প্রতিবেশী সাহিত্য
অরুণচন্দ্র রায়ের গল্প
(অনুবাদ : মিতা দাশ)
গল্পকার
পরিচিতিঃ জন্ম - ১৯৭৪, দারভাঙ্গা, বিহার। গৃহ মন্ত্রালয়ে এসিস্টেন্ট ডাইরেক্টর।
ইতিমধ্যে
দুটি
কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।
ভয়
রাত দশটা বাজে। আমি টিভি দেখছি। পর্দায় ক্রিকেট ম্যাচ চলছে। ভাষ্যকার জোরে চিৎকার করছেন। চিয়ারগার্ল নাচছে, চলছে স্টেডিয়ামে মানুষের উন্মাদনা। স্টেডিয়াম পরিপূর্ণ। পর্দায় ক্লোজ-আপে বিভিন্ন ধরনের মুখ দেখানো হচ্ছে। ক্যামেরা কয়েকবার বুকের দিকে ফোকাস করে থেমে যায়। আমার মনে হচ্ছে ক্রিকেট বল এখনই বেরিয়ে এসে আমার মাথা ভেঙ্গে যাবে। আমি ঘামতে শুরু করি। আমি শীতকালে গরম অনুভব করতে শুরু করি। আমি আমার সোয়েটার খুলে ফেলি। আমি সোফায় দেহ প্রসারিত করে অনেক কষ্টে দেহের ঘাম সহ্য করি। আমি চ্যানেল বদল করি, কিন্তু ক্রিকেট বল আমাকে ছাড়ে না। সে ক্রমাগত আমার বুকে পাঞ্চ মারছে, কখনো ইয়র্কের মতো আবার কখনো বাউন্সারের মতো।
এটি একটি নতুন চ্যানেল। কোনো কোনো মহাত্মা রাত দশটায় ধর্মোপদেশ দিচ্ছেন। আমি ভুলেই গেছি যে, এ কেমন রেকর্ডিং হাজার হাজার মানুষ মহাত্মার সামনে দাঁড়িয়ে উপদেশ শুনছে? মহাত্মা ভগবানের প্রশংসা করছেন। মাঝে সুন্দর গান বাজছে। মহাত্মা নাচতে শুরু করেন। ভক্তরাও নাচতে থাকে। এর মাঝে কিছু স্বেচ্ছাসেবক টাইপের মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পশু তাড়ানোর জন্য তার হাতে একটি লাঠি রয়েছে। তারা ব্যবস্থার দেখভাল করছে। তাদের রব যে দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন তার শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তারা লাঠি রেখেছে। বৈঠকে অনেক শান্তি আর প্যান্ডেলের জাঁকজমক দেখার মতো। হঠাৎ মনে হল প্যান্ডেলে গান বেজে উঠেছে। আমি টিভি মিউট করেছি। কিন্তু গানের আওয়াজ বাড়ছে। আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। নিঃশব্দ টিভি থেকে শব্দ আসছে। আমি টিভি বন্ধ করে দিয়েছি কিন্তু তারপরও গানের আওয়াজ আমার কানের পর্দা ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমি আমার কান বন্ধ করার চেষ্টা করছি কিন্তু ব্যর্থ। আমি আবার ঘামতে শুরু করেছি। আমি আমার শার্ট খুলে ফেলে দিয়েছি। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। রাত গভীর হয়েছে।
ঘর থেকে বের হয়েছি শুধু আমার জ্যাকেট পরে। আমার কলোনীর সিকিউরিটি গার্ড জেগে আছে। শীতকালে, যখন বাইরের তাপমাত্রা খুব কম থাকে, তখনও আমি তাকে একটি জামা গায়ে দেয়া দেখে অবাক হই না। মাত্র কয়েকটা গাড়ি কলোনিতে ঢুকেছে। তারা আমাকে জ্যাকেটের মধ্যে দেখেছে। কিন্তু ওরা ও কিছু বলল না। আমার মনে হয় এখানে কেউ কিছু বলে না, এক পক্ষে ভালো। তখন আমি ভাবি আমার ফ্রিজে কী আছে, আমার রান্নাঘরে কি রান্না হয়েছে?
