কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / ষষ্ঠ সংখ্যা / ১২৬

মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০২৫

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ১২৬ / দ্বাদশ বর্ষ : ষষ্ঠ সংখ্যা   


  

 

বিগত বিংশ শতাব্দীতে আমরা কয়েকটি যুগান্তকারী ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, যার মধ্যে দুটি বিশ্বযুদ্ধের পাশাপাশি আছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিকতা থেকে ভারত এবং আরো কয়েকটি দেশের মুক্তি, রাশিয়া চীন এবং পূর্ব ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যস্থা স্থাপন এবং তার বিপজ্জনক পরিণতি ইত্যাদি।  ‘কালিমাটি’ ১১১তম সংখ্যা যৌথভাবে সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করে আমি কাজল সেন এবং পূর্ণেন্দুশেখর মিত্র সবিনয়ে নিবেদন করি যে, যেহেতু আমাদের দুজনেরই জন্মতারিখ বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকে, তাই বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধে সংঘটিত বিশ্বের কোনো ঘটনারই আমরা প্রত্যক্ষদর্শী নই। যেটুকু  জেনেছি এবং উপলব্ধি করেছি তা বিশদ পড়াশোনা করে, ভিডিওতে সংরক্ষিত প্রচুর তথ্য ও তথ্যচিত্র ঘেঁটে, বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষদের বিবৃতি ও স্মৃতিচারণ অনুধাবন করে। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে জন্মগ্রহণ করার পর সারা বিশ্বে যা কিছু ঘটনা সংঘটিত হয়ে চলেছে, তার প্রতি আমাদের প্রত্যক্ষ দৃষ্টি আকর্ষিত হচ্ছে এবং আমরা তা বিশদভাবে অনুধাবন ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি। আর এই সূত্রেই আমাদের মনে হয়েছে, বিংশশতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের সত্তরের দশকে মূলত আমাদের দেশে এমন কিছু ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যা এই দেশের তৎকালীন স্থিতাবস্থায় এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সাহিত্য-কলা-শিক্ষা ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তনের সূচনা করেছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা একান্ত জরুরি যে, বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশকে সংঘটিত যেসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে  সত্তর দশককে শতাব্দীর অন্যান্য দশক থেকে পৃথকভাবে নির্দেশিত করেছে, একটা অন্য মর্যাদা দান করেছে, তা আমাদের সবারই জানা আছে এবং সে সম্পর্কে আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও ফোরামে আলোচনা করেছি। কিন্তু যেটুকু আলাপ ও আলোচনা করেছি তা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কতটা প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পেরেছি, সে সম্পর্কে আমরা আদৌ অবগত নই। এবং শুধু তাই নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা তাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি ভুল তথ্য, বিকৃত  ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। আর তাই পরবর্তী প্রজন্ম সত্তর দশকের মূল্যায়নে ভুল ধারণা পোষণ করেছে এবং অনীহা বোধ করেছে।

মূলত আমাদের মনের এই ভাবনা থেকেই আমরা ‘কালিমাটি’ পত্রিকার ৪৬তম বছরের ক্রমিক ১১১তম সংখ্যার জন্য বেছে নিয়েছি আলোচ্য বিষয় – সত্তরদশক। যে নির্দিষ্ট ঘটনাগুলি নিয়ে এই প্রাসঙ্গিকতায় বিচার  বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে, তার  একটি তালিকা এখানে রাখছি

নকশালবাড়ি আন্দোলন, জয়প্রকাশ নারায়ণ আহুত ছাত্রআন্দোলন, সারাভারত রেল ধর্মঘট  আন্দোলন, ভারতে এমার্জেন্সী ঘোষণা, পশ্চিমবঙ্গে তৎকালীন কেন্দ্রসরকার ও রাজ্য সরকারের শ্বেতসন্ত্রাস, ব্যাংক জাতীয়করণ, মহাকাশ অনুসন্ধান ও গবেষণার জন্য ISRO স্থাপন, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি – ভারত-পাকিস্তান সিমলা চুক্তি (১৯৭২), ভারত-সোভিয়েত বন্ধুত্ব, শান্তি, সহযোগিতা চুক্তি  (১৯৭১), দলিতসাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন, বাংলা ও অন্যান্য ভাষার সাহিত্যে ও শিল্পে নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রভাব ও পালাবদল,  ভারতীয় চলচ্চিত্রে নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রভাব ও পালাবদল, ১৯৭৫ সালের ৮ মার্চ থেকে আন্তর্জাতিক নারীদিবসের সূচনা,  সত্তর দশকের আন্দোলনের বিরোধীতায় ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, আচরণ, ভন্ডামি, জ্যোতিষ, সাম্প্রদায়িকতার প্রচার ও প্রসার শাসকশ্রেণীর পক্ষ থেকে, দন্ডকারণ্য থেকে মরিচঝাঁপি প্রবঞ্চনা, ভারতের প্রথম সফল পারমাণবিক পরীক্ষা, সত্তরের দশকের এক অনন্য নারী-অভ্যুত্থান : চিপকো আন্দোলন, উত্তাল সত্তরে প্রযুক্তির প্রথম প্রতিশ্রুতি।      

আলোচনার জন্য তালিকা আরও দীর্ঘ করা যেতে পারত। আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংযোজন করা যেতে  পারত। ‘কালিমাটি’ সম্পাদকমন্ডলীর পক্ষ থেকে আমরা মোটামুটি এই তালিকা সামনে রেখেই বিভিন্ন  লেখকের কাছে লেখা পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছিলাম। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত, তাঁরা সবাই আলোচ্য বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে অত্যন্ত মননশীল ও সংবেদনশীল লেখা পাঠিয়েছেন। যদিও কিছু আলোচ্যবিষয়ের ওপর লেখা সংগ্রহ করতে পারিনি। যে লেখাগুলি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে, তা সংকলিত করে প্রকাশ করা হল ‘কালিমাটি’ পত্রিকার এই সংখ্যাটি। যে বিষয় নিয়ে আমাদের এই সংখ্যার আয়োজন, সত্তরদশক, উল্লেখ করা বাহুল্য হবে, অর্থাৎ যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের এই সংখ্যাটি প্রকাশের আয়োজন ও তৎপরতা, তার আংশিক কাজই আমরা করতে সক্ষম হয়েছি। তবে আমরা আশাবাদী, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই বিষয়ের ওপর কাজ করে সম্পূর্ণতার পথে আরও অনেকটা এগিয়ে যেতে পারবেন। তাঁদের সচেতনতার প্রতি আমরা আস্থাশীল।  

‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের জানাই আমাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

অভিজিৎ মিত্র

সিনেমার পৃথিবী – ৪১


 

২০২৪ পুরনো হয়ে শেষ হয়ে গেল। নতুন বছর জানুয়ারী মেলে ধরেছে। পুরনো এই ধারাবাহিকও আজ এখানেই শেষ। সেই ২০২০-র কোভিড আচ্ছন্ন গরমের ছুটিতে এই লেখা শুরু করেছিলাম, কাজলদা চেয়েছিলেন কোভিডের ওপর সিরিয়াস একটা লেখা, আমি চেয়েছিলাম কোভিডের মত ভাইরাস নিয়ে যে কয়েকটা সিরিয়াস বিদেশি সিনেমা হয়েছে, সেগুলোর মোটামুটি একটা পর্যালোচনা পাঠকের সামনে তুলে ধরতে। ফলে ‘আউটব্রেক’ (১৯৯৫) ও ‘কন্টাজিয়ন’ (২০১১)। সেই লঘুচালে শুরু করার পর ৫ নম্বর পর্বে কোরিয়া নিয়ে আলোচনা শেষে মনে হয়েছিল লেখাটা সিরিয়াসলি অনেকদূর এগোনো যায়, যেহেতু ক্যামেরার পেছনে চোখ রাখা আর সিনেমা দেখা আমার ভাললাগার সাবজেক্ট। ফলে এতদিন দীর্ঘ ৪০ পর্বে সিনেমায় পৃথিবীর পঞ্চভূত নিয়ে বিভিন্ন রকম আলোচনা করেছি। সিনেমার আগা-ল্যাজা কেটে প্রচুর কচকচি। ক্লাসিক-কনটেম্পোরারি, ভাল-খারাপ, সুস্বাদু-অখাদ্য, লাইট-ক্যামেরা-সাউন্ড-অ্যাকশন, শট-সিনেমাটোগ্রাফি-কাট, পুরস্কারের যোগ্য-অযোগ্য, এইসব সাত-সতেরো নিয়ে সমালোচকদের নানা মত এবং সেসব ছবি দেখে আমার নিজের অনুভূতি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কোন্‌ কোন্‌ সিনেমা একদম শুরুর দিকে রয়েছে। এইসব ছবি থেকে কি কি শিক্ষনীয়। তার থেকেও বড় কথা, দেখতে দেখতে আগের ৪০ পর্বে ২০০-র বেশি ছবি নিয়ে আলোচনা, পৃথিবীর ৬টা মহাদেশের অন্তত ২৫টা দেশের সিনেমা, অন্তত ৫০ জন জীবিত-মৃত নায়ক নায়িকাদের নিয়ে মশলা মাখা, প্রায় ৫০ জন পরিচালকের ছবি নিয়ে আগাপাশতলা এবং ১৫ জন ক্যামেরাম্যানের সিনেমাটোগ্রাফির ওপর ছুরি-কাঁচি। আমার মত এক কবিতা/ছোটগল্প লেখকের হাত দিয়ে এই দীর্ঘ লেখা বের করে নেওয়ার সিংহভাগ ক্রেডিট কাজলদার। এবং আজ শেষবেলায় শেষ করব আবারো ‘আমার’ পছন্দ দিয়ে। তাহলে শেষের কবিতা শুরু করি?

