কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / দ্বিতীয় সংখ্যা / ১২৯

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / দ্বিতীয় সংখ্যা / ১২৯

মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

শান্তিরঞ্জন চক্রবর্তী

 

সমকালীন ছোটগল্প


আবিষ্কার

ছন্দিতা বয়সের হিসাবে তরুণী। অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী সে তবে দেখে কেউ বলবে না ছন্দিতা স্কুলগার্ল। কলেজ না হলেও অন্তত এগারো বারো ক্লাসের ছাত্রী বলেই ভুল করে অনেকে।

রুদ্রদেব, ছন্দিতার সদ্যনিযুক্ত গৃহশিক্ষক। বয়স তারও কেউ আন্দাজ করতে পারে না। বয়স সে যা-ই হোক না কেন  সকলেই তাকে প্রায় পঁচিশের যুবক বলে মনে করে থাকে। গৃহশিক্ষক হিসাবে নামডাক আছে তার। ছন্দিতার বাবা বলেছিলেন তার বন্ধুকে একজন ভাল প্রাইভেট টিউটরের কথা। তিনিই যোগান দিয়েছেন রুদ্রকে। ছন্দিতার মায়ের পছন্দ ছিল কোন শিক্ষিকার। মেয়ের বাড়ন্ত চেহারার দিকে তাকালে মন দুরদুর করে ওঠে। পুরুষ শিক্ষক। তিনি তো আর পুরো সময়টা বসে পাহারা দিতে পারবেন না! উঠতি বয়সের মেয়ে। একটু ছলবলে। শিক্ষক হিসাবে যতই নামডাক থাক, বয়স যা-ই হোক না কেন, পুরুষ মানুষ তো! বইপত্র একটু ঘাঁটাঘাটি করলেই জানা যায় তারপর টি ভি মোবাইল তো আছেই। পুরুষ মানুষ আশি বছর বয়সেও আঠেরো কুড়ি বছরের বৌ নিয়ে হেসে খেলে ঘর করতে পারে।

রুদ্রদেবের সামনে পেছনে নেই কেউ। মেধাবী ছাত্র। পোষ্ট গ্র্যাজুয়েশনে প্রথম শ্রেণীর প্রমাণপত্র কব্জায় থাকা সত্ত্বেও চাকরীর চেষ্টা করেনি কখনো। সেই যে বাবা মারা যাবার পর ক্লাস ইলেভেনে ছাত্র পড়ানো শুরু করেছিল, তারপর থেকে বিদ্যাবৃদ্ধি আর বিদ্যাদান এই দুটি কাজ ছাড়া আর কিছু করার কথা মাথায়ই আসেনি তার। ছাত্র ছাত্রীর একের পর এক সাফল্য নেশাসক্তের মত তাকে বেঁধে রেখেছে  এই গৃহ শিক্ষকতার কর্মে। তা ছন্দিতার মায়ের ভয়টা কোথায়? এমন তো নয় যে রুদ্র’র কোন মেয়ে ছাত্রী নেই! নেই কি, আছে তো বটেই এবং সংখ্যাটাও এমন কিছু নগন্য নয়। ভাল পড়ায়, তা ছাড়া সচ্চরিত্রের মানুষ বলে যার পরিচয়, তার কাছে তো চোখ বুজে ছেড়ে দেওয়া যায় মেয়েদের। ছন্দিতার বাবা ঐ চরিত্রের কথাটি তুলতেই ফোঁস করে উঠেছিলেন ছন্দিতার মা। তার সেই পুরনো যুক্তি, আগুন আর ঘি-এর উদাহরণ। ছন্দিতা অবশ্য মায়ের উৎকন্ঠা, বাবার যুক্তি প্রদর্শন এসবের একবিন্দুও  জানতে পারেনি কখনও। কোন কোন পুরুষের দৈহিক গঠন এমনই যে দেখা মাত্রই মেয়েদের মনে কি একটা  আকাঙ্ক্ষা যেন জেগে ওঠে। ঠিক উল্টো করে ভাবলে অর্থাৎ ছেলেদের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। এখানে সম্পর্কের যুক্তি খাটে না কোন। ছন্দিতা আর রুদ্রদেব এমনই দু’জন নারী পুরুষ। তবে এত মেয়েদের যে পড়াচ্ছেন রুদ্র, এতদিনে কি এমন একজনও ছাত্রীর দেখা পাননি তিনি যাকে দেখে তার কৌমার্য প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে?