কিছু মানুষ কিভাবে জানতে পারে? এই কথা ভাবতেই আমার মনে হয় যেন একটা বাউন্সার বল আমার কানে লেগেছে। শব্দটি সিনেমায় গুলি চালানোর মতো ছিল। আমি বল এড়িয়ে যেতেই আমার কানে উচ্চস্বরে মহাত্মার সভার সঙ্গীত বাজতে থাকে।
আমি সচেতন কি না ঠিক করতে পারছি না কিন্তু মনে হয় অনেক দূর চলে গেছি হাঁটতে হাঁটতে। রাস্তার আলোতে ফুটবল খেলছে কিছু শিশু। আমাকে আসতে দেখে ওরা থামে। বাচ্চাদের খেলা দেখাও বন্ধ করে দিয়েছি। বাচ্চারা আমার রাস্তা পার হওয়ার জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। কিন্তু আমাকে থামতে দেখে তারা আবার খেলতে চলে যায়। বন্ধ দোকানের সিঁড়িতে বসে আছি। অনেকক্ষণ ধরে বাচ্চাদের খেলা দেখছি, শিশুরা ক্লান্ত। ভাঙা পাইপে মুখ দিয়ে এক এক করে জল পান করছে তারা। ভাঙ্গা কলের জল খেয়ে ওরা অসুস্থ হয়ে পড়বে এই চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। বাচ্চারা হয়তো ভাবছে আমি পাগল। তারা তাদের খেলা বন্ধ করে বন্ধ দোকানের সামনে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেখানে কিছু কুকুর ও ঘেউ ঘেউ করছে। হয়তো এটাই তার রুটিন। এমনকি কুকুর গুলো একপাশে ঘুমিয়েছে। বাচ্চারাও ঘুমিয়েছে। আলো ম্লান হয়ে গেছে। কুয়াশাও ঘন হচ্ছে। মাত্র কয়েকটি রাস্তার বাতি জ্বলছে। কুয়াশায় হলুদ আলো আরও অসুস্থ দেখায়।
আমি বাড়ি ফিরতে শুরু করি। ঘুরতে গেলেই মনে হয় দ্রুতগামী একটি গাড়ি বাচ্চাদের পিষে দিয়েছে। শিশু এবং কুকুর সব ব্যর্থ হয়েছে। মিডিয়ার গাড়ি এসেছে। টিভিতে বড় শিরোনাম আসছে: গাড়ির ধাক্কায় তিন শিশু পিষ্ট হয়েছে। কে দেবে বিচার? আমার মনে হয় এই বাচ্চাগুলো যখন ঘুমাতে যাচ্ছে, কেন আমি তাদের বাড়িতে নিয়ে আসিনি। সে যদি ওদের নিজের বাড়িতে নিয়ে আসতো তবে এই শিশুরা গাড়ির নিচে মাড়িয়ে যেত না। আমি অপরাধবোধে ভরা, আমার পা উঠছে না। আমি পিছনে ফিরে তাকানোর সাহস জোগাড় করার চেষ্টা করছি। আমি ঘামে ভিজে জেগে উঠি। কিন্তু এই ঘামে কোনো আঠালোতা নেই। অনেকক্ষণ নড়াচড়াও করতে পারিনি। আবারও সাহস করে পেছন ফিরে তাকালাম। আমি দেখছি শিশু এবং কুকুর শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। তারা গভীর ঘুমে মগ্ন। এইমাত্র একটি গাড়ি দ্রুত চলে গেল কিন্তু বাচ্চারা নড়ল না। বাচ্চা কুকুরের মতো ঘুমাতে চাইলে ও ঘুমাতে পারি না। ফাঁপা ঘুমন্ত আমি বাড়ির দিকে ফিরি। ঘরটা খোলা রেখেছিল। হয়তো মাঝখানে বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিলো। এখন আলো এসেছে। আমি টিভি বন্ধ করতে ভুলে গেছি। টিভি চালু আছে কিন্তু কোন চ্যানেল আসছে না। রঙের ছোট বল পর্দায় ঝিকিমিকি করছে। আমি এই রঙিন বলগুলো যেকোনো চ্যানেলের চেয়ে ভালো পছন্দ করি। আমি পর্দার দিকে তাকাতে শুরু করি। এই বলগুলো দিয়ে কখনো সূর্য কখনো চাঁদ বানাই। সবুজ বৃত্ত নির্বাচন