দেখুন, আমাকে যদি সিনেমার একশ কুড়ি-পঁচিশ বছরের ইতিহাস ঘেঁটে বলতে বলা হয় আমার চোখে সেরা তিন, তাহলে গ্রিফিথের ‘দ্য বার্থ অব আ নেশন’ (১৯১৫) বলুন আর দাদাসাহেব ফালকের ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ (১৯১৩) বলুন, যেখান থেকেই হাঁটতে শুরু করি, আমার চয়েসঃ ১) টেকনিকাল প্রতিভার জন্য অরসন ওয়েলেসের ‘সিটিজেন কেন’ (১৯৪১), ২) শুধুমাত্র থিম, স্টাইল ও মনস্তাত্তিক ফিলোজফির জন্য ইংমার বার্গম্যানের ‘সেভেন্থ সিল’ (১৯৫৭), এবং ৩) দুর্দান্ত থিম ও সিনেমাটোগ্রাফির জন্য স্ট্যানলি কিউব্রিকের ‘2001: এ স্পেস ওডেসি’ (১৯৬৮)। খুব কাছাকাছি রাখব ফ্লেমিং-এর ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ (১৯৩৯) শুধুমাত্র টেকনিকালার ব্যবহারের কারণে। এবং আমার সেরা পরিচালকের নাম ইংমার বার্গম্যান, যেটা আমি আগেও  বিভিন্নবার বলেছি। ওনার প্রতি ছবির সাইকোলজিকাল ফিলোজফি আমাকে চুম্বকের মত বসিয়ে রাখে। ভাবায় এবং উপভোগ করায়। তবে ওনার খুব কাছাকাছি রাখব স্ট্যানলি কিউব্রিক-কে। উনি যত ছবি বানিয়েছেন, তার প্রতি সিনে এত অসাধারণ  ডিটেলিংয়ের কাজ এবং বুদ্ধিমত্তা আমি অন্য কারো সিনেমায় দেখিনি। তো, এইসব সিনেমা বা বার্গম্যান বা কিউব্রিক নিয়ে আমি আগেই আলোচনা করেছি। ফলে আজ ভাললাগা অন্য কিছু সিনেমা নিয়ে বলব যেগুলো এতদিন আলোচনায় রাখিনি বা বড়জোর উল্লেখ করেছি। তবে এখানেও একটা সাবধানবাণী শুনিয়ে দেওয়া ভাল। আমি সিনেমার ক্ষেত্রে বেশ জটিল। আজ যা ভাল লাগে, কাল হয়ত তার থেকে অন্য কিছু ভাল লাগে। অন্য কোন দৃষ্টিকোণ থেকে। কারণ আমরা তো রোজ কোন নাকোন নতুন ছবি দেখি, নতুন কিছু শিখি – ক্যামেরার কাজ, যে কোন শটের ডিটেলিং-কনস্ট্রাকশন-অ্যাবস্ট্রাকশন, সংলাপ, আবহ ইত্যাদি। ফলে আমার ভাললাগার ছবি কিন্তু সময় থেকে সময়ে বদলে যাবে। আপাতত যেগুলো বলতে পারি, সেগুলো হল গতানুগতিক সিনেমা পেরিয়ে একটু অন্য ভাবনার। যেগুলোর মধ্যে দিয়ে এটাও বোঝাতে চাই যে এদ্দিন যত মুভি নিয়ে কচকচি করেছি, তার বাইরেও প্রচুর ভাল ভাল সিনেমা রয়েছে যেগুলো দীর্ঘ ৪০ পর্বে আলোচনায় আসেনি। এবং আমার পছন্দের লিস্ট বেশ দীর্ঘ। সেজন্য বিভিন্ন জেনারের ১৭-টা ছবির মধ্যেই নিজেকে আপাতত গুটিয়ে রাখি যাতে শেষ আলোচনায় পেন চালাতে না হয়। এবং ভারতীয় সিনেমায় এদের বিকল্পগুলোও রাখলাম যেগুলো আমার হিসেবে এদের পাশে এক সারিতে বসানো যায়।

আমার চোখে, ছোটদের ছবিঃ ‘দ্য কিড’ (১৯২১, হলিউড) [বাংলা সিনেমায় এর বিকল্প হিসেবে বেছে নেব ‘কাবুলিওয়ালা’ (১৯৫৭)], থ্রিলারঃ ‘স্পেলবাউন্ড’ (১৯৪৫, হলিউড) [হিন্দিতে ‘য়ো কৌন থি’ (১৯৬৪)], ড্রামাঃ ‘ব্রিফ এনকাউন্টার’ (১৯৪৫, ব্রিটেন) [বাংলায় ‘ভুবন সোম’ (১৯৬৯)], যুদ্ধেরঃ ‘দ্য ক্রেনস আর ফ্লাইং’ (১৯৫৭, রাশিয়া) [বাংলায় ‘ওরা ১১ জন’ (১৯৭২)], কল্পবিজ্ঞানেরঃ ‘লা জেটি’ (১৯৬২, ফ্রান্স/জার্মানি) [তামিল ‘কাদু’ (১৯৫২)], হাসিরঃ ‘ডক্টর স্ট্রেঞ্জলাভ’ (১৯৬৪, ব্রিটেন) [হিন্দিতে ‘জানে ভি দো য়ারো’ (১৯৮৩)], ভয়েরঃ ‘কোয়াইদান’ (১৯৬৪, জাপান) [বাংলায় ‘মণিহার’-তিনকন্যা (১৯৬১)], প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্কঃ ‘দারসু উজালা’ (১৯৭৫, রাশিয়া) [কন্নড় ‘চেলুভি’ (১৯৯২)], নায়কোচিতঃ ‘গান্ধী’ (১৯৮২, ব্রিটেন) [বাংলায় ‘নায়ক’ (১৯৬৬)], ডকুমেন্টারিঃ ‘শোয়া’ (১৯৮৫, ফ্রান্স/জার্মানি/পোল্যান্ড) [হিন্দি ডকু ‘চিলড্রেন অব দ্য পায়ার’ (২০০৮)], দাঙ্গা/বর্ণবৈষম্য/ইতিহাসের দলিলঃ ‘মিসিসিপি বার্নিং’ (১৯৮৮, হলিউড) [বাংলায় ‘কলকাতা ৭১’ (১৯৭২)], সোশাল ব্ল্যাক-কমেডিঃ ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ (১৯৯৫, সার্বিয়া) [হিন্দিতে ‘ওম দর-বদর’ (১৯৮৮)], অ্যাডভেঞ্চারঃ ‘কাস্ট-অ্যাওয়ে’ (২০০০, হলিউড) [বাংলায় ‘অযান্ত্রিক’ (১৯৫৮)], অস্তিত্ব-মনস্তত্বঃ ব্ল্যাক সোয়ান (২০১০, হলিউড) [হিন্দিতে ‘বাঘ বাহাদুর’ (১৯৮৯)], সম্পর্কের জটিলতাঃ ‘দ্য হান্ট’ (২০১২, ডেনমার্ক) [বাংলায় ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ (১৯৯৩)], ভালবাসারঃ দ্য বাটারফ্লাই’জ ড্রিম (২০১৩, তুর্কি) [বাংলায় ‘দীপ জ্বেলে যাই’ (১৯৫৯)], রহস্যঃ ‘লবস্টার’ (২০১৫, আয়ারল্যান্ড/গ্রিস) [বাংলায় ‘কুহেলি’ (১৯৭১)] এবং সবশেষে সান্মানিক বিভাগেঃ ‘ইকিরু’ (১৯৫৭, জাপান) [বাংলায় ‘জলসাঘর’ (১৯৫৮)]।

ওপরে যতগুলো ছবির কথা লিখলাম, ১৮+১৮ = ৩৬ টা, সেগুলো সময় সুযোগ মত দেখুন। ভাল লাগবে। শুধু একটাই অনুরোধ, যখন দেখবেন, খোলা মনে দেখবেন, নানারকম সম্ভাবনা থেকে ছবির ভাল-মন্দ বিচার করবেন, সাহসী সিনেমাকে বাহবা জানাবেন।

যাইহোক, আজ এতগুলো ছবির ভেতর মাত্র দুটো ছবি নিয়ে কাটাছেঁড়া করব। এই লেখার ২৪ নম্বর পর্বে আমি বলেছিলাম এক ক্লাসিক রাশিয়ান ছবি ‘দ্য ক্রেনস আর ফ্লাইং’ নিয়ে কোন একদিন লিখব। আজ সেই কোন একদিন। এছাড়াও সাম্প্রতিক এক তুর্কি ছবি আমার বেশ ভাল লেগেছে, ‘দ্য বাটারফ্লাই’জ ড্রিম’। এই ছবি নিয়েও কিছু বলা দরকার। ১৯৫৭ এবং ২০১৩। এই দুটো পাশাপাশি আরো এক কারণে  রাখতে চাই – পুরনো বনাম নতুন – আমার চোখে অনেকটা কবিতার মত।

মিখাইল কালাটোজভের দেড় ঘন্টার সাদা-কালো যুদ্ধবিষয়ক ছবি ‘দ্য ক্রেনস আর ফ্লাইং’। ভিক্টর রজভের এক বিখ্যাত নাটক ‘লাইফ ইটার্নাল’-এর ওপর আধারিত। সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন সের্গেই উরুসেভস্কি। মুখ্য চরিত্রে অ্যালেক্সি বাটালভ ও তাতিয়ানা সময়লোভা। এই ছবি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের ছবি, ভেরোনিকা আর বরিসের অপূর্ণ প্রেমের ছবি, প্রতিশ্রুতি মৃত্যু খুন ধর্ষণ অবক্ষয় আনুগত্য স্বীকার ও কর্তব্যের ছবি, যুদ্ধের ফল হিসেবে সমাজ ও জীবন ধ্বংসের ছবি। কালাটোজভ এই ছবির ক্যানভাসে সূক্ষ্মভাবে এক শাশ্বত সত্যি ফুটিয়ে তুলেছেন। আজ অবধি একমাত্র সোভিয়েট ছবি যা কান ফিল্ম ফেস্টিভালে গোল্ডেন পাম পুরস্কার পেয়েছিল।

থিম বাদ দিলে প্রথমেই এই ছবির ক্যামেরার কাজ আলোচনায় উঠে আসবে। উরুসেভস্কি স্পেসিয়াল প্রক্সেমিক্স ও আলোছায়ার কাজ নায়িকার মুখের ওপর এমনভাবে দেখিয়েছেন, যা ভোলা যায় না। আরো একটা পয়েন্ট না বললে অনুচিৎ হবে। বরিস তার সঙ্গে দেখা না করেই যুদ্ধে চলে গেছে শুনে ভেরোনিকা যখন তাকে খুঁজতে বাসে চেপে যুদ্ধের র‍্যালির সামনে উপস্থিত। বাস থেকে নেমে একদৌড়ে সাঁজোয়া ট্যাঙ্কের সারি টপকে সে রাস্তার ওপাড়ে যায়। ক্যামেরা অনেক ওপর থেকে তাকে হারিয়ে না যেতে দিয়ে ফলো করে। আমার মতে গোটা সিনটা উরুসেভস্কি করেছেন একটা হাতে নেওয়া ক্যামেরায়, বাস থেকে নেমে তাতিয়ানার পেছনে ছুটে গিয়ে চেপে পড়েছেন এক ক্রেনে, তাতিয়ানা যখন দৌড়ে ট্যাঙ্কারের র‍্যালি পেরোচ্ছেন, তখন উরুসেভস্কি আস্তে আস্তে উঠে যাওয়া ক্রেনে শক্ত করে ধরে রেখেছেন সেই হ্যান্ডিক্যাম। অদ্ভুত! অনবদ্য!

এই সিনেমা আরো এক কারণে মনের কোণে লেগে থাকবে। ছবির নায়িকা তাতিয়ানা  সময়লোভার জন্য। সাবলীল অভিনয়। কেউ ভাবতে পারেনি এটাই ছিল ওনার প্রথম অভিনয়। এই সিনেমার জন্য কান ফিল্ম ফেস্টিভালে তাতিয়ানাকে বলা হয়েছিল ‘most modest and charming actress’। হলিউড থেকে অনেক অফার এসেছিল। দুর্ভাগ্য, তৎকালীন সোভিয়েত সরকার ওনাকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। এবং আগেও বলেছি, ষাটের দশকের পর উনি হঠাৎ ছায়াছবি জগৎ থেকে এবং লোকচক্ষু থেকে উধাও হয়ে যান। বহু পরে, নব্বইয়ের দশকে আবার ওনাকে দেখা যায়।

তুর্কি ছবি ‘দ্য বাটারফ্লাই’জ ড্রিম’ নিয়ে লিখতে গিয়ে প্রথমেই বারীনদার (ঘোষাল) একটা কবিতা মনে পড়ে গেল, অ্যাশট্রে। ‘এখনো সাজানো অ্যাশট্রে রাখা আছে / ব্যবহৃত হবে বলে / ব্যবহৃত, আমার গৃহিণী / নিজেও সে সাজতে ভালোবাসে /  হাসপাতাল থেকে ফিরে রোজ ছাই খোঁজে / ভরে উঠবার কাছে ভেঙে যায় / প্রতিবার অ্যাশট্রে সংক্রান্ত কিছু শিখে এসে / নিজেকে সাজায়’। ইলমাজ আর্গোদানের ১৩৮ মিনিটের ছবি দ্য বাটারফ্লাই’জ ড্রিম। ক্যামেরায় গোকান তির্য়াকি (আমি এর আগে ওনার কাজ দেখিনি)। মিউজিকে রহমান আলতিন, যিনি এই ছবির জন্য পাবলিক চয়েস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন। মুখ্য ভূমিকায় কিভাঞ্চ তাতলিতুগ, ম্যাত ফিরাত ও বেলচিম বিলগিন। এই ছবি ছিল ৮৬-তম অস্কার পুরস্কারে তুর্কির অফিশিয়াল এন্ট্রি, যদিও শেষ অবধি এটা নমিনেটেড হয়নি।

যাইহোক, যে কারণে এই ছবি আমার কলমে। এবং কেন এই ধারাবাহিকের একদম  শেষলগ্নে। দেখুন, আপনারা কেউ কেউ হয়ত জানেন যে আমি মূলত ‘কৌরব’  পত্রিকার লেখক। সেই ‘কৌরব’ পত্রিকা, যা বারীনদা আর কমলদা সত্তরের শুরু থেকে চালিয়ে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন - আশির দশকে কমলদার প্রতিকবিতা, বারীনদার যতিচিহ্নহীন নতুন কবিতা, শক্তি সুনীল বিনয় উৎপল জয় মৃদুল – এদের সবার কৌরবের পাতায় আত্মপ্রকাশ, এগুলো এখন ইতিহাসের পাতায়। ২০০৪ সালে কৌরব ১০০ সংখ্যা হয়ে যাবার পর যখন বারীনদা কমলদা কৌরব বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন তখন আর্যনীল আর আমি ছাপা কৌরবের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়েছিলাম, কারণ সেই ১৯৯৯ থেকে আর্যনীল আর আমি অনলাইনে ছাপা কৌরবের শুধু কবিতা সেকশন তুলে ধরতাম। কবিতার প্রতি সেই অকৃত্রিম ভালবাসা   নিয়ে আমরা অনেক বছর চালিয়েছি। আর্যনীল এর মাঝে circumference poetry নামক এক নতুন ধরনের কবিতার ধারণা তুলে ধরেছিলেন কৌরবে। কবিতার ফর্ম আর কনটেন্ট নিয়ে আমরা সবাই কৌরবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছি। তো, কবিতা ও প্রচলিত কবিতার মুক্তি আমাদের রক্তে। সুতরাং আমরা তো কবিতা আন্দোলনের ছবি নিয়ে উৎসাহিত হবই, তাই না? সেই কারণেই এই ছবি। চল্লিশের দশকে তুর্কির এক  বিশেষ কবিতা আন্দোলন ‘গারিপ’ এই ছবি রোমান্টিক আবহে তুলে ধরেছে। তিনজন তরুণ তুর্কি কবি লেখাপড়া শেষ করে ১৯৩৬ সালে তুরস্কের আঙ্কারায় ফিরে আসেন  ও তুর্কির প্রচলিত কবিতার ধারণা ধূলিসাৎ করে দেন। জোর দেন শব্দ থেকে উঠে  আসা ভাব প্রকাশের ওপর, তিনজন একসাথে প্রকাশ করেন ‘ভার্লিক’ নামক এক কবিতা ম্যাগাজিন যা আজো কবিতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। এই ছবির প্রধান যে দুই চরিত্র, কিভাঞ্চ ও ম্যাত, তারা সেই ‘গারিপ’ আন্দোলনের কবি।

১৯৪১ সালের পটভূমিকায় এই ছবি। মুশকিল, প্রধান দুই তরুণ কবি এই ছবিতে  ক্যানসার আক্রান্ত, যদিও দুজনেই ভাল থাকার চেষ্টা করে। এবং দুজনেই একজন নারীর প্রতি আকৃষ্ট, বেলচিম। দুজনেই চেষ্টা করে যুবতীর হৃদয় জেতার। সেখান থেকেই এই ছবির টুইস্ট। তারা কি পারবে? তারা কি আদৌ বেঁচে থাকবে? তারা কি কবিতা লেখা চালিয়ে যাবে? সিনেমাটা দেখুন। ভাল লাগবে।

থিম বাদ দিলে পড়ে থাকে অভিনয়, ডায়লগ। এই তরুণ তুর্কিদের থেকে সেটাও যথাযথ। এবং সিনেমাটোগ্রাফি। আউটডোর শুটিং-এ ক্যামেরাম্যান গোকান তির্য়াকি যথেষ্ট ভাল কাজ করেছেন। সমালোচনা করার মত আমার কিছুই নেই। তবে হ্যাঁ, সব ছাড়িয়ে যে কথা আমার বারবার মনে হয়েছে, এই ছবির মাধ্যমে পরিচালক আর্গোদান প্রায় ৭০ বছর পরে এক হারিয়ে যাওয়া কবিতা আন্দোলনকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তাই কবি হিসেবে এই লেখার মাধ্যমে আমি ওনাকে কুর্নিশ জানালাম।

ব্যস্‌, পাঠক, সিনেমার পৃথিবী এই অব্ধিই। আর নয়। এই লেখার শেষ ৪০ পর্বে আমি সিনেমা সম্বন্ধে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আপনাদের মতামত তৈরি করতে চেয়েছি, চোখ-কান খুলে দিতে চেয়েছি – আমার নিজের দেখা সিনেমাগুলোর ন্যারেশানের মাধ্যমে। তবুও যদি এই লেখার কোন পর্বে কোথাও মনে হয়, আমি ন্যারেটিভ না হয়ে অ্যাসার্টিভ হয়ে উঠেছি, নিজগুণে ক্ষমা করবেন। মোদ্দা কথা হল, আপনি কোন্‌  সিনেমাকে মাষ্টারপিস হিসেবে আপনার মনের অন্দরমহলে তুলে রাখবেন, সেটা আপনার ব্যাপার। তাহলে শুরু করুন নিজের সিনেমার জগৎ তৈরি করার। এবং সেই জগতের ভেতর নিজের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার। হ্যাঁ, যদি হঠাৎ এই শেষ লাইনে এসে মনে হয়, “...নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ, অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে...”, তাহলে চিঠি বা মেসেজের মাধ্যমে কাজলদাকে জানিয়ে দেবেন। সেক্ষেত্রে কয়েক মাস পরে আমি আবার বাংলা সিনেমার লুকিয়ে থাকা মণিমুক্তো নিয়ে আরেক ধারাবাহিক শুরু করব। আর এই অবধি এসে যদি মনে হয়, নাহ্‌, এই কচকচি মাস্টারের থেকে সিনেমার ঘোল আর নেওয়া যাচ্ছে না, তাহলে কমপ্লিট ফুলস্টপ।

হেডি ওয়েস্টের ১৯৬১ সালের সেই বিখ্যাত গান 500 miles মনে আছে তো?

  

প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায় হিন্দী ছায়াছবি

 


পরপর বড় পর্দায় আমার দেখা বাংলা এবং ইংরেজী ছায়াছবির ইতিহাস যখন লিপিবদ্ধ করেছি, তখন হিন্দী ছবিই বা বাকী থাকে কেন? তবে প্রথমেই কিছু তুলনামূলক তথ্য দিইঃ আমার মার স্মৃতিচারণের খাতা অনুযায়ী আমাকে প্রথম সিনেমা দেখতে নিয়ে যাওয়া হয় মেট্রোতে ১৯৫৯ সালে, আমার দু’বছর বয়স পূর্ণ হবার কয়েকদিন আগে। ছবিটি ছিল ১৯৫৮ সালের Tom Thumb, যার কিছুই আমার মনে নেই। যে ইংরেজী (আদতে ইটালীয়, ইংরেজীতে dub করা) ছবি দেখার কথা আমার প্রথম মনে পড়ে তা ষাটের দশকের গোড়ায় – ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩-র মধ্যে – লাইটহাউসে Trojan War অথবা The Trojan Horse। আবার, মার খাতায় লেখা আছে যে ১৮ই জুলাই ১৯৬০-এ আমাকে প্রথম বাংলা ছবি দেখানো হয়ঃ সম্ভবত কালীঘাট অঞ্চলের ঊজ্জ্বলায় উত্তমকুমার অভিনীত সখের চোর। এরও কিছু মনে নেই। প্রথম যে বাংলা ছবির কথা মনে আছে সেটি হলো ডিসেম্বর ১৯৬০-এ ভবানীপুরের ইন্দিরায় দেখা ছবি বিশ্বাস, বিশ্বজিৎ, সুলতা চৌধুরী অভিনীত শেষ পর্যন্ত

প্রথম পর্বঃ ১৯৬৪/৬৫

আমার দেখা প্রথম হিন্দী ছবি ১৯৬৪ সালে, ধর্মতলার জ্যোতি প্রেক্ষাগৃহে জাহানারা। ইতিহাস-আশ্রিত এই বিয়োগান্ত প্রেমোপাখ্যানে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন মালা সিনহা। প্রেমিক মীর্জা চাঙ্গেজী হয়েছিলেন ভারত ভূষণ, সম্রাট শাহজাহানের ভূমিকায় পৃথ্বীরাজ কাপুর, এবং মমতাজ হয়েছিলেন অচলা সচদেব।

দাদা ছবিটি দেখে এসে তার ভূয়সী প্রশংসা করায় তাঁর সঙ্গে মা আর আমি যাই দেখতে। ততদিনে, দাদার প্রভাবে আমি হয়ে উঠেছি হিন্দী ছায়াছবির গানের ভক্ত, সবচেয়ে প্রিয় কণ্ঠ মহম্মদ রফির। মূল ছবির আগে ট্যালকম পাউডার ‘হিমালয়া বুকে’-র বিজ্ঞাপনে আশা ভোসলের গলা শুনে চমৎকৃত হয়েছিলাম। মদন মোহনের সুরে, রাজেন্দ্র কৃষণের লেখা মূল ছবির গানগুলি আজও কানে বাজে। কিছুদিন পর আমার এক কাকার বিয়ের পর তাঁর কাছ থেকে উপহারস্বরূপ ছবির একাধিক গানের রেকর্ড আদায় করেছিলাম। বাড়িতে অতিথি সমাগম হলে, বিশেষ করে তাঁরা যদি অবাঙালি হতেন, অনুরোধ পেলে এগুলির মধ্য  থেকে যে গানটি গেয়ে শোনাতাম, সেটি ছবির প্রথম গান, মীর্জা চাঙ্গেজী-রূপী ভারত ভূষণের মুখে, মহম্মদ রফির গলায় ‘কিসী কি ইয়াদ মে দুনিয়া কো হ্যায় ভুলায়ে হুয়ে’। ছবিটি সম্বন্ধে পড়তে গিয়ে দেখি যে গানের মধ্য দিয়ে তখন রফির পাশে অস্তগামী শিল্পী তালাত মাহমুদকে আবার সামনে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল। ঘটনা, যে মীর্জা চাঙ্গেজীর মুখে প্রথম দুটি গানের পর মহম্মদ রফির বদলে তিনটি একক ও একটি দ্বৈত গানে তাঁর কণ্ঠ হয়েছিলেন তালাত। ইস্কুলে একবার তালাতের গাওয়া ‘ফির ওহী শাম, ওহী গম’ গেয়েছিলাম। একই ভাবে জাহানারার কণ্ঠ তাঁর গলায় প্রথম এবং তালাতের সঙ্গে দ্বৈত গানে লতা মঙ্গেশকর হলেও, মাঝে আরেকটি দ্বৈত গানে মীর্জা চাঙ্গেজী-রফির সঙ্গে জাহানারার কণ্ঠ হয়েছিলেন সুমন কল্যাণপুর।

ছবিটি সেই সাত বছর বয়সে মন্দ লাগেনি, তবে শাহজাহান রূপী পৃথ্বীরাজ কাপুরের কণ্ঠস্বর কানে পীড়াদায়ক লেগেছিল। মার ছবিটি একেবারেই ভালো লাগেনি এবং তিনি মাঝেমাঝেই ওই কণ্ঠের নকল করে বর্ষীয়ান অভিনেতাকে ভ্যাঙ্গাতেন। ইতিহাস-আশ্রিত ছবি হিসেবে উল্লেখযোগ্য ঔরংজেব চরিত্রের উপস্থিতি। সাধারণত মোগল যুগের প্রেক্ষাপটে যেসব ছবি এর আগে হয়েছে, যেমন ১৯৬৩ সালের তাজ মহল বা ১৯৪৬ সালের শাহজাহান, সেগুলিতে হয় ঔরংজেবকে দেখানো হয়েছে শাহজাহান/খুররমের শিশুপুত্র রূপে (তাজ মহল) বা ছবিতে সে চরিত্রের উপস্থিতিই নেই (শাহজাহান)। জাহানারা-তে একটি নাটকীয় দৃশ্যে জ্যেষ্ঠা ভগ্নীর ক্রোধজনিত তীব্র ভর্ৎসনার মুখে পড়তে দেখা যায় নতুন মোগল সম্রাটকে, যে ভর্ৎসনা নতমস্তকে মেনে নেন তিনি। তাতে অবশ্য ঔরংজেবের কৃতকর্মে কোন প্রভাব পড়েছিল তা নয়, ছবিতেও তেমন কিছু দেখানো হয়নি।

মালা সিনহা ফিল্মফেয়ারের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন, তবে জেতেননি। ছবিটি শ্রেষ্ঠ শিল্প পরিচালনার (রঙিন) পুরস্কার পেয়েছিল।

এর পরের বড় পর্দার হিন্দী ছবিও দেখি সেই জ্যোতিতেইঃ ১৯৬৪ সালের সাদা-কালোয় তোলাদোস্তি, যা পরে জেনেছিলাম বাংলা লালুভুলু (১৯৫৯)-র রূপান্তর। প্রশংসিত ছবিটির টিকিট কেনার ব্যাপারে এক অভিনব ছাড়ের ব্যবস্থা হয়ঃ ইস্কুল থেকে চিঠি নিয়ে গেলে টিকিটের দামে students’ concession পাওয়া যাবে। ইস্কুলের ফাদার প্রিফেক্ট চিঠি টাইপ করে দেন। দাদার সঙ্গে সোৎসাহে জ্যোতির টিকিট কাউন্টারে গেলাম। দাদা চিঠিশুদ্ধু হাত ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, “Students’ Concession!” পত্রপাঠ টিকিট বিক্রেতা জোরে হাত নেড়ে জানালেন যে ওটা হবে না! কেন তা মনে নেই। পরে অবশ্য ওই চিঠি ব্যবহার করে, ছাড় নিয়েই দাদার সঙ্গে ছবিটি দেখেছিলাম। ছ’টি গানের মধ্যে পাঁচটিই আমার তৎকালীন প্রিয় গায়ক মহম্মদ রফির কণ্ঠে। মজরু সুলতানপুরীর লেখা, লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলালের সুরারোপিত প্রত্যেকটি গান মুগ্ধ করা। ১৯৬৫ সালে অবশেষে বাবা আমাকে উপহার হিসেবে 4-speed record player, HMV কোম্পানীর Playmate কিনে দেন – এতদিন বাড়িতে রেকর্ডে গান শুনেছি দম দেওয়া গ্রামোফোনে, শুধু  ৭৮ গতির রেকর্ড বাজিয়ে। এবার ‘প্লে মেট’-এর সুবাদে বাড়িতে এল ৩৩.১/৩ গতির ‘লং প্লে’ Gems  from Tagore, এবং ছোট্ট ৪৫ গতির ‘ই পি’ বা extended play যাতে ছিল দোস্তি ছবির চারটি গান, চারটিই রফির কণ্ঠে। প্রত্যেকটি গান গলায় তুলে নিয়েছিলাম।

দোস্তি সে বছরের শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পায়, এবং ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের জন্য সাতটি বিভাগে মনোনীত হয়ে ছ’টি বিভাগে জয়ী হয়ঃ শ্রেষ্ঠ ছবি, শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালনা, শ্রেষ্ঠ গীত রচনা, শ্রেষ্ঠ নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী (মহম্মদ রফি), শ্রেষ্ঠ কাহিনী এবং শ্রেষ্ঠ সংলাপ। ১৯৬৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দী ছবির মধ্যে দোস্তি ছিল বক্স অফিসের হিসেবে তৃতীয় সফলতম ছবি।

বাবা ভারতীয় সৈন্যদলে থাকার সুবাদে সে সময় আমাদের বাসস্থান ছিল বালিগঞ্জ ময়দান ক্যাম্পের মধ্যে একটি বড় বাড়ি। এইরকম সময়ে সেখানে মাঠে পর্দা খাটিয়ে ১৬ মিলিমিটার প্রোজেকশানে ছবি দেখানো শুরু হয়। এই পরিসরে প্রথম যে ছবি দেখি তা হলো ১৯৫৯ সালের ষষ্ঠ সফলতম ছবি দিল দেকে দেখো। গল্পের ল্যাজামুড়ো যে খুব একটা বুঝেছিলাম তা নয়, কিন্তু গানগুলো মনে ধরেছিল আর খুব ভালো লেগে  গিয়েছিল নায়ক-নায়িকা শাম্মী কাপুর এবং আশা পারেখকে। শেষোক্ত সপ্তদশবর্ষিণীর নায়িকারূপে নাকি এটিই প্রথম ছবি ছিল। যেটা উল্লেখ্য, আমার সঙ্গে ছবিটি দেখেন আমার বাবা, এবং তাঁরও শাম্মী কাপুরকে ভালো লেগে যায়!

এই ছবির কথা এই জন্য বললাম যে দোস্তি-র পর সিনেমা হলে গিয়ে যে ছবি দেখি, তারও নায়ক ছিলেন শাম্মী কাপুর – দেশপ্রিয় পার্কের পাশে প্রিয়া সিনেমায় সেই ১৯৬৪ সালের রাজকুমার, যদিও মনে হয় ছবিটি দেখেছিলাম ১৯৬৫-তে। ইংরেজী ছবি নিয়ে স্মৃতিচারণার শেষ পর্বে বলেছি কিভাবে বাবা ১৯৬৫ থেকে সিনেমা দেখার ব্যাপারে এক নির্মম-সদয় রীতি চালু করেন। বছরের নির্দিষ্ট সময় জ্বর-উৎপাদক এবং অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক T. A. B. C. ইনজেকশন নিতে হবে, এবং তার কষ্ট ভোলার জন্য সিনেমা দেখা যেতে পারে! রাজকুমার দেখা এই পীড়াদায়ক প্রতিষেধক নেবার পরিণতি! গিয়েছিলাম দাদার সঙ্গে, এবং অত্যন্ত উপভোগ্য ও দৃশ্যতই প্রচুর ব্যয় করে তোলা এই রঙিন ছবির (দোস্তি আর দিল দেকে দেখো দুটিই ছিল সাদা-কালো) একটি দৃশ্যে দাদা অট্টহাসি হাসতে হাসতে আমার যন্ত্রণাক্লিষ্ট হাতে একটি ঘুষি বসিয়ে দেন! এই প্রথম হিন্দী ছবিতে তলোয়ার খেলা দেখলাম নায়ক রাজকুমার ভানুপ্রতাপ-শাম্মী কাপুর আর খলনায়ক নর্পত সিং-প্রাণের মধ্যে। ভানুপ্রতাপের পিতা মহারাজের ভূমিকায় শাম্মী কাপুরের বাস্তব জীবনে যিনি পিতা, সেই পৃথ্বীরাজ কাপুর আর সৎ-মার ভূমিকায় অচলা সচদেব – জাহানারা-র পুনরাবৃত্তি! রামানন্দ সাগরের লেখা গল্প – যেখানে বিদেশ থেকে ফেরা রাজকুমার বন্ধু কপিলের সঙ্গে পরামর্শ করে ভাঁড়ের মতো আচরণ করছে, যার আড়ালে সে আবিষ্কার করতে চায় তার বাবার বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র চলছে কিনা – এখন খুব আবছাভাবে হলেও কালজয়ী বিয়োগান্ত নাটকের নায়ক হ্যামলেটের আচরণকে মনে পড়ায়। রাজকুমার অবশ্য পুরোপুরি মিলনান্তক এবং শাম্মী কাপুরের ভাবমূর্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অনেকটাই কৌতুকরসে জারিত। বক্স অফিসের হিসেবে রাজকুমার ১৯৬৪-র পঞ্চম সফলতম হিন্দী ছবি।

১৯৬৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আরেকটি ছবি দেখব সুদূর ভবিষ্যতে, ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪-র মধ্যে, যখন আমি যতীন দাস পার্ক লাগোয়া শ্যামাপ্রসাদ কলেজে অধ্যাপনারতঃ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রযোজিত ও সুরারোপিত সাদা-কালো ছবি কোহরা। এর উৎস-কাহিনী ড্যাফনে ডু মোরিয়ারের ১৯৩৮-এ প্রকাশিত রেবেকা উপন্যাস, এবং তার থেকে ১৯৪০ সালে হওয়া হিচককের বিখ্যাত ছবিটি। ১৯৬২-তে বিশ সাল বাদ হিট করতে, পরের ছবিতে পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার বীরেন নাগ খানিকটা বাহুল্যবর্জনের পথে হাঁটলেন। কোহরা-র আবহ অনেক বেশী অবিমিশ্রভাবে রোমাঞ্চকর। এখানেও আগের ছবির মতো সেই নারীকণ্ঠে ভীতিজনক গান, শিল্পী অবশ্যই লতাঃ ‘ঝুম ঝুম ঢলতি রাত’। ছবির শুরুর দিকে গানটি গাইছে নায়কের প্রথমা স্ত্রী পুনম, যার মুখ আমরা সারা ছবিতে একবারও দেখতে পাবো না, শুধু চোখ দুটির  ওপর ক্যামেরা মাঝে-মাঝে zoom in করবে! আর পুনম কিন্তু বাকি ছবিতে বাংলা জিঘাংসা-র মঞ্জুশ্রী  (১৯৫১) বা বিশ সাল বাদ-এর রাধার (১৯৬২) মতো নকল ভূত নয়! পুনমের পূর্বসূরি হলো ১৯৫৮ সালের মধুমতী ছবির নায়িকা (বৈজয়ন্তীমালা), যে ছিল আসল প্রেতাত্মা। তবে, মধুমতীর প্রেত ফিরে এসেছিল তার হত্যাকারী উগ্রনারায়ণকে (প্রাণ) তার অপরাধ স্বীকার করাতে। পুনমের ভূত তাড়া করে ফিরেছে নায়ক অমিত সিং-এর দ্বিতীয় স্ত্রী রাজেশ্বরীকে। মধুমতীর ভূত, প্রাসাদের যে আলসে থেকে উগ্রনারায়ণের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মধুমতী আত্মহত্যা করেছিল (জিঘাংসা মনে পড়ে?), সেখান থেকেই প্রেমিক আনন্দকে (দিলীপকুমার) লাফিয়ে পড়তে বলে। ভূত পুনমও মানুষ সতীন রাজেশ্বরীকে দ্বিতীয়বার ‘ঝুম ঝুম ঢলতি রাত’ গেয়ে অমিতের প্রাসাদের ছাদে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে লাফিয়ে পড়তে বলে। শেষ মুহূর্তে অমিত রাজেশ্বরীকে বাঁচায়। বলতে দ্বিধা নেই, এই দ্বিতীয়বার গাওয়া গানটির রেকর্ড বাড়িতে শুনে সেই ৭/৮ বছর বয়সে বেশ ভয় পেতাম! তুলনায় এর আগের আপাত-ভৌতিক গানগুলি (মহল, মধুমতী, বিশ সাল বাদ) অতটা ভীতির উদ্রেক করে না।

কোহরা-র সম্পদ রাজেশ্বরীর ভূমিকায় ওয়াহিদা রেহমানের আর দাই-মা’র ভূমিকায় ললিতা পাওয়ারের অভিনয়, আর সবার ওপরে হেমন্তর সুরে একের পর এক গান। হেমন্তর প্রথম প্রযোজনা নীল আকাশের নীচে-র (১৯৫৯) গান ‘ও নদীরে’ এখানে প্রায় অপরিবর্তিতভাবে লতাকণ্ঠে শোনা গেছে ‘ও বেকারার দিল’ গানে। তবে, উৎস বাংলা গানটিতে তো নদীর প্রতি এক ধরনের উদাস ভালোবাসার অভিব্যক্তিই  ছিল। কোহরা-য় নায়িকার মনে জমে থাকা দুঃখ, হতাশা হঠাৎ প্রেমের ছোঁয়ায় কিভাবে অভিমান-ভরা উচ্ছ্বাসে পরিণত হয়েছে, হেমন্তর সুর আর লতার গায়কীতে তা মনকে মুগ্ধ করে দেয়। এক টুকরো আগুন (১৯৬৩) ছবিতে হেমন্তর সুরে উৎপলা সেন গেয়েছিলেন ‘হে বিরহী, সরে থেকো না’। গানটির আস্থায়ীর সুরটুকু নিয়ে বিশ্বজিতের মুখে হেমন্ত গাইলেন ‘রাহ বনি খুদ মঞ্জিল’। আর, বোধহয় সবার ওপরে ১৯৫৯ সালের দীপ জ্বেলে যাই ছবির সেই সম্মোহক ‘এই রাত তোমার আমার’-এর আস্থায়ী ব্যবহার করে, যা ছিল একাকী প্রেমিকের প্রেমিকাকে অনুভবে-পাওয়ার গান, তাকে হেমন্ত ও কবি-গীতিকার কইফি আজমি বদলে দিয়েছেন মুগ্ধ স্বামীর সামনে-উপস্থিত স্ত্রীর প্রতি সেই সম্মোহক ভালবাসার বহিপ্রকাশে। গানের চিত্রায়নও প্রশংসনীয়। বাংলা গানটির ভিডিও ক্ষতবিক্ষত! তাই শুধু হেমন্তর কণ্ঠে ‘এই রাত তোমার আমার’ এবং তার পরেই ‘ইয়ে নয়ন ডরে-ডরে’-র পূর্ণ দৃশ্য-সম্বলিত ভিডিওটিই সম্বল ইউটিউবে।

কোহরা বাণিজ্যিক সাফল্য পায়নি। হয়তো বিশ সাল বাদ-এ ব্যবহৃত ‘ফরমুলা’-র পুনরাবৃত্তি – সেই এক প্রাসাদ, তাকে ঘিরে বা তার মধ্যে – বিশ সাল বাদ-এ আপাত, এখানে আসল, মহিলা প্রেতাত্মার কণ্ঠে গান, এবং চিত্রায়নে ১৯৬২-র ছবিটির বহির্দৃশ্য গ্রহণের জায়গাগুলি অবধি অনেকটা এক থাকা, এবং সেই এক নায়ক-নায়িকা জুটি – দর্শকদের একঘেয়ে লেগে থাকতে পারে। অবশ্য ওই ১৯৬৪-তেই মুক্তি পেয়ে, আবার স্ত্রীকণ্ঠে (আপাত) ভৌতিক গান ব্যবহার করে বিশ সাল বাদ-এর সঙ্গে যুক্ত ধ্রুব চ্যাটার্জী রাজ খোসলার ও কৌন থী ছবিতে দারুণ বাণিজ্যিক সাফল্য পান। দুটি ছবির কোনটি আগে মুক্তি পায়, অন্তর্জালে তা নিয়ে পরস্পর-বিরোধী তথ্য রয়েছে।

এছাড়া, চিত্রনাট্যে যে ত্রুটি ছিল তা হেমন্ত আঁচ করলেও সঠিক দোষটি ধরতে পারেননিঃ

… সিনেমা লাইনের লোকের কাছে ফুলমার্ক পেল ‘কোহরা’।[1] কিন্তু আমার মনে তবু সংশয়। ছবিটার সব ভালো কিন্তু তবু একটা বিরাট ত্রুটি রয়ে গেছে গল্প বলার কায়দায়। একটা ধোঁয়াটে ভাব রেখে দিয়েছেন পরিচালক … তাই আমি বীরেনবাবুকে বললাম, ‘সবই ঠিক আছে, কিন্তু প্রেতাত্মার ব্যাপারটাকে দর্শকের কাছে অস্পষ্ট রাখছেন কেন। স্পষ্ট বলে দিন না ওটা প্রেতাত্মা। তাহলেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়…’

কিন্তু বীরেনবাবু আমার কথা মানলেন না। রাজি হলেন না এতটুকু বদলাতে। (আনন্দধারা, ৮১)

ছবিটি দেখার পর বলতে বাধ্য হচ্ছি যে প্রেতাত্মার ব্যাপারে কোন অস্পষ্টতা নেই। সমস্যা একমাত্র পুনমের ভূতের আচরণ![2]

রাজেশ্বরী অমিত সিং-এর দ্বিতীয় পক্ষ হয়ে আসতেই দাই-মা তার প্রতি বিরূপতা প্রদর্শন করতে থাকে, কারণ রাজেশ্বরী পুনমের মতো অভিজাত নয়। পুনম প্রাসাদের যে মহলে বাস করতো, রাজেশ্বরী সেখানে গেলে মৃতা পুন মের উপস্থিতি অনুভব করে, তার হাসি শুনতে পায়, এমনকি আয়নার সামনে তার ছায়ামূর্তিকে বসে থাকতেও দেখে। ঘটনা চরমে ওঠে পুনমের প্রেত যখন গান গাইতে-গাইতে রাজেশ্বরীকে  তাড়া করে নিয়ে যায় ছাদের আলসেতে এবং ফিসফিস করে তাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলে। আতঙ্কিত, সম্মোহিত রাজেশ্বরী তাই করতে যাচ্ছিল, এমন সময় অমিত তাকে ধরে ফেলে বাঁচায়। আমরা দেখেছি যে পুনমের জীবতাবস্থায় তার একাধিক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। তা, এরকম স্বৈরিণী নারী যে মৃত্যুর পর কোপনস্বভাব হয়ে নিরপরাধ সতীনের ওপর চড়াও হবে, এমন ভূতের গল্প, মনে হয়, অনেক আছে।

কিন্তু এবার স্পয়লার-সতর্কতা দিয়ে বলিঃ আমরা প্রথমে জানছি যে প্রথম স্ত্রীর ব্যাভিচারে ধৈর্য হারিয়ে অমিতই পুনমের মদ-খেয়ে-সংজ্ঞাহীন শরীরের ওপর গুলি চালিয়ে দেয়। তারপর গাড়িসহ পুমের দেহ জলায় ডুবিয়ে দেয়। এই পরের দৃশ্যটি হিচককের সাইকো (১৯৬০) থেকে অনুপ্রাণিত। স্ত্রীহত্যার দায়ে অমিত গ্রেপ্তার হয়, থানায় যাবার আগে বিহ্বল রাজেশ্বরী অমিতের পায়ে লুটিয়ে পড়ে। এই দৃশ্য দেখে দাই-মা ছুটে এসে আদালতে কবুল করে যে অমিত পুনমের মৃতদেহের ওপর গুলি চালিয়েছিল। দেবতুল্য  স্বামীর প্রতি পুনমের অবজ্ঞা দেখে দাই-মা স্বয়ং পুনমের মদে বিষ মিশিয়ে তাকে হত্যা করে!

গুলি চালালো স্বামী; বিষ দিল দাই-মা। পুনমের ভূত এই দু’জনকে একবারের জন্যও কিছু করল না, তার যত রাগ নিষ্পাপ রাজেশ্বরীর ওপর! আর, রাজেশ্বরীকে মারতে বিফল হয়ে পুনমের ভূত একেবারে হাওয়া হয়ে গেলো, অমিত-রাজেশ্বরী প্রাসাদে ফিরে সুখে সংসার করা শুরু করল!

কোহরা বড় পর্দায় দেখেছি, আশির দশকে, দু’বার। প্রথমবার ভবানীপুরের বিজলী সিনেমায় দুপুরের শো-তে। হলে পৌঁছে দেখি ছবি শুরু হয়ে গেছে, গান চলছে ‘ঝুম ঝুম ঢলতি রাত’। অতএব দ্বিতীয়বার গেলাম  মধ্য কলকাতায়, কলকাতা কর্পোরেশনের লাগোয়া মিনার্ভায় (যার নাম পরে বদলে হয় ‘চ্যাপলিন’; কোহরা দেখার সময় এই পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল কিনা মনে নেই)। সেখানে ছবিটির রোজ তিনটি প্রদর্শনী ছিল। তৃপ্তি করে গোড়া থেকে ছবিটি দেখেছিলাম। হাতে গোনা যে ক’টি হিন্দী ছবি একাধিকবার দেখেছি, সেগুলির মধ্যে কোহরা  তৃতীয়।

লক্ষ্যণীয়, সাম্প্রতিক সময় অবধি বিজলী শুধুই বাংলা ছবি আনত। আর মিনার্ভা/চ্যাপলিন মাঝে-মধ্যে হিন্দী ছবির আগ্রাসনের কাছে মাথা নত করলেও ষাটের দশকের শেষে পুনর্যাত্রা শুরু করেছিল ইংরেজী – মূলত কলম্বিয়া কোম্পানীর – ছবির মুক্তিস্থান হিসেবে!

 

(ক্রমশ)



[1] ছবিটি শিল্প নির্দেশনার জন্য ‘ফিল্মফেয়ার’ পুরস্কার পায়। ললিতা পাওয়ার পার্শ্বচরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর মনোনয়ন পেলেও জেতেননি।

 [2] এই বিশ্লেষণ আমার বন্ধুপ্রতীম ছাত্র অভিরূপ মাশ্চরকের।


শ্রেষ্ঠা সিনহা

 

সমর সেনের কবিতা : নাগরিক জীবনের আখ্যান



প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সমকালের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি সমর সেন (১৯১৬-১৯৮৭)। মহাযুদ্ধকালীন পরিবেশে বিট্রিশ রাজশক্তির পদতলে দলিত হয় ভারতীয় আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। সমালোচকদের মতে, ‘দীর্ঘ দিনের সহজ শান্ত জীবন-স্রোত হঠাৎ প্রবল ঘূর্ণাবর্তের রূপ গ্রহণ করে, সেই আবর্তে মানুষের প্রচলিত অনেক মূল্যবোধ তৃণখন্ডের মত ভেসে যায়। প্রথম-বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়া বা অভিঘাত ইওরোপের বিভিন্ন দেশে এরকমই হয়েছিল সন্দেহ নাই। ভারতবর্ষ এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়নি।’’

ব্রিটিশ শক্তির নিয়ন্ত্রাণাধীন ঔপনিবেশিক দেশ ভারতবর্ষ পরোক্ষভাবে যুদ্ধের দাবানলে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যুদ্ধের যাবতীয় ব্যয়-ভার গৃহীত হয় ভারতীয় কোষাগার থেকে। যার ফলে দেখা দেয় মন্বন্তর, আর্থিক মন্দা; বিপর্যস্ত হয় বাঙালি জনজীবনের নিয়মিত ছন্দ। মধ্যযুগীয় গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজের পরিবর্তে সমাজে যান্ত্রিক বিন্যাস দেখা যায়, ক্ষয়িষ্ণু ধারায় প্রবাহিত হয় মনুষ্যত্ব থেকে চিরকালীন মূল্যবোধ। সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দুতে ধীরে ধীরে উঠে আসতে শুরু করলো মানবজীবনের আদিম প্রবৃত্তি সহ প্রান্তিক জনমানসের কলতান। গোপিকানাথ রায়চৌধুরীর পর্যবেক্ষণ অনুসারে, “যুদ্ধোত্তর কালে জাতীয়-জীবনে নানা বিপর্যয় ও আন্দোলনের ফলে সমগ্র দেশের তথা বাংলার যুবচিত্ত অশান্ত, বিহ্বল ও হতাশ হয়ে উঠেছিল। প্রচলিত মূল্যবোধ সম্পর্কে সুতীব্র সংশয় ও জিজ্ঞাসা উদ্যত হয়ে উঠতে লাগল মনের মধ্যে’’

সমকালীন যন্ত্রণাদীর্ণ বেদনা ও সংবেদনশীলতা নিয়ে বাংলা কাব্য-কবিতার আসরে আবির্ভূত হন সমর সেন। সমালোচকদের মতে তিনি নাগরিক চেতনার কবি, মধ্যবিত্ত জীবনের চিত্রকর। পূর্বজ সাহিত্যিক কিংবা কবিদের থেকে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয় তাঁর সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটি। তিরিশের দশকে কবি সমর সেনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেই সময়পর্বের বেশকিছু কাল পূর্ব থেকে আধুনিক বাংলা কবিতার পত্তন হয়। রবীন্দ্রনাথের কথায়, “এটা কালের কথা ততটা নয়, যতটা ভাবের কথা। নদী সামনের দিকে সোজা চলতে চলতে হঠাৎ বাঁক ফেরে। সাহিত্যও তেমনি বরাবর সিধে চলে না। যখন সে বাঁক নেয় তখন সেই বাঁকটাকেই বলতে হবে মর্ডান। বাংলায় বলা যাক  আধুনিক। এই আধুনিকতা সময় নিয়ে নয় বরং মর্জি নিয়ে।” অর্থাৎ কবিতার আঙ্গিক রদবদলের দিকটিকেই ‘আধুনিকতা’-র সমার্থক হিসাবে নির্দিষ্ট করেন তিনি। অন্যদিকে রবীন্দ্র-পরবর্তী সময়ের ‘নির্জনতম কবি’ জীবনানন্দ দাশের মতানুসারে, “নতুন সময়ের জন্যে নতুন, ও নতুনভাবে নির্ণিত পুরানো মূল্য, নতুন চেতনা ও নতুনভাবে আবিষ্কৃত পুরানো চেতনার যে একান্ত দরকার শিল্পে ও জীবনে একালের কোনো-কোনো বাঙালি কবি সেটা বুঝতে পেরেছেন বলেই আজকের বাংলা কবিতা স্বভাবতই বিষয় ও রীতি নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষার একটা অব্যাহত প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে।”অর্থাৎ তিনি নতুনত্বের আঙ্গিকে চিরায়িত ভাব-ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর কবিতায় একদিকে যেমন চিরন্তন বোধ-বিশ্বাসের পাশাপাশি সমকালীন বিচ্ছিন্নতা-বিষণ্ণতা-একাকীত্বের সুরটিও লক্ষ্য করা যায়। সেই সঙ্গে পাশ্চাত্যের খ্যাতনামা তাত্ত্বিক এবং সাহিত্যিকদের চিন্তাদর্শে অনুপ্রাণিত হন সমকালীন কবিরা; “বাংলায় অতিবুদ্ধিজীবীরা মধ্যে তখন ইয়েটস্‌, এলিয়ট, পাউণ্ডের প্রচণ্ড প্রভাব, বিশেষ করে এলিয়টের কবিতা ও গদ্য রচনাবলীর।’’

নাগরিক জীবনের কবি সমর সেন কাব্য-কবিতার জগত মধ্যবিত্ত শ্রেণির যাপনের মধ্যেই সীমায়িত। ভারতে ইস্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসন কায়েমের সূত্র ধরেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে উদ্ভূত আর্থ-সামাজিক সমস্যা মধ্যবিত্তের জীবনলাপকে সর্বাধিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পূর্বজ সাহিত্যিক কিংবা কবিদের থেকে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয় সমর সেনের সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটি। তাঁদের মতে, “বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি যে পীড়িত ও বিব্রত এটা... নতুন আবিষ্কার নয়, সকলেরই মর্মে মর্মে এ গ্লানিকর তথ্য জানা আছে। এবং এর তত্ত্বের  দিকটাও খুব অননুভূত বা অজ্ঞাত নয়, মূলত অর্থনৈতিক, কিন্তু এটা দাস দেশ বলে রাজনৈতিক দিকটারও উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক। কিন্তু এ সমস্তই জানা কথা। পুনরাবৃত্তি করা যে কেবল অনর্থক তাই নয়, বিরক্তিকরও।” অথচ সমর সেনের কলমে বারংবার আবর্তিত হয়েছে নাগরিক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব; “আমি  সাধারণ মধ্যবিত্ত, চালচুলো বজায়ের চেষ্ঠায় তাই আছি। আমার গণ্ডি সীমাবদ্ধ ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে, সে গণ্ডি কখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি।” পূর্বজ সাহিত্যিক কিংবা কবিদের থেকে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয় সমর সেনের সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটি। কাব্যিক আর্দশ হিসাবে তিনি এলিয়টের চিন্তা-চেতনাকে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মতে একজন ব্যক্তির জীবন-যাপনের নানান পর্যায় তার চেতনার বিকাশে সহায়তা করে। যার ফলে তার মনের উন্মীলন ঘটে; “জীবনধারার ছাপ চেতনা ও স্মৃতিশক্তিকে গড়ে, চেতনা নয়। অপর পক্ষে এটা পরে বলা হয়েছে যে, উপরিকাঠামোর প্রভাব জীবন-ধারার পরিবর্তনে সাহায্য করে। এটা যৌথজীবনে যতটা সম্ভব ব্যক্তিগত জীবনে ততটা নয়।’’

সমকালীনতার প্রতিধ্বনি সাহিত্য-সম্ভারের সঙ্গে সঙ্গে কাব্য-চর্চার প্রেক্ষাপটেও বিধৃত হয়েছে। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কয়েকটি কবিতা’ প্রকাশিত হয়পরবর্তীতে একে একে প্রকাশিত হয় অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলি। এই বিষয়ে আত্মজীবনীতে তিনি লেখেন; “আমার কবিতা রচনার আয়ু অবশ্য বারো বছর – ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত, অর্থাৎ আমার আঠারো থেকে তিরিশ বছর বয়স পর্যন্ত। প্রথম বই ‘কয়েকটি কবিতা’ বের করি ১৯৩৭-এ স্বর্ণপদক বেচে, উৎসর্গ করি মুজফ্‌ফ্‌র আহমেদকে তৎকালীন মধ্যবিত্ত জীবনের আর্থিক অনটনের ছবিটি যার মাধ্যমে আরো একটু সুস্পষ্ট হয়ে ধরা পরে পাঠকের কাছে। আকৈশোর কমিউনিস্ট ভাবধারার আদর্শে লালিত হয়েছে তাঁর মন ও মনন। যান্ত্রিকতার অতলে নিমজ্জমান মহানগরীর কঙ্কালসার চিত্র ধরা পড়েছে ‘নাগরিক’ শীর্ষক কবিতায়;

“ভস্ম অপমান শয্যা ছাড়ো

হে মহানগরী!

রুদ্ধশ্বাস রাত্রির শেষে

জ্বলন্ত আগুনের পাশে আমাদের প্রার্থনা,

সমাজ জীবনের অস্পষ্ট চকিত স্বপ্ন...’’দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে একদিকে যেমন কৃত্রিমতার অভিঘাত পরিলক্ষিত হয় অন্যদিকে মানবিক মূল্যবোধ থেকে আবেগ-অনুভূতিরও অবলুপ্তি লক্ষ্য করা যায়যুগগত এই দোদুল্যমান পরিস্থিতি বিধৃত হয়েছে কবির কলমে-

‘রাত নেই, দিন নেই, বারে বারে চমকে উঠি,

আমার মনে শান্তি নেই, আমার চোখে ঘুম নেই,

স্পন্দমান দিনগুলি আমার দুঃস্বপ্ন’’১১

সমকালীন অস্থিরতার সঙ্গে সঙ্গে কবিতার বিষয় বা প্রেক্ষিত বদলের দিকটিও উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরচিত ‘চিত্রা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘উবর্শী’ শীর্ষক কবিতায় স্বর্গবাসিনী অপ্সরা ‘অনন্তযৌবনা’, ‘বিশ্বপ্রেয়সী’ হিসাবে চিত্রিত হয়েছে; কবির কথায়—

“যুগযুগান্তর হতে তুমি শুধু বিশ্বের প্রেয়সী

হে অপূর্বশোভনা উর্বশী!

মুনিগণ ধ্যান ভাঙি দেয় পদে তপস্যার ফল,

তোমারি কটাক্ষঘাতে ত্রিভুবন যৌবনচঞ্চল,

তোমার মদির গন্ধ অন্ধবায়ু বহে চারি ভিতে,

মধুমত্তভৃঙ্গসম মুগ্ধ কবি ফিরে লুব্ধচিতে

উদ্দাম সংগীতে।

নূপুর গুঞ্জরি যাও আকুল-অঞ্চলা

বিদ্যুৎ-চঞ্চলা১২

সমর সেন বিরচিত ‘কয়েকটি কবিতা’ কাব্যসংকলনের অন্তর্গত ‘উর্বশী’ নামক কবিতায় ভিন্নধরনের ছবি প্রতিফলিত হয়। সময়-সমাজ-যুদ্ধের ঘনান্ধকার করাল গ্রাসে যেন ‘অন্তনযৌবনা’ অপ্সরাও আজ বিমর্ষ। যে একদিন ‘বিশ্বপ্রেয়সী’রূপে সকলের বন্দিতা ছিল আজ সে মধ্যবিত্তের কাছে ‘দিগন্তে দুরন্ত মেঘের মতো’ ভাসমান। সমকালীন তিক্ততায় আজ যেন সেই স্বর্গবাসিনী ‘ক্লান্ত’, বিষণ্ণতায় পরিবৃতা তাই কবি বলেছেন—

“তুমি কি আসবে আমাদের মধ্যবিত্ত রক্তে

দিগন্তে দুরন্ত মেঘের মতো!

কিংবা আমাদের ম্লান জীবনে তুমি কি আসবে,

হে ক্লান্ত উর্বশী,

চিত্তরঞ্জন সেবাসদনে যেমন বিষণ্ণমুখে

উর্বর মেয়েরা আসে

কত অতৃপ্ত রাত্রির ক্ষুধার ক্লান্তি,

কত দীর্ঘশ্বাস,

কত সবুজ সকাল তিক্ত রাত্রির মতো,

আর কত দিন!’’১৩

ক্রান্তিকালের অনুচ্চারিত ব্যবধানে ‘প্রেম’ যেন ‘পণ্য’-এর নামান্তর। যৌনতা তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। নাগরিক জীবনের দ্বন্দ্বময়তা থেকে সাময়িক সুখ খুঁজে নেওয়ার জন্য যুব সম্প্রদায়ের ভিড় বাড়তে থাকে নিষিদ্ধ পল্লীর অন্ধকারে;-

“নরম মাংস স্তূপে গভীর চিহ্ন এঁকে

নববর্ষের নাগরিক চলে গেল রিক্ত পথে,

বন্ধ্যা নারীর অন্ধকারে পৃথিবীকে রেখে১৪

দুই মহাযুদ্ধের মধ্যকালীন সময় সূচকে মানুষের জীবন-ধারণের অন্যতম অবিচ্ছেদ্য বিষয় হিসাবে নিঃসঙ্গতা, নিরাশা, নৈঃশব্দতা প্রকটিত হয়। শূন্যতার অন্ধকারে প্রকটিত ‘আমিত্ব’-এর হাহাকার, নৈঃশব্দতায় চাপা পড়ে যায়। তখন মানুষের সঙ্গী হয়ে ওঠে নীরবতা, একাকীত্ব; কবির ভাষায়-

“কেন তুমি বাইরে যাও স্তব্ধ রাত্রে

আমাকে একলা ফেলে?

কেন তুমি চেয়ে থাক ভাষাহীন, নিঃশব্দ পাথরের মতো?

আকাশে চাঁদ নেই, আকাশ অন্ধকার

বাতাসে গাছের পাতা নড়ে,

আর দেবদারু গাছের পিছনে তারাটি কাঁপে আর কাঁপে;

আমাকে কেন ছেড়ে যাও

মিলনের মুহূর্ত হতে বিরহের স্তব্ধতায়?’’১৫ 

এহেন যান্ত্রিকতা থেকে কবি স্বস্তি খুঁজে পান ‘বৃষ্টির আভাসে’ সিক্ত সাঁওতাল পরগণার সবুজাচ্ছন্ন পরিবেশে‘বণিক সভ্যতার শূন্য মরুভূমি’ দিয়ে হেঁটে চলা কবি ‘মেঘ-মদির আকাশে’ নতুনভাবে স্বপ্ন দেখার রসদ খুঁজে পান;--

“বৃষ্টির আভাসে করুণ পথে ধুলো উড়ছে,

এমন দিনে সে-ধুলো মনে শুধু আনে

সাঁওতাল পরগণার মেঘমদির আকাশ;

চারিদিকে আকাশ মেঘ-মদির

আর কিসের দীর্ঘশ্বাস-সাঁওতাল পরগণার নিঃসঙ্গ স্তব্ধতা”১৬

অথচ কালের প্রবাহমানতায় ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সভ্যতার উল্লাসে সেই ‘মেঘ-মদির’ আকাশ যেন ‘দুঃস্বপ্ন’-এর নামান্তর। সবুজে ঘেরা প্রকৃতির সৌন্দর্যময়তা যন্ত্রসভ্যতার লেলিহান শিখার গ্রাসে হারিয়ে গিয়েছে। তাই মহুয়া বনের ধার থেকে ছড়িয়ে পড়া ‘কয়লা খনির গভীর বিশাল শব্দ’ কবি ব্যথিত করে তোলে। শিশির সিক্ত সকালের ধুলোমাখা অবসন্ন খনি-শ্রমিকদের ‘ঘুমহীন চোখ’ যেন কবিকে আবারো বাস্তবের মাটিতে ফিরিয়ে আনে;--

“এখানে অসহ্য নিবিড় অন্ধকারে

মাঝে মাঝে শুনি

মহুয়ার বনের ধারে কয়লা খনির

গভীর, বিশাল শব্দ,

আর শিশির ভেজা সবুজ সকালে

অবসন্ন মানুষের শরীরে দেখি ধুলোর কলঙ্ক,

ঘুমহীন তাদের চোখে হানা দেয়

কিসের ক্লান্ত দুঃস্বপ্ন।”১৭

 ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতায় একদিকে যেমন স্বপ্নের হাতছানি রয়েছে অন্যদিকে রয়েছে স্বপ্নভঙ্গের বাস্তবতা। পরিবর্তিত সময়-সমাজে ধনতান্ত্রিকতার শোষণাগারে মধ্যবিত্ত জীবনের দুঃসহ ধূসরতা প্রকটিত হয়। কবি চিত্তে সেই অবক্ষয় ধরা পড়ে বাস্তবতার প্রগাড়তায়। কবি বুদ্ধদেব বসু তাই সমর সেনের কবিতা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন;- “নাগরিক জীবনের খণ্ড খণ্ড ছবি বা উল্লেখ কোনো কোনো আধুনিক কবিতে থাকলেও সমগ্রভাবে আধুনিক নগরজীবন সমর সেনের কবিতাতেই প্রথম ধরা পড়লো। সমর সেন শহরের কবি, কলকাতার কবি, আমাদের আজকালকার জীবনের সমস্ত বিচার বিক্ষোভ ও ক্লান্তির কবি।”১৮

আসলে মধ্যবিত্ত জীবন-যাপনের সব সীমায়িত ধ্যান-ধারণা সহ শ্রেণিগত দ্বিধা-যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে মার্ক্সীয় আদর্শেই প্রতিফলিত হয়েছে, তাই সমর সেনের কবিতা হয়ে উঠেছে নাগরিক জীবনের অন্যতম লেখচিত্র

 

তথ্যসূত্র;

1.    রায়চৌধুরী, গোপিকানাথ, ‘দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যকালীন বাংলা কথাসাহিত্য’, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১০

2.    তদেব, পৃ ১২

3.    ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ‘রবীন্দ্র-রচনাবলী(১২ খণ্ড)’, বিশ্বভারতী, কলকাতা, পৃ ৪৮০

4.    দাশ, জীবনানন্দ, ‘কবিতার কথা’, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃ ১০০

5.    সেন, সমর, ‘বাবু বৃত্তান্ত’, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃ ২৪

6.    কর্মকার, বৃন্দাবন, ‘সমর সেন; কবির জীবন ও কবিতায় জীবন’, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, পৃ ৭৭

7.    সেন, সমর, ‘বাবু বৃত্তান্ত’, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃ ২৫

8.    তদেব, পৃ ৯০

9.    তদেব, পৃ ২১

10. সেন, সমর, ‘কয়েকটি কবিতা’, সিগনেট প্রেস, কলকাতা, পৃ ২৮

11. তদেব, পৃ ২২

12. ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ‘চিত্রা’ বিশ্বভারতী, পৃ ৫৫

13. সেন, সমর, ‘কয়েকটি কবিতা’, সিগনেট প্রেস, কলকাতা, পৃ ৪০

14. তদেব, পৃ ২২

15. তদেব, পৃ ৫

16. তদেব, পৃ ১১

17. তদেব, পৃ ৩৫

18. আচার্য্য, ডঃ দেবেশকুমার, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস(আধুনিক যুগ), ইউনাইটেড বুক এজেন্সি, কলকাতা, পৃ ৩৩৫