প্রথম দিন ছাত্রীকে দেখেই মনে মনে কেঁপে উঠলো রুদ্রদেব। এই মেয়ের চোখেই কি তার সর্বনাশ লেখা দেখল সে! না, হতে পারে না এমন। এতদিনের উপার্জিত সুনাম কিছুতেই খোয়াতে পারবে না রুদ্র। কেবল সুনাম কেন? সুনামের সঙ্গে সঙ্গে যে তার বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় গৃহ শিক্ষকতা, তাও যে হারাতে হবে তাকে! মানুষের চোখে দাগী  আসামীর মত বেঁচে থাকা সেও কি সম্ভব হবে তার  পক্ষে? হয় আত্মহত্যা, নয় জন্মস্থানের মায়া ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া। এর চেয়ে ভাল, কোনো  অজুহাতে এই টিউশানিটাই ছেড়ে দেবে সে। ছেড়ে তো দেবে, কিন্তু কোন অজুহাতে? প্রথম দিনেই এমন কিছু বলা যাবে না যা বিশ্বাস করাতে গিয়ে মিথ্যেবাদীর তকমা এঁটে যায় আবার। আজকের দিনটা অন্তত কাটাতেই হবে যে করেই হোক। ছন্দিতার বাবা মা দু’জনই এলেন স্যরের সঙ্গে আলাপ করতে। ছন্দিতার মা খুঁটিনাটি অনেক প্রশ্ন করলেন। জবাব দিয়ে গেল রুদ্র, কিন্তু প্রশ্নের ধরনে এমন কিছু খুঁজে পেল সে যাতে সে নিশ্চিত হল, মহিলার মনে ইতিমধ্যেই সন্দেহ দানা বেঁধেছে। এই সন্দেহ   এই পাহারাদারির বোঝা কাঁধে নিয়ে কি করে পড়াবে সে ছন্দিতাকে? মহিলা সোজা কথার মানুষ।  বলেই ফেলল সে, ‘আমার রান্নাঘরটা আবার এই ড্রইংরুমের পাশেই। কি করি বলুন, রাতের রান্নাটাও আমাকে করে ফেলতে হয় এ সময়েই’। রুদ্র বুঝল, কেন ছন্দিতার মা এ কথাগুলি বললেন। সময় বুঝে এই কারণটাকেই কাজে লাগাতে হবে, এমনই ভেবে রাখল রুদ্র।

সপ্তাহে তিনদিন পড়ানোর কথা। দু’দিন মাত্র পড়িয়েছে রুদ্র। এর মধ্যেই ছন্দিতার বাবার কাছে নালিশ চলে গেল, ‘এ কেমন মাস্টার? এ পড়াতে আসে, না তোমার মেয়ের সাথে গল্প করতে? পড়ার নামে অষ্টরম্ভা, সারা সময় তো কেবল, হাহা হিহি, এ মাস্টারকে তুমি ছাড়িয়ে দাও, কোন মেয়েমাস্টার নিয়ে এসো’। বাবার যুক্তি, পড়ানো শুরু করেছে মাত্র, এখনি কি বলে তাকে মানা করা যায়! ছন্দিতা ছিল পাশের ঘরেই। ঘরে ঢূকে জানিয়ে দিল রুদ্রস্যর ছাড়া আর কারো কাছেই পড়বে না সে। হাহা হিহি এমনি এমনি নয়, পড়াতে গিয়েই স্যর এমন সব উদাহরণ দেন যে না হেসে পারা যায় না। মা ক্ষেপে উঠে বললেন, ‘কোন কথা শুনতে চাই না আমি, বলেছি যখন, এ মাস্টার আর পড়াবে না তোমায়, পড়াবে না, ব্যস’। এমন চলতেই থাকে, বিশেষ্ করে যেদিন পড়াতে আসে রুদ্র। রুদ্র জানে না  ছন্দিতার মনের খবর।

রোজই ভাবে রুদ্র কি করে জানাবে যে তার পক্ষে ছন্দিতাকে পড়ানো সম্ভব নয়। আবার ছন্দিতার বাবাও ভাবছে কি উপায়ে মানা করবে সে। ঠিক এসময়েই ঘটল সে ঘটনাটি। ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন ছন্দিতার বাবা। হার্টের পেশেন্ট উনি। রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে একটি স্ট্রোক, আর সাথে সাথেই অসাড় হয়ে গেল শরীরের ডান দিকটা। এ ঘটনাটিকেই কাজে লাগাবে বলে মুখিয়ে থাকল ছন্দিতার মা। সেদিন পড়াতে এলেই তিনি বললেন রুদ্রকে, ছন্দিতার বাবার চিকিৎসার পেছনে অনেক খরচ। ডাক্তার, ফিজিওথেরাপি, ডাক্তার বললে আবার পেস মেকার বসানো, এত সব করে মেয়েকে প্রাইভেট পড়ানো  সম্ভব হবে না। তাই--!’ কথা শেষ হলো না। মাঝপথেই থেমে যেতে হল তাকে। রুদ্র বলল, ‘অমন করে বলছেন কেন? ভাল ছাত্রছাত্রী্র অসুবিধা থাকলে আমি এমনিতেই পড়িয়ে দিই, টাকা নিই না। ছন্দিতা এমনই একজন ছাত্রী। সে পরে কথা হবে, এখন বলুন তো আমি আর কিভাবে আপনার কাজে লাগতে পারি?’