করে গাছের পাতা তৈরি করেছি। এই পাতাগুলো কাঁপছে। রঙিন বল বাতাসে ভাসছে। আমি এই গোলগুলো ধরতে দৌড়াচ্ছি। ফুটবলের পিছনে ছুটে চলা সেই বাচ্চাদের মত হাঁড়িতে ফুলের উপর বসে আছে। ফুল হাসতে শুরু করেছে। তারপর ক্রিকেট বল দ্রুত আসে এবং টিভির পর্দা ভেঙ্গে যায়। ফুল থেকে প্রজাপতি উড়ে যায়। শিশুদের ফুটবল ধূসর হয়ে যাচ্ছে। গাছের পাতা কালো হতে থাকে । রঙিন বলের বদলে আবার বাতাসে ভাসতে শুরু করেছে রঙিন কণা। আমি আবার ঘামে ভরে গেছি।
ঘড়ির দিকে তাকালেই লক্ষ্য করি তারিখ বদলে গেছে। কিন্তু ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালে মনে হয় সব নিশ্চুপ। ক্যালেন্ডারে তারিখ পরিবর্তনের কোনো রোমাঞ্চ নেই। এমনকি সংবাদপত্রের ছেলেও তারিখ পরিবর্তনে রোমাঞ্চিত হয় না। খবরের কাগজের ছেলে সকালে আসবে। আমি তার জন্য তারিখ, দিন এবং মাসের অর্থ খুঁজে বের করার ব্যর্থ চেষ্টা করি। তার কোন মানে হয় না। তাঁর কাছে গান্ধীজীর জন্মদিন এবং তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী একই জিনিস। তৃতীয় এবং চতুর্থ তলা পর্যন্ত অবিচলিত হাতে সংবাদপত্র ছুঁড়ে দেওয়া।
তৃতীয় তলায় তিনি তিনটি খবরের কাগজ এমনভাবে ফেলে দেয় যাতে বারান্দায় রাখা পাত্রের গাছগুলো ভেঙে না যায়। এর জন্য অনেকবার লোকে তাকে তিরস্কার করতে শুনেছি। কি অটল হাত তার। ছেলেটার নাম জানি না। আমি কখনো তাকে তার নাম জিজ্ঞেস করিনি।
সে সবসময় লাল রেঞ্জের টি-শার্ট পরে। এতে পত্রিকার নাম ও লোগো ছাপা । গত রাতে, পৃষ্ঠা 35 ও লাড্ডির নাম এবং লোগো সম্বলিত টি-শার্ট পরে ছিল। তার টি-শার্টের সামনে এবং পিছনে সর্বত্র নাম এবং লোগো লেখা ছিল। নিযুক্ত ছিল। কেউ একজন আমাকে বলেছিল যে এই নামের কারণে তারা ক্রিকেট খেলে। কিন্তু এই সংবাদপত্র ছেলেটি এসব নামের কারণে সংবাদপত্র বিতরণ করে না। তাকে তার অসম্পূর্ণ পড়াশোনা শেষ করতে হবে এবং তার ভাইকে পড়াতে হবে।
আমি রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় আসি। এখান থেকে সামান্য আকাশ দেখা যায়। আকাশ দেখা যায় কিন্তু তারা দেখা যায় না। কলোনীর আলো আরও ম্লান হয়ে গেছে। কুয়াশা আরও বেড়েছে। দূর থেকে ভেসে আসছে ধীরে ধীরে যানবাহনের শব্দ। আমি জানি এখানে সম্পূর্ণ নির্জনতা নেই। কিছু মানুষ, কোনো না কোনো কারণে, কোনো না কোনো উপায়ে নির্জনতা ভাঙে বা ভাঙতে চায়। তারা একাকীত্ব পছন্দ করে না। যখন সবাই একা।
শিশুরা শোবার ঘরে ঘুমাচ্ছে। আর একা। বউ ঘুমাচ্ছে। সে একা। কিন্তু তাদের জন্য নির্জনতা কোথায়? এটা ঠিক গতকাল যখন আমি আমার ছেলেকে স্কুলে নামাতে স্কুটারে যাচ্ছিলাম। ছেলেটা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিল। আমার বাড়ন্ত পেটের কারণে, তার ছোট হাতগুলি তার কাছে পুরোপুরি পৌঁছাতে পারছে না। তার পিঠে একটি ভারী ব্যাগ বাঁধা ছিল। আমিও বললাম ব্যাগটা খুলে আমাকে দে আমি সামনে রাখব। কিন্তু সে ব্যাগের সাথে এতটাই সংযুক্ত ছিল যে সে অস্বীকার করল । সে সমস্ত বিশ্বের জিনিস গুলি তার ব্যাগে রাখে , যাতে কিছু ভুলে না যায় বা পিছনে ফেলে না আসে । জানতে চাইলে সে বলে, আজকাল বিজ্ঞানে ‘বন’ অধ্যায় চলছে। আমার কথা শুনে সে জোরে হেসে উঠল যখন আমি বললাম ফরেস্ট পড়তে বই লাগবে কেন ? পথে পার্কের সামনে থামলাম এবং তাকে কিছু গাছ-গাছালির পরিচয় করিয়ে দিলাম। কিন্তু স্কুলে যেতে দেরি হয়ে গেল। আমি তাকে যথাসময়ে স্কুলে পৌঁছাতে বাধ্য করি। ছেলেকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে ফেরার সময় আমি একা ছিলাম। হঠাৎ মনে হল আমার ছেলের স্কুল ব্যাগ আমার পিঠে ঝুলছে। হঠাৎ স্কুল ব্যাগের সাইজ বাড়তে থাকে। বইগুলো ব্যাগ থেকে বের হয়ে ছটফট করতে থাকে। কপি গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বই থেকে চিঠিগুলো বেরিয়ে এসে আমার কপালে মাছির মতো গুঞ্জন শুরু করল এবং আমি দ্রুত ব্রেক লাগালাম। চুলগুলো বাকি ছিল। পেছন থেকে আসা একটি গাড়ি আমাকে ধাক্কা দেয়।
আমি তখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। চাঁদ দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলো স্ট্রিট লাইটের হলুদভাব কমিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো বৈদ্যুতিক খুঁটি থেকে তারগুলো বেরিয়ে এসে আমার সারা শরীরে জড়িয়ে যাচ্ছে। চারদিক থেকে বিদ্যুতের তার আসতে শুরু করেছে, ইন্টারনেট, টেলিফোন, টিভির তার চারদিক থেকে আমাকে ঘিরে রেখেছে। স্পেশাল ইফেক্টের মতো, ওয়াইফাই থেকে অপটিক্যাল ফাইবারের বৃত্ত, মোবাইল টাওয়ার আর কোথায় যেন আমাকে জড়িয়ে ধরছে কে জানে। আমার পা নড়তে পারছে না, হাত বাঁধা। কিছু তার, যেগুলো বেতার, আমার নাক দিয়ে আমার উইন্ড পাইপ প্রবেশ করেছে। একটি তার আমার হৃৎপিণ্ডে বিদ্ধ হয়েছে এবং দ্রুত ধমনী দিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি পালানোর জন্য চাপ দিই। আমি যত জোরে ধাক্কা মারব ততই বেঁধে যাব। শুধু ধমনীর মাধ্যমে দ্রুত সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি পালানোর জন্য চাপ দিই। যতই ধাক্কা মারছে , ততই বেঁধেছি। শুধু তাই নয়, এই তারের সাথে সাথে আমার সামনে অগণিত ক্রিকেট বল দ্রুত গতিতে চলে আসছে, আমার কানে উচ্চস্বরে মহাত্মার সঙ্গীত বাজছে, বিভিন্ন ধরনের যানবাহন আমাকে পদদলিত করতে আসছে। মনে হচ্ছে আমার আর শক্তি নেই। আমি নিজেকে শেষবারের মতো ধাক্কা দিয়ে বারান্দা থেকে লাফ দিলাম। একটা বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই শব্দে আশেপাশের কেউ জেগে ওঠে।
সে তার বিভিন্ন গ্রুপে বার্তা পাঠায়, "শর্তাবলী ভোর চারটায় " এবং আপডেটের জন্য অপেক্ষা করতে - করতে সে টিভি চালু করে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন