ধারাবাহিক উপন্যাস
দ্য ক্লাউড
(দশম
পর্ব)
কবরখানা মাঠের ওপর অদ্ভুত জাদুময় শিশিরবিন্দু। হৈমন্তী সূর্যের আলো মেখে বিন্দুগুলি চিকচিক করছে। চারিদিকে পরিপাটি হয়ে ভীষণ নিয়মানুবর্তিতা মেনে কবরের শীতল শয্যাগুলো লাইন বরাবর। যেন মৃত্যুর পরে-ও অনেক জনগোষ্ঠীর শাখা এক-একটা লাইনে পরপর সহাবস্থান করছে। তাঁদের সুখদুখমাখা নিয়ত চলন যেন আগের মতোই। নিয়মানুবর্তিতা মেনে তৈরি সেইসব সমাধিস্থল ছবি হয়ে যাচ্ছে উৎপল চিত্রকরের ক্যানভাসে।
মনিরত্না ভরদ্বাজ ফিরলো বুঝি বা
তাঁর অতীতে। শরীর না থাকলেও মনে মনে মরিয়া সে। দেখার অদম্য আগ্রহের শেষ লক্ষ্য ওই কবরখানার
মাঠ। জাতি রীতি অনুযায়ী সাদা ফেইজ টুপি পরিহিত কিছু জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে আসতে দেখছে সে।
কী যে হয়, এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে! আনন্দ বা নিমচাঁদ, এঁরা কেউই নেই ধারেকাছে।
অতটা উপর থেকে মাটি খোঁড়া, সমাধি
দেওয়া দেখতে দেখতে চোখদুটো ধরে এলো মনিরত্নার। আধো ঘুম আর আধো জাগরণের মধ্যে সে দেখতে
পেলো, কবরখানা মাঠের মধ্য থেকে এক অনাবৃত কুহকজাল ভেদ করা অশরীরী পুরুষ ছায়া তার সামনে। 'আম্মা' খেতে দাও - এই ডাকে পৃথিবীর
কোন মাতৃজাতির না হৃদয় টাল খেয়ে যায়?
নিমচাঁদ গতকালই বলছিল, এই অঞ্চলের
বাতাস ভীষণ দূষণের কারণে কোনো কিছুই আর ভালো লাগছে না। রান্না করা খাবার কতো যত্নে
পরিবেশন করে মনিরত্না। অথচ দূষিত বাতাসে তৈরি খাদ্য তাঁর কাছে অখাদ্য বলেই মনে হচ্ছে।
আনন্দকে বলতে শোনা গেলো, আমি বইপত্রে দেখেছি, এই দেশ ছাড়িয়ে বহু দূরে রোম বলে এক দেশ
আছে। সেখানে ভ্যাটিকান সিটিতে দু'শো ছাব্বিশতম পোপ ফ্রান্সিস বাস করেন। পোপতান্ত্রিক
সমাজব্যবস্থায় বৃদ্ধ পোপের আশীর্বাদক্রমে আমাদের সকল পাপ ধৌত হয়ে পুণ্যে পরিণত হবে।
আরও শুনছিলো মনিরত্না নিমচাঁদ আর আনন্দের কথোপকথন থেকে। ভগবান যীশু যখন স্বর্গ যাত্রা থেকে বারবার ফিরে ফিরে আসেন মর্ত্যে, তখন নাকি স্বর্গের
চাবি এই পোপের ওপরই তিনি নস্ত্য করেন।
ঘুম জড়ানো চোখে মনিরত্না এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে, একথা সে আগে কখনও ভাবেনি। এক সুঠাম যুবক তার গৃহস্থালির মধ্যে এসে তাকে মা সম্বোধন করে খেতে দিতে বলছে।
মনিরত্না এতক্ষণে অনেকটা প্রকৃতিস্থ
হয়েছে।যুবক বলছে, আম্মা-র পিছু ডাক - বাবলু, ভাত বেড়েছি। খেয়ে যা। আমি না খেয়ে মোটরসাইকেল
নিয়ে বেড়িয়ে গেলাম। রাস্তায়-রাস্তায় ভীড়। বহুজাতিক দেশে এ কিসের গন্ডগোল! চারিদিকে
ধ্বজাধারী আর নামাজধারীদের বচসারত অবস্থার চক্রবুহ্যে আমি যেনো এক অভিমন্যু। বোমা এসে
লাগলো আমার বাঁ বুকে। কিছু বুঝে উঠবার আগেই আমি আমার থেকে বেড়িয়ে শূন্য হয়ে গেলাম।
মহাকাশের রকমসকম মহাকাশচারীরাই বোঝেন। সে হিসেবে আনন্দ, নিমচাঁদ, এরা সব মহাকাশচারী। মহাকাশ কারও বাপের একার নয়, একথা ওরা বোঝে। আর শরীর বিহীন এইসব আত্মাদের তাই কোনো পাসপোর্টেরও বালাই নেই। সুনীল আকাশে বিচরণরত দুই পারলৌকিক আত্মা ভ্যাটিকান সিটিতে মহান পোপের কাছে পৌঁছে গেলো। পোপ বা পাপ্পার দরবারে ঝড় উঠলো। পোপ ফ্রান্সিস বললেন, হে তৃতীয় বিশ্বের ঝড়ের বেগ, তোমরা থামো। প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বের পরে তোমাদের বিশ্বে শিক্ষার আলো পরেছে। তাই দুঃখের আলোর খেলাও তোমাদের মানতে হবে। কিন্তু তবুও আমি আশীর্বাদ করি, তোমাদের চৈতন্য হউক। আনন্দ পোপের আশীর্বাদ পেয়ে নিজেকে ধন্য হওয়ার গল্প করছে মনিরত্নার কাছে। মনিরত্নাও অপলকভাবে তাকিয়ে ওদের মুখ থেকে শুনছে মুক্তির বার্তা।
বাবলুকে খেতে দিয়েছে বাবলুর পরলোকের
আরও এক মা মনিরত্না। তাঁর হাতে হাওয়া মহলের কারুকার্য শোভিত পাখা। মনিরত্না বাবলুর
মাথায় পাখা নাড়ছে। বাতাসের ময়দা দিয়ে ধবধবে সাদা লুচি আর হাওয়া আলুর হিং-এর দম। বাবলুর
পরলোকে এইবার বুঝি একটু একটু করে ধাতস্থ হয়ে ওঠার সময় হয়েছে। মনিরত্না জিজ্ঞেস করলো,
নাম কি তোমার? বাবলু বললো, জাহাঙ্গীর আলম বাবলু...
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন