কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / দ্বিতীয় সংখ্যা / ১২৯

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / দ্বিতীয় সংখ্যা / ১২৯

মঙ্গলবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৫

ময়ূরী মিত্র

 

ব্যক্তিগত গদ্য

সুখতারা

 


ছেলেবেলা - আমার বেলার শুরু ৷ থাকতাম  বেলগাছিয়ার একটি ভাড়াবাড়িতে ৷ সে বাড়ির চারতলায় বড়  দুটো ছাদ ৷  ঠিক মাঝে একটি ছোট চিলেকোঠার ঘর৷ তাতে ভাড়া থাকতেন একটি বিহারী পরিবার৷ এই পরিবারের ছেলেগুলোই ছিল আমার খেলার সাথী৷ বয়সে কয়েকটা আমার থেকে বড়ই হবে৷ কিন্তু বাঁদরামি করব,  মন করলেই কেমন একটা সমভাব চলে আসত ৷ কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে প্রচুর শ্রম আর মেধায় নতুন নতুন বাঁদরামির খোঁজ চালাতাম ৷

ঠিক হল -  ছাদে আমাদের পোষা খরগোশের বার্থডে পার্টি করা হবে ৷ বার্থ ডে হিসেবে ধরা হল / কোনো এক মাসের প্রথম রবিবারকে৷ দুটো কারণ৷ ঐদিন ভাড়াটে গৃহস্থদের হাতে বাড়তি টাকা থাকবে এবং ঐদিন পুরুষরা বাড়িতেও থাকবেন ৷ ফলে ঢের বেশি চাঁদা আদায় হবে৷ মিষ্টান্ন খাওয়াব, কথা দিয়ে তখনকার দিনে ফ্ল্যাট প্রতি দশ কুড়িটাকা আদায় করলাম৷

রাতের অনুষ্ঠানে  প্রথমে আমার একক নৃত্য ৷ দর্শক কেবল ঐ ছেলেগুলো ৷  গোল চোখে দেখছে তারা আমাকে৷ মেমজামা পরে নাচ্ছি আর গাংফড়িং এর রঙ্গে গান ধরেছি -- মিশনারি স্কুল থেকে শেখা সাহেবমেম গান৷ সেসময় খ্রিস্টানদের প্রার্থনা সঙ্গীতের নাম দিয়েছিলাম সাহেবমেম গান ৷ মারাত্বক  টালেন্ট তখন আমার ৷ দেখে বিহারী বন্ধুর দল তাদের দেশোয়ালি রেসিপিতে নিজেরাই বানিয়ে ফেলল বার্থডে ডিনার৷  রুটি, পাতাহীন পালংশাক (পাতা খরগোশে আগেই খেয়ে রেখেছিল) গোল আলুর মরিচ ঝাল, মাংসকিমার ফুলঝুরি ৷ চচ্চড়ি জাতীয় কিছু দেখলেই প্রাণের আনন্দে বলতাম ফুলঝুড়ি ৷ আসলে  কম হওয়ায় পুরো কিমাটা ছ্যারাব্যারা হয়ে ফুলঝুরি থেকে খসে পড়া তারাফুল হয়ে যাচ্ছিল ৷ বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না নিশ্চয়, এই ফুলঝুরি ডিনারের খরচ জুগিয়েছিল ফ্ল্যাটের দশ ভাড়াটে ! রাত অব্দি আমার মিষ্টান্নের অপেক্ষায় থেকে একসময় ঘুমোতেও গিয়েছিল৷

আর আমি? সেরাতে ঐ অবাঙালি, পরীক্ষায় ফেল করা ছেলেগুলোকে প্রাণ ঢেলে ভালোবেসে ফেলেছিলাম৷  ঠিক করেছিলাম, এবার থেকে ফেলই হবে আমার মোক্ষ ৷ ফেল না করলে তো ওদের ছেড়ে এগিয়ে যেতে হবে আমায়৷ ভালোবাসতে বাসতে এমন একটা দশা হল, যে ওদের ছেড়ে একফোঁটাও এগোতে চাইতাম না আমি৷ চিটে গুড়ের মতো লেগে থাকতাম ওদের সাবান না ঘষা গায়ে ৷ তখন আমার ডেইলি রুটিন -- দুপুরবেলা ওদের ময়লা বিছানায় শুয়ে একই তালে ঠ্যাং নাচানো ৷ বিকেল গড়িয়ে যেত বিহারী রাজা রানীর প্রেমগল্প শুনতে শুনতে৷

ছাদ জুড়ে বৈশাখী ঝড়৷

হাতদুটোকে দুপাশে বেশ করে ছড়িয়ে দৌড়তাম একটি গোলাকার বৃত্তে -- খুঁতহীন রাউন্ড শেপে ৷  কী ভীষণ ভয়! পাশাপাশি দৌড়োতে গেলে যদি হাতগুলো ছুটে যায় দিকবিদিক৷ যদি তাতে ধাক্কা খেয়ে পিছনে থেকে যায় ওরা! চারটের মধ্যে কে যে আমার বেশি পছন্দের ছিল, আজ জিজ্ঞেস করলে বলতে পারব না৷ তারা আমার একদঙ্গল প্রাণসখা আর তাদের মাঝে এক বেলাজ ভূতনী৷ আমার সেই একদঙ্গল সখা,  পুরুষ নিয়ে আমার জল্পনা আমার লাজশরমের শেষ ঘটিয়ে দিয়েছিল ৷ পুরুষ এল মানুষ হয়ে ৷ নিলামও মানুষ ভেবেই ৷

সখা-সখী দেখার নেশাটা এই সময় থেকেই কি আমার মধ্যে ডালপালা ছড়িয়েছিল? মনে করতে পারি নে তো ৷ তবে নেশাটা যবে টের পেলাম, ততদিনে সে নেশা ব্যপ্ত করেছে আমার ভুবনসংসার ৷ রোগা সখা - জীর্ণ সখী - জয়ী সখা - হিংস্র সখী -- কত কীই না খুঁজে পেতে তখন ঝোলায় ভরি ৷ ঝোঁক হল সার্কাস পার্টির সংসার দেখার ৷ ছাউনির আড়ালে তা সবসময় গোপন কিনা! না ফোটা বুক আমার তোলপাড় হত -- দিনে তাদের দেখতে না পেয়ে ৷ খালি মনে হত -- আমার অগোচরে টিনের দেওয়ালের ওপাশে কত সখার সঙ্গে কত সখীর অহরহ বন্ধুত্ব হয়ে চলেছে রে! শুধু আমি তাদের সে বন্ধুত্ব দেখতে পাচ্ছি না ৷  শীতকাল ভর বেলগাছিয়ার মাঠ জুড়ে সার্কাস বসত ৷ শীতের ছুটিতে ঠিক দশটা নাগাদ এক ঠোঙা বাদাম ভাজা নিয়ে টিনের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে দেখতাম - রাতের রঙ মাখা দেবদূতেরা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে রয়েছে রোদে! আমাদের মতো করে রাঁধছে - বড় গরাসে খাবার তুলছে৷ থুপিয়ে কাপড় কাচ্ছে – আবার শুকিয়ে পাট পাট করে তুলছে ঘরে!

সার্কাসের বর বউয়ের সংসার দেখে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছি -- ঠিক তখনই একটা পরিবার আমাকে টানটান উত্তেজনা দিল ৷ বর বউ দুজনেই একই খেলা দেখায় - আর  বউটা বরের চোখের সামনেই     ঐ সার্কাসের এক অন্য পুরুষ নিয়ে ঘোরে ৷ বেশ  মজা রে! বর এজন্য দৈনিক বউকে ঠেঙ্গায় - ফের সন্ধ্যেবেলা তিনজনে মিলে খেলা দেখায় ৷ অবাক লাগত - মার খেয়ে বউটার শরীর আরো লকলক করে - চোখে হাসি আরো হাসি ঝিলিক পাড়ে ৷ মাসের পর মাস ঐ মাঠে আস্তানা বেঁধে থাকায় বউয়ের সঙ্গে ততদিনে বেশ ভাব হয়ে গ্যাছে আমার। চেপে ধরতেই বললে - বরের কাছে দর পেতেই সে নাকি দুনম্বর লোকটার সঙ্গে প্রেমের গল্প ফেঁদেছে ৷ বর যখন এই কারণে তাকে মাটিতে ঠেসে ধরে - বেশ লাগে নাকি তার!  মনে আছে, সেবার সার্কাস উঠে যাবার আগের রাতে এসব বলতে বলতেই নিটোল কোমরটা একপাক ঘুরিয়ে খেলা দেখাতে চলে গিয়েছিল মেয়েটি ৷ পাশে সে -- সেইই -- সে সন্ধেতে আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম, বরের লাগামহীন মহব্বত পেতে বিয়ের পরদিনই খুঁজে নেব একটি সুঠাম হাসকুটে  গুন্ডা। শুনে মায়ের মার থামছিল না ৷ থামছিল না আধঘুমে আমার শিউরে ওঠা ৷ ধূসর হয়েছে সে সাধ ৷

ফুরোয়নি মানুষের পদ্মবুক খোঁজা ৷


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন