যমে।

মল্লিকা এ জন্মে বিভিন্ন প্রাচীন প্রাসাদ সংস্কারের সংস্থায় কাজ নিয়েছিল যাতে, বারবার রক্তঘাটের রাজবাড়ীর যে স্বপ্ন সে দেখত, তার খোঁজ সে পায়। আর মন্দিরা আসলে পুলিশকর্মী এ সি পি রাঠোর, যিনি ভণ্ড ওঝা রুহানকে ধরার ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলেন! এ কথা রাঠোর সর্বসমক্ষে জানানো মাত্র রুহান অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়!

একাধিক পর্বে ভিন্ন যৌনতার আলোচনা করা হয়েছে। ভুল ভুলাইয়াঁ ৩ হলো চণ্ডীগড় করে আশিকী-র সমপর্যায়ের।

সবশেষে পরিচালক শ্রীরাম রাঘবনের উক্তি বাংলায় তর্জমা করবঃ ‘ভুল ভুলাইয়াঁ ৩-এ কার্তিক আরিয়ানের রূপান্তরকামী অবতারই ছবির সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা! দুঃখিত মাধুরী, বিদ্যা ও তৃপ্তি!’

স্ত্রী - ২ - সরকাটে কী আতঙ্ক (২০২৫)

 


সপ্তম পর্বে যা এই ছবি সম্বন্ধে লিখেছিলাম তা অবশ্য বেশী প্রযোজ্য স্ত্রী নামে ২০১৮ সালের ছবিটির ক্ষেত্রে। আপনাদের সুবিধের জন্য সে কথাগুলি আবার দিলামঃ

শহরের প্রেতাত্মা বেছে বেছে পুরুষদেরই অপহরণ করে তাদের ওপর শারীরিক, মানসিক, এবং আধ্যাত্মিক নির্যাতন চালায়, এবং সেটাই এই ‘কমেডি’-র হাস্যরসের মূল উৎস। আবার বলি, লিঙ্গটা পাল্টে দিন; মজা পাবেন তো? হ্যাঁ, অনেক নারী এবং নারীবাদীরা মজা পাবেন, বলবেন, যুগ যুগ ধরে চলে আসা নারী নির্যাতনের এইই তো সঠিক উত্তর!

নারীবিদ্বেষের প্রত্যুত্তর যদি পুরুষবিদ্বেষ মনে করা হয় হয় – misandry as the response to misogyny – তবেই এই ছবিগুলি ভালো লাগতে পারে। স্ত্রী ২-তে আবির্ভূত হচ্ছে পুরুষ স্কন্ধকাটা যে হলো শহরের এককালীন সর্দার চন্দ্রভানের (সুনীল কুমার) আত্মা। সেইই স্ত্রী আর তার প্রেমিককে হত্যা করেছিল আর তার আত্মা ‘প্রগতিশীল’ মেয়েদেরই বেছে বেছে অপহরণ করে। তার উৎপাতের প্রেক্ষিতে শহরের মহিলাদের বলতে শোনা যায়, “এতদিন স্ত্রীর কল্যাণে পুরুষগুলোকে বেশ তাঁবে রাখা যাচ্ছিল, এই নতুন ভূতটা এসে সব গোলমাল করে দিচ্ছে!” চন্দ্রভানের বংশধর চন্দ্রবংশীর ভূমিকায় দেখা গেছে অক্ষয় কুমারকে, আর ভেড়িয়া থেকে ভাস্কররূপী বরুণ ধাওয়ানকেও স্কন্ধকাটার সঙ্গে যুদ্ধ করতে দেখা যাবে।

ছবির মূল বক্তব্যঃ এককালে হয়ে আসা নারী-নির্যাতনের প্রতিকার পুরুষ-নির্যাতন এবং তাতে বাধা যে দেবে সেইই ছবির খলনায়ক। অতএব এই ছবি নিয়ে আর বাক্যব্যয় করতে চাই না।

কোহরা (১৯৬৪)



সবাই বলবেন যে তিনটি আলোচিত ছবিই তো ‘কমেডি-হরর’! নির্ভেজাল ভয়ের কোন হিন্দী ছবিই কি দেখিনি? উত্তরঃ হ্যাঁ, দেখেছিলাম, সেই আশির দশকের গোড়ায়, এবং এই ধারাবাহিকের প্রথম পর্বেই সে ছবি আলোচিত হয়েছিল। এককালে অত্যন্ত ভালো লাগা ছবি যার ভাবমূর্তি বন্ধুপ্রতীম ছাত্র অভিরূপ মাশ্চরকের নির্মম বিশ্লেষণের আঘাতে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে! আপনাদের মনোরঞ্জনের জন্য সেই আলোচনাও আবার দিলামঃ

১৯৬৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আরেকটি ছবি দেখব সুদূর ভবিষ্যতে, ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪-র মধ্যে, যখন আমি যতীন দাস পার্ক লাগোয়া শ্যামাপ্রসাদ কলেজে অধ্যাপনারতঃ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রযোজিত ও সুরারোপিত সাদা-কালো ছবি কোহরা। এর উৎস-কাহিনী ড্যাফনে ডু মোরিয়ারের ১৯৩৮-এ প্রকাশিত রেবেকা উপন্যাস, এবং তার থেকে ১৯৪০ সালে হওয়া হিচককের বিখ্যাত ছবিটি। ১৯৬২-তে বীস সাল বাদ হিট করতে, পরের ছবিতে পরিচালক বীরেন নাগ খানিকটা বাহুল্যবর্জনের পথে হাঁটলেন। কোহরা-র আবহ অনেক বেশী অবিমিশ্রভাবে রোমাঞ্চকর। এখানেও আগের ছবির মতো সেই নারীকণ্ঠে ভীতিজনক গান, শিল্পী অবশ্যই লতাঃ ‘ঝুম ঝুম ঢলতি রাত’। ছবির শুরুর দিকে গানটি গাইছে নায়কের প্রথমা স্ত্রী পুণম (থেলমা দেবী), যার মুখ আমরা সারা ছবিতে একবারও দেখতে পাবো না, শুধু চোখ দুটির ওপর ক্যামেরা মাঝে-মাঝে zoom in করবে! আর পুণম কিন্তু বাকি ছবিতে বাংলাজিঘাংসা-র মঞ্জুশ্রী (১৯৫১) বা হিন্দীবীস সাল বাদ-এর রাধার (১৯৬২) মতো নকল ভূত নয়!  পুণমের পূর্বসূরি হলো ১৯৫৮ সালের মধুমতী ছবির নায়িকা (বৈজয়ন্তীমালা), যে ছিল আসল প্রেতাত্মা। তবে, মধুমতীর প্রেত ফিরে এসেছিল তার হত্যাকারী উগ্রনারায়ণকে (প্রাণ) তার অপরাধ স্বীকার করাতে। পুণমের ভূত তাড়া করে ফিরেছে নায়ক অমিত সিং-এর (বিশ্বজিৎ) দ্বিতীয় স্ত্রী রাজেশ্বরীকে (ওয়াহিদা রেহমান)। মধুমতীর ভূত, প্রাসাদের যে আলসে থেকে উগ্রনারায়ণের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মধুমতী আত্মহত্যা করেছিল (জিঘাংসা মনে পড়ে?), সেখান থেকেই প্রেমিক আনন্দকে (দিলীপকুমার) লাফিয়ে পড়তে বলে। ভূত পুণমও মানুষ সতীন রাজেশ্বরীকে দ্বিতীয় বার ‘ঝুম ঝুম ঢলতি রাত’ গেয়ে অমিতের প্রাসাদের ছাদে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে লাফিয়ে পড়তে বলে। শেষ মুহূর্তে অমিত রাজেশ্বরীকে বাঁচায়। বলতে দ্বিধা নেই, এই দ্বিতীয়বার গাওয়া গানটির রেকর্ড বাড়ীতে শুনে সেই ৭/৮ বছর বয়সে বেশ ভয় পেতাম! তুলনায় এর আগের (আপাত-)ভৌতিক গানগুলি (মহল, মধুমতী, বীস সাল বাদ) অতটা ভীতির উদ্রেক করে না।

কোহরা-র সম্পদ রাজেশ্বরীর ভূমিকায় ওয়াহিদা রেহমানের আর দাই-মা’র ভূমিকায় ললিতা পাওয়ারের অভিনয়, আর সবার ওপরে হেমন্তর সুরে একের পর এক গান। হেমন্তর প্রথম প্রযোজনা নীল আকাশের নীচে-র (১৯৫৯) গান ‘ও নদীরে’ এখানে প্রায় অপরিবর্তিতভাবে লতাকণ্ঠে শোনা গেছে ‘ও বেকারার দিল’ গানে। তবে, উৎস বাংলা গানটিতে তো নদীর প্রতি এক ধরণের উদাস ভালোবাসার অভিব্যক্তিই ছিল। কোহরা-য় নায়িকার মনে জমে থাকা দুঃখ, হতাশা হঠাৎ প্রেমের ছোঁয়ায় যেভাবে অভিমান-ভরা উচ্ছ্বাসে পরিণত হয়েছে, হেমন্তর সুর আর লতার গায়কীতে তা মনকে মুগ্ধ করে দেয়। এক টুকরো আগুন (১৯৬৩) ছবিতে হেমন্তর সুরে উৎপলা সেন গেয়েছিলেন ‘হে বিরহী, সরে থেকো না’। গানটির আস্থায়ীর সুরটুকু নিয়ে বিশ্বজিতের মুখে হেমন্ত গাইলেন ‘রাহ বনি খুদ মঞ্জিল’। আর, বোধহয় সবার ওপরে ১৯৫৯ সালেরদীপ জ্বেলে যাই ছবির সেই সম্মোহক ‘এই রাত তোমার আমার’-এর আস্থায়ী ব্যবহার করে, যা ছিল একাকী প্রেমিকের প্রেমিকাকে অনুভবে-পাওয়ার গান, তাকে হেমন্ত ও কবি-গীতিকার কইফি আজমি বদলে দিয়েছেন মুগ্ধ স্বামীর সামনে-উপস্থিত স্ত্রীর প্রতি সেই সম্মোহক ভালবাসার বহিপ্রকাশে। গানের চিত্রায়নও প্রশংসনীয়। বাংলা গানটির ভিডিও ক্ষতবিক্ষত! তাই শুধু হেমন্তর কণ্ঠে ‘এই রাত তোমার আমার’ এবং তার পরেই ‘ইয়ে নয়ন ডরে-ডরে’-র পূর্ণ দৃশ্য-সম্বলিত ভিডিওটিই সম্বল ইউটিউবে।

কোহরা বাণিজ্যিক সাফল্য পায় নি। হয়তো বীস সাল বাদ-এ ব্যবহৃত ‘ফরমুলা’-র পুনরাবৃত্তি – সেই এক প্রাসাদ, তাকে ঘিরে বা তার মধ্যে – বীস সাল বাদ-এ আপাত, এখানে আসল, মহিলা প্রেতাত্মার কণ্ঠে গান, এবং চিত্রায়নে ১৯৬২-র ছবিটির বহির্দৃশ্য গ্রহণের জায়গাগুলি অবধি অনেকটা এক থাকা, এবং সেই এক নায়ক-নায়িকা জুটি – দর্শকদের একঘেয়ে লেগে থাকতে পারে। অবশ্য ওই ১৯৬৪-তেই মুক্তি পেয়ে, আবার স্ত্রীকণ্ঠে (আপাত) ভৌতিক গান ব্যবহার করে বীস সাল বাদ-এর সঙ্গে যুক্ত ধ্রুব চ্যাটার্জী রাজ খোসলার ও কৌন থী ছবিতে দারুণ বাণিজ্যিক সাফল্য পান। দুটি ছবির কোনটি আগে মুক্তি পায়, অন্তর্জালে তা নিয়ে পরস্পর-বিরোধী তথ্য রয়েছে।

এছাড়া, চিত্রনাট্যে যে ত্রুটি ছিল তা হেমন্ত আঁচ করলেও সঠিক দোষটি ধরতে পারেননিঃ

… সিনেমা লাইনের লোকের কাছে ফুলমার্ক পেল ‘কোহরা’।[1] কিন্তু আমার মনে তবু সংশয়। ছবিটার সব ভালো কিন্তু তবু একটা বিরাট ত্রুটি রয়ে গেছে গল্প বলার কায়দায়। একটা ধোঁয়াটে ভাব রেখে দিয়েছেন পরিচালক … তাই আমি বীরেনবাবুকে বললাম, ‘সবই ঠিক আছে, কিন্তু প্রেতাত্মার ব্যাপারটাকে দর্শকের কাছে অস্পষ্ট রাখছেন কেন। স্পষ্ট বলে দিন না ওটা প্রেতাত্মা। তাহলেই সব পরিষ্কার হয়ে যায় …’

কিন্তু বীরেনবাবু আমার কথা মানলেন না। রাজি হলেন না এতটুকু বদলাতে।  (আনন্দধারা, ৮১)

ছবিটি দেখার পর বলতে বাধ্য হচ্ছি যে প্রেতাত্মার ব্যাপারে কোন অস্পষ্টতা নেই। সমস্যা একমাত্র পুণমের ভূতের আচরণ![2]

রাজেশ্বরী অমিত সিং-এর দ্বিতীয় পক্ষ হয়ে আসতেই দাই-মা তার প্রতি বিরূপতা প্রদর্শন করতে থাকে, কারণ রাজেশ্বরী পুণমের মতো অভিজাত নয়। পুণম প্রাসাদের যে মহলে বাস করতো, রাজেশ্বরী সেখানে গেলে মৃতা পুণমের উপস্থিতি অনুভব করে, তার হাসি শুনতে পায়, এমনকি আয়নার সামনে তার ছায়ামূর্তিকে বসে থাকতেও দেখে। ঘটনা চরমে ওঠে পুণমের প্রেত যখন গান গাইতে-গাইতে রাজেশ্বরীকে তাড়া করে নিয়ে যায় ছাদের আলসেতে এবং ফিসফিস করে তাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলে। আতঙ্কিত, সম্মোহিত রাজেশ্বরী তাই করতে যাচ্ছিল, এমন সময় অমিত তাকে ধরে ফেলে বাঁচায়। আমরা দেখেছি যে পুণমের জীবতাবস্থায় তার একাধিক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। তা, এরকম স্বৈরিণী নারী যে মৃত্যুর পর কোপনস্বভাব হয়ে নিরপরাধ সতীনের ওপর চড়াও হবে, এমন ভূতের গল্প, মনে হয়, অনেক আছে।

 

কিন্তু এবার স্পয়লার-সতর্কতা দিয়ে বলিঃ

আমরা প্রথমে জানছি যে প্রথম স্ত্রীর ব্যাভিচারে ধৈর্য হারিয়ে অমিতই পুণমের মদ-খেয়ে-সংজ্ঞাহীন শরীরের ওপর গুলি চালিয়ে দেয়। তারপর গাড়ীসহ পুণমের দেহ জলায় ডুবিয়ে দেয় । এই পরের দৃশ্যটি হিচককের সাইকো (১৯৬০) থেকে অনুপ্রাণিত । স্ত্রীহত্যার দায়ে অমিত গ্রেপ্তার হয়, থানায় যাবার আগে বিহ্বল রাজেশ্বরী অমিতের পায়ে লুটিয়ে পড়ে। এই দৃশ্য দেখে দাই-মা ছুটে এসে আদালতে কবুল করে যে অমিত পুণমের মৃতদেহের ওপর গুলি চালিয়েছিল। দেবতুল্য স্বামীর প্রতি পুণমের অবজ্ঞা দেখে দাই-মা স্বয়ং পুণমের মদে বিষ মিশিয়ে তাকে হত্যা করে!

গুলি চালালো স্বামী; বিষ দিল দাই-মা। পুণমের ভূত এই দু’জনকে একবারের জন্যও কিছু করল না, তার যত রাগ নিষ্পাপ রাজেশ্বরীর ওপর! আর, রাজেশ্বরীকে মারতে বিফল হয়ে পুণমের ভূত একেবারে হাওয়া হয়ে গেলো, অমিত-রাজেশ্বরী প্রাসাদে ফিরে সুখে সংসার করা শুরু করল!

কোহরা বড় পর্দায় দেখেছি, আশির দশকে, দু’বার। প্রথমবার ভবানীপুরের বিজলী সিনেমায় দুপুরের শো-তে। হলে পৌঁছে দেখি ছবি শুরু হয়ে গেছে, গান চলছে ‘ঝুম ঝুম ঢলতি রাত’। অতএব দ্বিতীয়বার গেলাম মধ্য কলকাতায়, কলকাতা কর্পোরেশনের লাগোয়া মিনার্ভায় (যার নাম পরে বদলে হয় ‘চ্যাপলিন’; কোহরা দেখার সময় এই পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল কিনা মনে নেই) । সেখানে ছবিটির রোজ তিনটি প্রদর্শনী ছিল। তৃপ্তি করে গোড়া থেকে ছবিটি দেখেছিলাম। হাতে গোনা যে ক’টি হিন্দী ছবি একাধিকবার দেখেছি, সেগুলির মধ্যে কোহরা তৃতীয়।

লক্ষ্যণীয়, সাম্প্রতিক সময় অবধি বিজলী প্রধানত বাংলা ছবিই আনত। আর মিনার্ভা/চ্যাপলিন মাঝে-মধ্যে হিন্দী ছবির আগ্রাসনের কাছে মাথা নত করলেও ষাটের দশকের শেষে পুনর্যাত্রা শুরু করেছিল ইংরেজী – মূলত কলম্বিয়া কোম্পানীর – ছবির মুক্তিস্থান হিসেবে!

 


[1] ছবিটি শিল্প নির্দেশনার জন্য ‘ফিল্মফেয়ার’ পুরস্কার পায়। ললিতা পাওয়ার পার্শ্বচরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর মনোনয়ন পেলেও জেতেন নি।

[2]এই বিশ্লেষণ আমার বন্ধুপ্রতীম ছাত্র অভিরূপ মাশ্চরকের।


মৌ চক্রবর্তী

 

ঘরওয়ালি-র নাসির… ফিরে দেখা_

 


প্রতি,  

                                                                                                                             হে দর্শক... ওই দেখুন, একুশ শতকের নামী সিনেমার অভিনেতার পোস্টার। হ্যাঁ, আরও দেখতে, জানতে, বুঝতে থিয়েটার দেখতে হবে। আমি একজন দর্শক। যে নাটক সিনেমা দেখতে ভালবাসি। এই ভালবাসার কারণ ছিল একটা। বিশেষ করে দেখতে পাওয়া। আমার সেই অবুঝ বেলায় কতগুলো আলো চোখের সামনে নেচে বেড়াত। কখনও প্রজাপতি রঙের। কখনও হলদে রঙ মেখে যায় গায়ে পায়ে। সব মিলিয়ে দারুণ ব্যাপার! কখনও হাততালি দিচ্ছে। আমিও দিয়েছি তাল মিলিয়ে। সেসব অন্ধকার ঘরের মধ্যে চোখের সামনে কিছু মানুষের ঘোরাঘুরি। মা বলতেন, অভিনয় করছেন। নাটক। না না থিয়েটার! থিয়েটার দেখতে যাব, যাচ্ছি, গেছি... একটা থিয়েটারের কথা লিখি। নাসিরউদ্দিন শাহ-র অভিনয়। একক ভূমিকা, কথক ও অভিনেতা। সে দারুণ। নাম বলতে পারবেন কেউ?

নাটকের নাম মনে নেই। নাটকের আর যে বা যাঁরা কুশীলব, তাঁদেরও মনে নেই। শুধু মনে রয়েছে... নাসিরউদ্দিন শাহ-এর একক অভিনয়। হ্যাঁ, আরেকটু পরেই শুরু হবে। মানে হয়েছিল সেদিন। দিন, তারিখ মনে নেই। মনে পড়ে সন্ধ্যা। অডিটোরিয়াম, এন এস ডি-র। আর ব্যক্তিগত স্মৃতি।

এই ‘আলো দেখা’—এই নেশাই আমাকে বড় হয়ে শহর থেকে শহরে টেনেছে।

সিনেমা পর্দা আমার কাছে জানলা—দূরের পৃথিবী দেখা যায়। কিন্তু থিয়েটার? থিয়েটার ছিল দরজা, যেখানে আমি ঢুকে পড়ি, আবার বেরও হয়ে যাই। এই যাওয়া-আসার তীব্রতা, মানুষের মুখ, আলো-ছায়ার শব্দহীন সংলাপই আমাকে একদিন পৌঁছে দেয় দিল্লির এন এস ডি-তে। 'সেখানে ছিলাম আমি...’ আলো-নেশাগ্রস্ত এক মানুষ। যে কিনা থিয়েটারের অন্ধকারে

শ্বাস নিতে শেখার চেষ্টা করছে।                                                                                                                                            এবারে ফ্ল্যাশব্যাক... স্মৃতিময় স্তর, খুব সম্ভবত নাট্যকার কৃষ্ণা চন্দর-এর গল্প অবলম্বনে তৈরি ‘ইস্মত আপ কে নাম’ সিরিজের অংশ ‘ঘরওয়ালি’? যদি তাইই হয়… “ঘরওয়ালি (Gharwali)” - কাহিনি,  চরিত্র, আবহ, অভিনয়ের ধরন।

লেখক: ইসমত চুঘতাইনাট্যরূপদান ও অভিনয়: নাসিরউদ্দিন শাহআপন স্মৃতির সঙ্গে সবচেয়ে মিল থাকা অংশ

কুর্তা-পাজামা। একক ন্যারেশনঘুরে দাঁড়ানো, কুর্তার ঝুল ঘুরে ‘ঘাঘরা-ভাব’ তৈরি হওয়াআলো একটু কমে–বাড়েমঞ্চে খুব কম প্রপউর্দু–হিন্দির মিশ্র গদ্যরীতি

এবার, আমার দেখা সেই রাত।

মঞ্চে তিনি এলেন - নাসিরউদ্দিন শাহ। ছোট ঝুলের সিল্কের কুর্তা, নরম আলোয় রঙ বদলায়—কখনও ধূসর, কখনও নীলচে, কখনও যেন সোনালি ধুলো লেগে আছে।এমন সাধারণ পোশাকও কেমন রাজকীয় হয়ে ওঠে তাঁর গায়ে - এটাই তাঁর বিশেষত্ব। আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল, আর এক মুহূর্তে তৈরি হল এক নতুন পৃথিবী। না কোন বড় সেট, না প্রপ - শুধু তাঁর কণ্ঠ, শরীর, আর শ্বাসের ভেতরে জন্ম নিল মির্জা। মির্জা…।

গল্প সামাজিক। আরে, গল্প তো সামাজিকই হবে। নইলে চরিত্ররা আসে কোত্থেকে!

গল্প — একজন বয়স্ক পুরুষ মির্জা , তার নিঃসঙ্গতা, সরলতা, আর তার জীবনে আচমকা ঢুকে পড়া চঞ্চল, স্বাধীনচেতা যুবতী লাজো। কেন্দ্রীয় চরিত্র মির্জা - একজন মধ্যবয়স্ক একা থাকেন। তার ঘর, রান্না, পরিষ্কার সবকিছু বিশৃঙ্খল। একদিন তার জীবনে আসে লাজো - এক চঞ্চলা, কম বয়সি মেয়ে। সে কাজ করতে আসে মির্জাবাড়িতে।

লাজো দিনে দিনে বুঝে যায়। এ বাড়ির মালিক বোকাসোকাসহজএকলাতাকে দিয়ে অনেক কিছু করিয়ে নেওয়া যায়লাজো ধীরে ধীরে মীরাজাকে মেপে ফেলেসে ঘর পরিষ্কার করে, রান্না করেবুড়োর সামনে লাজুকতার অভিনয় করেআবার কখনও খুব স্পষ্টভাবে তাকে উত্তেজিত করেএকটা দৃশ্য আছে যেখানে নাসিরউদ্দিন শাহ কুর্তা ঘুরিয়ে, কোমর নেড়ে লাজোর অভিব্যক্তি দেখান — এটাই হয়ত স্মৃতির ‘ঘাগরা-ভাব নাচ’।

মির্জা লাজোর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। সে লাজোর ওপর কোনই নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে না, উল্টো লাজো তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। লাজো চাইলেই ঘর থেকে বেরোয়, আবার আসেঅন্য পুরুষদের সঙ্গে কথা বলে, মির্জাকে ঈর্ষা করায়

লাজো মির্জাকে শারীরিকভাবে প্ররোচিত করেএটা খুব সূক্ষ্মভাবে দেখানো হয় - নাসিরউদ্দিন শাহ কেবল দেহভঙ্গি ও কণ্ঠের ওঠানামায় এটা করেন। হাস্যরস, দেহভঙ্গি, চোখ ঘোরানো - সব মিলিয়ে।

কিন্তু মঞ্চে যা দেখলাম, তা গল্পের পুনর্কথন নয়, বরং দু’জন মানুষের নিঃশব্দ টানাপোড়েন, ক্ষমতার লড়াই, আকর্ষণ, দখল, আবার ছেড়ে দেওয়া - সবই ফুটে উঠছিল একমাত্র একজন মানুষের শরীরে।

সবচেয়ে বিস্ময়কর মুহূর্ত - যখন নাসির লাজোকে ফুটিয়ে তুলতে কোমর দোলালেন, কুর্তার ঝুল হাওয়ায় হালকা ঘুরে উঠল। এক সেকেন্ডের জন্য মনে হয়েছিল, যেন সত্যিই এক মেয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে।

 


কোন বাড়াবাড়ি নয়, না কার্টুন - শুধু দেহভঙ্গির নিখুঁত স্বরূপান্তর। মির্জার হাসি কিঞ্চিৎ বোকা, নিঃসঙ্গতার গন্ধ মিশে আছে। লাজোর চোখ—তির্যক, চঞ্চল, প্রায় জ্বালাময়ী। আরেহ জনাব…” এই উর্দু উচ্চারণে এক অদ্ভুত দুষ্টুমি।

সব বদল হচ্ছিল চোখের, কণ্ঠের, ভঙ্গির সামান্যতম নড়াচড়ায়। নাটকের চূড়ান্ত শক্তি এখানেই - এক শরীরের মধ্যে দুই জীবনের ওঠানামা। এক মুহূর্তে বৃদ্ধ, পরের মুহূর্তে নবযুবতী। এটাই থিয়েটার, এটাই জাদু।

শেষ দৃশ্যে লাজো ফিরে আসে - আর মির্জার মুখে ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত শান্তির হাসি। নাসিরের শরীরে  অভিনয় তখনও সত্যিকারের সুখের প্রতিমা সাজেহ্যাঁ, মঞ্চের বাঁ-দিকে নাট্য ঘটনার শেষ ধাপ। আলো? রঙ মনে নেই। তবে, হলুদ আর নীল মনে হচ্ছে এই দৃশ্যে মিলবে-মেলাবে। তাই… মধুরও সমাপন।

নাটক শেষ হওয়ার পরও সেই মির্জা আমার সঙ্গে চলল অডিটোরিয়ামের সিঁড়ি বেয়ে। তারপর? তারও পরে পোশাক পাল্টে তিনি এলেন নৈশভোজ আসরে। যেন তিনি আর পাঁচজনের মতো একজন। একজনই বটে! তিনি একজন অভিনেতা। অফ হোয়াইট শার্ট আর ধূসর ট্রাউজার। কেশ বিন্যাস সাদা, মেকআপ ছাড়াই। চশমা। অনেক গুণী মানুষ। হাসছেন, কথা কইছেন... তিনিও। আমার ঝাঁপি থেকে এই স্মৃতি লাফিয়ে তুলল স্বপ্ন থেকে। আর তাই লেখা গেল, এবারের ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি।

ও হ্যাঁ, স্মৃতির ছবির নেগেটিভ পজেটিভ হল লেখায়। আর ছবি, ওয়েব মাধ্যম থেকে নেওয়ার ঋণ।

__ইতি

একুশ শতকের এক ফ্ল্যাশব্যাক স্বত্বাধিকারী


মধুবন চক্রবর্তী

 

রবীন্দ্রনাথের বর্ষা, নিঃসঙ্গতা : শ্রাবণ সঙ্গীত




বৃষ্টি থেমে গেলে জলের ফোঁটাগুলো যখন রাস্তায় জড়ো হয়, তখন মনে হয়, সদ্য যেন শিউলি ফুটেছে, কিংবা কদম ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে চারিদিক থেকে। সূর্য উপুড় করে বিকেলকে ঢেলে সাজিয়েছে ঠিকই তবু অদ্ভুত এক বৃষ্টিভেজা গন্ধ ঘিরে ধরেছে চারিদিক। মনখারাপ এক বিকেল, এক বিষণ্ণ বিকেল। দূর থেকে ভেসে আসছে কাঙ্খিত বর্ষার মর্মস্পর্শী সেই গান

"মেঘের পরে মেঘ জমেছে

পরান আমার কেঁদে বেড়ায় দুরন্ত বাতাসে" ... প্রবল মেঘের ঘনঘটায় কবির মন ব্যাকুল, দিশাহারা, ঘনকালো মেঘের আড়ালে বর্ষার স্পর্শ কবিকে এক অজানা নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরছে। নিঃসঙ্গ মনের ভাবপ্রবন মন উড়ে চলেছে কালিদাসের যুগে যেখানে আরও স্পষ্টভাবে উপস্থিত কালিদাস, তাঁর 'মেঘদূত’ তার রেবানদী ও শ্যামলশৈলশির! যে গানের সঙ্গে বাঙালির সংস্কৃতি অনাঙ্গ কীভাবে জড়িত যে গানের সঙ্গে গেঁথে আছে বাঙালির চিরকালের গরিমা অহংকার।

"বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এলো

আমার মনে

কোন সে কবির ছন্দ বাজে ঝরো ঝরো বরিষণে"।

ভরে"...

আবার পরে গিয়ে বলছেন-

"সে কে বাঁশি বাজিয়েছিল কবে প্রথম সুরে তালে,

প্রাণেরে ডাক দিয়েছিল সুদূর আঁধার আদিকালে।

তার বাঁশির ধনী খানি আজ আষাঢ়‌‌ দিল আনি"

সেই অগোচরের তরে আমার হৃদয় নিলো

হ'রে"...

আষাঢ়ের উদ্দেশ্যেই যে এত কিছু বলা তা আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না। এই আষাঢ় সংগীতের নিবিড় নস্টালজিয়া আমাদের এক অজানা, অদেখা বর্ষা যুগের কোন এক অজানা পথে নিয়ে যায়।‌

আবার ধরুন শুধুমাত্র আষাঢ়ের ধ্বনির ম্যাজিক দেখা গেল আরেকটি অসামান্য গানে অসাধারণ আধুনিকতার মোড়কে। গানটিকে রচনা করলেন তিনি আষাঢ়ের কন্ঠে বজ্রমানিকের মালা গেঁথে দিয়ে। আপনাদের মনে আছে তো সেই গানটি।

"বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা আষাঢ় তোমার মালা তোমার শ্যামল শোভার বুকে বিদ্যুতেরই জ্বালা"…।

কবি বারবার এই আষাড়ের ভয়ঙ্কর রূপ দেখেছেন। কখনোও পর্দার বুকে কখনও বা নিজের ঘরের ভেতরেই। একই সঙ্গে প্লাবন ও ধ্বংসের ভয়ঙ্কর রূপ তিনি লিখেছেন আর তাই তিনি লিখেছেন

"আমার শুকনো পাতার ডালে এই বর্ষায় নব শ্যামের আগমনের তালে"...

চাতকের অপেক্ষা যখন শেষ হয়, তখন সত্যি মনে মিলনের এক আনন্দ নিয়ে আসে। কিন্তু সেই বর্ষা যখন দীর্ঘস্থায়ী হতে থাকে, তখন দুঃখ যাপন যেন বেড়েই চলে। বর্ষা আর নিঃসঙ্গতা হাত ধরাধরি করে হেঁটে চলে সারাজীবনের মতো। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ নিঃসঙ্গতা অনুভব করেছেন সেই বাল্যকাল থেকে। কাব্য কবিতা সৃষ্টির তাগিদ অনুভব করলেও, শুধু বর্ষা কেন গ্রীষ্মকেও নিরীক্ষা করতেন যেন একাকী। আসলে প্রকৃতির সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ, বলা যায় নাড়ির যোগাযোগ। একমাত্র কবিই তো বলতে পারেন,

"আজ যেমন করে চাইছে আকাশ তেমনই করে চাও গো "...

পুকুরঘাটে দুপুরের জনশূন্য নিস্তব্ধতা

এক বৈশাখীর মধ্যাহ্নের একাকীত্ব বালক রবির মনের একাকীত্বের সঙ্গে যেন মিলেমিশে এক হয়ে যায়।

গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে বালক কবি লুকিয়ে ছাদে উঠে যেতেন তিনি বলছেন-

"বরাবর এই দুপুর বেলাটা নিয়েছে আমার

মন ভুলিয়ে"...

এক বালক যখন গ্রীষ্মের খরতাপের সঙ্গে তার মনের নিঃসঙ্গতাকে মিলিয়ে নিতে পারে, সে যখন যৌবনে পা দেয় তাঁর নিঃসঙ্গতার ব্যাপ্তি যে বেশি হতে পারে, তা সহজেই আমরা অনুভব করতে পারি। এই নিঃসঙ্গতা ক্রমশ বেড়েছে। বালক ভানুসিংহ ছদ্মনামে যখন একের পর এক পদ লিখে চলেছেন, তখন কোনোও এক নির্জন বর্ষণমন্দ্রিত দুপুরে খাটের ওপর উপুর হয়ে শুয়ে লিখে ফেললেন-

"গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে

মৃদুল মধুর বংশী বাজে

বিসরি ত্রাস লোক লাজে

সজনী আও আও লো"...

নিঃসঙ্গতা ও বর্ষা যেন চির অপরচিত নিভৃত মনের কোনও অজানা জীবনকে উদঘাটিত করে। বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য কবিহৃদয়কে ব্যাকুল করে।

"দূরের পানে মেলে আঁখি

কেবল আমি চেয়ে থাকি

পরান আমার কেঁদে বেড়ায় দুরন্ত বাতাসে"...

আবার সোনার তরী কাব্যগ্রন্থে

অঝোর বর্ষণের ঘোর লাগা মুহূর্তের কথায় মূর্ত হয়ে ওঠে।

"গগনে গরজে মেঘ

ঘন বরষা

কুলে একা বসে আছি

নাহি ভরসা (সোনার তরী) "...

আবার প্রচলিত গানে কৃষ্ণকলি, মেঘলা আকাশ, আর কালো হরিণ চোখ, যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

"কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি.....

কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক

মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে

কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ".....

বর্ষার সাথে কবির আত্মীয়তা নিবিড়।

বর্ষার বিভিন্ন রঙ, কবিমন, নানাভাবে পরিক্রম করে। বর্ষার অঝোর ধারা কখনোও তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে যায় কালিদাসের যুগে। অতৃপ্ত বাসনা, চাওয়া পাওয়ার দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি পেয়ে কবিমন অচিনপুরের যাত্রায় উধাও হয়। অচিনপুরের উদ্দ্যেশ্যে যেতে যেতে বর্ষার আবেদন যেন কোন মোহময়তায় প্রবেশ করায় তাঁকে। বর্ষার আকাশে অভিমানের মেঘ যখন জড়ো হয়, তখন সে একা হয়ে যায় বিশ্ব সংসারে।

মনে হয় শ্রাবণ কি বৃষ্টির ঘনঘটায় তাঁর একাকীত্ব দূর করতে পারবে? বলতে পারবে-

"হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মত নাচে রে"....

বর্ষা আসলেই তার মন উতলা হয়ে ওঠে। আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা, বাতাসে আদ্রতার ছোঁয়া, বৃষ্টি ধারায় প্রকৃতি যখন সজল সবুজ, তখন তাঁর কবির মন হয়ে ওঠে রোমান্টিক। বর্ষামঙ্গল কবিতায় কবি বলছেন,

"স্নিগ্ধ সজল মেঘকজ্জল দিবসে

বিবশ প্রহর অচল অলস আবেশে

শশী তারা হীনা অন্ধতামসী যামিনী

কোথা তোরা পূবকামিনী "....

বর্ষা তার সম্ভারসমূহ দিয়ে প্রকৃতিকে যে রূপে সাজিয়ে তোলে, কবি তো সেই রূপেরই পূজারী। তাই কবি মন চিরকাঙ্ক্ষিত বর্ষা ঋতুকে ডাক দিয়ে বলে-

"এসো শ্যামল সুন্দর,

আনো তব তপোহরা তৃষাহারা সঙ্গসুধা ".....

বসন্তের গর্ভেই বসবাস বর্ষার। আবার বর্ষার গর্ভজাত এই বসন্ত। বর্ষা চির রোম্যান্টিক। আর রোমান্টিসিজমের রাজাই তো বসন্ত। বাদল দিনে তাই রোমান্টিক কবির ভাবনা, মেঘের সঙ্গী হয়ে উড়ে চলে দিকদিগন্তের পানে। কদম, কেতকী, হাসনুহানার গন্ধ নিয়ে বৃষ্টির সিম্ফনি কবি শুনতে থাকেন এক মায়াময় আবেশে। কবি বলে ওঠেন

"মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো ওই

দোলে মনে দোলে অকারণ হরষে "...

কবির বিরহকাতর মন কাউকে কি ব্যকুলভাবে প্রত্যাশা করে? মাঝে মাঝে নিজেকেও অচেনা লাগে। যা ছিল কবির সম্পূর্ণ আজানা, অদেখা তাকেই এতদিন অতি সংগোপনে, সন্তর্পনে নিজের মধ্যে লালন করে এসেছেন কবি। মেঘদের সম্মেলনে আজও ভেসে আসে সেই স্মৃতি, যাকে তিনি খুঁজে বেরিয়েছিলেন আজন্মকাল, আচমকা তাকেই যেন খুঁজে পাওয়া। আবিষ্কার করেন এক অচেনা বর্ষাকে। এই পৃথিবীর সঙ্গে, প্রকৃতির ছয় ঋতুর সঙ্গে তাঁর গভীর আত্মীয়তা। ছিন্নপত্রগুলির অনেক স্থানে সেই আত্মীয়তার খবর পাওয়া যায়। যেমন

তিনি বলছেন "আমার সর্বাঙ্গে এবং সমস্ত মনের উপর বিশুদ্ধ নতনেত্র প্রকৃতির কি একটা বৃহৎ উদার বাক্যহীন স্পর্শ অনুভব করি (ছিন্নপত্রাবলী ৩১)। ওই যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে ওটাকে এমন ভালোবাসি, ওর ওই গাছপালা নদী ঘাট কোলাহল বিশুদ্ধতার প্রভাত সন্ধ্যা, সমস্ত দুহাতে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে,আমি এই পৃথিবীকে ভারী ভালবাসি"।

প্রকৃতির প্রতি তাঁর অমোঘ টান। সেই প্রকৃতির প্রাণসংগীত বসন্ত। আর অনুরাগ অভিমান যত বর্ষাকে ঘিরে। বহু কবিতা ও গানের মধ্যে দিয়ে কবি সেই অনুভূতি বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। কখনোও শ্রাবণের আমন্ত্রণে তিনি উন্মাদ হয়েছেন। কখনোও বা বসন্তের আগমনী বার্তায়। তিনি বলেছেন-

"কোন পুরাতন প্রাণের টানে'

আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে

কখনো বাদল ছোঁয়া লেগে.....

বসন্তকে তিনি খুঁজে পেতেন বর্ষার গভীরেও। বসন্ত যেখানে শুধুই রোমান্টিকতা। বর্ষার অন্তরে বিরহের গভীরতা, কবির কাছে রোমান্টিকতার থেকেও বেশি কিছু। অনেক বেশি সীমাহীন। তাই তিনি বলেন-

"ঝরঝর ঝরো ভাদরও বাদরও

বিরহকাতর শর্বরী

ফিরেছে এখন অসীম রোদন

কানন কানন মর্মরী

অথবা

"আজি ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে

জানিনে জানিনে কিছুতে কেন যে

মন লাগে না"

বর্ষার সংগীত রচনা ক্ষেত্রে কবির রোমান্টিকতা প্রাধান্য পেয়েছে।বর্ষায় আসলে, প্রকৃতির এক অচেনা, অজানা জগৎ উদঘাটিত হয়, অতি সংগোপনে সবার অজ্ঞাতে যাকে সে নিজেই লালন করেছে। আচমকা যখন সে তার স্বরূপ নিয়ে চলে আসে, কবি কিরকম যেন চঞ্চল হয়ে ওঠেন। কাঙ্ক্ষিত সুখ না পাওয়ার আপাতত যন্ত্রণা দগ্ধ করে হৃদয়কে।

১৩২১ সনের আষাঢ় মাসে লেখা আষাঢ় প্রবন্ধে কবি লেখেন-

"ভারতবর্ষের প্রত্যেক ঋতুরই একটা না একটা উৎসব আছে। কিন্তু কোন ঋতু যে নিতান্ত বিনা কারণেই তাহার হৃদয় অধিকার করিয়াছে, তাহা যদি দেখিতে চাও, তবে সংগীতের মধ্যে সন্ধান করো। কেননা, সঙ্গীতেই হৃদয়ের ভিতরকার কথাটা ফাঁস হইয়া পড়ে। বলিতে গেলে, ঋতুর রাগ রাগিণী কেবল বর্ষার আছে আর বসন্তের। সংগীত শাস্ত্রের মধ্যে সকল ঋতুরই জন্য কিছু কিছু সুরের বরাদ্দ থাকা সম্ভব। কিন্তু সেটা কেবল শাস্ত্রগত। ব্যবহারে দেখতে পাই_ বসন্তের জন্য আছে বসন্ত আর বাহার আর বর্ষার জন্য মেঘ, মল্লার, দেশ এবং আরোও বিস্তর। সংগীতের পাড়ায় ভোট লইলে বর্ষারই হয় জিত"।

বর্ষার সময় পৃথিবী যে কি অপরূপ সুন্দর হয়ে ওঠে এবং গভীরভাবে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে তা তিনি দেখেছেন বহুবার। সুন্দর প্রকৃতির কোলে দোল খেতে খেতে ১৮৯১ সালের জুন মাসের ১৯ তারিখে বর্ষাকে প্রথম আলিঙ্গন করেছিলেন চিঠিতে-

"আকাশের কোনখানে যেন একটা আস্ত জগত ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। ব্যাখ্যা করেছেন " কাল ১৫ মিনিট বাইরে বসতে না বসতে পশ্চিমে ভয়ানক মেঘ করে এলো---

খুব কালো গাড়ো আলু থালু রকমের মেঘ। তারই মাঝে মাঝে চোরা আলো পড়ে রাঙ্গা হয়ে উঠেছে__ এক একটা ঝড়ের ছবিতে যেমন দেখা যায় ঠিক সেই রকম"।

তাঁর লেখায় বর্ষাকেই তিনি যে প্রাধান্য দিয়েছেন বহুবার এটাই প্রকট হয়ে উঠেছে। পূর্ববঙ্গে থাকাকালীন ঠাকুর পরিবারের জমিদারের দেখাশোনার কাজে শিলাইদহ, সাজিদাপুর এবং পাতিসরে অনেকদিন তাকে থাকতে হয়েছিল। সেই সময় পদ্মানদী এবং তারও তীরবর্তী অঞ্চলে, বিশেষ করে বর্ষার সময় বর্ষার সেই অপরূপ দৃশ্য তাঁকে অভিভূত করে তোলে। সেখান থেকে মধ্য বয়সে হৃদয়ে লাগে ঘোর। নতুন করে আসে রোমান্টিকতা। প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ, বেদনা সংমিশ্রিত বিবিধ অনুভতির জন্ম হয়।

বর্ষা কবির মনে প্রধানত বেদনার সুরকেই প্রতিফলিত করেছে। আর নববসন্তের মাধুর্য কবির মনে আনন্দের শিহরণ জাগিয়ে তুলেছে। একদিকে বেদনাবিধুর বর্ষাকে আবাহন করা। অন্যদিকে নববসন্তের আনন্দকেও আমন্ত্রণ জানানো।

কবি বর্ষার অন্তরের অন্তঃস্থলে আবিষ্কার করেছেন, মধুর বেদনাবিধুর সৌন্দর্যকে, খুঁজে পেয়েছেন মন হারাবার এক নির্জন নিঝুম একাকী সময়কে। যেখানে সে আর শুধু বর্ষা মুখোমুখি। বৃষ্টির নিজস্ব ছন্দ আছে। সেই ছন্দের মাধুর্যে বর্ষা নিজে কখনোও চঞ্চল, কখনোও উগ্র কখনোও বা অদ্ভুত এক অলৌকিক পরিবেশ তৈরি করে। বলা যেতে পারে অতিপ্রাকৃত বিষয় তৈরি হয়। কবিগুরুর গানের মধ্যেও সেই অতিপ্রাকৃত বিষয় ধরা দেয়। স্বনামধন্য সঙ্গে শিল্পী স্বাগতালক্ষ্মী দাসত্বের একটি প্রতিবেদনে পড়েছিলাম। তিনি বলছেন-

"সঘন গহন রাত্রি" এই গানটির কথা।

যেখানে স্কেচ করতে করতে আধো অন্ধকার একটি মেয়ের অবয়ব তিনি কল্পনা করেছিলেন কল্পনা করেছিলেন সেই মেয়েটি যেন কাদম্বরী দেবী। তাঁর বর্ষার গানকে বিভিন্ন শিল্পী বিভিন্নভাবে কল্পনা করেছেন। উপলব্ধি করেছেন তাদের মতন করে ব্যাখ্যা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ জীবনে এত যন্ত্রনা দেখেছেন, বিচ্ছেদ দেখেছেন, তাই হয়তো মেঘ বৃষ্টি রোদ্রের ঘনঘটায় কোথাও যেন অলৌকিকতা মিশে যায় তাঁর গানের মধ্যে রচনার মধ্যে সাবলীলভাবে। বর্ষাকে তিনি কখনও যেন নিঃসঙ্গতার দেবী হিসেবে কল্পনা করেছেন।

বর্ষার মধ্যে এমনিতেই রোমান্টিকতা আছে যে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে অন্যকে ব্যথিত করতে পারে, ছান্দিক করে তুলতে পারে। সেই ছন্দ কখনোও ঝমঝম করে কখনো বা টিপটিপ করে, কখনো বা মুষলধারে শরীর মন ভিজিয়ে দেয়।

মানব হৃদয়ে তৈরি হয় এক অদ্ভুত ছন্দ। এক অদ্ভুত অনুভূতি। আবার কখনোও বা এই বৃষ্টি তৈরি করে সব হারানোর যন্ত্রণা। রবীন্দ্রনাথ যেভাবে বর্ষাকে দেখেছেন সেভাবে হয়তো আমরা কখনোই দেখতে পারি না। তার দেখানো দৃষ্টিতে বর্ষাকে দেখার চেষ্টা করি।