টাকার অভাব নেই কিন্তু কাঠকাঠ কথা শোনানোর জন্যই ছন্দিতার মা পাড়ায় কারও প্রিয় হয়ে উঠতে পারেননি। এটাই হল কারণ যে এমন দুর্যোগেও তিনি কাউকে সঙ্গে পেলেন না। আঠেরো পূর্ণ হতেই বাবা বিয়ে দিয়ে দিলেন মেয়েকে। ছন্দিতার বাবা পাত্র হিসাবে ভালই। চাকুরে ছেলে। নিজের ঘরও আছে একটি। বিয়ের পর বছর ঘুরতেই ছন্দিতা। বাইরের কোন কাজে মাথা ঘামাতে হয়নি কখনো। অনভিজ্ঞ কোন মহিলার কাছে এই পরিস্থিতি তো অজানা নির্জন দ্বীপে হঠাৎ এসে পড়া কোন এক নাবিকের মত। রুদ্র’র কথা শুনে যেন কেমন একটা বল পেয়ে গেলেন মনে। বললেন, ‘আপনার জানা কোন ভাল স্নায়ুর ডাক্তার যদি থাকে!’ অত অত ছাত্র পড়ায় যে তাদের অভিভাবকদের মধ্যে কেবল স্নায়ুর ডাক্তার  কেন, খুঁজলে প্রায় সব রোগের ডাক্তারই পাওয়া সম্ভব। তাই হল। রুদ্র’র ব্যবস্থাপনায় ছন্দিতার বাবার চিকিৎসা শুরু হল, কিন্তু ডাক্তার বললেন, পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে সময় লাগবে। তা বলে রুদ্র তো  তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে পারে না! এবার রুদ্র ছন্দিতার মায়ের কাছে ছন্দিতাকে পড়ানোর অক্ষমতার কথা জানালো। ছন্দিতার মায়ের মনে তখন অন্য ভাবনা। এ ছেলে তো কেবল মাস্টার নয়, এর যে অনেক ক্ষমতা। একে হাতছাড়া করলে তো পরে পস্তাতে হবে! লোকটা বিছানায় পড়ে, কবে  সুস্থ হবে তার ঠিকানা নেই। আদৌ সুস্থ হবে কিনা তারও কি নিশ্চয়তা আছে কিছু? রুদ্র কথাটা পাড়তেই তিনি প্রবলভাবে মাথা নেড়ে তার আপত্তি জানালেন। বললেন, ‘কি বলছেন মাস্টারমশাই, আগে ছন্দিতার বাবা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠু্ক, তারপর না কথা হবে!’ ছন্দিতা দাঁড়িয়ে শুনছিল সব কথা। রুদ্র কথাটা পাড়তেই এমন এক মোহময় দৃষ্টিতে তাকালো ছন্দিতা যে পড়াতে পারবে না একথা সে একটু আগে নিজের মুখেই বলেছে বলে বিশ্বাস হল না তার।

রুদ্র’র মনে হল এ যেন সেই প্রেয়সীর চোখ যার জন্য যুগ যুগ অপেক্ষায় থাকা যায়। যেন বলা যায়, আমরা দু’জনে ভাসিয়া এসেছি যুগল প্রেমের স্রোতে, যেন বলা যায় তোমারেই যেন ভাল বাসিয়াছি  শত রূপে শত বার জীবনে জীবনে যুগে যুগে অনিবার’। রুদ্র’র মনে এক বিরাট প্রশ্ন, এইতো এতটুকু বয়স, এর মধ্যেই প্রেমের এমন ভাষা শিখলো কোথায় ছন্দিতা? বৈষ্ণব পদাবলীর অনুরাগ পূর্বরাগ সব যেন ওর চোখে একযোগে ভাষা পেয়েছে। এ অনুভূতি রুদ্র’র কাছেও নতুন। পড়া আর পড়ানো ছাড়া  জীবনের আর কোন দিক নিয়ে ভেবে দেখা হয়নি। এ যেন এক নতুন আবিষ্কার, যে আবিষ্কার মনকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সকল যুক্তি বুদ্ধির বাইরে কোন এক অজানা সমুদ্রসন্ধানে।

ছন্দিতার মা বললেন, ‘কি মাস্টারমশাই আমি যা বললাম ভেবে দেখলেন সে কথাটা?’ কোন সুদূরে  যেন হারিয়ে গিয়েছিল রুদ্র’র মন! যেন সেখান থেকেই জবাব দিল সে, ‘ভেবে দেখবো’। ‘ঠিক আছে’, বলে ছন্দিতার বাবার ডাকে সেদিকে চলে গেলেন ছন্দিতার মা। অপ্রস্তুত দেখালো রুদ্রকে। স্বগত সংলাপের মত বলল যেন, ‘আমি আসি।‘

দরজার বাইরে পা রেখেছে রুদ্র। পেছনে সন্তর্পণে এসে দাঁড়ালো ছন্দিতা। বলল  অস্ফূটে, ‘আসবেন তো  স্যর?’ ‘আমাকে যে আসতেই হবে, ছন্দিতা’, বলে দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেল রুদ্র ছন্দিতার দৃষ্টির  বাইরে।

কি এক অনন্য অনুভূতির উচ্ছ্বাসে কোথায় যেন ভেসে গেল ছন্দিতা।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন